ছোট একটা স্কাউটশিপে করে মহাকাশযান থেকে চার জন গ্রহটিতে নেমে আসছিল। স্কাউটশিপটা একটু বেশি ছোট, একসাথে দুজনের বেশি বসার কথা নয়। তার মাঝে চার জন চাপাচাপি করে বসেছে। দীর্ঘ সময় বায়ুশূন্য মহাকাশে ভেসে ভেসে এসেছে, বিশাল মহাকাশযানের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত ভ্রমণে তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ করে ছোট একটা স্কাউটশিপে করে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করামাত্র প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে তাদের পৃথিবীর কথা মনে পড়ে যায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সাথে এর অবিশ্যি একটি বড় পার্থক্য রয়েছে–এই বায়ুমণ্ডলটি বিষাক্ত। স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণে বসেছে লি–রয়, যদিও পুরো কাজটি করা হচ্ছিল মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার থেকে।
স্কাউটশিপটা নিচে নেমে আসতে আসতে হলুদ রঙের একটি মেঘের ভিতর একটি বড় ঝাঁকুনি খেয়ে খুব সাবধানে দিক পরিবর্তন করল। নিডিয়া দুই হাতে শক্ত করে দেয়াল ধরে রেখে বলল, এ রকম ঝাঁকুনি হবে জানলে আমি মহাকাশযানেই থাকতাম। রিশান ঘোট গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে ধাকতে বলল, ঝাঁকুনিতে আমার বিশেষ আপত্তি নেই কিন্তু কোনোভাবে বিষাক্ত গ্যাস খানিকটা ভিতরে না ঢুকে যায়।
লি-রয় সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল, আরেকটা বড় ঝাঁকুনি কোনভাবে সামলে নিয়ে বলল, এই শেষ, যদি এ রকম হতে থাকে, আমি ফিরে গিয়ে অন্য ব্যবস্থা করছি।
অন্য কী ব্যবস্থা করবে?
পুরো মহাকাশযানটা নামিয়ে আনব–এইসব ছোটখাটো স্কাউটশিপ যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু নয়।
ষুন লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সেটা হয়তো আরো বড় যন্ত্রণা হবে। বাইরে অসম্ভব ঠাণ্ডা, বড় একটি ইঞ্জিন যদি কোনোভাবে জমে যায়, মহাকাশযানকে চালু করতে গিয়ে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।
তা ঠিক।
বাইরে আবার গাঢ় হলুদ রঙের এক ধরনের মেঘ ভেসে এল এবং তার মাঝে ঝাঁকুনি খেতে খেতে স্কাউটশিপটা নিচে নামতে থাকে। চার জন যাত্রী কোনোভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে। বসে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটা মাটির কাছাকাছি এসে গ্রহটাকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। মানুষের বসতিটা কিছুক্ষণের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায়, স্বচ্ছ অর্ধগোলাকৃতি কিছু ডোম, কিছু চতুষ্কোণণা টাওয়ার এবং নানা আকারের এন্টেনা। এর মাঝে কোনো একটি চতুর্থ মাত্রার বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
স্কাউটশিপের অবলাল সংবেদী চোখ খুঁজে খুঁজে অবতরণক্ষেত্রটি খুঁজে বের করে। দীর্ঘদিন অব্যবহারে সেটি প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে আছে। স্কাউটশিপটা খুব সাবধানে সেখানে নেমে এল। স্কাউটশিপ থেকে নামার আগে তারা ভেতরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না। বসতির মাঝে যে মানুষগুলো আছে তারা যে কারণেই হোক কারো সাথে যোগাযোগ করতে রাজি নয়।
স্কাউটশিপ থেকে মূল মহাকাশযানে যোগাযোগ করে লি–রয় পুরো অবস্থাটি আরেকবার পর্যালোচনা করে নেয়। তারপর সবাইকে বিশেষ পোশাক পরে নিতে আদেশ করে।
বিষাক্ত পরিবেশে অনির্দিষ্ট সময় থাকার জন্যে বিশেষ ধরনের পোশাকটি পরতে দীর্ঘ সময় নেয়। একজনের আরেকজনকে সাহায্য করতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়ে যখন সবাই স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে এল তখন বাইরে বিচিত্র এক ধরনের ঝড় ব্রু হয়েছে। আকাশে ঘোলাটে এক ধরনের আলো বিদ্যুৎ চমকানোর মতো করে ঝলসে উঠেছে। বাতাসে হলুদ ধুলো উড়ছে এবং সবকিছু ছাপিয়ে চাপা এক ধরনের গোঙানোর মতো শব্দ। পুরো পরিবেশটিতে এক ধরনের অশরীরী আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। চার জনের ছোট দলটি মানুষের বসতির দিকে হাঁটতে শুরু করে। সবার সামনে রিশান, তার হাতে একটি শক্তিশালী এটমিক ব্লাস্টার। সবার পিছনে লি–রয়, তার হাতে মাঝারি আকারের লেজারগান। মাঝখানে নিডিয়া এবং ষুন, তারা ছোট দুটি ভাসমান বাক্সে কিছু রসদ টেনে নিচ্ছে।
স্কাউটশিপের অবতরণক্ষেত্র থেকে মানুষের বসতির মূল গেটটি খুব কাছাকাছি কিন্তু তবু এই ছোট দলটির সেখানে পৌঁছতে অনেকক্ষণ লেগে খেল। গেটটি বন্ধ এবং রিশান সেখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে। দীর্ঘ সময় কেটে যায় এবং শেষ পর্যন্ত মাথার উপরে একটি মনিটরে একজন মানুষের ভয়ার্ত দেখা যায়। মানুষটি আতঙ্কিত গলায় বলল, কে?
আমরা একটি মহাকাশ অভিযানের দল। তোমাদের বিপদ সঙ্কেত পেয়ে দেখতে এসেছি।
মানুষটি আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তার মুখ দেখে মনে হয় সে তাদের কথা বিশ্বাস করছে না।
লি–রয় আবার বলল, আমাদের ভিতরে আসতে দাও।
মানুষটি তবু কোনো কথা বলল না, একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
লি–রয় একটু অধৈর্য হয়ে বলল, আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি, আমাদের ভিতরে আসতে দাও।
ও আচ্ছা দিচ্ছি। তোমরা একটু অপেক্ষা কর।
উপরের মনিটর থেকে মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
ষুন নিচু গলায় বলল, এরা বাইরের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
হা। নিডিয়া যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি ভিতরে কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
রিশান বলল, প্রাচীনকালে মানুষ যেরকম দুর্গ তৈরি করত এই বসতিটাকে দেখে আমার সেরকম মনে হচ্ছে।
নিডিয়া বলল, কিছু একটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু আমি ঠিক ধরতে পারছি না কী।
ধরতে না পারার কী আছে, যেটা পছন্দ হচ্ছে না সেটা হচ্ছে এই গ্রহটা। তাকিয়ে দেখ একবার।
লি–রয়ের কথা শুনে সবাই তাকিয়ে দেখল এবং সাথে সাথে সত্যিই সবার গা কাটা দিয়ে ওঠে। আকাশে ঘোলাটে এক ধরনের আলো সেটি কখনো একটু বেড়ে যায় কখনো একটু কমে যায়। আলোটি আসছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে এবং ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ নয়–গাঢ় হলুদ রঙের। উপরে তাকালে মনে হয় যেন ঘোলা পানির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডলও স্থির নয়, সবসময় ঝড়ো বাতাস বইছে। শুরু হলুদ রঙের এক ধরনের ধুলো উড়ছে, ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে। আবছা আলোতে খুব বেশি দেখা যায় না কিন্তু যতদূর চোখ যায় ততদূর রুক্ষ পাথর এবং খানাখন্দ। চারদিকে এক ধরনের বিভীষিকা ছড়িয়ে আছে।
নিডিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে সরে পড়তে পারলে বাচি।
লি–রয় অধৈর্য হয়ে আরেকবার বন্ধ–দরজার দিকে তাকাল, তারপর গলার স্বর ট্রান্সমিটারের আর. এফ, ব্যান্ডে সব ফ্রিকোয়েন্সিতে ছড়িয়ে দিয়ে বলল, তোমরা ভিতরে যারা আছ তারা আমাদের ঢুকতে দাও। যদি সেটি না কর আমরা জোর করে ঢুকতে বাধ্য হব। আমরা তোমাদের সাহায্য করতে এসেছি।
লি–রয়ের হুমকিতে কাজ হল মনে হয়, প্রথমে খুট করে একটা শব্দ হল এবং সাথে সাথে বড় দরজাটি হাট করে খুলে যায়। প্রথম ঘরটি বায়ুচাপ নিরোধক ঘর। বাইরের দরজাটি বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে ভিতরে চাত্রা স্বাভাবিক হতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা কোয়ারেন্টাইন ঘরে এসে প্রবেশ করল এবং তাদেরকে জীবাণুমুক্ত করার জটিল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপারটি শুরু হয় গেল।
শেষ পর্যন্ত যখন তারা মানুষের মূল বসতিতে প্রবেশ করতে পারল তখন কারো আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি নেই।
মানুষের মূল বসতিটি যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে মহাকাশচারীর এই দলটিকে অভ্যর্থনা করার জন্যে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। মানুষগুলো নির্জীব, তাদের গায়ের চামড়া বিবর্ণ চোখে অসুস্থ হলুদাভ এক ধরনের রং। তারা কোনো ধরনের উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে শীতল গলায় তাদের অভ্যর্থনা জানাল। লি–রয় একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি লি–রয়, মহাকাশ অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের দলপতি
মানুষগুলো কৌতূহলহীন চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। শেষ পর্যন্ত একজন, যার গায়ের কাপড় ধূসর এবং অপরিষ্কার, একটু এগিয়ে এসে ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমাকে অভিবাদন।
তোমাদের পাঠানো চার মাত্রার বিপদ সঙ্কেত পেয়েছি। আমাদের তথ্যকেন্দ্রে তোমাদের সব খবর রয়েছে।
ও।
হ্যাঁ, আমরা তোমাদের উদ্ধার করে পৃথিবীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।
মানুষগুলো কোনো উচ্ছ্বাস না দেখিয়ে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। লি–রয় আবার কথোপকথন শুরু করার চেষ্টা করল, তোমাদের অনেক বড় বিপদ বলে জানিয়েছ। বিপদটা কী ধরনের বলবে?
গ্রুনি।
গ্রুনি?
হ্যাঁ। রুনি একজন একজন করে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলেছে।
গ্রুনিটা কে?
রিশান লি–রয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, এই গ্রহের যে এককোষী প্রাণের বিকাশ হয়েছে– একটা জীবাণু ছাড়া আর কিছু নয়, সেটাকে এখানকার মানুষেরা গ্রনি বলে ডাকে।
মানুষগুলো সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ল।
তোমরা এখানে সব মিলিয়ে কতজন মানুষ ছিলে?
প্রথমে এসেছিল চার জন, চল্লিশ বছর আগে। দশ বছর পরে এসেছিল আরো চার জন। তারপরের বার তিন জন। শেষ বার এসেছে পাঁচ জন।
তার মাঝে মারা গেছে কয়জন?
সবাই।
সবাই তো হতে পারে না, তোমরা তো বেঁচে আছ।
হ্যাঁ আমরা ছাড়া। চার জন মানুষ মাথা নেড়ে বলল, আমরা চার জন ছাড়া।
আর কেউ বেঁচে নেই?
মানুষগুলো কোনো উত্তর দিল না। অন্যমনস্কভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
লি–রয় আবার জিজ্ঞেস করল, আর কেউ বেঁচে নেই?
অপরিষ্কার কাপড় পরা নির্জীব ধরনের মানুষটি চোখ তুলে বলল, না।
নিডিয়া একটু এগিয়ে লি–রয়ের হাত স্পর্শ করে বলে, আমার মনে হয় এদের ধাতস্থ হওয়ার জন্যে খানিকটা সময় দেয়া দরকার। আমরা একটু পর তাদের সাথে কথা বলি।
রিশান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, সেটাই ভালো। ততক্ষণ আমরা জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখি।