০৫. জলকন্যা

জলকন্যা

গভীর রাতে টেলিফোনের শব্দ শুনে আমি প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলাম। টেলিফোনের শব্দের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক থাকে, মাঝরাতে সেই আতঙ্ক মনে হয় আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমি অন্ধকার হাতড়াতে হাতড়াতে কোনোমতে টেলিফোন ধরে বললাম, হ্যালো। এবারেও কোনো শব্দ নেই। টেলিফোনটা রেখে দিয়ে বিছানায় ফিরে যাব কিনা ভাবছি তখন টের পেলাম টেলিফোনটা উল্টো ধরেছি। আমার মতো মানুষের জন্য এটা রীতিমতো সমস্যা। বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার সাথে দেখা হলে তাকে বলতে হবে এমন একটা টেলিফোন আবিষ্কার করতে যেটার উল্টোসিধে নেই, যে টেলিফোনে দুইদিকেই কানে লাগিয়ে শোনা যাবে আবার দুইদিকেই কথা বলা যাবে।

আপাতত টেলিফোনের ঠিক দিকটাই কানে লাগিয়ে তৃতীয়বারের মতো বললাম, হ্যালো।

অন্যপাশ থেকে একজনের কথা শুনতে পেলাম, বলল, কী হল শুধু হ্যালো হ্যালো কছু কথার উত্তর দিচ্ছে না কেন?

কী আশ্চর্য! অনিক লুম্বার কথা ভাবছিলাম আর ঠিক তার টেলিফোন এসে হাজির। আমি বললাম, এত রাতে কী ব্যাপার?

রাত? রাত কোথায় দেখলে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি? চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ঘুটঘুটে অন্ধকার?

হ্যাঁ। অনিক লুম্বা বলল, তুমি নিশ্চয়ই চোখ বন্ধ করে রেখেছ। চোখ খুলে দেখ।

আমি তখন আবিষ্কার করলাম যে, গভীর রাত মনে করে আসলেই আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি চারদিকে এক ধরনের হালকা আলো। আবছা আবছা আলোটা অত্যন্ত বিচিত্র, কখনো সকালে ঘুম ভাঙে নি বলে ভোরের আলো দেখি নি, তাই আমার কাছে আরো বিচিত্র মনে হয়। অনিক বলল, চোখ খুলেছ?

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, ইয়ে, কয়টা বাজে?

ছয়টা। ঘুটঘুটে মাঝরাত মোটেও না।

আমি হাই তুলে বললাম, সকাল ছয়টা আমার কাছে মাঝরাতের সমান।

অনিক লুম্বা ধমক দিয়ে বলল, বাজে কথা বলো না।

আমি বললাম, কী হয়েছে বলো।

তুমি এক্ষুনি চলে এস।

আমি অবাক হয়ে বললাম, চলে আসব? আমি? কোথায়?

আমার বাসায়।

কেন কী হয়েছে?

এলেই দেখবে। তাড়াতাড়ি। বলে আমি কিছু বলার আগেই অনিক টেলিফোন রেখে দিল।

সকালবেলাতে এমনিতেই আমার ব্রেন শর্ট সার্কিট হয়ে থাকে, ভালোমন্দ কিছুই বুঝতে পারি না। অনিক লুথার কথাও বুঝতে পারছিলাম না, ঘুমানোর জন্যে বিছানার দিকে যাচ্ছিলাম তখন আবার টেলিফোন বাজল। আমি আবার ঘুম ঘুম চোখে টেলিফোন ধরে বললাম,  লো।

অন্যপাশে অনিক লুম্বার গলা শুনতে পেলাম, খবরদার তুমি বিছানায় ফিরে যাবে না কিন্তু। এক্ষুনি চলে এস, খুব জরুরি।

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই সে অন্যপাশে টেলিফোন রেখে দিয়েছে। বাথরুমে গিয়ে চোখ-মুখে পানি দিয়ে ঘুমটা একটু কমানোর চেষ্টা করলাম। খুব একটা লাভ হল না। কিছু একটা খেলে হয়তো জেগে উঠতে পারি। এত সকালে কী খাওয়া যায় চিন্তাভাবনা করছি তখন আবার টেলিফোন বাজল। শুয়ে ভয়ে টেলিফোন ধরে কিছু বলার আগেই অন্যপাশ থেকে অনিক লুম্বা বলল, এখন আবার খেতে বসে যেও না! এক্ষুনি ঘর থেকে বের হও, কুইক।

আমি কিছু বলার আগেই এবারেও সে আবার টেলিফোন রেখে দিল। আমি তখন বাধ্য হয়ে কাপড়-জামা পরে ঘর থেকে বের হলাম। ভেবেছিলাম এত সকালে নিশ্চয়ই কাকপক্ষী পর্যন্ত ঘুম থেকে ওঠে নি। কিন্তু বাইরে বের হয়ে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। বাস চলছে, টেম্পাে চলছে, রিকশা-স্কুটারে রাস্তা গিজগিজ করছে। মানুষজন ছোটাছুটি করছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার! এই দেশের মানুষ কি সকালবেলা শান্তিতে একটু ঘুমাতেও পারে না? আমি আর দেরি করলাম না। একটা সিএনজি নিয়ে অনিকের বাসায় রওনা দিলাম।

অনিকের বাসার গেট খোলা। বাসার দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখি টেবিলের ওপর কিছু ময়লা কাপড় স্কুপ করে রেখে অনিক গভীর মনোযোগে সেদিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, দেখ জাফর ইকবাল! দেখ।

ময়লা কাপড়ের স্থূপের মাঝে দেখার কী থাকতে পারে আমি বুঝতে পারলাম না। কাছে গিয়ে দেখেও কিছু বুঝতে পারলাম না, বললাম, কী দেখব?

ঠিক তখন পুরোনো কাপড়ের বাতিলের ভেতর কী একটা জানি টা চা শব্দ করে উঠল, আমি লাফিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বললাম, কী শব্দ করছে?

দেখছ না? বাচ্চা—

বাচ্চা? আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, কিসের বাচ্চা?

কিসের বাচ্চা মানে? অনিক বিরক্ত হয়ে বলল, বাচ্চা আবার কিসের হয়? মানুষের বাচ্চা।

মানুষের বাচ্চা? আমি অবাক হয়ে কাছে গিয়ে দেখি সত্যি সত্যি ময়লা কাপড়ের পুঁটলির ভেতরে ছোট একটা মাখা, প্রায় গোলাপি রঙ, সেটা একটু একটু নড়ছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করছে। আমি প্রায় বিশ্বাস করেই ফেলেছিলাম যে সত্যি সত্যি মানুষের বাচ্চা, কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, অনিক ঠাট্টা করছে। একজন মানুষের বাচ্চা এত ছোট হতে পারে না, নিশ্চয়ই এটা তার কোনো একটা আবিষ্কার, কোনো একটা পুতুল বা অন্য কিছু। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, তোমার এই পুতুলের বাচ্চা দেখানোর জন্যে আমাকে এত সকালে ডেকে এনেছ?

পুতুলের বাচ্চা কী বলছ? অনিক রেগে বলল, এটা সত্যিকারের মানুষের বাচ্চা।

আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, দেখ অনিক, আমি বোকা হতে পারি, কিন্তু এত বোকা না। মানুষের বাচ্চা কখনো এত ছোট হয় না।

তুমি কয়টা মানুষের বাচ্চা দেখেছ?

অনেক দেখেছি। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, আমার ছোট বোন শিউলির যখন মেয়ে হল আমি কোলে নিয়েছিলাম। আমি কোলে নিতেই আমার ওপর হিসি করে দিয়েছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে—

নাই। অনিক বলল, মানুষের বাচ্চা জন্মানোর সময় এইরকম ছোটই থাকে, তুমি ভুলে গেছ। এই দেখ–

অনিক ময়লা কাপড়ের পুঁটলিটা একটু আগলা করল। এখন আমি ছোট ছোট হাত-পা দেখতে পেলাম। সেগুলো আঁকুপাকু করে নড়ছে। নাভিটা নিশ্চয়ই কাচা-দেখে মনে হয় সেখানে কী একটা যেন ঝুলে আছে। অনিক তাড়াতাড়ি আবার কাপড়ের পুঁটলি দিয়ে বাচ্চাটাকে ঢেকে ফেলল। আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, তুমি কোথায় পেলে বাচ্চাটাকে?

বারান্দায়।

বা-বারান্দায়?

হ্যাঁ।

তোমার বারান্দায় বাচ্চা কোথা থেকে এল?

সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি। সেই জন্যেই তো তোমাকে ডেকে এনেছি।

আমি ঢোক গিলে বললাম, আ-আমি তোমাকে বলতে পারব?

হয়তো পারবে না। কিন্তু দুজন থাকলে একটু কথা বলা যায়। একটু পরামর্শ করা যায়। একটা ছোট বাচ্চা, তার ভালোমন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে না?

আছে। আমি মাথা নাড়লাম, তার ভালোমন্দ বলে একটা ব্যাপার আছে। তবে–

অনিক ভুরু কুঁচকে বলল, তবে কী?

একটা ছোট বাচ্চা যার কাছে চলে আসে, তার কোনো ভালো নেই। তার শুধু মন্দ।

তুমি কী বলতে চাইছ?

ছোট বোন শিউলিকে দেখেছিলাম। তার প্রথম বাচ্চা হবার পর খাওয়া নেই ঘুম নেই। কেমন যেন পাগলী টাইপের হয়ে গেল। এখনো ঠিক হয় নি।

অনিক ছোট বাচ্চাটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, সেটা পরে দেখা যাবে। এখন কী করা যায় বলো।

আমি মাথা চুলকালাম, বললাম, এর মা-বাবাকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে ফেরত দিতে হবে।

এর মা-বাবা যদি বাচ্চাটাকে নিজের কাছে রাখতই তা হলে আমার বারান্দায় কেন ফেলে গেল?

আমি আবার মাথা চুলকালাম। কোনো একটা সমস্যায় পড়লেই আমার মাথা চুলকাতে হয়। আমার কপাল ভালো। আমার জীবনে খাওয়া এবং ঘুম ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার নেই। সমস্যাও কম, তা না হলে মাথা চুলকানোর কারণে এতদিনে সেখানকার সব চুল উঠে যেত। অনিক বলল, এই ময়লা কাপড় দিয়ে বাচ্চাটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে, তার মানে এর মা-বাবা নিশ্চয়ই গরিব।

তাই বলো। আমি আরো ভাবছিলাম তুমি এত ছোট বাচ্চাটাকে কেন এত ময়লা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছ!

আমি রাখি নাই।

তা হলে খুলে রাখছ না কেন?

বাচ্চাটা মার জন্ম হয়েছে। একটা বাচ্চা থাকে মায়ের পেটে, সেখানে শরীরের গরমটুকু থাকে। যখন জন্ম হয় তখন বাইরের পৃথিবী তার কাছে কনকনে ঠাণ্ডা। তাই তাকে গরম করে রাখতে হয়।

আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, তুমি কেমন করে জান?

বাচ্চাটা পাবার পর আমি কি বসে আছি মনে করেছ? ইন্টারনেটে ছোট বাচ্চা সম্বন্ধে যা পাওয়া যায় সব ডাউনলোড করে পড়া শুরু করে দিয়েছি না?

আমি দেখলাম তার টেবিলের আশপাশে কাগজের স্তুপ। অনিক বলল, আমি এর মাঝে ছোট বাচ্চার একটা এক্সপার্ট হয়ে গেছি। তুমি জান একটা ছোট বাচ্চার যখন জন্ম হয়, তখন প্রথম চদ্বিশ ঘণ্টা সে শ্রেনেক কিছু করতে পারে, যেটা পরে করতে পারে না। হাত দিয়ে ধরে ফেলতে পারে, মুখ ভাংচাতে পারে—

মুখ ভাংচাতে পারে?

অনিক হাসল, বলল, অনুকরণ করতে পারে। আমি জিব বের করলে সেও জিব বের করবে। কিন্তু বাচ্চাটা বেশিরভাগ সময় চোখ বন্ধ রাখছে।

অনিকের কথা শুনে কিনা কে জানে বাচ্চাটা ঠিক তখন দুই চোখ খুলে ড্যাবড্যাব করে তাকাল। অনিক বাচ্চাটার কাছে মুখ নিয়ে নিজের জিব বের করতেই এইটুকুন ছোট্ট বাচ্চা তার লাল টুকটুকে জিব বের করে অনিককে ভেংচি কেটে দিল। অনিক জিবটা ভেতরে ঢোকাতেই বাচ্চাও তার জিব ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। অনিক আবার জিবটা বের করতেই এইটুকুন গ্যাদা বাচ্চা আবার তার জিবটা বের করে ফেলল! কী আশ্চর্য ব্যাপার।

অনিক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ ব্যাপারটা? ঠিক যেটা বলেছিলাম। জন্ম হবার পরপর ছোট বাচ্চাদের অসম্ভব কিছু রিফ্লেক্স থাকে। মাঝে মাঝে এ সময় এরা খপ করে ধরে ফেলতে পারে।

অনিক তখন তার একটা আঙুল বাচ্চাটার সামনে নাড়াতে থাকে এবং অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সত্যি সত্যি বাচ্চাটা খপ করে আঙুলটা ধরে ফেলল। অনিক আনন্দে দাঁত বের করে হেসে বলল, দেখেছু ব্যাপারটা? দেখেছ?

আমি বললাম, দেখেছি। কিন্তু—

অনিক আমার দিকে না তাকিয়ে বলল, কিন্তু কী?

তোমার বাসার বারান্দায় একটা গ্যাদা বাচ্চা পাওয়া গেছে, সেটা নিয়ে তুমি কিছু একটা করবে না?

সেই জন্যেই তো তোমাকে ডেকে এনেছি। কী করতে হবে তুমি কর। আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে একটু গবেষণা করি। বইপত্রে যেসব কথা লিখেছে সেগুলি সত্যি কিনা পরীক্ষা করে দেখি।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, অনিক তুমি গবেষণা করার অনেক সময় পাবে। আগে ব্যাপারটা কাউকে জানাও।

অনিক বাচ্চাটার ওপর ঝুঁকে পড়ে নিজের মাথাটা একবার বামে আরেকবার ডানে নিয়ে বলল, উঁহুঁ গবেষণা করার অনেক সময় পাব না। বাচ্চা জন্ম নেওয়ার পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা তাদের এরকম রিফ্লেক্স থাকে। একটু পরে আর থাকবে না।

আমি বললাম, তা হলে তুমি কী করতে চাও?

বাচ্চাটা চোখ দিয়ে ট্র্যাক করতে পারে কিনা দেখছি।

আমি বুঝতে পারলাম অনিক এখন কিছুই করবে না, সে তার গবেষণা করে যাবে। যা করার আমাকেই করতে হবে এবং প্রায় সাথে সাথে আমার মনে পড়ল, আমি নিজে নিজে কোনো কাজই করতে পারি না। খাওয়া এবং ঘুমের বাইরে জীবনে কোনো কাজ নিজে করেছি বলে মনে পড়ে না।

ঠিক এরকম সময় আমার সুব্রতের কথা মনে পড়ল। সুব্রতের জন্ম হয়েছে এই ধরনের কাজের জন্যে! আমি অনিকের টেলিফোন দিয়ে সুব্রতকে ফোন করলাম। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর সুব্রত এসে ফোন ধরল, ঘুম ঘুম গলায় বলল, হ্যালো।

আমি বললাম, সুব্রত, আমি জাফর ইকবাল।

জাফর ইকবাল? সুব্রত অবাক হয়ে বলল, তুই এত ভোরে কী করছিস?

একটা জরুরি কাজে—

জরুরি কাজ? তোর আবার জরুরি কাজ কী হতে পারে? ঘুমাতে যা।

আমি বললাম, না, না সুব্রত, ঠাট্টা নয়। আসলেই জুরুরি কাজ।

কী হয়েছে?

আমি তখন সুব্রতকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। শুনে সুব্রত চেঁচিয়ে উঠে বলল, বলিস কী তুই?

আমি বললাম, ঠিক বলছি। এই এতটুকুন একটা বাচ্চা। গোলাপি রঙের। এই এতটুকুন হাত-পা। এতটুকুন আঙুল।

কী আশ্চর্য!

আসলেই আশ্চর্য। এখন কী করতে হবে বল।

পুলিশে জিডি করতে হবে।

জিডি? আমি অবাক হয়ে বললাম, সেটা আবার কী জিনিস?

জেনারেল ডায়েরি।

সেটা কেমন করে করতে হয়?

থানায় গিয়ে করতে হয়।

থানায়? আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম, থানা পুলিশ থেকে আমি সব সময় এক শ হাত দুরে থাকতে চাই।

হ্যাঁ। সুব্রত বলল, থানায় যেন্তে হবে। তবে তুই একা একা যাস না, কী বলতে কী বলে ফেলে আরো ঝামেলা পাকিয়ে ফেলবি। আমি আসছি।

সুব্রতের কথা শুনে আমি একটু ভরসা পেলাম, কিন্তু তবুও ভান করলাম আমি যেন একাই করে ফেলতে পারব। বললাম, তোর আসতে হবে না। আমি একাই বিড়ি করে ফেলব।

বিডি না গাধা, জিডি। তোর একা করতে হবে না। আমি আসছি তুইও থানায় চলে আয়।

সুব্রত টেলিফোনটা রেখে দেবার পর আমি আবার অনিকের দিকে তাকালাম। সে হাতে একটা ছোট টর্চলাইট নিয়ে ছোট বাচ্চাটার সামনে লাফালাফি করছে। আমি বললাম, অনিক, আমি থানায় জিডি করিয়ে আসি।

খাও। বলে সে আবার আগের মতো ছোট ছোট লাফ দিতে লাগল। আমি আগেও দেখেছি অনিক একটা টিকটিকির দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকে। আর এটা তো টিকটিকি না—এটা একটা মানুষের বাচ্চা।

আমি থানার সামনে গিয়ে সুব্রতের খোজে ইতিউতি তাকাতে লাগলাম। তার এখনো দেখা নেই, তাকে ছাড়া একা একা আমার ভেতরে ঢোকার কোনো ইচ্ছা নেই কিন্তু থানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল। পুলিশ হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেই আমি নার্ভাস হয়ে যাই আর যখন কটমট করে তাকায়, তখন তো কথাই নেই, আমার রীতিমতো বাথরুম পেয়ে যায়। আমি থানার সামনে থেকে সরে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই পুলিশ বাজখাই গলায় হাঁক দিল, এই যে, এই যে মোটা ভাই।

তুলনামূলকভাবে আমার স্বাস্থ্য একটু ভালো কিন্তু এর আগে আমাকে কেউ মোটা ভাই ডাকে নাই। আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, আমাকে ডেকেছেন?

আর কাকে ডাকব? এদিকে শুনেন।

আমি কাছে এগিয়ে এলাম। পুলিশটা কয়েকবার আমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখল, দেখে বলল, আমি অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ করছি আপনি কেমন সন্দেহজনকভাবে থানার সামনে ইটাহাটি করছেন। ব্যাপারটা কী?

না মানে ইয়ে ইয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল, হাত ঘামতে লাগল, বুক ধড়ফড় করতে লাগল।

পুলিশটা আবার ধমক দিয়ে উঠল, কী হল, প্রশ্নের উত্তর দেন না কেন?

আমি ঢোক গিলে বললাম, আমি ইডি না বিছি কী যেন বলে সেটা করাতে এসেছি।

ইভি? বিডি? সেটা আবার কী?

পুলিশের হম্বিতম্বি শুনে আমাদের ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে উঠেছে। তার ভেতর থেকে একজন বলল, জিডি হবে মনে হয়।

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, হ্যাঁ, হা জিডি। জিডি করাতে এসেছি।

পুলিশটা চোখ পাকিয়ে বলল, জিডিকে আপনি ইডি বিডি বলছেন কেন? পুলিশকে নিয়ে টিটকারি মারেন?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না-না, আমি মোটেও টিটকারি মারতে চাই নাই। শব্দটা ভুলে গিয়েছিলাম।

একটা জিনিস যদি ভুলে যান, তা হলে সেটা করাবেন কেমন করে?

প্রশ্নটার কী উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না বলে চুপ করে থাকলাম। পুলিশটা ধমক দিয়ে বলল, আর জিডি করাতে হলে বাইরে ঘোরাঘুরি করছেন কেন? ভেতরে যান।

কাজেই সুব্রতকে ছাড়াই আমাকে ভেতরে ঢুকতে হল। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাকে আমার থেকে মোটা একজন পুলিশ অফিসারের সামনে নিয়ে গেল। সে একটা ম্যাচকাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, কী ব্যাপার?

আমি বললাম, ইয়ে, একটা জিডি করাতে এসেছি।

কী নিয়ে জিডি?

একটা বাচ্চা পাওয়া গেছে।

পাওয়া গেছে না হারিয়ে গেছে?

পাওয়া গেছে।

পাওয়া গেলে আবার জিডি করাতে হয় নাকি? বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেন বাড়ি কোথায়, সেখানে নিয়ে যান। সব কাজ কি পুলিশ করবে নাকি? পাবলিকের একটা দায়িত্ব আছে? কয়দিন পরে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হলেও আপনারা জিডি করাতে চলে আসবেন। আপনি জানেন জিডি কস্রাতে কত সময় লাগে? কত ঝামেলা হয়? আপনাদের কোনো কাজকর্ম নাই?

পুলিশ অফিসারটা টানা কথা বলে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত যখন থামল তখন বললাম, বাচ্চাটা খুব ছোট।

কতটুকু ছোট?

আমি হাত দিয়ে বাচ্চাটার সাইজ দেখালাম। পুলিশ অফিসার চোখ কপালে তুলে বলল, কিসের বাচ্চা? মানুষের না ইন্দুরের?

জি মানুষের।

মানুষের বাচ্চা এত ছোট হয় কেমন করে? আর অত ছোট বাচ্চাটা এসেছে কেমন করে?

সেটা তো জানি না। কেউ একজন রেখে গেছে মনে হয়।

কেন রেখে গেছে?

সেটা তো জানি না।

কখন রেখে গেছে?

সেটাও তো জানি না।

বাচ্চা ছেলে না মেয়ে?

আমি মাথা চুলকে বললাম, সেটাও জানি না।

পুলিশ অফিসার দাঁত কিড়মিড় করে বলল, আপনি যদি কিছুই না জানেন, তা হলে এখানে এসেছেন কেন? আমি কি আপনার সন্ধী নাকি দুলাভাই যে আমার সাথে মশকরা করতে আসবেন? বাসাটা কোথায়?

আমি অনিকের বাসার নম্বরটা জানতাম, কিন্তু পুলিশের ধমক খেয়ে সেটাও ভুলে গেলাম, মাথা চুলকে বললাম, ইয়ে, মানে ইয়ে–

পুলিশ অফিসার একটা বাজখাই ধমক দিয়ে বলল, আপনারা কি ভাবেন আমাদের কোনো কাজকর্ম নাই? আপনাদের সাথে খোশগল্প করার জন্যে বসে আছি আপনাদের কোনো কাজকর্ম না থাকলে এইখানে চলে জাসবেন। কোনো একটা বিষয়ে জিডি করার জন্যে? শহরে মশা থাকলে জিডি করাবেন? আকাশে মেঘ থাকলে জিডি করাবেন? বউ ধমক দিলে জিডি করাবেন?

কিছু একটা বলতে হয়, তাই মিনমিন করে বললাম, ইয়ে বিয়ে করি নি এখনো, বউ ধমক দেবার চান্স নাই

এত বয়স হয়েছে এখনো বিয়ে করেন নাই? পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে বলল, কী করেন আপনি?

ইয়ে সেরকম কিছু করি না।

তা হলে আপনার সংসার চলে কেমন করে?

আমি তখন ঘামতে শুরু করেছি। আমতা-আমতা করে বললাম, আসলে সেরকম সংসারও নাই–

পাশের টেবিলে একজন মহিলা পুলিশ বসে ছিল। সে বলল, স্যার ভেরি সাসপিশাস কেস। দেখেও সেরকম মনে হয়। চুয়ান্ন ধারায় অ্যারেস্ট দেখিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দেন—

আমি আঁতকে উঠে বললাম, কী বলছেন আপনি?

মহিলা পুলিশ বলল, ঠিকই বলেছি। আমরা এই লাইনে কাজ করি। একজন মানুষকে দেখলেই বুঝতে পারি সে কী জিনিস?।

পুলিশ অফিসার নতুন একটা ম্যাচকাঠি বের করে আবার দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, ঠিকই বলেছ। চুয়ান্ন ধারায় চালান করে দেই। জন্মের মতো শিক্ষা হয়ে যাবে।

একজন মানুষকে যে চাউলের বস্তার মতো চালান করা যায় আমি জানতাম না, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই দেখলাম সত্যি সত্যি হাজতের মাঝে চালান হয়ে গেছি। ঘরঘর করে লোহার গেটটা টেনে বিশাল একটা তালা ঝুলিয়ে যখন আমাকে হাজতে আটকে ফেলল, আমার মাথায় তখন রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়ল।

হাজতের ভেতরে যে জিনিসটা সবচেয়ে প্রথমে লক্ষ করলাম সেটা হচ্ছে দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধটা কোথা থেকে আসছে সেটাও দেখা যাচ্ছে। ভয়ের চোটে আমার বাথরুম পেয়ে গেছে কিন্তু হাজতের ভেতরে এই দরজাবিহীন বাথরুম দেখে সেই বাথরুমের ইচ্ছাও উবে গেল। ভেতরে গোটা দশেক মানুষ শুয়ে-বসে আছে। দুই-চারজনকে একটু চিন্তিত মনে হল, তবে বেশিরভাগই নির্বিকার। একজন ম্যাচের কাঠি দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আছে?

কিসের কথা জিজ্ঞেস করছে বুঝতে পারলাম না, বললাম, কী আছে?

সেইটাও যদি বলে দিতে হয় তা হলে হাজ্জতে আমি আর আপনি কথা বলছি কেন?

আমি বললাম, আমি মানে আসলে—

আরেকজন বলল, বাদ দে। চেহারা দেখছিস না লেব্দু, টাইপের।

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কিসের কেইস আপনার?

আমি বললাম, কোনো কেইস না। ভুল করে–

কথা শেষ হবার আগেই হাজতে বসে থাকা সবাই হা হা করে হেসে উঠল যেন আমি খুব মজার একটা কথা বলেছি। একজন হাসি থামিয়ে বলল, আমাদের সামনে গোপন করার দরকার নাই। বলতে পারেন, কোনো ভয় নাই–

আমি বললাম, না, না, আপনারা যা ভাবছেন মোটেও তা না। একটা ছোট বাচ্চা–

কথা শেষ করার আগেই একজুন বলল, ও! ছেলেধরা!

আমি প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলাম তখন আরেকজন বলল, লজ্জা করে না ছেলেধরার কাম করতে? বুকে সাহস থাকলে ডাকাতি করবেন। সাহস না থাকলে চুরি করবেন। তাই বলে ছেলেধা? ছি ছি ছি।

ষাগোছের একজন বলল, বানামু নাকি?

মাঝ বয়সের একজন বলল, এখন না। অন্ধকার হোক।

মণ্ডগোছের মানুষটা বিরস মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল কখন অন্ধকার হবে আর কখন আমাকে বানাবে সে জন্যে অপেক্ষা করার তার ধৈর্য নাই। আমার মনে হল আমি ডাক ছেড়ে কাঁদি।

আমার অবিশ্যি ডাক ছেড়ে কাদতে হল না, ঘণ্টাখানেকের মাঝে সুব্রত এসে আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে গেল। যে পুলিশ অফিসার আমাকে চালান দিয়েছিল সে-ই তালা খুলে আমাকে বের করে আনল। সুব্রত তার হাত ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, খ্যাংক ইউ গনি সাহেব। থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।

গনি সাহেব বললেন, আমাকে থ্যাংকস দেওয়ার কিছু নাই। আইনের মানুষ, আইন যেটা বলে আমরা সেটাই করি। তার বাইরে যাবার আমাদের কোনো ক্ষমতা নাই।

থানা থেকে বের হয়েই সুব্রত আমাকে গালাগাল শুরু করল। বলল, তোর যতো গাধা আমি জন্মে দেখি নাই। জিডি করতে এসে নিজে অ্যারেস্ট হয়ে গেলি? আমার যদি আসতে আরেকটু দেরি হত, তা হলে কী হত? যদি জেলখানায় চালান করে দিত?

আমি বললাম, তুই দেরি করে এলি কেন? তোর জন্যেই তো আমার এই বিপদ।

আমি রওনা দিয়ে ভাবলাম ছোট বাচ্চাদের একটা হোম থেকে খোঁজ নিয়ে যাই। তোর বন্ধু পুরুষ, ছোট বাচ্চার দেখাশোনা করতে পারবে না। এর জন্যে দরকার একটা হোম। একটা অনাথাশ্রম।

আছে এরকম জায়গা?

থাকবে না কেন? এই যে ঠিকানা নিয়ে এসেছি। কথাও বলে এসেছি। সুব্রত আমাকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলল, যে মহিলা দায়িত্বে আছেন তার নাম দুর্দানা বেগম।

দুর্দানা বেগম? এটা কী রকম নাম?

সুব্রত বিরক্ত হয়ে বলল, আমি কি নাম রেখেছি নাকি? আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন?

দোষ দিচ্ছি না। জানতে চাচ্ছি।

সুব্রত মুচকি হেসে বলল, তবে নামটা দুর্দানা বেগম না হয়ে দুর্দান্ত বেগম হলে মনে হয় আরো ভালো হত।

কেন?

আসলেই দুর্দান্ত মহিলা। অনাথাশ্রমটাকে চালায় একেবারে মিলিটারির মতো। পান থেকে চুন খসার উপায় নাই। কী ডিসিপ্লিন—দেখলে অবাক হয়ে যাবি।

আমি ভীতু মানুষ, নিয়মশৃঙ্খলাকে বেশ ভয় পাই, তাই দুর্দানা বেগম আর ভার অনাথাশ্রমের কথা শুনে একটু ভয়ই পেলাম। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাচ্চাদের মারধর করে নাকি?

আরে না। দুর্দানা বেগমের গলাই যথেষ্ট, মারধর করতে হয় না।

সুব্রত তার ঘড়ি দেখে বলল, তুই এখন কোথায় যাবি?

অনিক লুম্বার বাসায়। তুইও আয়, বাচ্চাটাকে দেখে যা।

নাহ। এখন সময় নাই। ঢাকা শহর নর্দমা পুনরুজ্জীবন কমিটির মিটিং আছে।

নর্দমা পুনরুজ্জীবনেরও কমিটি আছে?

না থাকলে হবে? ঢাকা শহর পানিতে তা হলে তলিয়ে যাবে। সুব্রত আমার দিকে হাত নেড়ে হঠাৎ লাফ দিয়ে একটা চলন্ত বাসে উঠে গেল। বাস থেকে মাথা বের করে বলল, আজকেই দুর্দানা বেগমের সাথে যোগাযোগ করবি কিন্তু।

আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, করব।

আমি অবিশ্যি দুর্দানা বেগমের সাথে যোগাযোগ না করে অনিকের বাসায় ফিরে। গেলাম। এখনো অনিকের গেট খোলা এবং দরজা খোলা। ঢকে দেখি ভেতরে লাবরেটরি ঘরে একটা বড় টেবিলে একটা বিশাল অ্যাকুরিয়ামের মাঝে অনিক পানি ভরছে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কী করছ?

অ্যাকুরিয়ামে পানি ভরছি।

সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমি জানতে চাইছি কেন এরকম সময়ে ল্যাবরেটরি ঘরের মাঝখানে একটা অ্যাকুরিয়াম, আর কেন এরকম সময়ে এখানে পানি ভরছ?

অনিক আমার কথার উত্তর না দিয়ে হাসিমুখে তাকাল। আমি বললাম, বাচ্চাটা কোথায়?

ঘুমাচ্ছে। একটা ছোট বাচ্চা বেশিরভাগ সময় ঘুমায়। পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক সত্য।

কোথায় ঘুমাচ্ছে?

এই যে। আলমারিতে।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম আলমারির একটা তাক খালি করে সেখানে কয়েকটা টাওয়েল বিছিয়ে বিছানা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে এইটুকুন একটা বাচ্চা তার পিছনটুকু ওপরে তুলে মহা আরামে ঘুমাচ্ছে। এরকমভাবে একটা বাচ্চা ঘুমাতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না।

অনিক বলল, ছোট বাচ্চাদের তিনটা কাজ–খাওয়া, ঘুম এবং বাথরুম। সে তিনটাই করে ফেলেছে। বাচ্চাটা অত্যন্ত লক্ষ্মী। অনিক হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, বলল, তুমি হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলে?

আমি রাগ হয়ে বললাম, আমার কী হল না হল সেটা নিয়ে তোমার খুব মাথাব্যথা আছে বলে তো মনে হল না।

অনিক একটু অবাক হয়ে বলল, তোমার কিছু হয়েছে নাকি?

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, হয় নি আবার? হাজত খেটে এসেছি।

অনিক মুখ হাঁ করে বলল, হাজত খেটে এসেছ। কেন?

আমি রাগে গরগর করে বললাম, তোমার লক্ষ্মী বাচ্চার জন্যে।

লক্ষ্মী বাচ্চার জননা?

হ্যাঁ।

কেন?

কারণ আমি জানি না তোমার লক্ষ্মী বাচ্চা কেমন করে এখানে এসেছে, কেন এসেছে এবং কখন এসেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আমি জানি না তোমার লক্ষ্মী বাচ্চাটি ছেলে না মেয়ে।

সে কী! তুমি জান না?

না।

কী আশ্চর্য! অনিক অ্যাকুরিয়ামের পানি ভরা বন্ধ করে আমার কাছে এসে আমায় হাত ধরে টেনে আলমারির কাছে নিয়ে গেল। বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বলল, এর মুখের দিকে তাকাও! দেখছ না এটি একটি মেয়ে। কী সুইট চেহারা দেখছ না? একটা মেয়ে না হলে কখনো চেহারা এরকম সুইট হতে পারে?

ঘুমের ভেতরে বাচ্চারা হাসাহাসি করে আমি জানতাম না, অবাক হয়ে দেখলাম ঠিক এরকম সময়ে বাচ্চাটি তার মাঢ়ী বের করে একটু হেসে দিল। তখন আমার কোনো সন্দেহ থাকল না যে এটি নিশ্চয়ই একটা মেয়ে। বললাম, ঠিকই বলেছ। নিশ্চয়ই মেয়ে। তবে–

তকে কী?

কাপড় খুলে একবার দেখে নিলে হয়।

অনিক বলল, হ্যাঁ। সেটাও দেখেছি।

গুড। এসব ব্যাপারে শুধু চেহাবার ওপরে ভরসা না করে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো।

অনিক আবার তার অ্যাকুরিয়ামের কাছে গিয়ে পানি ভবতে ভরতে বলল, সকালবেলা উঠেই তোমার এত ঝামেলা। আমার খুব খারাপ লাগছে শুনে।

এখন খারাপ লেগে কী হবে? তবে আমার একটা অভিজ্ঞতা হল!

সেভাবেই দেখ। নতুন অভিজ্ঞতা। জীবনে অভিজ্ঞতাই হচ্ছে বড় কথা।

আমি আলোচনাটা অভিজ্ঞতা থেকে অ্যাকুরিয়ামে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম, জিজ্ঞেস করলাম, এখন বলো এত বড় অ্যাকুরিয়ামে পানি ভরছ কেন?

অনিক একটু ইতস্তত করে বলল, একটা পরীক্ষা করার জন্যে।

কী পরীক্ষা করবে?

ছোট বাচ্চারা নাকি জন্মাবার পর সাঁতার কাটতে পারে।

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, অবাক হয়ে বললাম, সাঁতার কাটতে পারে?

হ্যাঁ। পরীক্ষা করে দেখা গেছে ছোট বাচ্চাদের জন্মের পরপর পানিতে ছেড়ে দিলে তারা সাঁতার কাটতে পারে।

এবারে পানির অ্যাকুরিয়ামের রহস্য খানিকটা পরিষ্কার হল। আমি বললাম, তুমি এই বাচ্চাটাকে পানির মাঝে ছেড়ে দিতে চাও?

অনিক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই এটা সত্যি কি না।

আমি মুখ হাঁ করে কিছুক্ষণ অনিকের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বললাম, তুমি বলতে চাও যে এই ছোট বাচ্চাটাকে এই পানির মাঝে ফেলে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখবে সে সাতার কাটতে পারে কি না?

হ্যাঁ।

তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে।

না, না, তুমি যা ভাবছ—

আমি অনিককে বাধা দিয়ে বললাম, তুমি যদি ভালো একটা গেদা বাচ্ছাকে পানিতে ফেলে দিয়ে তাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে আর আমি বসে বসে সেটা দেখব, তা হলে জেনে রাখ তুমি মানুষ চিনতে ভুল করেছ।

অনিক বলল, আরে আগে তুমি আমার কথা শোন।

তোমার কোনো কথা আমি শুনব না। তুমি যদি এই মুহূর্তে এই ছোট বাচ্চাকে পানিতে ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা বন্ধ না কর তা হলে প্রথমে আমি গনি সাহেবকে তারপর দুর্দানা বেগমকে ফোন করব।

অনিক বলল, এরা কারা?

গনি সাহেব হচ্ছে আমার থেকেও মোটা একজন পুলিশ অফিসার। আমি তার কাছে জিডি করাতে গিয়েছিলাম, বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে বলতে পারি নাই বলে আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

আর দুর্দানা বেগম?

দুর্দান বেগমের ভালো নাম হওয়া উচিত দুর্দান্ত বেগম। কারণ এই মহিলার হুঙ্কার শুনলে ছোট বাচ্চাদের কাপড়ে পিশাব হয়ে যায়। সে ছোট ছোট বাচ্চাদের একটা হোম চালায়। তাকে খবর দিলে সে এসে তোমার গলা টিপে ধরবে।

অনিক বলল, তুমি বেশি উত্তেজিত হয়ে গেছ। একটু শান্ত হও।

আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, আমি মোটেই উত্তেজিত হই নাই–

আমার হুঙ্কার শুনে বাচ্চাটা ঘুম থেকে উঠে ট্যাঁ ট্যাঁ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। অনিক কুলল, দিলে তো চিৎকার করে বাচ্চাটাকে তলে–

অনিক ছুটে গিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, একটা ছোট বাচ্চা ঘরে থাকলে এরকম কঁাড়ের মতো চিৎকার করতে হয় না।

অনেক কষ্টে গলা না তুলে শান্ত গলায় বললাম, আমি সঁড়ের মতো চিৎকার করতে চাই না। কিন্তু তুমি যেসব কাজকর্ম করতে চাইছ সেটা শুনলে যে কোনো মানুষ সঁড়ের মতো চিৎকার করবে।

বাচ্চাটা একটু শান্ত হয়েছে। অনিক আবার তাকে আলমারিতে বন্ধ করে রাখতে রাখতে বলল, তুমি কি ভাবছ আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে কোনোরকম বিপদের কাজ করব?

একটা বাচ্চাকে পানিতে ফেলে দেওয়ার থেকে বড় বিপদের কাজ কী হতে পারে?

তুমি শান্ত হও। আমার কথা আগে শোন। একটা বাচ্চা যখন মায়ের পেটে থাকে তখন সে কোথায় থাকে?

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এটা আবার কী রকম প্রশ্ন? মায়ের পেটে যখন থাকে তখন তো মায়ের পেটেই থাকে।

আমি সেটা বলছি না—আমি বলছি মায়ের পেটের ভেতরে কোথায় থাকে? একটা তরল পদার্থের ভেতর। সেখানে তার নিশ্বাস নিতে হয় না কারণ আমবিলিকেল কর্ড দিয়ে মায়ের শরীর থেকে অক্সিজেন পায়, পুষ্টি পায়।

অনিক জ্ঞানবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে পারলে থামতে চায় না, তাই হাত নেড়ে বলতে লাগল, জন্ম হবার পর ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিতে হয়। অ্যামিবিলিকেল কর্ড কেটে দেওয়াহয় বলে মুখ দিয়ে খেতে হয়। মায়ের পেটের ভেতরে তরল পদার্থে তারা খুব আরামে থাকে, তাই জন্মের পরও তাদেরকে পানিতে ছেড়ে দিলে তারা মনে করবে পেটের ভেতরেই আরামে আছে–

আমি আপত্তি করে বললাম, ঠাণ্ডায় নিউমোনিয়া হয়ে যাবে।

অনিক বলল, আমি কি ঠাণ্ডা পানিতে ছাড়ব নাকি?

তা হলে কোথায় ছাড়বে?

পানির তাপমাত্রা থাকবে ঠিক মায়ের শরীরের তাপমাত্রা। কুসুম কুসুম গরম—

আর নিশ্বাস?

মুখে লাগানো থাকবে মাস্ক। সেখানে থাকবে অক্সিজেন টিউব।

কান দিয়ে যদি পানি ঢোকে?

কানে থাকবে এয়ার প্লাগ।

কিন্তু তাই বলে একটা ছোট বাচ্চাকে পানিতে ছেড়ে দেওয়া—

অনিক বলল, আমি কি বাচ্চাকে ঝপাং করে পানিতে ফেলে দেব? আস্তে করে নামাব। যদি দেখি বাচ্চাটা পছন্দ করছে আস্তে আস্তে প্রথমে পা তারপর শরীর তারপর মাথা–

কিন্তু–

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। এই এক্সপেরিমেন্ট আমাকে আর কে করতে দেবে? তুমি দেখ এর মাঝে বাচ্চাটাকে একবারও আমি বিপদের মাঝে ফেলব না।

অনিকের ওপর আমার সেটুকু বিশ্বাস আছে, তাই আমি শেষ পর্যন্ত রাজি হলাম।

অনিক অ্যাকুরিয়ামটা পানিতে ভর্তি করে সেটার মাঝে একটু গরম পানি মিশিয়ে পানিটাকে আরামদায়ক কুসুম কুসুম গরম করে নিল। পানিতে একটা ছোট হিটার আরেকটা থার্মোমিটার বসাল। থার্মোমিটারের সাথে অনেক জটিল যন্ত্রপাতি। তাপমাত্রা কমতেই নাকি নিজে থেকে হিটার চালু হয়ে আবার আগের তাপমাত্রায় নিয়ে যাবে। অ্যাকুরিয়ামের পাশে একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার। তার পাশে একটা নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার। দুটো গ্যাস মাপমতো মিশিয়ে সেখান থেকে একটা প্রাস্টিকের টিউবে করে একটা ছোট মাঙ্কে লাগিয়ে নিল। এই ছোট মাস্কটা বাচ্চার মুখে লাগাবে।

সবকিছু ঠিকঠাক করে অনিক বাচ্চাটাকে নিয়ে আসে। তার মুখে মাস্কটা লাগানোর সময় সে কয়েকবার টা টা করে আপত্তি করল কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিল। যখন দেখা গেল সে বেশ আরামেই নিশ্বাস নিচ্ছে তখন শুনিক সাবধানে বাচ্চাটার জামাকাপড় খুলে অ্যাকুরিয়ামের পানিতে নামাতে থাকে। আমি পাশেই একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি বাচ্চাটা পানি পছন্দ না করে তা হলে অনিক তুলে আনবে, আমি শরীর মুছে দেব।

কিন্তু পা-টা পানিতে ডোবানো মাত্রই বাচ্চাটার চোখ খুলে গেল এবং আনন্দে হাত-পা নাড়তে লাগল। অনিক খুব ধীরে ধীরে বাচ্চাটাকে নামাতে থাকে, কুসুম কুসুম গরম পানি, বাচ্চাটার নিশ্চয়ই খুব আনন্দ হচ্ছে, সে হাত-পা নাড়তে নাড়তে ফুর্তি করতে শুরু করে দিল। অনিক আরো সাবধানে নামিয়ে প্রায় গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে দিল, তখন বাচ্চাটা একেবারে পাকা সাঁতারুর মতো সাঁতার কাটতে শুরু করে দিল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম অনিকের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে সে অ্যাকুরিয়ামের ভেতর সাঁতার কাটছে। হঠাৎ করে মাথা পানির ভেতরে ড়ুবিয়ে পানির নিচে চলে গেল, আমি ভয়ে একটা চিৎকার করে উঠছিলাম কিন্তু দেখলাম ভয়ের কিছু নেই। বাচ্চাটা নির্বিঘ্নে মাস্ক দিয়ে নিশ্বাস নিতে নিতে পানিতে ওলটপালট খেয়ে সাতার কাটছে। এরকম আশ্চর্য একটা দৃশ্য যে হতে পারে আমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

অনিক আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, দেখেছ? দেখেছ তুমি?

হ্যাঁ।

ছোট বাচ্চা পানিতে কত সহজে সাঁতার কাটে দেখেছ?

সত্যিই তাই। এইটুকুন ছোট বাচ্চা পানির নিচে ঠিক মাছের মতো সাঁতার কাটতে লাগল। দুই হাত দুই পা নেড়ে অ্যাকুরিয়ামের একপাশ থেকে অন্যপাশে চলে যাচ্ছে, হঠাৎ ওপরে উঠে আসছে, হঠাৎ ডিগবাজি দিয়ে নিচে নেমে আসছে। একেবারে অবিশ্বাস্য দৃশ্য। অনিক বলল, এক্সপেরিমেন্ট কমপ্লিট। এবারে তুলে নেওয়া যাক, কী বলো?

আমি বললাম, আহা হা! বাচ্চাটা এত মজা করছে, আরো কিছুক্ষণ থাকুক না।

অনিক বলল, ঠিক আছে তা হলে থাকুক।

ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল। আমি চমকে উঠে বললাম, কে?

অনিক বলল খবরের কাগজ নিয়ে এসেছে। তুমি দরজা খুলে কাগজটা রেখে দাও দেখি–আমি বাচ্চাটাকে দেখছি।

আমি বাইরের ঘরে এসে দরজা খুলতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম, পাহাড়ের মতন একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখটা বাঘের মতন। চোখ দুটো জ্বলছে, চুল পিছনে ঝুঁটি করে বাঁধা। আমাকে কেউ বলে দেয় নি, কিন্তু দেখেই আমি বুঝতে পারলাম, এই মহিলা নিশ্চয়ই দুর্দানা বেগম। মহিলাটি বাঘিনীর মতো গর্জন করে বলল, এই বাসায় একটা ছোট বাচ্চা পাওয়া গেছে?

আমি মিনমিন করে বললাম, হ্যাঁ।

আমি বাচ্চাটাকে দেখতে এসেছি।

আমি বললাম, বা-বা-বাচ্চাটাকে দেখতে এসেছেন?

হ্যাঁ মহিলা গর্জন করে বলল, আমার নাম দুর্দান বেগম। আমি ছোট বাচ্চাদের একটা হোম চালাই।

ও আচ্ছা। আমি বললাম, ভেরি গুড ভেরি গুড—

মহিলা আবার গর্জন করল, বাচ্চা কোথায়?

আছে ভেতরে।

দেখান আমাকে।

আমি আমতা-আমতা করে বললাম, বাচ্চার কী দেখতে চান?

বাচ্চাকে কীভাবে রাখা হয়েছে, কী খাচ্ছে, কীভাবে ঘুমাচ্ছে—এইসব। বাচ্চার বিপদের ঝুঁকি আছে কিনা, অযত্ব হচ্ছে কিনা—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে কিনা—

দুর্দানা বেগমের লিস্ট অনেক বড়, মাত্র বলতে শুরু করেছিল কিন্তু হঠাৎ করে থেমে গেল, কারণ ঠিক তখন বাসার সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে, আর সেই গাড়ি থেকে বিশাল একজন পুলিশ অফিসার নেমে এল, একটু কাছে এলেই আমি চিনতে পারলাম, গনি সাহেব, আজ সকালে এই মানুষ আমাকে হাজতে পুরে রেখেছিল।

দরজার সামনে আমাকে দেখে গনি সাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ক্ষুধার্ত বাঘ যখন একটা নাদুসনুদুস হরিণ দেখে তার মুখে মনে হয় ঠিক এরকম হাসি ফুটে ওঠে। গনি সাহেব তার দাতগুলি বের করে বলল, আপনি এখনো আছেন?

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, জি আছি।

নিজের চোখে দেখতে এলাম।

কী দেখতে এসেছেন?

বাচ্চাটা আসলেই আছে কিনা। থাকলেও কেমন আছে—আজকাল কোনো কিছুর ঠিক নাই। হয়তো ছোট বাচ্চাটার ওপর অত্যাচার।

দুর্দানা বেগমের পুলিশের কথাটা খুব মনে ধরল। বলল, ঠিক বলেছেন। ছোট বাচ্চাও যে একজন মানুষ সেটা অনেকের খেয়াল থাকে না। এক বাসায় গিয়ে দেখি বাচ্চাকে ভেজা কাঁথার মাঝে শুইয়ে রেখেছে।

গনি সাহেব বলল, ভেজা কঁাথা কী বলছেন? আমি গ্যারান্টি দিতে পারি, এই ঢাকা শহরে এমন ঘাঘু ক্রিমিনাল আছে যে পারলে বাচ্চাকে পানিতে ড়ুবিয়ে রাখবে।

দুর্দানা বেগম চোখ গোল গোল করে বলল, বলেন কী আপনি?

গনি সাহেব নাক দিয়ে শব্দ করে বলল, আমি এই লাইনের মানুষ, চোর-ডাকাত-গুণ্ডা নিয়ে আমার কারবার। দুনিয়ায় যে কত কিসিমের মানুষ আছে আপনি জানেন না। আমি

জানি।

গনি সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাসা কার?

আমি মিনমিন করে বললাম, আমার বন্ধুর।

তাকে ডাকেন।

আমি কিছু বলার আগেই দুইজনে প্রায় ঠেলে বাইরের ঘরে ঢুকে গেল। আমি তাদেরকে বসিয়ে প্রায় দৌড়ে ভেতরে ঢুকে গেলাম। বাচ্চাটা তখনো অ্যাকুরিয়ামে মহাআনন্দে সঁতরে বেড়াচ্ছে, অনিক চোখ-মুখে একটা মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। আমাকে দেখে বলল, কী হল, পেপারটা আনতে এতক্ষণ?

আমি ফিসফিস করে বললাম, পেপার না।

তা হলে কে?

দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব। বাচ্চা দেখতে এসেছে। এক্ষুনি বাচ্চাকে পানি থেকে তোল। এক্ষুনি।

বাইরের ঘর থেকে দুর্দানা বেগম আবার বাঘিনীর মতো গর্জন করল, কোথায় বাড়ির মালিক?

অনিক ফিসফিস করে বলল, আমি ওদেরকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখছি। তুমি বাচ্চাটাকে তোল। মাস্ক খুলে একটা টাওয়েলে জড়িয়ে নিয়ে আস।

আ-আ-আমি?

তুমি নয় তো কে?

বাইরের ঘর থেকে আবার হুঙ্কার শোনা গেল, কোথায় গেল সবাই?

অনিক তাড়াতাড়ি উঠে গেল। আমি তখন বাচ্চাটাকে পানি থেকে তোলার চেষ্টা করলাম। এত ছোট একটা বাচ্চাকে যখন শুকনো জায়গায় রাখা হয় তখন সে নড়তে চড়তে পারে না, এক জায়গায় শুয়ে থাকে। কিন্তু পানিতে সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। একটা ছোট বাচ্চা সেখানে তুখোড় সাঁতারু। আমি তাকে চেষ্টা করেও ধরতে পারি না। একবার খপ করে তার পা ধরলাম সে পিছুলে বের হয়ে গেল। আরেকবার তার হাত ধরতেই ডিগবাজি দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা না, মনে হল আমার দিকে তাকিয়ে জিব বের করে একটা ভেংচি দিল। এবার দুই হাত ঢুকিয়ে তাকে ধরতে চেষ্টা করলাম, তারপরেও কেমন করে যেন পিছলে বের হয়ে গেল। অনিক কতক্ষণ দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেবকে আটকে রাখতে পারবে কে জানে, আমি এবার তাকে ভালোভাবে ধরার চেষ্টা করলাম আর তখন ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার টিউবটা আমার হাতে পেঁচিয়ে গেল, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে ছাড়া পাবার জন্যে একটা ডিগবাজি দিতেই তার মুখ থেকে মাস্কটা খুলে যায়। মাস্কটার ভেতর থেকে অক্সিজেনের বুদ্বুদ বের হতে থাকে আর সেটা ধীরে ধীরে পানিতে ভেসে উঠতে থাকে।

আমি অনেক কষ্ট করে চিৎকার চেপে রাখলাম-বিস্ফারিত চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছি, দেখছি ধীরে ধীরে বাচ্চাটা পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে ধরার চেষ্টা করছি, আর কী আশ্চর্য সেই অবস্থায় আমার হাত থেকে সে পিছলে বের হয়ে গেল। বাচ্চাটার নিশ্বাস নেবার জন্যে অক্সিজেন নেই কিন্তু সেটা নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। অ্যাকুরিয়ামের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় মাছের মতো সঁতরে যেতে যেতে দুটো ডিগবাজি দিল। তারপর হাত-পা নাচিয়ে আমার দিকে এগিয়ে জিব বের করে আমাকে ভেংচে দিল। কিন্তু নিশ্বাস নেবে কীভাবে? আমি আবার হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম, বাচ্চাটা আমার হাত থেকে পিছলে বের করে মাথাটা পানির ওপর এনে নিশ্বাস নিয়ে আবার পানির নিচে ড়ুবে গেল! এই বাচ্চার মতো চালু বাচ্চা আমি আমার জন্যে কখনো দেখি নি। আগে মুখে একটা মাঙ্কু লাগানো ছিল, সেখান থেকে অক্সিজেনের নল বের হয়েছিল, এত কিছু ঝামেলা নিয়ে সার দিতে তার রীতিমতো অসুবিধে হচ্ছিল। এখন তার শরীরের সাথে কিছু লাগানো নাই, সাঁতার দিতেও ভারি সুবিধে। তাকে ধরবে এমন সাধ্যি কার আছে? পানির ভেতবে ডিগবাজি দিতে দিতে ছুটে যাচ্ছে, আর যখন নিশ্বাস নেবার দরকার হয় তখন ভুশ করে মাথা বের করে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার পানিতে ঢুকে যাচ্ছে। আমি বিস্ফারিত চোখে এই বিস্ময়কর দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। পুরো ব্যাপারটি তখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

হঠাৎ করে আমার মাথা ঘুরে উঠল, আমি পড়েই যাচ্ছিলাম, কোনোমতে দেওয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বসে পড়ার চেষ্টা করলাম। বড় একটা আলমারি ধরে তার পাশে বসে পড়লাম, মনে হচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব।

ঠিক এই সময় ঘরটাতে দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব এসে ঢুকল। আলমারির আড়ালে ছিলাম বলে তারা আমাকে দেখতে পেল না কিন্তু আমি তাদের দেখতে পেলাম। তারা পুরো ঘরটিতে চোখ বুলিয়ে অ্যাকুরিয়ামের দিকে তাকাল, বাচ্চাটা সাতরে ওপরে উঠে ভুশ করে মাথা বের করে আবার নিচে নেমে এল। আমি নিশ্চিত ছিলাম দুর্দানা বেগম এখন গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দেবে কিন্তু সে চিৎকার দিল না। দুজনেই অ্যাকুরিয়াম থেকে তাদের চোখ সরিয়ে ল্যাবরেটরির অনা কোনায় নিয়ে গেল। তারা নিজের চোখে দেখেও বিষয়টা বুঝতে পারছে না, ধরেই নিয়েছে অ্যাকুরিয়ামে একটা মাছ সাঁতার কাটছে। কী আশ্চর্য ব্যাপার!

দুর্দানা বেগম বলল, আপনার বাসায় একটা বাচ্চা অথচ আপনার ঘরবাড়ি এত নোংরা?

শুধুমাত্র অনিক পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারছে, সে নিশ্চয়ই নিজের চোখকে বিশ্বাস। করছে না। উত্তরে কোনো একটা কথা বলার চেষ্টা করে বলল, ক-ক-করব। পপ-পরিষ্কার করব।

গনি সাহেব নাক দিয়ে ফোঁৎ করে শব্দ করে বলল, আপনার মোটা বন্ধুটা বাচ্চাটাকে নিয়ে আসছে না কেন?

অনিক বলল, আ-আ-আনবে। আপনারা বাইরের ঘরে বসেন। এ-এ-এক্ষুনি নিয়ে আসবে।

দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব ঘর থেকে বের হতেই আমি কোনোমতে উঠে আবার অ্যাকুরিয়ামে হাত ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বাচ্চাটাকে উদ্দেশ করে বললাম, দোহাই লাগে তোমার সোনামণি। আল্লাহর কসম লাগে তোমার কাছে আল! প্লি-ই-জ!।

এত চেষ্টা করে যে বাচ্চাটাকে ধরতে পারি নি সেই বাচ্চা হঠাৎ সঁতরে এসে দুই হাত দুই পা দিয়ে আমার হাতটাকে কোলবালিশের মতো ধরে ফেলল। আমি পানি থেকে বাচ্চ আঁকড়ে ধরে রাখা হতিষ্টা বের করে, বাচ্চাটাকে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। এর আগে কখনো ছোট বাচ্চা ধরি নি, তাই খুব সাবধানে দুই হাতে ধরে বাইরে নিয়ে এসে দাঁড়ালাম।

দুর্দানা বেগম ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাচ্চাকে গোসল করাতে গিয়ে দেখি নিজেই গোসল করে ফেলেছেন।

গনি সাহেব বলল, ছোট বাচ্চাকে পানির কাছে নেবার সময় খুব সাবধান।

দুর্দানা বেগম বলল, কিছুতেই যেন পানিতে পড়ে না যায়।

আমি মাথা নাড়লাম, পড়বে না। কখনো পড়বে না।

দুর্দানা বেগম আর গনি সাহেব দুজনেই ভুরু কুঁচকে মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু যেই আমি তোয়ালেটা সরিয়ে বাচ্চাটাকে দেখালাম দুজনের মুখ হঠাৎ করে নরম হয়ে গেল। দুজনেই বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে রইল, আর কী আশ্চর্য, বাচ্চাটা জিব বের করে দুজনকে ভেংচে দিল!

গনি সাহেব দুর্দানা বেগমের দিকে আর দুর্দানা বেগম গনি সাহেবের দিকে তাকাল। তারপর দুজনেরই সে কী হাসি! মনে হয় সেই হাসিতে ঘরের ছাদ উড়ে যাবে।

এই পৃথিবীতে ছোট বাচ্চা থেকে সুন্দর কিছু কি আর আছে?

———