০৫. গাঢ় অন্ধকার

অন্ধকার।

গাঢ় অন্ধকার।

আলো ও শব্দহীন অনন্ত সময়ের জগৎ। আমার কোনো রকম বোধ নেই। বেঁচে আছি কিনা তাও বুঝতে পারছি না। এটা কি মৃত্যুর পরের কোনো জগৎ? অন্য কোনো জীবন? আমার মধ্যে সর্বশেষ স্মৃতি যা আছে, তা হচ্ছে একটি বিভীষিকার স্মৃতি। চারদিকে লেলিহান শিখা। গ্যালাক্সি-টু নামের অসাধারণ মহাকাশযানটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সব স্মৃতি তো এইখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার পরেও মনে হচ্ছে চেতনা বলে একটা কিছু এখনো আমার মধ্যে আছে। সব শেষ হয় নি, কিংবা শেষের পরেও কিছু আছে।

আমি চিৎকার করতে চাই, কোনো শব্দ হয় না। হাত-পা নাড়তে গিয়ে মনে হয় আমার হাত-পা বলে কিছু নেই। চারদিকে সীমাহীন শূন্যতা। আমার চেতনা শুধু আছে, আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তা কী করে হয়! অন্ধ ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমি প্রাণপণ শক্তিতে চিৎকার করতে যাই, তখন মনে হয় কেউ একজন যেন আমাকে ভরসা দেয়। আমি তার কণ্ঠ শুনতে পাই না, উপস্থিতি বুঝতে পারি না–কিন্তু তবুও মনে হয় কেউ এক জন পরম মমতায় আমাকে লক্ষ করছে। বলছে, ধৈর্য ধর। সহ্য কর। আমি আছি। আমি পাশেই আছি।

কে, তুমি কে?

ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও।

আমি কি জীবিত না মৃত

সহ্য কর।

কী সহ্য করব আমার তো কোনো শারীরিক কষ্ট হচ্ছে না। শরীর বলে কি আমার কিছু নেই

ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে পড়।

ঘুমিয়ে পড়তে বলছ কেন আমি কি জেগে আছি

ঘুমিয়ে পড় ঘুমিয়ে পড়। দীর্ঘ ঘুম। নিরবচ্ছিন্ন ঘুম।

তুমি কে?

আমি কোনো জবাব পাই না। তখন মনে হয় সমস্তটাই কি কল্পনা তাইবা হবে কী করে আমি কল্পনা করছি কীভাবে, একজন মৃত মানুষ কি কল্পনা করতে পারে, কীভাবে করে, কল্পনা ছাড়া সে কি অন্য কিছু করতে পারে না, আমার বাকি জীবন কি কল্পনা করে করেই কাটবে অযুত নিযুত লক্ষ কোটি বৎসর ধরে আমার কাজ হবে শুধু কল্পনা করা অনন্ত মহাশূন্যে ঘুরে বেড়ান। আমি কি তাই করছি ঘুরে বেড়াচ্ছি মহাশূন্যে

কোনো কূল-কিনারা পাই না। এক সময় যে চেতনা অবশিষ্ট আছে, তাও লোপ পায়। গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়ি। আমার মনে হয় অনন্তকাল কেটে যায় ঘুমের মধ্যে। আবার ঘুম ভাঙে। আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কে কোনো শব্দ হয় না। চারদিকে দেখি, ঘন অন্ধকার। ক্ষীণ স্বরে বলি, আমি কোথায়

আবার আগের মতো কেউ আমাকে ভরসা দেয়। তার কথা শুনতে পাই না। তাকে দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করি, সে বলছে, ভয় নেই। কোনো ভয় নেই।

কে তুমি কে

ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। আমরা তোমার পাশেই আছি।

তোমরা কারা

সময় হলেই জানবে।

কখন সময় হবে

হবে, শিগগিরই হবে। ঘুম এবং জাগরণের আরো কয়েকটি চক্র পার হতে হবে।

আমার সঙ্গীরা কোথায়

এর কোনো জবাব পাওয়া যায় না। আমার চেতনা আবার আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কী ভয়ঙ্কর জটিলতা। আমি কাতর কণ্ঠে বলি, অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। আলো চাই সামান্য কিছু আলো।

ধৈর্য ধর। সহ্য করে যাও। অপেক্ষা কর।

আমি অপেক্ষা করি। অপেক্ষা করতে করতেই হয়তোবা নিযুত লক্ষ কোটি বছর পার হয়ে যায়, কিংবা কে জানে এই জাগতে হয়তো সময় বলে কিছু নেই।

হয়তো আমার মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর পর নতুন একটি অবস্থায় আমি আছি। এই অবস্থায় শরীর নেই, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কিছুই নেই, আছে শুধু চেতনা। এই চেতনা নিয়ে আমি ভেসে আছি অনন্ত মহাশূন্যে। আমার চারপাশে বিপুল অন্ধকার, নৈঃশব্দের ভয়াবহ মহাশূন্য…