০৫.
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙাতে খাবার ঘরে এসে ঢুকলাম। তখন ঘড়িতে সাতটা বাজে। দেখি, লোলা একটুকরো কাপড় নিয়ে কাউন্টারের ওপরটা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে। ওর পরনে খুব ছোটো একটা লাল প্যান্ট। গায়ে হলদে চোলি। এই পোশাকে লোলা আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এই স্বল্প পোশাকের বিরুদ্ধে যেন বিদ্রোহ করছে ওর উদ্ধত যৌবন। মনে মনে জেনসনকে হিংসা করলাম।
লোলা প্রথমে আমাকে দেখতে পায়নি। হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়ায় লক্ষ্য করলাম মুখে বিরক্তির ভাব। কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে পড়ে ও সামনের দিকটা ঘষতে লাগলো। ঝুঁকে পড়ায় চোখে পড়লো ওর সুগঠিত দুই স্তন–অন্তর্বাসের অনুপস্থিতি
রান্নাঘরের টেবিলের কাছে জেনসন বসেছিলো। টেবিলের ওপর স্তূপীকৃত নোট আর খুচরা পয়সা। একপাশে একটা খালি প্লেট, ছুরি, কাটা চামচ, আর এক কাপ কফি। আমাকে দেখে সে হাসলো, এসো জ্যাক, ভেতরে এসো। কি খাবে বল? স্যান্ডউইচ, ডিম?
না, মিঃ জেনসন, শুধু এক কাপ কফি।
জেনসন আমাকে বললো, এদিকের সব কাজ সারা হয়ে গেলে, আমি আর লোলা ওয়েন্ট ওয়ার্থে যাবো; কিছু জিনিসপত্র কেনার আছে। গতকাল যা বিক্রি হয়েছে, গত কবছরে কোনও দিন তার অর্ধেকও বিক্রি হয়নি। জ্যাক, এবারে ঠিক করেছি রেস্তোরাঁর বিক্রির ওপর তোমাকে পাঁচ পার্সেন্ট কমিশন দেবো। ওয়েন্ট ওয়ার্থ থেকে ফেরার সময় একটা অ্যাপ্রন নিয়ে আসবোতোমার কাজ করতে অনেক সুবিধা হবে।
কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, পোশাক ইত্যাদি কেনার জন্য আমার হাতে একশো ডলার খুঁজে দিলো জেনসন।
আমি জেনসনকে ধন্যবাদ জানালাম। জেনসন বললো, আরে ধন্যবাদ জানাবার কি আছে। এ তো তোমার পাওনা টাকা থেকেই দিলাম। রেস্তোরাঁর কমিশন হিসাবে আগাম দিলাম।
জেনসন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো, জ্যাক কাল যে পুরোনো ইঞ্জিনটা দেখলে ওটা ওজন দরেই কিনে এনেছি; কিন্তু এখন ভাবছি, ইঞ্জিনটার পেছনে খাটলে হয়তো ওটাকে চালু করা যাবে। যাই হোক ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি আর লোলা বেরিয়ে পড়ছি, তুমি কি একা থাকতে পারবে?
কেন পারবো না? আমার একা থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না।
কফির কাপটা ধুয়ে রাখলাম, একটা সিগারেট ধরিয়ে খাবার ঘরে গেলাম।
লোলা পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ফ্রট পাই এর জারে লেবেল লাগিয়ে রাখছিলো,আমি যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। শরীরের রক্ত চলাচল দ্রুত হয়ে উঠলো, যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি গত রাত্রে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা লোলাকে। লোলা আমার উপস্থিতি টের পেয়েও ফিরে তাকালো না। আমি আর অপেক্ষা না করে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
সকালের হালকা রোদে বেশ ভালোই লাগছে। রাতের ঠাণ্ডা আমেজটা যেন যেতে গিয়েও যায়নি। একটা ঝাটা নিয়ে পাম্পের কাছটা ঝাট দিতে শুরু করলাম। তারপর ঝাট দেওয়া শেষ করে গুমটি ঘরে গেলাম। সেখানে ইঞ্জিনটা নিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে জেনসন আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
আমরা বেরোচ্ছি,জ্যাক, তোমার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
না, না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি ঠিক পারবো।
জেনসনের পিছন পিছন গুমটি ঘরের দরজা পর্যন্ত এলাম। দেখি, বাংলো থেকে লোলা বেরিয়ে আসছে। পরনে একটা সবুজ রঙের আঁটোসাঁটো সুতী পোশাক।
জেনসন আমার কোমরে এক খোঁচা মারলো, কি হে, একেবারে বোবা হয়ে গেলে যে! দেখেছো কি রকম সেজেছে আমার বউ?
বোকার মত হেসে বললাম আপনার স্ত্রী সত্যিই সুন্দরী মিঃ জেনসন।
সবাই তো তাই বলে! জেনসনের মুখে গর্বের হাসি, যাকগে, চলি আবার দুপুরে দেখা হবে। ওদের গাড়ি একরাশ ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে গেলো
একটা সিগারেট ধরিয়ে চারপাশে তাকালাম : দেখতে লাগলাম পয়েন্ট অফ নো রিটার্নকে। সত্যিই এরকম একটা জায়গা যদি আমার থাকতো। আর থাকতে লোলার মত সুন্দরী স্ত্রী।
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আবার ইঞ্জিনটার কাছে ফিরে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই স্থির হয়ে কাজ করতে পারছি না।–লোলার চিন্তাকে মন থেকে মুছে ফেলা অসম্ভব। গত রাতের কথা বারে বারে মনে পড়ছে
এইভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে গেলো। একসময় দেখি, একটা শেভ্রলে গাড়ি গুমটি ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার আরোহী গাড়ি থেকে নামলো। বয়স হবে বছর চল্লিশের মতো। লম্বা, রোগা চেহারা, পরনে রঙ ওঠা একটা নীল প্যান্ট, ময়লা কালো জামা। গলায় একটা লাল রুমাল বাঁধা মাথায় বাদামী রঙের টুপি।
আগন্তুক এসে গুমটি ঘরে ঢুকলো৷ কাছ থেকে আরো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। তাকে দেখেই আমি কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মনে হলো লোকটার চেহারায় কেমন যেন একটা পুলিশ পুলিশ ভাব, বিশেষ করে ঐ অন্তর্ভেদী সন্দেহ ভরা শিকারী চোখ জোড়ায়। আমরা উভয়ে উভয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো আমার ভিতরটা যেন তন্নতন্ন করে দেখছে। আমি ইঞ্জিনটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, কি চাই?
লোকটা প্যান্টের পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, চাই তো অনেক কিছুই। যেমন ধরো জানতে চাই তোমার পরিচয়; এখানে তুমি কি করছো,হয়তো জানতে চাই মিঃ জেনসন এখন কোথায় আছেন, হয়তো তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই, নিজের চরকায় তেল দিন উপদেশটা-কি বলল?-লোকটা খিকখিক করে হেসে উঠলো।
লোকটার কথা শুনে আমার সারা শরীর রাগে জ্বলে উঠলো, কিন্তু মনে হলো লোকটার পরিচয় না নিয়ে লোকটার ওপর রাগ করাটা ঠিক হবে না।
ঠাণ্ডা স্বরেই জবাব দিলাম, মিঃ জেনসন ও মিসেস জেনসন ওয়েন্টওয়ার্থে গেছে। আর আমি হলাম জ্যাক প্যাটমোর এখানে নতুন চাকরিতে ঢুকেছি।
তাই নাকি! তার মানে কার্ল তোমাকে চাকরি দিয়েছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
হু–ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার!
আমি তো ভাবতেই পারিনি ওর স্ত্রীর অমতে কার্ল এখানে লোক রাখবে। কথা বলার সময় তার সন্দেহভরা চোখ আমার ময়লা পোশাক, ছেঁড়া জুতো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। একসময় নিজের মনেই মাথা নাড়লল, কি যেন ভাবলো, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমি কার্লের শ্যালক, আমার নাম রিক্সজর্জ রিক্স।
আমি অনুমান করলাম এ নিশ্চয় জেনসনের মৃত স্ত্রীর ভাই, লোলার কেউ নয়। সুতরাং বাজে কথায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই ভেবে ইঞ্জিনটার দিকে মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ ঘাড়ের ওপর তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করলাম। গীয়ার বক্সের ওপর থমকে দাঁড়ালো আমার কর্মব্যস্ত হাত।
এসব পুরোনো মাল কেনাবেচার ব্যাপারে কার্লের বুদ্ধি আছে। কিন্তু মানুষ চিনতে ওর সময় লাগে, সেরকম বুদ্ধি ওর নেই।
চমকে উঠলাম। কি ইঙ্গিত করছে রিক্স?
কার্লের বউকে তোমার কেমন লাগে? ইঞ্জিনটার ওপর ঝুঁকে থাকায় সে আমার মুখের পরিবর্তন দেখতে পেলো না। কারণ রিক্স কিভাবে জানবে যে, সব সময় আমি শুধু লোলার কথাই ভাবছি।
ভালই, স্ক্রু ড্রাইভার নিয়ে ক্ল্যাচ-প্লেট খুলতে শুরু করলাম।
ভালো? তোমার তাই মনে হয়? কিন্তু জেনে রেখো চাঁদ, লোলা তোমাকে পছন্দ তো করেই না, এখানে কেউ কাজ করুক তাও সে চায় না আমাকেই বলে তাড়াতে পারলে বাঁচে। ঐ ধরনের একটা উটকো মেয়েকে বিয়ে করে বসবে তা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু লোলা খুব চালাক মেয়ে। কালের মতো পয়সাওয়ালা লোককে ও হাতছাড়া করতে চায়নি। তাই ওর সামনে যৌবনের মায়াজাল বিছিয়ে টোপ ফেলেছে। যাই হোক তুমি খুব সাবধানে থেকো বৎস, মনে রেখো তোমাকে বেশিদিন এখানে থাকতে হচ্ছে না। কার্লকে যেমন করে তোক রাজি করিয়ে ও তোমাকে তাড়াবেই।
আমি এমন একটা ভাব করলাম যেন খুব অবাক হয়ে গেছি, বোকা বোকা চোখ করে রিক্সের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, আপনি কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি এখানে শুধু চাকরিতে ঢুকেছি।
রিক্স দাঁত বার করে হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ, তুমি চাকরিতে ঢুকেছো ঠিক কথা, কিন্তু অন্য কেউ কার্লের টাকায় ভাগ বসাক, তা ভোলা চাইবে না। সমস্ত টাকা ও একাই নিতে চায়। আমার চোখকে ও ধোঁকা দিতে পারবে না। শুধুমাত্র টাকার জন্যই ও কার্লকে বিয়ে করেছে। লোলাকে চিনতে তোমার এখনও অনেক বাকি।
তাছাড়া, তুমি হয়তো জানোনা, কার্ল অত্যন্ত মিতব্যয়ী।বছরের পর বছর ও শুধু টাকা জমিয়ে গেছে; বিনা প্রয়োজনে একটা পয়সাও খরচা করেনি। কিন্তু কারোর উপকার করার সময় ও কোনো দ্বিধা না করেই টাকা খরচ করে। আর লোলা সেটা ভালোভাবেই জানে। তাই স্বামীকে চোখে চোখে রাখে–যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো বাজে খরচ না হয়। কার্ল যদি ওর অমতে কিছু করে তবে রাত্রিবেলা লোলা তার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তাই বলছি তুমি আর এখানে বেশি দিন নয়। লোলা হয়তো ভাবছে, ওর মতো তুমিও কালের টাকা হাতানোর ধান্দায় আছে।
আমি কোনো জবাব না দিয়ে কাজ করে চললাম। ক্ল্যাচ-প্লেটগুলো পেট্রলে ভিজিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। রিক্স তখনও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে লক্ষ্য করছিলো, কিন্তু আমার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলো।
আচ্ছা–শুধু শুধু আর তোমার সময় নষ্ট করবোনা, দরজা ছেড়ে রিক্স এগিয়ে এলো, বাড়িতে একটা কাজের জন্য আমার কয়েকটা যন্ত্রপাতি দরকার। অন্য সময় কার্লের থেকেই নিয়ে যাই–কিন্তু সে তো এখন নেই, কি আর করবো বলতে বলতে সে যন্ত্রপাতির তাকের কাছে এগিয়ে গেলো, দেখি কোন্টা লাগবে–হাত বাড়িয়ে রিক্স দুটো ভ্রু ড্রাইভার আর একটা হাতুড়ি তুলে নিলো, তারপর হাত বাড়ালো একটা ড্রিল এর দিকে।
মিঃ রিক্স ওগুলো আপনাকে দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। রিক্স থমকে দাঁড়ালো, ভাবলেশহীন মুখে ফিরে তাকালো।
আমি বললাম, মিঃ জেনসন তো এখানে নেই; তার অনুমতি ছাড়া যন্ত্রপাতি দেওয়াটা ঠিক হবে না। আপনি অপেক্ষা করুন, তিনি ফিরে এলে তাকে বলে নিয়ে যাবেন।
আমার কথায় কান না দিয়ে ও ড্রিলটা তুলে নিলো। ওর জন্য ভেবোনা দোস্ত, আমি কার্লের আত্মীয়, আমি এগুলো নিলে কার্ল কিছু মনে করবে না।
আমি তাকে বললাম যে, আমি নিরুপায়। আর আপনার যদি সেরকম দরকার থাকে, তবে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, মিঃ জেনসন এসে পড়বেন।
রিক্সের সারা মুখ ঘেমে উঠেছে, মুখটা হয়ে উঠেছে আরো কুৎসিৎ, তাহলে তুমিও লোলার সঙ্গে ভিড়েছ? কার্লের টাকার লোভ তোমার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। তাহলে কি লোলার সঙ্গে খাটবাজি করছো?
আমার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গেলো, খামচে ধরলাম রিক্সের জামার কলার। দুবার ঝাঁকানি দিয়ে এক ঝটকায় দরজার দিকে ছিটকে ফেলে দিলাম।
রিক্সের হাত থেকে যন্ত্রপাতিগুলো ছিটকে পড়লো, গলায় হাত বোলাতে বোলাতে সে উঠে দাঁড়ালো। মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। চোখে ওর জ্বলন্ত দৃষ্টি, ঠিক আছে। দাঁড়া শালা কার্লকে বলে তোর ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আমি তেড়ে যেতেই ও গাড়ির দিকে ছুটে চলে গেলো। তারপর মুহূর্তমাত্র দেরী না করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো।
একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। এ ব্যাপারটা জেনসনের কানে গেলে কি হবে কে জানে। তবে ভরসা এই রিক্সের নালিশ শোনার আগেই আমি সাফাই গাইতে পারবো।
দুপুরের দিকে মালপত্র কিনে জেনসন ফিরে এলো। গাড়ি থেকে মাল নামাতে নামাতে তাকে রিক্সের ব্যাপারটা বললাম। কিন্তু লোলার সম্বন্ধে যে কথাগুলো শুনেছি, সেগুলো চেপে গেলাম। আমি জেনসনকে বললাম, মিঃ রিক্স কিছুতেই আমার কথা না শোনায় তাকে আমি তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি।
জেনসন হাসতে আরম্ভ করলো, ঠিক করেছে। জর্জ ব্যাটা এক নম্বরের বদমাস। আগে যতবারই জিনিসপত্র নিয়ে গেছে, একবারও ফেরৎ দেয়নি। এখন লোলা আসাতে ব্যাটা জব্দ হয়েছে। তবে তোমাকে বলে রাখছি জ্যাক, আমি না থাকলে ওকে একটা জিনিসও দেবে না।
আমি নিশ্চিন্ত হলাম। জেনসন যে আমার ওপর রাগ করেনি তাতেই আমি খুশী। কিন্তু মনে হলো রিক্সকে রাগিয়ে আমি বোধহয় ভালো করিনি। এবার থেকে ওর ওপর নজর রাখতে হবে। বলা যায় না, কোন দিন হয়তো আমার অজান্তেই ও আমার বিপদ ডেকে আনবে।
পুব আকাশে ভোরের সূর্য দেখা দিয়েছে। মরুভূমির আবহাওয়ায় একটা হালকা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়েছে। দূরের ধূসর পাহাড়ের ছায়া যেন পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে মরুভূমির বালির ওপর।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম গত তিন সপ্তাহের কথা জেনসনের কথা-লোলার কথা। এই তিন সপ্তাহ এখানে কাটানোর পর ফার্নওয়ার্থকে মনে হয় এক মিথ্যে দুঃস্বপ্ন। জীবনের সেই অধ্যায়টা যেন কেউ সযত্নে মুছে ফেলেছে স্মৃতির পৃষ্ঠা থেকে।
লোলা এখনও আমাকে সহজ ভাবে নিতে পারেনি। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। কিন্তু ওর প্রভাবকে আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পিরবো কিনা জানি না।
জেনসনের মতো সহজ সরল মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। তার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে গেছে।
একথা ঠিক যে জেনসন লোলাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। কিন্তু একটু আড্ডা দেওয়ার জন্য একজন পুরুষ সঙ্গী তার দরকার ছিল। তাই আমাকে পেয়ে একেবারে মেতে উঠেছে। আমি এইরকম লোকের প্রতি কিছুতেই অকৃতজ্ঞ হতে পারবো না।
জেনসনের মুখ থেকেই শুনেছি কি ভাবে আয়কর ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর সঞ্চয় করে সে এক লাখ ডলার জমিয়েছে। ওর একমাত্র ইচ্ছা আরও কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে লোলাকে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়বে। তবে ভোলা জেনসনের ইচ্ছার কথা এখনও জানে না।
বিছানা ছেড়ে উঠতেই নজরে পড়লো রেস্তোরাঁর বারান্দার দিকে। লোলা একটা চেয়ারে বসে। ছুরি দিয়ে তরকারি কুটছে।
আজ আমার মাইনের দিন। বাথরুমে স্নান করতে করতে ভাবছিলাম কোথায় ফার্নওয়ার্থ আর কোথায় জেনসনের আন্তরিকতা– এইভাবে যদি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেতো।
প্রাতঃরাশ সেরে গুমটি ঘরে গেলাম। আগের দিন জেনসন একটা পুরোনো মোটর কিনে এনেছিলো, সেটা সারাতে বসলাম। কিছুক্ষণ বাদেই জেনসন এসে উপস্থিত, হাতে একগোছা নোট, জ্যাক, নাও-ধরো, এখানে আড়াইশো ডলার আছে। মাইনের চল্লিশ, রেস্তোরাঁর কমিশন একশো দশ আর সেই ইঞ্জিনটার জন্য একশো।
কিন্তু মিঃ জেনসন–এত টাকা
আরে তোমার জন্যই তো আজ আমার ব্যবসা এত ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তুমি আসার পর থেকেই লাভের অঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
আমি আর আপত্তি না করে হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিলাম। জেনসনকে আমি বললাম, এগুলো নিয়ে আমার কাছে মোট পাঁচশো দশ ডলার হলো, কিন্তু টাকাগুলো খরচ করার তো কোন উপায় দেখছি না। বরং যদি আপনার ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন, তাহলে টাকাগুলো ওখানেই রাখতে পারি।
জেনসন তো আমার কথা শুনে হেসেই অস্থির, ব্যাঙ্কে কখনো কেউ টাকা রাখে? কখন কোন্ ব্যাঙ্কে লালবাতি জ্বলবে কেউ বলতে পারে না। আমি আমার সমস্ত টাকা একটা সিন্দুকে রাখি। যখন ইচ্ছা, সুবিধা মতো খরচ করতে পারি। তাছাড়া আমার ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে লোলা সহজেই টাকাটা পেয়ে যাবে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি ইচ্ছা করলে তোমারটাও আমার কাছে জমা রাখতে পারো জ্যাক। যখন খুশী চেয়ে নেবে।
হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। অবাক বিস্ময়ে জেনসনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তার মানে–ঐ এক লাখ ডলার আপনি একটা সিন্দুকে রেখেছেন?
হ্যাঁ, তাতে হয়েছে কি?–হুঁ হুঁ বাবা, সে যে-সে সিন্দুক নয়, রীতিমত লরেন্স কোম্পানির সিন্দুকবাজারের সেরা। জেনসনের মুখে গর্বের হাসি আর ধরে না।
আমিও জেনসনের কথায় সায় দিলাম, সত্যিই, ওর চেয়ে আর ভালো সিন্দুক বাজারে নেই।
জেনসন আমার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বললো, যাও টাকাগুলো নিয়ে এসো। সিন্দুকে জমা, করে রসিদ দিয়ে দিই। দরকার পড়লেই চাইবে, লজ্জা করবে না সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে।
তাড়াতাড়ি তোষকের তলা থেকে সব টাকা বের করে এনে জেনসনের হাতে তুলে দিলাম। সে আমাকে পাঁচশো দশ ডলারের একটা রসিদ দিলো। রসিদটা এক পলক দেখে নিয়ে পকেটে ভরলাম।
টাকাগুলো পকেটে রেখে জেনসন ঘড়ি দেখলো, বেলা হয়ে এলো। একটু পরেই বাস এসে পড়বে। প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জ্যাক তুমি বরং রান্নাঘরে গিয়ে লোলাকে সাহায্য করো। টাকাটা রেখে এসে আমি এদিকটা সামলাচ্ছি। যাও, এখন থেকেই লেগে পড়ো।
সম্মতি জানিয়ে রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়ালাম।
লোলা ফ্রট পাইগুলো জারে জারে সাজিয়ে রাখছিলো, আমি ঘরে ঢুকতেই পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালো। ওর সবুজ চোখে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছে। সারা মুখে একটা চাপা কৌতুক খেলা করছে।
আমি জানতে চাইলাম কোনো কাজ আছে কিনা।
লোলা হাসলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটা ধড়াস করে উঠলো। আজ পর্যন্ত একদিনও আমাকে দেখে হাসেনি। তাহলে আজ
লোলার হাসি আরও ক্রুর হয়ে উঠলো।
মুহূর্তে বিপদের লাল সংকেত ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
মিস্টার প্যাটমোর? কথা বলার সুরটা যেন কেমন অদ্ভুত মনে হলো।
রান্নাঘরে যাও। সকালে যে জিনিসপত্রের বাক্সটা দিয়ে গেছে ওটা আমি টেবিলের ওপর তোমার জন্য খুলে রেখে এসেছি। গেলেই দেখতে পাবে।
রান্নাঘরে গেলাম। দেখি টেবিলের ওপর ছড়ানো রয়েছে কতকগুলো খাবারের টিন, পলিথিনে মোড়া দুডজন মুরগী, তাছাড়া অন্যান্য কিছু জিনিসপত্র।
খাবারের টিনগুলোর ওপরে রাখা রয়েছে একটা ভাজ করা খবরের কাগজ, সম্ভবত কোন কিছু মোড়া ছিল। ওটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করলাম। অর্ধেকটা খুলতেই বুকের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটলো–চোখের সামনে যেন মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে
কাগজের প্রথম পাতাতেই বড় বড় হরফে লেখা
কুখ্যাত সিন্দুক লুণ্ঠনকারী আজও পলাতক তার নীচে আমার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ছাপানো ফটোটার দিকে চোখ পড়তেই অনুভব করলাম মৃত্যুর অশরীরী স্পর্শ। এমনিতে ফটোটা অত্যন্ত বাজে ছাপা হয়েছে; বলতে গেলে আমাকে চেনাই যায় না। কিন্তু লোলার তাতে এতোটুকু অসুবিধে হয়নি। দেখি ফটোটার ওপর পেন্সিল দিয়ে ও আমার গোঁফটা নিখুঁত ভাবে এঁকে দিয়েছে।
ফাওয়ার্থকে আর মিথ্যে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হলো না। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার বীভৎস নারকীয় অত্যাচারের দৃশ্য।
ওকল্যান্ডের খবরের কাগজ কি করে ওয়েন্টওয়ার্থের দোকানে গেলো তা বলতে পারি না। আমার শান্তি নিরাপত্তার সুখ-স্বপ্ন এক মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেলো। লোলা নিশ্চয়ই জেনসনকে একথা বলেনি। যদি বলে থাকতো তবে জেনসনের কথাবার্তায় তা বুঝতে পারতাম। এখন তাহলে শুধু লোলার ফোন করার অপেক্ষা। ফোন পেয়েই পুলিশ ভ্যান এসে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে ফার্নওয়ার্থে।
তাড়াতাড়ি খবরের কাগজটা নিয়ে জ্বলন্ত স্টোভে গুঁজে দিলাম, দেখতে দেখতে ওটা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। ভাবলাম, লোলা যদি পুলিশকে জানিয়ে দেয় আমি এখানে ছিলাম, তাহলে প্রথমেই ওরা যে শহরে আমাকে খোঁজ করবে, তা হলো ট্রপিকা স্প্রিংস। আর ওকল্যান্ডে ফিরে যাবো সে সাহসও আমার নেই।
তাহলে এখন কি করা যায়?না, তার চেয়ে বরং ট্রপিকা স্প্রিংসে যাওয়া যাক। তারপর সেখান থেকে অন্য কোথাও পালানো যাবে, পাঁচশো ডলারের কথা ভাবতেই মনে হলো সেগুলো তো জেনসনের কাছে। আবার এখন যদি সে টাকা ফেরত চাই, তবে কি জেনসন সন্দেহ করবে না?
বিস্ময়-বিভীষিকায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। চিন্তাশক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে।
লোলা রান্নাঘরের দরজা খুলে ভিতরে এসে ঢুকলো, ও আমার চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলে আমার মনোভাব।
আমিও অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে ওকে দেখতে লাগলাম।
ও হঠাৎ আমাকে বললো, আমাদের দুজনের একটা আলোচনা হওয়া দরকার। আজ তো তোমাকে সারারাত কাজ করতে হবে তাই না? রাতে কার্ল ঘুমোলে আমি আসবো।
বুঝলাম ও পুলিসে খবর দেয়নি। আমার সঙ্গে আলোচনা করে কোনো রফা করতে চায়। কিন্তু মনে হলো আমার নিরাপত্তার বিনিময়ে ও কিছু চাইতে পারে? আমি এখন লোলার হাতের মুঠোর মধ্যে। ও যা বলবে তা করতে আমি বাধ্য। এবং লোলাও সেটা জানে। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে ওর কথামতো রান্নাঘর ছেড়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। যাবার আগে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম ওর হলদে চোলি আর লাল প্যান্টের ওপর।.
ভারাক্রান্ত মনে বাইরে এলাম, ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ পেলাম না।
একটু পরে বাস এসে পড়ায় আমরা তিনজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রেস্তোরাঁয় খদ্দেরের ভীড় বাড়তে লাগলো।
ঘণ্টাখানেক পর বাস চলে গেলে জেনসনের কথামতো পাম্পগুলোর দিকে খেয়াল রাখার জন্য বাইরের বারান্দায় এলাম। যাক, এখানে বসে অন্ততঃ একটু ভাববার সময় পাওয়া যাবে। এতোক্ষণ পর সেই ভয়টা আবার আমাকে আঁকড়ে ধরলো। সম্ভব-অসম্ভব নানান চিন্তা এসে ভীড় করলো মাথার মধ্যে। একটা সিগারেট ধরিয়ে আয়েস করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম।
হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি হতেই ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। দেখি, লোলা রেস্তোরাঁর বাইরে বেরিয়ে এসেছে। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একগাদা প্লেট।
এই অপগণ্ড লোকটাকে এখানে কি জন্য এনেছো? লোলা তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, কাজের নাম নেই, বসে বসে শুধু গেলা। আমাকে একাই সব কাজ করতে হবে নাকি?
লোলা–চাপা স্বরে ধমকে উঠলো জেনসন। আমি জ্যাককে বলেছি এখানে বসতে। পাম্পগুলো দেখতে।
আমি চেয়ার ছেড়ে রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে গেলাম, ভুল হয়ে গেছে মিসেস জেনসন, এবারকার মতো মাপ করুন।
লোলা ঝড়ের বেগে চলে গেলো বাংলোর দিকে। ভেতরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো।
লোলা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম জেনসনের মুখে দুশিন্তার ছায়া। আমি যতদূর সম্ভব তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম। আমি সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করে জেনসনকে বলি এ ব্যাপারটা পুরোটাই একটা সাজানো নাটক; আজ রাতে আলাদা শোবার ব্যবস্থাটা পাকাপাকি করার জন্যই লোলার এই অভিনয়।
রান্নাঘরে দুজনে কাজ করছি। হঠাৎ কানে এলো গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। উঠে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম–লোলা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরনে সেই সবুজ পোশাক। ও গাড়ি ছুটিয়ে দিলো ওয়েন্টওয়ার্থের দিকে, চমকে উঠলাম! কোথায় যাচ্ছে লোলা? থানায় না তো?
জেনসন আমার দিকে তাকিয়ে বললো, জানো জ্যাক, মাঝে মাঝে ওর জন্য আমার দুঃখ হয়, আমার সঙ্গে ঝগড়া হলেই ও ওরকম করে। ভাবি প্রথম জীবনে হয়তো খুব কষ্ট করতে হয়েছে, তাই ওর ব্যবহার এরকম। ভেবেছিলাম তুমি আসার পর আমরা দুজনে একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবো, কিন্তু কোনদিনই কোথাও যাবার জন্য ওকে রাজি করাতে পারিনি। যাকগে ওসব কথা বাদ দাও। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে আবার কাজে মন দিলো।
এরপর গাড়ির ভীড় বাড়তে শুরু করায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম
রাত প্রায় সোয়া এগারোটায় লোলা ফিরলো। গাড়ি থেকে নেমে সোজা গিয়ে ঢুকলো নিজের ঘরে। সশব্দে বন্ধ করে দিলো ঘরের দরজা।
জেনসন ভারী পদক্ষেপে বাংলোর দিকে এগিয়ে চললো। বিষাদের ছায়া তখনও ওর মুখ থেকে মিলিয়ে যায় নি।
রেস্তোরাঁর বারান্দায় বসে শ্রীমতীর অপেক্ষা করতে লাগলাম। জেনসন ঘুমিয়ে না পড়লে লোলা আসতে পারবে না। সুতরাং একটু সময় লাগবে। একটা সিগারেট ধরিয়ে একমুখ ধোয়া ছাড়লাম। ভাবতে লাগলাম নিজের বর্তমান অবস্থার কথা।
যদি জেনসনের কাছে টাকাগুলো না রাখতাম, তাহলে কখন হাওয়া হয়ে যেতাম। কেউ আমার খোঁজও পেতো না। কিন্তু এই কপর্দকহীন অবস্থায় পালাবার চিন্তা করা শুধুই পাগলামি।
সুতরাং মাথায় চিন্তার পাহাড় নিয়ে লোলার আসার অপেক্ষায় বসে রইলাম। চোখদুটো আটকে রইলো বাংলোর আলোকিত জানলার দিকে।
.
০৬.
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত একটা চল্লিশ বাজে। চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম–হঠাৎ বাংলোর দরজায় চোখ পড়লো, লোলা চুপিসাড়ে বেরিয়ে আসছে। অবসন্নভাবে পা ফেলে ও আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। পরনে একটা সাদা শার্ট আর ফিকে সবুজ রঙের স্কার্ট।
রেস্তোরাঁর বারান্দা অন্ধকারে ঢাকা। সামনের খোলা উঠোনে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। লোলা বারান্দায় উঠে এসে চেয়ার টেনে নিয়ে আমার কাছে বসলো।
মনকে তৈরী করলাম। বুঝতে পারলাম না, কি শর্তের বিনিময়ে ও আমার নিরাপত্তা অক্ষুণ্ণ রাখবে।
সিগারেটের হালকা লাল আলোয় লোলার মুখটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে।
তোমাকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেছি, কারসন। প্রথম থেকেই সন্দেহ করেছিলাম, তুমি ছদ্ম পরিচয়ে এখানে আছে। কিন্তু তুমি যে ফার্নওয়ার্থ থেকে পলাতক–শেট কারসন, তা ভাবতে পারিনি–আর তোমার সিন্দুক বিশারদ হওয়াটা নিতান্তই ভগবানের আশীর্বাদ।
আপনি কি পুলিশে খবর দিতে চান?
লোলা জানালো এখনও সে কিছু ঠিক করেনি। সেটা আমার মতামতের ওপরই নাকি নির্ভর করবে। আমি ওর কথায় রাজী হলে ভালো না হলে সোজা ফার্নওয়ার্থ। ও আরো বললো যে, কাগজে লিখেছে তুমি লরেন্স সেফস্ কর্পোরেশন-এ কাজ করতে–তোমাকে একটা সিন্দুক খুলতে হবে কারসন! কার্লের একটা লরেন্স সিন্দুক আছে–তোমাকে সেটা খুলতে হবে।
সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে বসলাম। তাহলে রিক্স দেখছি মিথ্যে কথা বলেনি। লোলা শুধুমাত্র টাকার লোভেই জেনসনকে বিয়ে করেছে।
সিন্দুক থেকে কিছু যদি আপনার নেবার থাকে তো, মিঃ জেনসনকে বলছেন না কেন? আমি বোকা সাজার চেষ্টা করলাম, কারণ লোলার উদ্দেশ্যটা আমি ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই।
বেশী চালাক সাজবার চেষ্টা করো না, কারসন। বিকেলে কি বলেছিলাম তা আশা করি ভুলে যাওনি? এখন থেকে আমি যা বলবো, নয়তো
রিক্সের কথাই দেখছি সত্যি! শুধু টাকার জন্যই এতোদিন এখানে পড়েছিলেন?
বাজে কথা ছেড়ে কাজের কথায় এসো, সিন্দুক তুমি খুলছো কিনা বল?
খোলার পর?
লোলা নড়েচড়ে বসলো, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো, তুমি এক হাজার ডলার পাবে, আর পালিয়ে যাবার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা সময় তোমাকে দেওয়া হবে।
আমি মনে মনে লোলার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারলাম না। আমি সিন্দুক খুলবো আর এক লাখ ডলার তুমি হাতাবে। তারপর দয়া করে আমাকে এক হাজার ডলার ভিক্ষে দেবে। আর পালাবার জন্য, কিছু সময়! আর তাও কিনা জেনসন থেকে শুরু করে পুলিশ পর্যন্ত সবাই যাতে ভাবে, আমিই সিন্দুকের টাকাটা হাতিয়ে কেটে পড়েছি! চমৎকার–তোমার জবাব নেই সুন্দরী!
আমি লোলাকে বললাম, আপনি ঐ এক লাখ ডলার চুরি করার মতলবে আছে, আর মিঃ জেনসন ভেবেছিলেন আপনাকে নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণে যাবেন।দু-হাতে খরচ করবেন, সব আপনারই জন্য। শ্লেষে আমার গলার স্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। লোলাকে যেন আর সহ্য করতে পারছি না। আমার বেশী রাগ হলো জেনসনের মতো লোককে ও ঠকিয়েছে বলে।
অন্ধকারে অনুভব করলাম লোলা তাকিয়ে রয়েছে কারসন, আমার মনে হয় সিন্দুকটা। খুললেই তোমার ভালো হবে।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম সিন্দুকটা আমাকে খুলতেই হবে। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু জেনসনের কথা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে। সে আমার একমাত্র বন্ধু, শুভাকাঙ্খী–আমার কত উপকার করেছে, আর তাকেই এভাবে পথে বসাবো? অথচ ফার্নওয়ার্থের কথা মনে পড়তেই ভয়ে একেবারে শিউরে উঠছি।
আমি লোলাকে প্রশ্ন করলাম, সিন্দুকটা কোন্ ঘরে আছে?
লোলা বললো, বাংলোর বসার ঘরে। আগামী শনিবার সন্ধ্যেবেলা কাল ওয়েন্টওয়ার্থে একটা মিটিং এ যাবে। তারপর রাত একটায় ফিরবে। ওর মধ্যেই কাজটা শেষ করতে হবে।
একটা সিগারেট ধরলাম। লাইটারের আলোয় দেখলাম, লোলার চোখ জোড়া লোভে চক্চক্। করছে। কারো আসন্ন মৃত্যুর প্রত্যাশায় যেন অপেক্ষা করছে এক বিশাল শকুনি।
আমি জানতে চাইলাম সিন্দুক খোলার সময় লোলা কোথায় থাকবে?
লোলা বললো, শনিবার তোমার জায়গায় আমি সারারাত কাজ করবো। তুমি যখন সিন্দুক খুলে টাকা নিয়ে হাওয়া হবে, তখন আমি রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকবো।
টাকা যে চুরি গেছে সেকথা লোকে জানবে কিন্তু আমি কিছুই জানতে পারবো না। অন্ধকারের মধ্যে ঝকঝক করে উঠলো লোলার দাঁতের সারি।
আমিও মনে মনে এক মতলব আঁজলাম। এমনিতেই তো আমাকে পালাতে হবে, ক্ষতির মধ্যে শুধু চাকরিটা–তা যাকগে। কিন্তু জেনসন যাতে আমাকে ভুল না বোঝে, সে ব্যবস্থা আমাকে করতেই হবে। মতলবটা যে কার্যকরী হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমি সিন্দুক খোলার পর লোলা যখন টাকাগুলো নিতে থাকবে তখন এক ঘুষিতে ওকে অজ্ঞান করে সমস্ত টাকা নিয়ে পালাবো। যাবার আগে টেলিফোনের তার কেটে দিয়ে যাবো। তারপর ট্রপিকা স্প্রিংস থেকে জেনসনের সমস্ত টাকা ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করবো। সঙ্গে একটা চিঠিও লিখে পাঠাবো কি ধরনের এক বাজারের মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। তাহলে নিশ্চয়ই জেনসনের ভুল ভাঙবে।
মুখে খুব একটা কিছু বললাম না। শুধু বললাম দেখুন মিসেস জেনসন মিঃ জেনসনকে ঠকানোটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না। তিনি আমার জন্য কত করেছেন, তাছাড়া।
ওসব ন্যাকামো রাখো, কারসন।
সোজাসুজি বলো সিন্দুক খুলছে, না ফার্নওয়ার্থে ফিরে যাবে?
আর যেখানেই যাই, ফানওয়ার্থে আমি ফিরছি না।
লোলার দিকে চোখ তুলে তাকালাম, অতোবার করে আপনাকে বলতে হবেনা। যখন বলেছি খুলবো, তখন খুলবো। তাই যেন হয়, মিস্টার শেট কারসন। লোলা বাংলোর দিকে এগিয়ে চললো। দেখতে পেলাম, যেতে যেতে ও একবার পিছন ফিরে তাকালো, মুখে জয়ের হাসি।
সিগারেটের টুকরোটা বালির ওপর ছুঁড়ে দিলাম, দেখা যাক সুন্দরী, কে হারে আর কে জেতে।
পরদিন লোলাকে রান্নাঘরে একা পেয়ে সিন্দুকের নম্বরটা এনে দিতে বললাম। কারণ ওটা না পেলে সিন্দুকটা কি ধরনের তা বোঝা যাবে না। আর সিন্দুক ভাঙতে হলে সেটা অবশ্যই জানা প্রয়োজন, পরে জেনসনের অনুপস্থিতির সুযোগে ও এক টুকরো কাগজ এনে আমার হাতে দিলো। নম্বরটা দেখেই বুঝলাম সিন্দুকটা অত্যন্ত পুরনো মডেলের বাজারে এখন আর পাওয়াই যায় না। লোকে এই ধরনের চাবি-ছাড়া সিন্দুক অপছন্দ করায় কোম্পানি এই সিন্দুক তৈরী বন্ধ করে দেয়, কেননা এ ধরনের সিন্দুকগুলোর দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তালা এঁটে যায়। এছাড়া এই সিন্দুকগুলো খুলতে চোর-গুণ্ডাদের খুব একটা কষ্ট করতে হবে না।
ভাবতে ভালো লাগলো যে সিন্দুক খুলতে বড় জোর আমার দশ মিনিট লাগবে। আর সময় যতো কম লাগবে, ততোই ভালো–পালাবার জন্য কিছু বেশী সময় পাওয়া যাবে।
পরদিন সকালবেলা আমি আর জেনসন গ্যারেজে কাজ করছি। হঠাৎ কাজ থামিয়ে ও বলে উঠলো জ্যাক, শনিবার সাতটায় আমাকে ওয়েন্টওয়ার্থে যেতে হবে,–একটা মিটিং আছে। ফিরতে ফিরতে একটা দেড়টা বাজবে।-লোলা সেদিন রাত্তিরে কাজ করবে বলছিলো, তুমি পারো তো ওর দিকে একটু লক্ষ্য রেখো। বলা যায় না, কখন কোন মাতাল ড্রাইভার উল্টোপাল্টা কাজ করে বসে।
বুকের ভেতর একটা চাপা দুঃখ অনুভব করলাম। জেনসন আমাকে এতখানি বিশ্বাস করে? একবারও ভেবে দেখলো না যে লোলাকে একা পেয়ে আমিও তো কোনো মাতাল ড্রাইভারের মতো কাজ করতে পারি। আমি বললাম, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, মিঃ জেনসন, আমি অবশ্যই নজর রাখবো।
জেনসন হেসে বললো, তোমার মতো একজন বিশ্বাসী তোক পেয়ে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে, জ্যাক–তোমাকে চিনতে আমি ভুল করিনি।
আমি জেনসনের থেকে ওর গাড়িটা চেয়ে নিলাম ট্রপিকা স্প্রিংসে কয়েকটা জিনিস কেনাকাটা করার জন্য আর চাইলাম একশো ডলার। জেনসন একটু অবাক হলেও আমার কথা রাখলো। জেনসনের কাছ থেকে তখনকার মতো বিদায় নিয়ে আমি গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। লোলা রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে আমায় লক্ষ্য করছে। যদি জানতো যে ওর জন্য আমি কি ফঁদ পেতেছি, তবে ওখানে আর হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতো না।
ট্রপিকা স্প্রিংসে পৌঁছতে প্রায় ঘণ্টাচারেক সময় লেগে গেলো। সেখানে পৌঁছেই খোঁজ নিলাম ন্যু–ইয়র্কের ট্রেন কটায় ছাড়ে। প্লেনে করে পালানোর মতলব অনেক ভেবেচিন্তেই ত্যাগ করেছি। কারণ লোলা পুলিশে আমার খবর দেওয়া মাত্রই অর্থাৎ পুলিশ আমার পালানোর খবর পেলেই ট্রপিকা স্প্রিংসের এয়ারপোর্টে আমার খোঁজ করবে। তাছাড়া রাত্রিবেলা প্লেনে যাবো কিনা, তারও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, রাত সাড়ে বারোটায় ন-ইয়র্কে যাবার একটা ট্রেন আছে। অতএব চিন্তিত হওয়ার কোন কারণ নেই। জেনসন সাতটায় ওয়েন্টওয়ার্থে রওনা হবে। আর সাড়ে সাতটার মধ্যে সিন্দুক খুলে লোলাকে ল্যাং মেরে আমিও কেটে পড়বো, তাহলে ট্রপিকা ম্প্রিংসে পৌঁছে ট্রেন ধরার জন্য আধঘণ্টারও বেশী সময় পাওয়া যাবে। সহজে যাতে পুলিশের চোখে না পড়ি তাই আমার সাজ-পোশাক পরিবর্তন করার কথা ভাবলাম। ঠিক করলাম ছদ্মবেশ ধরে পুলিশের চোখে ধুলো দিতে হবে।
তাই ট্রেনের খোঁজখবর নিয়ে একটা দোকানে গেলাম। একটা হালকা বাদমী প্যান্ট আর একটা ছাই রঙের কোট কিনলাম। কোটের সামনের পকেট দুটো গাঢ় সবুজ রঙের, যাতে বহুদুর থেকে চোখে পড়ে। আরো কিনলাম একজোড়া জুতো, গাঢ় বাদামী রঙের একটা টুপি, এক শিশি কলপ ও একটা গগ। এই জিনিসগুলো একটা সুটকেস কিনে তাতে ভরে ফেললাম। গাড়ির ক্যারিয়ারে সুটকেসটা বন্ধ করে ফিরে চললাম পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এ।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা পার হয়ে মরুভূমিতে এসে পড়লাম। দূরের বালিয়াড়ির ওপর ইতস্ততঃ ছড়ানো ঘন ক্যাকটাসের ঝোঁপ। গাড়ি থামিয়ে ক্যারিয়ার থেকে সুটকেসটা বের করে এগিয়ে চললাম ক্যাকটাস ঝোঁপের দিকে। একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ওটাকে লুকিয়ে ফেললাম। একমাত্র আমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে এটা খুঁজে বের করা একেবারেই অসম্ভব।
পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন ছেড়ে পালাবার পথে এখানে নেমে চেহারা এবং বেশবাস সমস্ত পাল্টে নেবো। তারপর ট্রপিকা স্প্রিংস থেকে ট্রেন ধরে সোজা নু-ইয়র্ক। লোলা আমার চেহারার বর্ণনা দিলেও পুলিশ আমাকে ছদ্মবেশে চিনতে পারবে বলে মনে হয় না।
নিশ্চিন্ত মনে আবার গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ফিরে এসেই কাজে মন দিলাম। যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় আমি জেনসন এবং লোলা–তিনজনেই কাজ করে চললাম। রাত প্রায় এগারোটার সময় রেস্তোরাঁ একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়লো। শেষ খদ্দেরটি চলে যাবার পর জেনসন আমাকে পেট্রল পাম্পগুলো দেখতে বলে শুতে চলে গেলো।
আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরে এসে বসলাম। চেয়ারে হেলান দিয়ে পয়েন্ট অফ নো রিটার্নকে আর একবার ভালো করে দেখলাম। আর মাত্র একটা দিন তারপর এ জায়গা ছেড়ে আমাকে চিরকালের জন্য চলে যেতে হবে। আজই প্রথম অনুভব করলাম, পয়েন্ট অফ নো রিটার্নকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। এ জায়গা ছেড়ে যেতে আমার মন চাইবে না।
শনিবার সন্ধ্যে সাতটা। গুমটিঘরে সেই পুরোনোমোটরটা নিয়ে কাজ করছিলাম, পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকালাম, সামনেই দাঁড়িয়ে জেনসন।
জ্যাক আমাকে এখনই যেতে হবে। সাতটা বাজে, আর দেরী করা ঠিক হবেনা।ফিরতে ফিরতে হয়তো দুটোও বেজে যেতে পারে।
জেনসন রেস্তোরাঁর দিকে পা বাড়ালো। সম্ভবতঃ লোলার কাছ থেকে বিদায় নিতে। একটু পরে সে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
ঝড়ের বেগে ছুটে চললো জেনসনের মার্কারি, যতোদূর দেখা গেলো চেয়ে রইলাম।
আমি বাংলোর দিকে পা বাড়ালাম সেই অভিশপ্ত সিন্দুক খোলার জন্য। অভিশপ্ত এই কারণেই বললাম যে এর জন্যই তো আমাকে জেনসনের মতো লোকের বন্ধুত্ব হারাতে হচ্ছে।
লোলা বাংলোর দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলো আমার জন্য উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠায় ওর মুখমণ্ডল বিবর্ণ, কিন্তু চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল। আমাকে দেখেই চাপা স্বরে বলে উঠলো, তাড়াতাড়ি শুরু করো কারসন।
আমি সিন্দুকটা কোথায় আছে জেনে নিয়ে লোলাকে পাম্পের কাছে থাকতে বললাম কেননা তেল নেবার জন্য কোনো ট্রাক এসে পড়তে পারে।
লোলা চলে যাবার পর বসবার ঘরে গিয়ে সোফাটা সরিয়ে সিন্দুকটাকে এক নজরে দেখলাম। যা ভেবেছি তাই। শুধু কম্বিনেশন ঘোরালেই সিন্দুকটা খুলে যায়–চাবির আর প্রয়োজন হয় না। লোলা দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করছিলো। ওকে বললাম, গ্যারেজ থেকে কয়েকটা যন্ত্রপাতি আনতে হবে। আপনি বরং রেস্তোরাঁটা বন্ধ করে দিন। নয়তো কোনো খদ্দের এসে চীৎকার শুরু করে দেবে।
লোলা জানালো যে, সে অনেক আগেই রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে। আমি আর সময় নষ্ট না করে ওকে পাশ কাটিয়ে বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। গ্যারেজ থেকে গোটা কয়েক যন্ত্রপাতি নিয়ে একটা বড় ক্যাম্বিসের ব্যাগে ভরে বাংলোয় ফিরে চললাম। টাকাগুলো এই ব্যাগে নিয়েই পালাতে হবে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটা পুরোনো ঝরঝরে প্যাকার্ড এগিয়ে আসছে। লোলা গাড়িটাকে দেখতে পেয়ে পাম্পের দিকে এগিয়ে এলো। আমি আর অপেক্ষা না করে বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। নিছক কৌতূহল বশে গাড়িতে বসে থাকা লোক দুটোর দিকে এক পলক তাকালাম–শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেলো। পা দুটো যেন পাথর হয়ে গেলো। যেন কেউ আঠা দিয়ে আটকে দিয়েছে মেঝেতে
গাড়িতে বসে দুজন পুলিস! আমি তখন ঘামতে শুরু করেছি। পায়ে পায়ে বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলাম।
অ্যাই—শোনো–বাজখাই গলায় একজন ডেকে উঠলো। পুলিস দুজন গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমায় লক্ষ্য করছে।
লোলাও বুঝতে পেরেছিলো লোক দুটোর আসল পরিচয়। দেখলাম ও ভয়ার্ত চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে।
আমি ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু যতোখানি ভয় পেয়েছিলাম তা নয়। ওরা জানালো যে, ওদের একটা চাকা আসবার পথে ফেঁসে গেছে। গাড়ির ক্যারিয়ারের চাবিটা আমার হাতে দিল, এবং চটপট সারাবার ব্যবস্থা করতে বললো।
আমি আর দেরীনা করে ক্যারিয়ার খুলে চাকাটা বের করলাম। ওরা লোলার দিকে তাকালো। আঙুল দিয়ে গাড়িটাকে দেখালো, এটাতে পেট্রল ভরার ব্যবস্থা করো; আর দ্যাখো খাবার দাবার কিছু আছে কিনা।
লোলা একটু ইতস্ততঃ করলেও রেস্তোরাঁ যে বন্ধ সে কথা বলতে আর সাহস করলো না।
যাই হোক আটটা দশের সময় হতচ্ছাড়া পুলিশ দুটোর হাত থেকে নিস্তার পেলাম। কিন্তু আসল কাজ আর হলো না। খদ্দেরের পর খদ্দের আসতে লাগলো। অবশেষে বাধ্য হয়ে রেস্তোরাঁ খুলতে হলো। আমি আর লোলা অক্লান্ত ভাবে পরিশ্রম করে চললাম।
রাত প্রায় দশটার সময় নিঃশ্বাস ফেলার একটু সুযোগ পেলাম। সামনে এঁটো কাপ প্লেটের প। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে লোলা।
আমি এগুলো ধুয়ে রাখছি। তুমি গিয়ে সিন্দুক খোলো।
আমি লোলাকে বললাম যে, আজ অনেক দেরী হয়ে গেছে। এর জন্য অন্য একটা দিন ঠিক করতে হবে।
লোলা আগুন ঝরা চোখে আমার দিকে তাকালো, আশা করি আমার কথাটা তোমার কানে গেছে কারসন।
আর ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই তো মিঃ জেনসন ফিরে আসবেন, তাহলে পালাবার সময়টা আমি পাবো কখন?
লোলা কোনো জবাব না দিয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো এখনও ভেবে দেখো কি করবে।
বুঝলাম ও মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না। পুলিশকে জানাতেও পারে। সুতরাং আর দেরী না করে গ্যারেজে গেলাম। যন্ত্রপাতির ব্যাগটা নিয়ে আবার ফিরে চললাম বাংলোর দিকে।
এখন দশটা বেজে দশ মিনিট। অর্থাৎ তিনটের আগে ট্রপিকা স্প্রিংসে পৌঁছনো অসম্ভব, সেখানে গিয়ে প্রথমেই আমাকে স্টেশন ওয়াগনটার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ জেনসন পুলিশকে যখনই জানাবে আমি স্টেশন ওয়াগনে করে পালিয়েছি ওরা ট্রপিকা স্প্রিংসে এসে আগে ওটারই খোঁজ করবে। তারপর আমাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ভাগ্য সহায় থাকলে হয়তো পুলিশের চোখে ধুলো দিতে পারবো।
বসবার ঘরে গিয়ে আলো জ্বেলে দিলাম। তারপর যন্ত্রপাতি নিয়ে সিন্দুকের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম।নম্বর বসানো চাকতিটা একটু একটু করে ঘোরাতে আরম্ভ করলাম।ঝুঁকে পড়ে ইস্পাতের দরজায় কান চেপে রইলাম। একুট পরেই খুটকরে একটা শব্দ হলো। অর্থাৎ প্রথম নম্বরটা মিলে গেছে। সিন্দুক সম্বন্ধে যাদের অভিজ্ঞতা আছে, তারা ঐ সামান্য শব্দ শুনেই বুঝতে পারে নম্বরটা ঠিক মতো মিলেছে কিনা। এবার দ্বিতীয় সারির চাকতি নিয়ে পড়লাম–
মিনিট দশেক পর হাতল টেনে সিন্দুকের দরজা খুলে ফেললাম। চোখের সামনে থাকে থাকে সাজানো একশো ডলার নোটের একশোটা বাণ্ডিল। এক লাখ ডলার-জেনসনের সারা জীবনের সঞ্চয়।
ক্যাম্বিসের ব্যাগটা টেনে নিয়ে নোটের বান্ডিলের দিকে হাত বাড়ালাম।-একি! জ্যাক!! তুমি এখানে কি করছো!!!
একটা উত্তপ্ত ইস্পাতের ফলা যেন আমার বুকটাকে এফোঁড় ওফোড় করে দিলো-কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম–একটা হাত নোটের বাণ্ডিলের ওপর স্থির-সময়ের তরঙ্গ থেমে রইলো ঐ একটি বিশেষ মুহূর্তে
ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জেনসন, চোখ দুটো যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি তখন অসাড় হয়ে গেছি, ফ্যাল ফ্যাল করে জেনসনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, জেনসন ভারী পা ফেলে ঘরের ভেতর এসে দাঁড়ালো, জ্যাক! এ তুমি করছো কি? সমস্ত যন্ত্রণা, হতাশা ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে। লজ্জায় ঘৃণায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। জেনসনের বিশ্বাসের স্বর্গ আমি নিষ্ঠুর ভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছি।
ধীরে ধীরে উঠেদাঁড়িয়ে বললাম, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, মিঃ জেনসন। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার টাকা আমি চুরি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু নয়। যদিও জানি, একথা বিশ্বাস করা আপনার পক্ষে খুব কঠিন, তবু দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না।
এমন সময় ঘরের দরজায় লোলা এসে দাঁড়ালো। ওর সারা শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। জেনসনকে দেখেই তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল কি হয়েছে, কার্ল?–একি? ও সিন্দুক খুলছে? আমি আগেই জানতাম। তোমাকে বারবার সাবধান করেছি–অচেনা লোককে কখনো বিশ্বাস করো না। এখন বুঝতে পারছো তো?
জেনসনের কানে লোলার কথাগুলো ঢুকলো কিনা কিছুই বোঝা গেলো না। সে তখন একই ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে বললো, জ্যাক, তুমি এভাবে–তার অর্ধসমাপ্ত কথাগুলো চাবুকের মতো আমার বিবেকের ওপর আছড়ে পড়লো।
কিন্তু মিঃ জেন–
এর পরেও কি তোমার কিছু বলার আছে?
হ্যাঁ আছে। আমার নাম জ্যাক প্যাটাের নয়, শেট কারসন। মাস দেড়েক হলো আমি ফার্নওয়ার্থ থেকে পালিয়ে এসেছি। একটা কাগজে আমার ছবি দেখে মিসেস জেনসন আমাকে চিনতে পারেন, এবং আমি যদি সিন্দুক না খুলি, তবে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন বল ভয় দেখান।
লোলা গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠলো, চোর মিথ্যেবাদী কোথাকার! কার্ল! তুমি এই লোকটার কথায় কান দিও না। নিজেকে বাঁচাবার জন্য ও মিথ্যে কথা বলছে! আমি এখুনি পুলিশে ফোন করছি।
জেনসন ধীরে ধীরে লোলার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, তুমি এর মধ্যে নাক গলাতে এসো না। পুলিশ ডাকবো কি ডাকবো না, সেটা আমি বুঝবো, যেটা ভালো হয় আমিই করবো।
লোলা দেওয়ালে হেলান দিয়ে গোখরো সাপের মতো ফুঁসতে লাগলো। ওর সবুজ চোখের তারায় ভয়ার্ত সতর্ক দৃষ্টি।
আমি একে একে জেনসনকে সমস্ত কিছু জানালাম। টাকাটা যে তাকে ফেরৎ পাঠাতাম, তাও বললাম।
সব শুনে জেনসন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। মনে হলো এই অল্প সময়ের মধ্যেই তার বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে। লোলার দিকে তাকিয়ে বললো, শুতে যাও লোলা। এ ব্যাপার নিয়ে কাল আলোচনা করা যাবে। আজ আর তোমাকে রাত জাগতে হবে না। যাও শুয়ে পড়ো গিয়ে।
লোলা পায়ে পায়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলো পুলিশকে ফোন করার জন্য।
জেনসন এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলো, ফোন করার ব্যাপারটা আমি ভাববো!
ঘর থেকে এক ধাক্কায় ওকে বের করে দিয়ে এসে সোফায় বসলো।
তখনও আমি ভোলা সিন্দুকের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।
কি আশ্চর্য ব্যাপার দ্যাখো, জ্যাক! আমাদের সভাপতি হঠাৎ হার্টফেল করায় মিটিং মাঝপথে ভেঙে গেলো। অদ্ভুত ব্যাপার একজন মারা গেলো, আর তার জন্য আমি আবিষ্কার করলাম আমার বউ একটা বাজারে মেয়ে।
তার কথায় চমকে উঠলাম, তার মানে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?
জেনসন আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। একটা বিষয় বেদনার ছায়া ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। চোখের মণির ওপর অশ্রুর আস্তরণ। সে মৃদুস্বরে বললো, জ্যাক, তোমাকে আগেই বলেছিলাম, লোক চিনতে আমার ভুল হয় না। কিন্তু স্ত্রীলোকের ব্যাপারে আমি একেবারেই অজ্ঞ। এখনই তা বুঝতে পারছি।
আমি মিঃ জেনসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, বুঝতেই তো পারছেন, এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিলো না–অনেকক্ষণ পরে বুক ভরে শ্বাস নিলাম। মনটা অনেক হাল্কা হলো।
জেনসন আমাকে জানালো যে, আমাকে এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে কেননা এ জায়গাটা আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। লোলা যে ভাবেই হোক পুলিশকে জানাবে। আমাকে কিছু টাকা দিয়ে স্টেশন ওয়াগনটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে বললো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কেননা যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে। জেনসন আমাকে তিরিশ হাজার ডলার দিতে চাইল ন-ইয়র্ক গিয়ে ব্যবসা করার জন্য। আমি আপত্তি জানালাম। কিন্তু কোনো ফল হলো না। জেনসন বললো, জ্যাক, আমি যখন বলছি, এ টাকা তোমাকে নিতেই হবে। পৃথিবী ভ্রমণের শখ আমার মিটে গেছে। সুতরাং এ টাকা আমার আর কোনোকাজে লাগবেনা।কিন্তু তোমার এখন টাকার প্রয়োজন, তাই তোমাকে দিচ্ছি।আর একটা কথা মনে রেখো-জ্যাক, তোমাকে আগে যেমন ভালোবাসতাম, এখনও তেমনি বাসি। জেনসনের চোখের কোণে চিকচিক করছে দুফোঁটা অশ্রু।
ঠিক তখনই লোলাকে দেখলাম। ও দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। পরনে একটা সবুজ পোশাক, মুখ শুকনো পাতার মতো বিবর্ণ, চোখ দুটো বেড়ালের মতো জ্বলছে। আর এক হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটা ৪৫ বোরের রিভলভার।
.
০৭.
ঘরের পরিবেশে নেমে এলো মৃত্যুর নিঃস্তব্ধতা। শুধু টেবিল ঘড়ির টিকটিক আর লোলার উত্তেজিত শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ
লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো জেনসন। লোলা কর্কশ স্বরে শাসিয়ে উঠলো খবরদার এক পা নড়বে না। সিন্দুকের সমস্ত টাকা আমি নেবো। কাউকে এর একটা পয়সাও আমি দিচ্ছি না!
লোলা! তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? গুলিভরা রিভলভার নিয়ে আর ছেলেমানুষি কোরো না-ওটা নামিয়ে রাখো। জেনসন আরো বললো, লোলা, দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে এ টাকা আমি তোমার জন্য সঞ্চয় করেছি। এখন ওসব পাগলামী ছেড়ে বন্দুকটা নামিয়ে রাখো।
ওসব বাজে কথায় আমার মন ভুলবে না। আমাকে আটকালে আমি পুলিশকে বলে দেবো, একজন জেল পালানো কয়েদীকে তুমি এতোদিন ধরে জেনেশুনে আশ্রয় দিয়েছে। আরো জানাবো যে আয়কর ফাঁকি দিয়ে জমানো এই একলাখ ডলারের কথা।
রাগে জেনসনের চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। সে এক পা এক পা করে লোলার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।
সাবধান মিঃ জেনসন–তীক্ষ চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে সিন্দুকের দরজায় হাঁটু দিয়ে মারলাম এক ধাক্কা। দরজা সশব্দে বন্ধ হওয়া মাত্রই স্বয়ংক্রিয় তালা ক্লিক করে এঁটে গেলো।
লোলা আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকালো। পলকে বুঝতে পারলো স্বয়ংক্রিয় ভাবেই সিন্দুকের দরজায় তালা এটে গেছে। অন্ধ ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে, হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে ও এগিয়ে এলো–তারপর রিভলভারের বিকট শব্দে জানলার শার্সিগুলো কেঁপে উঠলো ঝনঝন করে।
জেনসন লোলার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। ভয়ার্তচোখে তার দিকে তাকালাম। কয়েক সেকেন্ড পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলো জেনসনের বিশাল দেহ, পরমুহূর্তে হাঁটু ভেঙে দড়াম করে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। পড়বার সময় হাত দুটো পাশের টেবিলটা আঁকড়ে ধরায় সেটাও হুড়মুড় করে উল্টে পড়লো। গোটা বাংলোটাই থরথর করে কেঁপে উঠলো।
লোলার ভয়ার্ত চীৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। তখন ওর হাত থেকে কুৎসিত দর্শন রিভলভারটা খসে পড়েছে। পেছন ফিরে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে–যেন নিষ্ঠুর বাস্তবকে অস্বীকার করতে চাইছে।
জেনসনের দেহ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সামান্য একটা সীসের টুকরো ওর জীবনীশক্তি নিঃশেষে শুষে নিয়েছে। কার্ল জেনসন যে আর বেঁচে নেই এই কথাটা যেন আর বিশ্বাস করতে পারছি না।
লোলা হঠাৎ একটা চাপা আর্তনাদ করে অন্ধের মতো ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কানে এলো শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করার শব্দ।
জেনসনের মৃতদেহের কাছেচুপচাপ বসে রইলাম। কি করব কিছু ভাবতে পারছি না। পুলিশে খবর দেওয়ার মতো বোকামির কাজ আমি কখনই করবো না, লোলা যদি বলে বসে জেনসনকে আমিই গুলি করেছি, আর আমার আসল পরিচয়টা জানিয়ে দেয়, তবে ওরা–আর কোনো প্রমাণ চাইবে না।
হঠাৎ বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ানোর আওয়াজ পেলাম। তাড়াতাড়ি উঠে যেতে গিয়ে রিভলভারটা পায়ে ঠেকলো। শীঘ্র সেটা কুড়িয়ে পকেটে রাখলাম।বাংলো থেকে বেরিয়ে পাম্পের দিকে এগিয়ে চললাম।
বাইরে বের হতেই চোখে পড়লো একটা বিরাট সবুজ রঙের ক্রাইমলার পাম্পের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। গাড়ির আরোহী একজন মোটাসোটা বয়স্ক নোক ও তার সঙ্গিনী একটি অল্পবয়সী মেয়ে।
লোকটা আমাকে দেখেই হাজার রকমের কথা বলতে শুরু করে দিলো। বিশ লিটার পেট্রোল আর দুলিটার মোবিল, খাবার-দাবার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
লোকটার একটা কথাও আমার কানে ঢুকলোনা। আচ্ছন্নের মতো যান্ত্রিকভাবে গাড়ির ট্যাঙ্কে তেল ঢালতে শুরু করলাম। তারপর অতি কষ্টে ওদের খেতে বসিয়ে বাইরে এলাম। ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে একটু ভাববার সময় পেলাম।
যেভাবেই ধরা যাক না কেন, আমার অবস্থা এখন কলে পড়া ইঁদুরের মতো। অবশ্য লোলারও একই অবস্থা। তরে জেনসনের মৃত্যুটাকে নেহাত আকস্মিক দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। লোলা হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসার সময় আচমকা ট্রিগার-এ চাপ পড়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে এটি দুর্ঘটনা। কিন্তু পুলিশ কি তা স্বীকার করবে?
ওরা প্রশ্ন করবে লোলা রিভলবার নিয়ে অতো রাতে কি করছিলো? তখনই লোলাকে টাকার কথা বলতে হবে; আর তাহলেই একে একে সমস্ত কথাই বেরিয়ে পড়বে। লোলা খুনের দায়ে জড়িয়ে পড়বে। তবে পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেতে লোলা যে জেনসনের হত্যার দায়টা স্রেফ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আমার ইচ্ছে করছিলো স্টেশন ওয়াগন নিয়ে এক্ষুনি পালিয়ে যাই। কিন্তু লোলা যদি পুলিশে জানিয়ে দেয়, তবে প্রথমেই ফোনের তার কাটতে হবে। তারপর ওর হাত পা বেঁধে রেখে কেটে পড়বো-কিন্তু না, তাতেও বিপদে আছে। হয়তো কোনো গাড়ির চালক তেল নিতে এসে কাউকে না দেখে বাংলোয় গিয়ে খোঁজ করতে পারে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এলো। লোলা যদি আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়, দিক না আমিও তাহলে পুলিশকে ঐ এক লাখ ডলারের কথা জানিয়ে দেবো। বলবো, ঐ টাকার কোনো আয়কর জেনসন দেয়নি। তাহলেই লোলার বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আর লোলার যা টাকার লোভ সে কখনই এটা চাইবে না। এছাড়াও বন্ধ সিন্দুক খোলার জন্য এখন আমাকে লোলার প্রয়োজন হবে। কারণ সিন্দুকের কম্বিনেশনটা জেনসন ছাড়া আর কেউ জানে না।
আমি ঠিক করলাম এই প্যাঁচেই লোলাকে জব্দ করবো। কিন্তু জেনসনের মৃতদেহটার কি হবে? দেখেশুনে কোনো একটা জায়গায় পুঁতে ফেলবো। আর সেই সঙ্গে ওর অনুপস্থিতির জন্য একটা ভালোরকম গল্প ফাঁদলেই হবে। খদ্দেরদের শোনাতে হবে, না হলে ওরা সন্দেহ করবে।
আমি বাংলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি লোলার হাতে টেলিফোনের রিসিভার–ও পুলিশে ফোন করছে।
আমাকে দেখেই ও থমকে গেলো। এর মধ্যেই লোলার চেহারা ভেঙে পড়েছে। শরীরের সমস্ত রক্ত কেউ যেন শুষে নিয়েছে। পাথরের চোখের মতো স্থির দৃষ্টিতে একজন আর একজনের দিকে চেয়ে রইলাম। মনে হলো যেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আসন্ন সঙ্কেতের অপেক্ষা করছে।
লোলার হাতে রিসিভার আর আমার হাতে ৪৫ রিভলবার ওরই দিকে তাক করা।
রিভলবারের দিকে চোখ পড়তেই লোলা চমকে উঠলো। মুহূর্তের জন্য ও হয়তো ভাবলল, আমি ওকে নৃশংসভাবে খুন করবো। ও কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভার নামিয়ে রাখলো।
আমি বললাম, শোবার ঘরে চলো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। রিভলবার নামিয়ে ওকে এগোতে ইশারা করলাম।
শোবার ঘরে ঢুকে লোলা খাটের ওপর গিয়ে বসলো, ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইলো আমার হাতের রিভলবারের দিকে।
আমি লোলাকে বললাম, তুমি কোথায় ফোন করছিলে? পুলিশে? হয়তো ভেবেছ জেনসনকে খুন করার দায়টা আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দেবে কি বলো? কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছো যে পুলিশে খবর দিলে তোমার অবস্থাটা কি হবে? ওরা যদি আমাকে এই খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করে তবে ঐ টাকার কথা আমাকে বলে দিতে হবে। আর ওরা সমস্ত আয়কর হিসেব করে নেওয়ার পর তোমার কপালে কি থাকবে, একবার ভালো করে ভেবে দেখো।
লোলার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝলাম, আমার কথায় ও ভয় পেয়েছে। অতোগুলো টাকা হারাবার আশঙ্কায় ওর মনের ভেতর শুরু হয়ে গেছে সাইক্লোন।
এ ছাড়াও আর একটা উপায় আছে। তা হলো জেনসনের দেহটা লুকিয়ে ফেলতে হবে।রটিয়ে দিতে হবে ও জরুরী কাজে হঠাৎ বাইরে গেছে। তারপর যখন নিরাপদ মনে করবো তখন সিন্দুক খুলে দিয়ে আমি চলে যাবো আর তোমার টাকা তুমি পেয়ে যাবে। আমি আরও বললাম যে, তুমি যদি টাকা না চাও তবে পুলিশে ফোন করো, আমি বাধা দেবো না। আর যদি টাকা পেতে চাও তবে আমার কথায় তোমাকে রাজি হতে হবে।
আমি লোলার দিকে তাকিয়ে রইলাম। জানতাম এত কিছুর পর ও কখনো পুলিশে খবর দেবে না। তবুও আমি রিভলবার হাতে সতর্ক হয়ে রইলাম।
একসময় লোলা মুখ খুললো, টাকাগুলো এখনই দিয়ে দাও, আমি চলে যাচ্ছি। কথা দিচ্ছি, কাউকে তোমার কথা বলবো না।
না। আমি যখন ভালো মনে করবো তখনই তুমি টাকাগুলো পাবে, তার আগে নয়। আর যদি এটুকু ধৈর্য ধরতে না পারো তবে গিয়ে পুলিশকে খবর দাও।
এতোক্ষণে বোধহয় লোলা নিজের অবস্থাটা উপলব্ধি করতে পারলো। বুঝতে পারলো একটা অদৃষ্ট ফাঁদ ওকে চারিদিক থেকে জড়িয়ে ধরেছে, যার হাত থেকে ওর আর মুক্তি নেই। ওর মুখের ওপর হতাশা, ক্ষোভ, ক্রোধ একসাথে ছড়িয়ে পড়লো। ও বিছানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
আমি লোলাকে কিছুক্ষণ সময় দেবার জন্য ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। আগে আঘাতটা সামলে উঠুক, তারপর দুজন মিলে জেনসনের মৃতদেহটার ব্যবস্থা করবো।
যখন আবার বাংলোয় ফিরে এলাম তখন রাত একটা বাজে। লক্ষ্য করলাম, লোলার ঘরে এখনও আলো জ্বলছে। ঘরের দরজায় পৌঁছে হাতল ঘোরাতেই বুঝলাম, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
লোলাকে ডাকলাম চীৎকার করে, কিন্তু লোলা দরজা খুললো না।
বুঝতে পারলাম, ও এখনও প্রকৃতিস্থ হয়নি। কিন্তু আর সময় নষ্ট করলে হবে না, তাই একাই বেরিয়ে পড়লাম।
মনে মনে ঠিক করলাম যে গুমটি ঘরেই জেনসন-এর দেহ কবর দেবো। তাহলে কেউ যে দেখে ফেলবে এমন সম্ভাবনা কম। একটা কোদাল আর একটা বেলচা নিয়ে গুমটি ঘরে গেলাম, কোণের দিকে, পুরোনো লোহা-লক্কড়ের স্তূপের পাশে একটা জায়গা দেখে খুঁড়তে শুরু করলাম
প্রায় সাড়ে তিনটের সময় আমার কাজ শেষ হলো। অতি কষ্টে জেনসন-এর দেহ কবর দিলাম। আমি কি করছিনা করছি লোলা একবারও দেখতে এলোনা। গর্ত ভরাট করে ওপরটা সমান করতে প্রায় একঘণ্টা লেগে গেলো। এরপর কাজ করার যে বড় ভারী টেবিলটা ছিলো, সেটাকে টেনে নিয়ে এসে রাখলাম জেনসনের কবরের ওপর। কারো পক্ষে জানা তো দূরের কথা আন্দাজ করাও সম্ভব নয়, যে ওটার তলায়-মাটির চার ফুট নীচে জেনসন শুয়ে আছে।
গুমটি ঘরের আলো নিবিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম, স্নান করে জামাকাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। এর মধ্যেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আর আধঘণ্টার মধ্যেই পাহাড়ের ফাঁকে উঁকি দেবে সূর্য।
সকাল সাড়ে ছটার সময় ট্রপিকা স্প্রিংসে যাবার প্রথম ট্রাকটা এসে দাঁড়ালো।
ট্যাঙ্কে তেল ভরছি, ড্রাইভারটা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলো, মিঃ জেনসনকে যে দেখছি না?
আমি বুঝতেই পেরেছিলাম যে এইরকম একটা অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে। এখন থেকে দিনের পর দিন এই একই প্রশ্ন আমাকে শুনতে হবে।
মিঃ জেনসন এখানে নেই। অ্যারিজোনায় গেছেন, ওখানে আর একটা পেট্রল পাম্প খুলবেন, তাই জায়গা দেখতে গেছেন।
গত রাত্রে ভেবে ভেবে গল্পটা তৈরী করেছি। এর চেয়ে ভালো কিছু আর আমার মাথায় আসেনি।
লোকটা বেশ কৌতূহলী বলে মনে হলো। তাহলে এটা এখন কে দেখাশোনা করবে, তুমি? হ্যাঁ–একটু ইতস্ততঃ করে বললাম, আমি আর মিসেস জেনসন। লোকটা একটু চমকে উঠলেও কিছু না বলে রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া সেরে, দাম মিটিয়ে ট্রাকে এসে উঠলো। তারপর তীক্ষ্ণ কান ফাটানো শব্দে শিস্ দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো।
.
০৮.
ট্রাকটা চলে যাবার পর রান্নাঘরে যেতেই লোলার সঙ্গে দেখা হলো। মুখের মধ্যে কেমন যেন একটা অবসন্ন ভাব, চোখের কোলে কালি।
লোলার পরনে লাল প্যান্ট, গায়ে সাদা চোলি।ও আমার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলোকার্লের কি করলে?
ওর দেহটা আমি পুঁতে ফেলেছি।–যাকগে শোনো–এখন থেকে আমরা দুজনে মিলেই এ জায়গাটা দেখাশোনা করবো। কিন্তু কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাবো না। যখন সময় হবে আমি চলে যাবো। যাবার আগে সিন্দুক খুলে দিয়ে যাবো।
লোলার চোখে ঝলক দিলো হায়েনার লোভাতুর দৃষ্টি, কিন্তু সেটা কবে? তাছাড়া কার্লের বন্ধুবান্ধব আছে তারা জানতে চাইবে কার্ল কোথায় গেছে!
সে সব আমার অনেক আগেই ভাবা হয়ে গেছে। তোমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে সে অ্যারিজোনায় গেছে। মাস দুয়েকের আগে ফিরবে না। এই কমাস তুমিই এসব দেখাশোনা করবে, আর আমি তোমাকে সাহায্য করছি।
সে না হয় হলো। কিন্তু দুমাস পর কি হবে?কার্লকে তো ওরা আর ভুলবেনা; তখনও একই কথা বার বার জিজ্ঞেস করবে। কি উত্তর দেবো?
আমি লোলাকে বললাম, দুমাস পর তুমি কার্লের একটা চিঠি পাবে। তাতে লেখা থাকবে, সে ওখানে গিয়ে আর একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। এবং তাকে শীগগিরই বিয়ে করছে। এখানে সে আর ফিরবে না। তোমাকে যাতে খাওয়া পরার কষ্টে না পড়তে হয়, সেইজন্য এখানকার পেট্রল-পাম্পটা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছে। এই দুঃসংবাদটা প্রত্যেকেই নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করবে। তারপর চারিদিক ঠাণ্ডা হলে আমিও কেটে পড়বো। তখন ইচ্ছে করলে এ জায়গাটা বেচে তুমি অন্য কোথাও চলে যেতে পারবে।
তার চেয়ে এক কাজ করো; কার্ল তোমাকে যে তিরিশ হাজার ডলার দিচ্ছিলো সে টাকাটা তুমি এখনই সিন্দুক খুলে নিয়ে নাও, তাহলে নু-ইয়র্কে পৌঁছে তোমার অসুবিধে হবেনা। তারপর বাকি টাকাটা
না। জেনসনের একটা টাকাও আমি ছোঁবো না। তাছাড়া এ জায়গাটা আমার পক্ষে বেশ নিরাপদ। আরো কিছুদিন না দেখে পালানোটা ঠিক হবে না।
হঠাৎ বাইরে একটা গাড়ির শব্দ পেলাম। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বের হতেই দেখি, একজন লম্বা, থলথলে চেহারার পুরুষ রেস্তোরাঁর দরজায় দাঁড়িয়ে, চুলের রঙ সোনালী, গাঢ় নীল চোখ বয়স প্রায় চল্লিশ।
লোকটা সরাসরি প্রশ্ন করলো, জেনসন কোথায়?
আমি থতমত খেয়ে জবাব দিলাম, তিনি বেরিয়েছেন। কিছু প্রয়োজন থাকলে আমাকে বলতে পারেন।
আমাদের কথাবার্তা শুনে লোলা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। আগন্তুকের দিকে চোখ পড়তেই মিষ্টি হাসিতে ওর মুখ ভরে গেলো ও, মিঃ ল্যাশ! এতো সকাল সকাল যে–কি ব্যাপার?
লোলাকে দেখে সে টুপি খুলে অভিবাদন জানালো গুড মর্নিং, মিসেস জেনসন। ওয়ালেসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে কার্লের সঙ্গে কিছু কথা ছিল। ও বোধহয় আপনাকে বলেছে, আমাদের সভাপতি ওয়ালেস কাল রাতে হার্টফেল করে মারা গেছে। তার শোকসভায় কার্লেরই বক্তৃতা দেবার কথা। কিন্তু শুনলাম কাল এখানে নেই।
লোলা বললো একটু আগে এলেই কার্ল-এর সঙ্গে দেখা হতো। এই আধঘণ্টা হলো ও ট্রপিকা ম্প্রিংসে রওনা হয়েছে।
ল্যাশ অবাক হয়ে তাকালো, অসম্ভব! এই তো ঢুকবার সময় দেখলাম, ওর গাড়িটা গ্যারেজেই রয়েছে, তাহলে
দেখলাম মিথ্যে কথা বলার জুড়ি নেই লোলার। ল্যাশের কথায়ু ওর মুখের ভাবে এতোটুকু পরিবর্তন হলোনা। ঠিকই দেখেছেন মিঃ ল্যাশ। কার্ল বলে গেছে, ফিরতে ওর মাস দুয়েক লাগবে। এতোদিন গাড়ি ছাড়া আমার অসুবিধে হবে ভেবে গাড়িটা আর নিয়ে যায়নি। অ্যাডাম ওকে তার ট্রাকে করে ট্রপিকা স্প্রিংসে নিয়ে গেছে।
ল্যাশ চোয়ালে হাত বোলাতে লাগলো। বুঝতে পারলাম, সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। কালের হুট করে উধাও হয়ে যাওয়াটা তার কাছে ভালো ঠেকছে না।
একটা ক্ষীণ সন্দেহ যে ল্যাশের মনে উঁকি মারছে বেশ বুঝতে পারলাম। কেন গেছে কিছু জানেন?
গত রাতে মিটিং থেকে ফেরার পর কার্লের একটা ফোন আসে। কে যেন খবর দেয় অ্যারিজোনায় একটা পেট্রল পাম্প নাকি জলের দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ব্যস, ওই খবর পেয়েই ও সাত সবাইকেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েছে। কাউকে জানাবার আর সময় পায়নি।
লোলার উত্তরে ল্যাশ যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হলো, মানে-ব্যাপার কি জানেন আমি ভাবতেই পারিনি, কার্ল এমনি না বলে হঠাৎ করে চলে যাবে।
ল্যাশ চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো, ঘুরে তাকালে আমার দিকে, একে তো চিনলাম না, মিসেস জেনসন?
ওর নাম জ্যাক প্যাটমোর আমাদের এখানে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে; কালই ওকে এনেছে।
ল্যাশের চাউনি দেখে মনে হলো আমাকে তার একটুও পছন্দ হয়নি।ল্যাশ চলে যেতেই লোলা রান্নাঘরে ফিরে গেলো। এতোক্ষণে সাহস ফিরে পেলাম। জেনসনের অ্যারিজোনায় যাওয়ার গল্পটা ল্যাশ যখন বিশ্বাস করেছে, অন্য লোকেও করবে। তবে একথা নিশ্চিত যে লোলাকে জড়িয়ে আমাকে নিয়ে অনেক কথা উঠবে। অতএব সাবধানে থাকাই ভালো।
আজ রবিবার। অত্যাধিক কাজের চাপ। সারা দিনে লোলা আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। রাত বারোটার সময় আমি কাজের হাত থেকে রেহাই পেলাম। একটু ফুরসত হওয়ায় গেলাম রান্নাঘরে।
গিয়ে দেখি কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় লোলা ওর গাউনটা খুলতে শুরু করেছে। আমাকে দেখেই ও থমকালো। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। আবার সে গাউন খোলায় মন দিলো।
হঠাৎ যেন একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম,শরীরে বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেলো।বুকের মধ্যে লকলক করে জ্বলে উঠলো কামনার লেলিহান শিখা। অসীম প্রচেষ্টায় নিজেকে সংযত করলাম।
লোলা গাউনটা খুলে একটা বাক্সে রাখলো। তারপর রান্নাঘরের খিড়কি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো।
আমি আলো নিভিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। শোবার আগে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম।
লোলার শোবার ঘরের জানলা হাট করে খোলা। ঘরে আলো জ্বলছে, শুধু তাই নয়, লোলা দাঁড়িয়ে রয়েছে আলোর ঠিক নীচেই, পরনের চোলিটা ওর বাঁহাতে ঝুলছে। একটু পরেই ও ঝুঁকে পড়ে প্যান্টটা মেঝে থেকে তুলে নিলো। বোধহয় প্রয়োজনের একটু বেশিই অপেক্ষা করলো। তারপর লঘু ছন্দে এগিয়ে চললো বাথরুমের দিকে
অবশ হাতকে আপ্রাণ চেষ্টায় জানলা বন্ধ করতে বাধ্য করলাম।
এইভাবেই দিন যায়। সারাদিন লোলার রান্নাঘরেই কাটে। আমার দিকে একবার তাকানো তো দূরের কথা একটা কথাও বলে না। রাতের নিয়মেরও কোনো হেরফের হয় না।
রাত এগারোটা বাজলেই লোলা বাংলোয় ফিরে যায়। ওর শোবার ঘরের জানলা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয় না। এই চুড়ান্ত প্রলোভন এড়াবার জন্য ওই সময়টা রেস্তোরাঁ ছেড়ে একেবারে বের হইনা। যখন দেখি বাংলোর আলো নিভে গেছে তখন শুতে যাই। কিন্তু শয়নে-স্বপনে জাগরণে চোখের সামনে যদি একই ছবি ভাসতে থাকে–ঘুমোবো কখন?
এইভাবে চারদিন কেটে গেলো। গরমটা যেন হঠাৎকরে বেড়ে গেছে। উত্তপ্ত মরুভূমির হাওয়া অসহ্য হয়ে উঠলো। ট্রাক গাড়ির চলাচলও কমে আসতে লাগলো। স্বাভাবিক ভাবেই কাজের চাপ একেবারে কমে আসতে লাগলো।
জেনসন মারা যাবার আটদিন পর লোলা গাড়ি নিয়ে ওয়েন্টওয়ার্থে গেলো।
একদিন আমি কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গুমটি ঘরের দরজায় একটা মানুষের ছায়া। মুখ তুলে তাকাতেই পায়ের নীচে মাটি যেন দুলে উঠলো।
দরজায় দাঁড়িয়ে জর্জ রিক্স। আসন্ন বিপদের জন্য মনে মনে সতর্ক হলাম। রিক্সের পরণে সেই একই নোংরা জামাকাপড়।
গুড মর্নিং, আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, কার্ল কোথায়?
ঘর্মাক্ত হাত দুটো মুছতে মুছতে আমি উত্তর দিলাম, মিঃ জেনসন এখানে নেই, বাইরে গেছেন। ক চাই আপনার?
শোন ছোকরা বেশীফরফর কোরোনা। আমার দরকার আমি বুঝবো। তুমি এখানে চাকরি করো বলেই তো জানতাম। নাকি হঠাৎ মালিক হয়ে বসেছো?
আমি তো তা বলিনি। আপনার কি দরকার, তা জানতে চেয়েছি।
কার্ল কোথায় গেছে?
ব্যবসার ব্যাপারে অ্যারিজোনায় গেছেন।
কবে ফিরবে?
ঠিক জানিনা। হয়তো মাস দুয়েক লাগবে।
কার্লের ঠিকানাটা আমাকে দাও। আমার পেনসনের কাগজে সই দরকার। সব সময় কালই ওটা সই করে। তাই ওর সই না হলে পেনসনের টাকা পাওয়া যাবে না।
আমি বললাম যে, আমার কিছুই করার নেই। ঠিকানা জানা থাকলে আমি দিয়েই দিতাম। একবারের বেশী দু-বার বলতে হতো না। মিঃ জেনসন না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে।
রিক্স টুপি খুলে মাথায় হাত বোলালো। চোখের মণি অচল, অনড়। তার মানে দুমাস অপেক্ষা করতে হবে?–তা এতদিন চলবে কি করে?
রিক্স দাঁত কিড়মিড় করতে করতে হঠাৎ চোখ তুলে তাকালো, মনে করো যদি সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে যায়? যদি লোলা অসুস্থ হয়ে পড়ে? ধরো এই পেট্রল পাম্পে আগুন লেগে যায়? তখন কার্লকে তো অবশ্যই একটা খবর দেবে। জরুরী প্রয়োজনে খবর দেওয়ার জন্য কার্ল নিশ্চয়ই একটা ঠিকানা দিয়ে গেছে?
না। মিসেস জেনসনও অসুস্থ হচ্ছে না, আর এখানে আগুন লাগছে না। অতএব ভালোয় ভালোয় কেটে পড়ো। আমার কাজ আছে।
এরপর স্টেশন ওয়াগানটার কাছে ফিরে গিয়ে ডিস্ট্রিবিউটর হেডটা আটকে বনেট বন্ধ করে দিলাম।
মিসেস জেনসন কখন ফিরবে?
বলতে পারছি না–তবে মনে হয় দেরী হবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর অবশেষে রিক্সের ভাঙা স্বর কানে এলৈ।
আমাকে কুড়িটা ডলার ধার দিতে পারবে?
টাকা তো আমার নয় যে ইচ্ছামতো ধার দেবো। যাও আর বিরক্ত করো না।
কিন্তু রিক্সের যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। একটু চুপ করে থেকে ও বললো, ভাবছি ম্যারিজোনা পুলিশকে খবর দেবো। ওরা হয়তো কার্লের ঠিকানা খুঁজে বার করতে পারবে।
একটা শক্ত নাট আপ্রাণ শক্তিতে খোলার চেষ্টা করছিলাম। রেঞ্চটা নাটের গা থেকে পিছলে যেতেই সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। রিক্স বলে কি!
ও কিন্তু কথাগুলো অত্যন্ত সাধারণ ভাবেই বলেছে। হয়তো তেমন কিছু ভেবে বলেনি। কিন্তু পুলিশ যদি রিক্সের কথায় সত্যি সত্যি জেনসনের খোঁজ শুরু করে তাহলেই বিপদ। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেলো।
গলার স্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, তাই করো। পুলিশ দিয়ে খোঁজ করাচ্ছো শুনলে হয়তো মিঃ জেনসন বেশী খুশী হবেন– হয়তো তোমার কাগজে একটার জায়গায় দুটো সই করে দেবেন।
তা কি আর করা যাবে! তুমি যখন কার্লের ঠিকানা জানোই না তখন এছাড়া আর উপায় কি! কার্ল যা খুশী ভাবে ভাবুক, ওর সই আমাকে পেতেই হবে। তবে আমার কি মনে হয় জানো? লোলা হয়তো জানে। তোমার কাছে চেপে গেছে। লোলা ফিরে এলে ওকে বোলো। শেষ পর্যন্ত ও যদি ঠিকানা না দেয় তবে বাধ্য হয়ে অ্যারিজোনা পুলিশকে জানাবো। কার্লকে খুঁজে বের করতে ওদের বেশী সময় লাগবে না।
এবার রিক্সের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ঠিক আছে লোলা ফিরলে আমি অবশ্যই তাকে বলবো। আমি যতদূর জানি–ঠিকানা মিসেস জেনসন জানেন না,তবু একবার জিজ্ঞেস করবো।
রিক্সের মতো লোককে একথা বলা মানে হার স্বীকার করে নেওয়া। কিন্তু কি আর করা যাবে? কোনো পুলিশ অফিসার এখানে এসে জেনসনের খোঁজ করবে, একথা ভাবাই যায় না।
রিক্স যাবার আগে বলে গেলো যে কাল রাতে সে আবার আসবে। আর আমি যেন ঠিকানাটা জোগাড় করে রাখি।
রিক্স চলে যাবার পর নিজেকে বড়ো ক্লান্ত মনে হলো। তাড়াতাড়ি চাকাটা সারিয়ে রেস্তোরাঁয় গেলাম।একটা গ্লাসে কিছুটা হুইস্কি ঢেলে চুমুক দিলাম। রিক্সের কথাগুলো মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করতে লাগলো। হুইস্কি শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে পায়চারি করতে লাগলাম।
অ্যারিজোনা পুলিশ কি রিক্সের চিঠির কোনো গুরুত্ব দেবে? হয়তো দেবে না। কিন্তু ও যদি বলে দেয় যে, জেনসন উধাও, আর তার স্ত্রী ওর কর্মচারীর সঙ্গে রাত কাটাচ্ছে, তাহলে? অনেক সময় এরকম সামান্য খবর পেয়েই পুলিশ তদন্ত শুরু করে দেয়। ওরা যদি জেনসনকে অ্যারিজোনায় খুঁজে না পায় তবে নির্ঘাত এখানে লোক পাঠাবে।
আমি ভাবতে লাগলাম যে, যেমন করেই হোক রিক্সের মুখ বন্ধ করতেই হবে। এবং তার একমাত্র পথ হলো ওকে টাকা দেওয়া। এভাবে টাকা দিয়ে হয়তো ওকে মাস দুয়েক ঠেকিয়ে রাখা যাবে। তারপর? জেনসন যে অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে ভেঙ্গে পড়েছে সে কথা কি বিশ্বাস করবে? রিক্স যে রকম স্বভাবের লোক তাতে নিঃসন্দেহে চিঠিটা দেখতে চাইবে। কিন্তু চিঠিটা জাল বলে কি বুঝতে পারবে? মনে হয় চিনে ফেলার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ ওর পেনসনের কাগজে সব সময় জেনসনই সই করতো। সুতরাং ও সহজেই বুঝতে পারবে চিঠিটা জেনসনের লেখা নয়। তারপর?
যতই ভাবতে লাগলাম পরিস্থিতি তততই জটিল মনে হতে লাগলো। রিক্সের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে বুঝে শুনে প্রতিটি পা ফেলা উচিত। হঠাৎ করে সাময়িক উত্তেজনার বসে কিছু একটা করে বসা ঠিক নয়। ভাবলাম লোলা ফিরে এলে ওর সঙ্গে একটা আলোচনা করা প্রয়োজন।
রাত দশটায় লোলা ফিরলো। লোলার গাড়ির শব্দে বাইরে এলাম। দেখলাম
লোলা গাড়ি থেকে নেমেই হনহন করে বাংলোর দিকে হেঁটে গেলো। ছুটে ওর পাশে গিয়ে হাজির হলাম, তোমার সঙ্গে জরুরী কথা আছে।
কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ও দরজা খুলে বাংলোয় ঢুকে পড়লো। পিছন পিছন আমিও ঢুকলাম। ওকে বললাম তোমার পেয়ারের দোস্ত,রিক্স আজ সকালে এখানে এসেছিলো।
লোলার সবুজ চোখ জোড়ায় যেন আগুন ঠিকরে বের হলো। ও ভীষণ ভাবে চমকে উঠলো। ওর মুখের রেখা কঠিন হলো। রাগের বদলে ফুটে উঠলে এক সতর্ক ভাব। আমি নির্বিকার ভাবে বসবার ঘরে গিয়ে একটা চেয়ারে বসলাম। লক্ষ্য করলাম, কার্পেটের ওপর যে রক্তের দাগ ছিল সেটা লোলা পরিষ্কার করে ফেলেছে। চোখ তুলে দেখি ও দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমি বললাম, রিঙ্গ, মিঃ জেনসনের খোঁজ করছিলো। ওর পেনসনের কাগজে তার সই দরকার–তাই কার্লের ঠিকানা চাইছিলো।
লোলা নির্বিকারযেন শুনতে হয় তাই শুনছে।
ঠিকানা জানিনা বলার পর ও বলছে, অ্যারিজোনা পুলিশকে জেনসনের খোঁজ করতে বলবে। কারণ তার সই না হলে রিক্স পেনসনের টাকা পাবে না।
লোলাকে একটু চিন্তিত দেখালো। ও দরজা বন্ধ করে আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে এসে বসলো। আমি জানালাম যে রিক্স কাল রাতে আবার আসবে বলেছে। এর মধ্যেই আমাদের ভেবে ঠিক করতে হবে যে রিক্সকে নিয়ে কি করা যায়, যেহেতু রিক্স আমাদের দুজনেরই শত্রু।
লোলা শান্তভাবে একটা সিগারেট ধরালো, এতে ভাববার কি আছে? সিন্দুকটা খুলে তোমার টাকা নিয়ে তুমি ভেগে পড়ো, বাকী টাকাটা নিয়ে আমিও কেটে পড়বো। রিক্স এসে দেখবে, আমরা কেউ নেই।
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, কিন্তু ভেবে দেখেছো কি কোনো লোক পেট্রল নিতে এসে যদি দেখে জায়গাটা খালি তবে কি হবে? রিক্স যখন দেখবে আমরা কেউ নেই তখন ও অবশ্যই পুলিশে খবর দেবে। আর তখনই আমাদের পেছনে ফেউ লাগবে।
জায়গাটা যে বিক্রী করে দেবে তারও কোনো উপায় নেই। কেননা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে জেনসন মৃত এবং সে উইল করে জায়গাটা তোমাকে দিয়ে গেছে। তখন আর জানতে কারো বাকি থাকবে না যে কার্লকে তুমি খুন করেছ।
লোলার মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারলাম যে ও হাড়ে হাড়ে অনুভব করছে যে, কি ফাঁদে আমরা জড়িয়ে পড়েছি। লোলার দুহাতের চেটো চেয়ারের হাতল দুটোকে নিষ্ফল আক্রোশে নিষ্পেষিত করতে লাগলো।
তুমি এখানে থাকো, আর সিন্দুক খুলে আমার টাকা আমাকে দিয়ে দাও–আমি চলে যাবো। কেউ জানতে চাইলে বলবে যে আমি অ্যারিজোনায় কার্ল-এর কাছে গেছি না ফেরা পর্যন্ত এই পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন-এর দায়িত্ব তোমার ওপরেই আছে।
তুমি কি ভেবেছো রিক্সের মতো লোক সে কথা বিশ্বাস করবে? প্রথমে জেনসন উধাও হলো তারপর তুমি–পেট্রল পাম্পে আমি একা। ও সোজা পুলিশকে গিয়ে বলবে, আমি তোমাদের দুজনকে খুন করে এখানকার মালিক হয়ে বসেছি। রিক্সের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও ওরা তদন্ত করতে এখানে আসবেই। তারপর হয়তো জানতে পারবে আমার পরিচয়-খুঁজে পাবে জেনসনের মৃতদেহ।
লোলা ভয় পেয়ে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলো, কি? তুমি কার্লকে এখানে কবর দিয়েছো? পাগলামোর একটা সীমা থাকা দরকার।
আমি বললাম, আমার এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিলো না। তাছাড়া কোথায় বা কবর দেবো? তুমি কি আমাকে সাহায্য করেছিলে? ভেবেছিলে তিনমনী লাশটাকে আমি একা স্টেশন ওয়াগনে তুলে নিয়ে যাবো। চমৎকার! কার্লকে আমি গুমটি ঘরে পুতে ফেলেছি। পুলিশ যদি রিক্সের কথায় এখানে এসে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেয় তবে নির্ঘাত ওর দেহ খুঁজে পাবে।
লোলা তীক্ষ্ণ স্বরে চীৎকার করে উঠলো, তার মানে? তোমার সঙ্গে আমাকে এখানে চিরদিন থাকতে হবে?
চিরদিন কিনা জানিনা, তবে থাকতে হবে। এছাড়া আমাদের আর কোনো পথ নেই।
অনেক সহ্য করেছি, আর নয়, তুমি থাকলে থাকো। আমি এখানে এক মুহূর্তও থাকছি না, এক্ষুনি আমার টাকা আমাকে দিয়ে দাও।
হাত বাড়িয়ে সিন্দুকটা দেখালাম, তাহলে যাও, আর দেরী করছো কেন? সিন্দুক খুলে টাকা নিয়ে চলে যাও! তবে আমার কথাগুলো আর একটু ভেবে দেখো, তাহলেই বুঝতে পারবে, এ ছাড়া আমাদের আর পথ নেই।
বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। লোলা চেয়ারেই বসে রইলো, চোখে আতঙ্ক আর ঘৃণা নিয়ে। রিক্সের চিন্তাকে কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারলাম না। রাত বারোটা পর্যন্ত পাম্পের কাছে বসে রইলাম। চেয়ে দেখলাম বাংলোর আলোও জ্বলছে, অর্থাৎ লোলার মনেও একই ভাবনা।
অবশেষে চিন্তার হাত থেকে রেহাই পেতে ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে, জামা কাপড় ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু বুঝলাম ঘুমোবার চেষ্টা নিরর্থক।
হঠাৎ ঘরের দরজা খোলার মৃদু শব্দে চমকে উঠলাম। রিক্সের চিন্তা মন থেকে মিলিয়ে গেলো। কাঠ হয়ে শুয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলাম
ঘরের মধ্যে ঢুকলে এক ছায়ামূর্তি। জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়া চাঁদের আলোয় তাকে চিনতে। আমার ভুল হলো না। সে হলো ভোলা।
ওর গায়ে সবুজ সিল্কের চাদর। চাঁদের রুপোলী আলো সেটার গায়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে। লোলা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আমার পাশে বসলো। ওর চাপা ফিসফিস স্বর কানে এলো, শেট যদি আমাদের একসঙ্গেই থাকতে হয় তবে আর মিছিমিছি শত্রুতা করে লাভ কি?
-ও আমার দেহের ওপর ঝুঁকে এলো–আমার মুখের ওপর নামিয়ে আনলো ওর মুখ-ওর তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো আমার ঠোঁটে