চিঠি পড়তে পড়তেই মাহতাব সাহেবের মাথা ব্যথা ফিরে এল। চোখ টনটন করতে লাগল। আজ কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি কি বেশি টেনশান করছেন? বাড়াবাড়ি ধরনের এই টেনশানের মানে কী?
মাহতাব সাহেব টেলিফোন হাতে নিলেন। জালাল খাঁর সঙ্গে কথা বললে যদি টেনশান কিছু কমে। সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। জালাল নিজে টেনশানমুক্ত জীবনযাপন করে। যে নিজে টেনশানমুক্ত জগতে বাস করে সে অন্যদের টেনশান দূর করতে পারে না।
হ্যালো জালাল?
হ্যাঁ। কে?
চিনতে পারছি না কে?
না।
আমি মাহতাব।
ও আচ্ছা তুই। তোর টেলিফোন পাব এটা আমি ভাবছিলাম। অরণ্যের খবর কী?
জানি না কী খবর। তাকে তালাবন্ধ করে রেখেছি।
সে-কী! কেন?
আমি তার ব্যাপারে কনফিউজড।
কনফিউজড হলেই তাকে তালাবন্ধ করে রাখতে হবে? তুই একটা কাজ কর। তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দে।
অসম্ভব! তাকে আমি হাতছাড়া করব না।
জালাল খাঁ হেসে ফেললেন। মাহতাব বললেন, তুই হাসছিস কেন?
তুই অসম্ভব রকম টেনস্ হয়ে আছিস এই জন্যে হাসছি। আমার ধারণা তোর প্রেসার বেড়েছে। ড্রপ বিট হচ্ছে। তুই একজন ডাক্তার ডেকে আন।
জালাল শোন, আগামী বৃহস্পতিবারে তোর কি অবসর আছে?
আমার সব দিনই অবসর, আবার সবদিনই ব্যস্ততা।
বৃহস্পতিবারটা তুই অবশ্যই অবসর রাখবি। আমার বাগানবাড়িতে যাবি। সেখানে খলিলুল্লাহকে নিয়ে জটিল একটা এক্সপেরিমেন্ট করব।
তুই বারবার তাকে খলিলুল্লাহ বলছিস কেন? টুনটুনি তার নাম দিয়েছে। অরণ্য। তাকে অরণ্য ডাকবি। মাহতাব শোন, আমি তোর এই অদ্ভুত মানুষ নিয়ে ভাবছি। কিছু পড়াশোনা করছি। আমার ধারণা সে Homo superior।
Homo superior কী?
ডারউইনের এডভালিউশনের ধারায় মানুষের পরের বিবর্তন হলো Homo superior |
ভালো করে বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলার সময় এখনো আসে নি। যখন সময় আসবে তখন বুঝিয়ে বলব। মাহতাব, আমি টেলিফোন রাখলাম। পড়ার মাঝখানে কেউ টেলিফোন করলে আমার খুবই বিরক্তি লাগে।
মাহতাব সাহেব খানিকটা বিব্রত গলায় বললেন, তোকে একটা হাস্যকর প্রশ্ন করছি, তুই কিন্তু হাসবি না।
জালাল খাঁ বললেন, তুই কন্ট্রাডিকটরি কথা বলছিস। হাস্যকর কথা বলবি অথচ আমি হাসতে পারব না? আচ্ছা চেষ্টা করব না হাসতে, বল কী কথা?
এমন কি হতে পারে যে খলিলুল্লাহ আসলে মানুষ না। জিন।
জিন?
হ্যাঁ, জিন।
মাটির কলসিতে যারা বন্দি থাকে তারপর ধোয়া হয়ে বের হয় সেরকম কিছু?
মাহতাব বিরক্ত গলায় বললেন, তুই আমার কথাগুলি ফানের দিকে নিয়ে যাচ্ছিস। আমি ফান করছি না।
জালাল খাঁ বললেন, তোর ঘরে কি ঘুমের ওষুধ আছে?
আছে।
কয়েকটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে তুই ঘুমিয়ে পড়। আমি ভোরবেলা তোর সঙ্গে কথা বলব। সকালে তুই আরেকটা কাজ করবি—অরণ্যকে কোনো এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি। ডাক্তার তার ব্লাড গ্রুপ পরীক্ষা করবে, ইসিজি নেবে। ডাক্তার যখন বলবে অরণ্যের ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তখন নিশ্চয়ই ভাববি না যে অরণ্য মানুষ না জিন। জিনদের ও পজিটিভ ব্লাড গ্রুপ থাকার কথা না।
খলিলুল্লাহর ব্লাড গ্রুপ ও পজিটিভ তোকে কে বলল?
কেউ বলেনি, কথার কথা বলছি। তুই কি আর কিছু বলবি?
না।
আমি কি টেলিফোন নামিয়ে রাখতে পারি?
মাহতাব সাহেব কিছু বললেন না। জালাল খাঁ টেলিফোন নামিয়ে রাখার পরেও তিনি বেশ কিছু সময় রিসিভার কানে নিয়ে বসে রইলেন।
ঘড়িতে এখন এগারোটা বাজে। টুনটুনির জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়া যাবে না। মাহতাব সাহেব দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সেকেন্ডের কাটা নড়ার কট কট শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনি যে উত্তেজিত এই কট কট শব্দ তার প্রমাণ। উত্তেজিত হলেই সেকেন্ডের কাঁটা নড়ার কট কট শব্দ তিনি শুনতে পান। ঘড়িটি কি দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলবেন?
এখন বাজছে এগারোটা এক। আশ্চর্য, মাত্র এক মিনিট পার হয়েছে? সময় কি থমকে গেছে? মাহতাব সাহেবের মনে হচ্ছে তিনি অনন্তকাল ধরে বসে আছেন। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার কট কট শব্দ শুনছেন।
টুনটুনি খলিলুল্লাহর ঘরে বসে আছে। সে বসেছে চেয়ারে। খলিলুল্লাহ দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে আছে। টুনটুনি বলল, আপনাকে যে তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে এতে কি আপনার খারাপ লাগছে?
না।
খারাপ লাগছে না কেন?
আম্মাজি, আমার কোনো কিছুতেই খারাপ লাগে না।
আমাকে আপনি আম্মাজি ডাকেন কেন?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না, হাসল।
আপনার মা কি দেখতে আমার মতো ছিলেন।
আমার মায়ের কথা আমার মনে নাই।
মাকে কখনো দেখেন নি?
মনে নাই।
আপনার বাবাকে আপনি দেখেছেন?
মনে নাই।
আপনার কিছুই মনে নাই এটা কেমন কথা?
আম্মাজি, আমার একবার খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। অসুখের পর আগের কথা সব ভুলে গেছি।
কী অসুখ হয়েছিল?
মাথায় যন্ত্রণা হয়েছিল। এমন যন্ত্রণা যার কোনো মা-বাপ নাই। তখন চোখের সামনে শুধু কলকজা দেখতাম।
স্বপ্নে দেখতেন?
স্বপ্নে দেখতাম না বাস্তবে দেখতাম সেটা খেয়াল নাই। শুধু দেখতাম কলকবজা। বড় কষ্ট করেছি। অসুখ অনেকদিন ছিল।
এখন সেই স্বপ্ন দেখেন না?
না, এখন অন্য কিছু দেখি।
কী দেখেন?
খলিলুল্লাহ জবাব দিল না। হাসল। টুনটুনি বলল, আজ আমার খুব মন খারাপ।
খলিলুল্লাহ বলল, কেন মন খারাপ? আজ আমার মায়ের মৃত্যুদিন। বাবা দিনটার কথা ভুলে গেছেন। আজ তোমার মায়ের মৃত্যুদিন।
হ্যাঁ। আপনার যেমন আপনার মায়ের কথা কিছু মনে নেই আমারও আমার মায়ের কথা কিছু মনে নেই। আমার যখন দুবছর বয়স তখন আমার মা মারা যান। দুবছর বয়সের স্মৃতি মানুষের মাথায় থাকে না।
তোমার বাবা আর বিয়ে করেন নি?
বিয়ে করেছিলেন। নতুন মা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। চিটাগাং থেকে ঢাকা আসার পথে রোড এক্সিডেন্ট হয়। ড্রাইভার এবং মা দুজনই মারা যান। বাবা আহত হয়েছিলেন। অনেক দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
টুনটুনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আসল মার কথা আমার মনে নেই, কিন্তু নতুন মার কথা মনে আছে। উনি আমাকে খুব আদর করতেন। আমার টুনটুনি নাম উল্টো করে আমাকে ডাকতেন নিটুনটু। আচ্ছা আপনি ঘুমান, আমি উঠি। আপনার ঘর আমি তালাবন্ধ করে রাখব, আপনি রাগ করবেন না।
আমি রাগ করব না।
আপনার যদি কখনো মনে হয় আপনি এখানে থাকবেন না, পালিয়ে যাবেন-তাহলে আমাকে বলবেন, আমি গভীর রাতে এসে তালা খুলে দেব। আপনি বাড়ির পেছনে চলে যাবেন, সেখান থেকে দেয়াল টপকে পালিয়ে যাবেন। পারবেন না?
হ্যাঁ পারব।
টুনটুনি খলিলুল্লাহর দরজায় তালা লাগিয়ে দিল।
মাহতাব উদ্দিন ঘুমুতে গেলেন রাত একটায়। ঘুমুতে যাবার আগে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে একটা ডরমিকাম খেলেন। সাত মিলিগ্রামের ডরমিকম, নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্যে যথেষ্ট। ঘুমের ওষুধ খাবার সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নাকি নিয়ম নেই। পাঁচ দশ মিনিট পরে যেতে হয়। শরীর বিলাক্স করার জন্যে সামান্য হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বিছানায় যাবার ঠিক আগে আগে এক কাপ গরম দুধ এবং এক গ্লাস হিম শীতল পানি খেতে হয়। তিনি সবই করলেন কিন্তু তার ঘুম এলো না। দেয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা প্রথমে দেয়ালে তারপর দেয়াল থেকে তার মাথার ভেতরে কট কট করতে লাগল। তিনি বিছানা থেকে উঠে ঘড়ি নামিয়ে তার ব্যাটারি খুলে রাখলেন। তারপরেও সেকেন্ডের কাটার কটকটানি বন্ধ হলো না। মাথার ভেতর কট কট করতেই থাকল।
তাঁর ঘুম এলো ফজরের নামাজের পর। ঘুমের মধ্যে তিনি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি তাঁর বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘুম ভাঙতেই চারদিকে লালাভ আলো দেখতে পেলেন। সেই সঙ্গে শো শোবিজ বিজ শব্দ। ব্যাপারটা কী জানার জন্যে চারদিকে তাকাচ্ছেন, হঠাৎ চোখ পড়ল ঘরের মেঝের দিকে। ঘরের মেঝেটা বদলে গেছে। এটা এখন আর মেঝে না, গলিত লাভার মতো হয়ে গেছে। লাভা ফুটছে। বুদবুদ ভাঙছে। সেখান থেকেই বিজ বিজ শব্দ হচ্ছে। ঘটনা কী? তিনি কি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে আগ্নেয়গিরির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন? তিনি আতঙ্কে অস্থির হয়ে খাটে উঠে বসলেন এবং লক্ষ করলেন তার রট আয়রনের খাটের পায়া জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির লাভাতে গলে গলে যাচ্ছে তিনি দ্রুত নেমে যাচ্ছেন লাভা সমুদ্রে। যে দিকে চোখ যাচ্ছে গলন্ত লভা।
শোঁ শোঁ শব্দ আসছে। শব্দটা হচ্ছে ঠিক মাঝখানে। কোনো একটা ঘটনা সেখানে ঘটছে। ভয়ঙ্কর কোনো ঘটনা। মাহতাব সাহেব স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কিছু একটা বের হয়ে আসছে। একটা মানুষের মাথা। মানুষটা কে? খলিলুল্লাহ? হ্যাঁ খলিলুল্লাহই তো। মাহতাব সাহেব চেঁচিয়ে বললেন, কী চাও তুমি, কী চাও?
মানুষের মাথার মুখ হা হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, আমি কিছু চাই না।
চলে যাও তুমি, চলে যাও।
কোথায় চলে যাব?
যেখান থেকে এসেছ সেখানে চলে যাও।
যাব কীভাবে? আপনি তো আমাকে তালাবন্ধ করে রেখেছেন!
মাহতাব সাহেব স্বপ্নের ভেতর চেঁচাচ্ছেন টুনটুনি, চাবি দিয়ে তালা খুলে দে। চলে যাক। এ যেখান থেকে এসেছে সেখানে চলে যাক।
মাহতাব উদ্দিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন তাঁর সারা শরীর ঘামে ভেজা।