কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই আপনাকে শকুন্তলা দেবী!
বলুন। মৃদুকণ্ঠে কথাটি বললে শকুন্তলা।
গলাটিও মিষ্টি।
মিঃ সরকারের মুখে শুনলাম আপনি সারদাবাবুকে বইটই পড়ে শোনাতেন, তাঁর লেখাপড়ার কাজও সব করে দিতেন?
হ্যাঁ।
তাহলে কতকটা তাঁর পার্সোন্যাল অ্যাসিস্টেন্টের মতই আপনি ছিলেন বলুন এখানে তাঁর কাছে? বিমল বলে।
তাই বলতে পারেন।
হুঁ। আচ্ছা কাল রাত্রের দিকে শেষ কখন তাঁর সঙ্গে আপনার কথাবার্তা হয়?
সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত এই লাইব্রেরীতেই তো আমরা ছিলাম। রাত নটার পর এখান থেকে আমি চলে যাই। রাত তখন সোয়া এগারোটা হবে, তিনি আবার আমাকে ডেকে পাঠান তাঁর ঘরে।
অত রাত্রে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন যে?
ওঁর ঘুমের ট্যাবলেটের শিশিটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, সেটা খুঁজে দেবার জন্য।
খুঁজে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ।
কোথায় ছিল সেটা?
ওঁর ঘরে রাইটিং টেবিলের ড্রয়ারেই ছিল, কতকগুলো কাগজের তলায় চাপা পড়েছিল শিশিটা।
তারপর?
আমি যখন বের হয়ে আসছি, আমাকে বললেন দশরথকে বলে দেবার জন্যে, তাঁকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিতে।
অত রাত্রে চা!
হ্যাঁ, চা-পানের ব্যাপারে তাঁর কোন সময়-অসময় ছিল না। যখন-তখনই খেতেন। অতিরিক্ত চা-পানের জন্যই তো ডাক্তার চৌধুরী বলেছিলেন ওঁর ইনসমনিয়া হয়।
দিনে-রাতে কত কাপ চা খেতেন?
তা কুড়ি-পঁচিশ কাপ তো হবেই। আর খেতেনও অত্যন্ত স্ট্রং লিকারের চা।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, আপনি যখন সারদাবাবুর চিঠিপত্র লেখা ও হিসাবপত্র দেখার ব্যাপারে সাহায্য করতেন, তখন আশা করি নিশ্চয়ই আপনি কনফিডেন্সেই ছিলেন?
হ্যাঁ, উনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
স্বাভাবিক। আচ্ছা সারদাবাবু লোকটি কিরকম ছিলেন বলে আপনার ধারণা?
খুব শান্ত, ধীর ও বিবেচক প্রকৃতির লোক ছিলেন সারদাবাবু। ভেবেচিন্তে তবে কোন মতামত প্রকাশ করতেন।
আচ্ছা আপনি তো শুনলাম আট মাসের মত এখানে আছেন, তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কখনো আপনার সঙ্গে কোন আলোচনা হয়নি?
না। কখনো কোন কারণেই ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কারও সঙ্গে কোন আলোচনা করতেই তিনি ভালবাসতেন না। সে ব্যাপারে তাঁকে অত্যন্ত রিজার্ভই বরং মনে হয়েছে বরাবর।
বৃন্দাবনবাবুর প্রতি তাঁর মনোভাবটা কেমন ছিল?
ভালই। বৃন্দাবনবাবুকে অত্যন্ত তিনি ভালবাসতেন বলেই তো আমার মনে হয়।
অতঃপর বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার প্রশ্ন করল, এবারে আপনি কি করবেন ঠিক করেছেন কিছু?
ইট ইজ টু আর্লি টু থিঙ্ক দ্যাট! তাছাড়া যে কাজের জন্য এখানে আমি এসেছিলাম তার যখন আর প্রয়োজন হবে না, চলেই যাব।
আচ্ছা শকুন্তলা দেবী, ধন্যবাদ, আপনি যেতে পারেন।
শকুন্তলার পরে ঘরে ডাকা হল পুরাতন ভৃত্য দশরথকে।
পূর্ববৎ বিমলই দশরথকে এবারে প্রশ্ন শুরু করে।
লোকটার চোখ দুটি মনে হল বেশ লাল ও ফোলা-ফোলা। লোকটা একটু আগেও কাঁদছিল বুঝতে কষ্ট হয় না।
চেহারাটা রোগাটে পাকানো দড়ির মত। মাথার চুলের এক-তৃতীয়াংশ প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে।
পরিধানে একটি খাটো ধূতি ও ফতুয়া।
কতদিন এ বাড়িতে আছ দশরথ?
তা বাবু এককুড়ি বছরেরও বেশী।
বরাবর তুমি বুড়োবাবুর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলে?
হ্যাঁ, বাবুর কাজ ছাড়া আর কোন কাজই কখনও আমাকে করতে হয়নি। বাবু আমাকে ছেলের মতই ভালবাসতেন। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে দশরথের গলাটা ধরে এল, চোখের কোল ভিজে উঠল।
কোঁচার খুটে চোখ মুছতে মুছতে আবার দশরথ বললে, কি যে হয়ে গেল মাথামুণ্ড কিছু এখনও আমি বুঝে উঠতে পারছি না! বাবু যে কেন বিষ খেয়ে মরতে গেলেন!
তোমার বাবু বিষই খেয়েছেন বলে তাহলে তোমার ধারণা দশরথ? বিমল প্রশ্ন করে সহসা।
বিশ্বাস না হলেও তাই তো দেখছি বাবু!
তোমার বাবুকে কাল রাত্রে শেষবারের মত তুমিই তো চা দিয়ে এসেছিলে দশরথ, তাই না?
আজ্ঞে চা-টা আমি নিজে হাতে তৈরী করে দিলেও চা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কেতুর হাত দিয়ে।
কেতু! সে কে?
বুড়ো হয়েছি, খাটতে পারি না—তাই আমাকে সাহায্য করবার জন্যে বাবুরই আজ্ঞামত দিন পনের হল একজন নতুন বেয়ারা রাখা হয়েছিল। তারই নাম কেতুচরণ। সে-ই চা টা দিয়ে এসেছিল।
ও! তারপর?
কিন্তু কেতু ফিরে এসে বললে, চা নাকি খুব কড়া হয়নি, তাই আর এক কাপ কড়া করে চা বাবু চেয়েছেন। তাড়াতাড়ি আর এক কাপ চা কেতুই তৈরী করে নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসে।
তুমি তাহলে কাল রাত্রে যাওনি তোমার বাবুর ঘরে?
না। শরীরটাও কাল তেমন আমার জুত ছিল না, হাঁপানির টানটা বেড়েছিল। তাই সন্ধ্যা থেকে শুয়েই ছিলাম, তবে বাবুর খবর রেখেছি।
তোমার বাবু কি রকম প্রকৃতির লোক ছিলেন দশরথ?
খুব ঠাণ্ডা আর গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন।
বৃন্দাবনবাবুকে তোমার বাবু খুব ভালবাসতেন, তাই না?
হ্যাঁ, ঐ তো ভাইপোদের মধ্যে একমাত্র তাঁর কাছে ছিল, তাছাড়া বাবুর তো কোন ছেলেপিলেও ছিল না।
একমাত্র বৃন্দাবনবাবুই-বৃন্দাবনবাবুর আরও ভাই আছেন নাকি? ও কথা বলছ কেন দশরথ?
আছেন বৈকি, মধু দাদাবাবু-তা তিনি তো বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেননি অনেককাল হয়ে গেল।
কেন? তিনি কোথায়?
কে জানে, কেউ জানে না। দশ বছর আগে সেই যে বাবু তাঁকে বাড়ি থেকে দূর করে। কি কারণে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, আর বড় দাদাবাবু বাড়িমুখো হননি।
তাঁর বৌ, ছেলে-মেয়ে কিছু নেই?
না, তিনি তো বিয়েই তখনও করেননি।
ও, আচ্ছা বৃন্দাবনবাবু ও মধুবাবু-তোমার বাবুর বড় ভাইয়ের ছেলে, না?
হ্যাঁ বাবুরা দুই ভাই, রণদাবাবু ও বাবু। বড় ভাইয়ের দুই ছেলে, এক মেয়ে।
মেয়েটির বুঝি বিবাহ হয়ে গিয়েছে?
বিয়ে হয়েছিল, বছর দুই হল তিন মারা গেছেন। তাঁর এক ছেলে আছে বিজনবাবু।
আচ্ছা দশরথ, তুমি যেতে পার। হ্যাঁ ভাল কথা, তোমাদের কেতুচরণকে একটু পাঠিয়ে দাও তো এ ঘরে।
আজ্ঞে কেতু তো নেই বাবু!
কেতু নেই? কেন, কোথায় গিয়েছে?
জানি না, সকাল থেকেই বাড়িতে তাকে দেখছি না।
বাড়িতে নেই?
না।
হঠাৎ চলে যাবার মানে?
তা কেমন করে বলব বাবু, তবে দেখছি না তাকে সকাল থেকে—
অতঃপর বিমল কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবে।
তারপর আবার প্রশ্ন করে, তা লোকটা দেখতে ছিল কেমন?
বেশ লম্বা-চওড়া কালোমত, তবে বাঁ পাটা দুর্বল ছিল বলে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কুঁজো হয়ে চলত কেতু।
লোকটার স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল বলে তোমার মনে হয়? আর হঠাৎ এভাবে চলে গেলই বা কেন?
কেন চলে গেল বুঝতে পারছি না, লোকটা তো বেশ ভালই ছিল, কাজকর্মও দুদিনেই শিখে গিয়েছিল। কাবাবুর লোকটাকে পছন্দও হয়েছিল।
কোথায় তার বাড়ির ঠিকানা কিছু জান?
না বাবু, শুনেছিলাম সংসারে নাকি তার কেউ নেই, মেদিনীপুরে কোন্ গাঁয়ে নাকি বাড়ি বলেছিল।
অতঃপর ভৃত্য গোকুল, ঠাকুর হরিদাস, দারোয়ান রামভজন, দাসী পিয়ারী প্রভৃতিকে দু-চারটে প্রশ্নাদি করে, মৃতদেহ শহর হাসপাতালে ময়না তদন্তের জন্য পাঠিয়ে এবং সারদাচরণ সরকারের ঘরে টেবিলের উপর রক্ষিত তখনও অধসমাপ্ত চা সমেত চায়ের কাপটা সঙ্গে নিয়ে বিমল সেন সরকার-ভিলা থেকে বের হয়ে এল।
পথেই বিমলের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে সুশান্ত ও বিনয় তাদের বাড়ির দিকে চলে গেল।
উক্ত ঘটনার দিনসাতেক বাদে বিকেলের দিকে সুশান্ত ও বিনয় বেড়াতে বেড়াতে থানায় গিয়ে হাজির হতেই বিমল সাদরে ওদের অভ্যর্থনা জানায়, আয়-বস!
সুশান্তই চেয়ারে বসতে বসতে প্রশ্ন করে, তারপর, তোর সরকার-ভিলার কেসটা কি দাঁড়াল? সুইসাইড না হোমিসাইড?
কে জানে, বুঝতে পারছি না। আজই ওপরওয়ালার কাছে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিলাম। বিচিত্র ব্যাপার!
কি রকম!
ময়দা তদন্তের রিপোর্ট বলছে, নিকোটিন পয়েজনিং নাকি মৃত্যুর কারণ—
নিকোটিন!
হ্যাঁ, কিন্তু কোথা থেকে যে ঐ মারাত্মক বিষটি এল কিছু ভেবেই পাচ্ছি না। আর সুইসাইডই যদি হয় তো, ঐ রেয়ার পয়েজনটাই বা সারদাবাবু কোথা থেকে যে যোগাড় করলেন, তাও তো মাথামুণ্ডু কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
তাহলে তোর ধারণা কি কেসটা সত্যি হোমিসাইডই?
হোমিসাইডই যে বলব জোর গলায় তারও তো কোন ক্লু পাচ্ছি না।
মৃত্যু যে সারদাবাবুর নিকোটিন পয়জনিংয়েই হয়েছে স্থিরনিশ্চিত হলি কি করে?
সেই অর্ধসমাপ্ত চায়ের কাপের চাটা অ্যানালিসিসের জন্য পাঠিয়েছিলাম কলকাতায় কেমিক্যাল এগজামিনারের কাছে। তার মধ্যে কোন পয়জনের ট্রেসই মেলেনি। অথচ সিভিল সার্জেন বলছেন ময়না তদন্ত করে-এ কেস অফ ডেফিনিট নিকোটিন পয়েজনিং!
তাহলে?
যাক গে, বড়কর্তাদের জানিয়ে দিয়েছি। এখন তাঁদের যা করবার করুন। বড়ঘরের ব্যাপারেই সব আলাদা। বেটা বুড়োর তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তার পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্টের খুপসুরৎ থেরা দেখলেই মাথা ঘুরে যাবার যোগাড়!
বিনয় বললে, বৃন্দাবনবাবুকে আজও তো সকালে সরকার-ভিলার সামনে দেখেছিলাম। ভদ্রলোক এখানেই আছেন বুঝি এখনও?
শুধু তিনি কেন, শকুন্তলা দেবীটিও তো শুনলাম এখনও রয়েছেন এখানেই।
দেখ, বৃন্দাবন আর ঐ শকুন্তলা দেবীরই কাজ হয়তো! সুশান্ত এবারে বলে।
বিচিত্র নয়।
কিন্তু ব্যাপারটা যতই বিচিত্র হোক, স্থানীয় লোকেদের যে সে সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা আছে সেরকম কিছু মনে হল না।
কারণ ব্যাপারটা যেন ক্রমশঃ ধামাচাপা পড়বারই যোগাড় হয়েছিল।
এমন সময় প্রায় আরও দিন সাতেক অর্থাৎ দুর্ঘটনার পক্ষকাল বাদে সন্ধ্যার সময় বিমলের থানার অফিসঘরের মধ্যেই বসে সুশান্ত, বিনয়, ফ্যাটি গুপ্ত ও বিমল সেন রীতিমত আড্ডার আসর যখন জমিয়ে তুলেছে, তখন বাইরের বারান্দায় অপরিচিত একটা জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
বেশ ভারী জুতোর শব্দ।
পরক্ষণেই ভারী, মোটা অপরিচিত গলা শোনা গেল দরজার ওপাশে, দারোগাবাবু আছেন?
কে? ভেতরে আসুন!
একটু পরেই ভারী জুতোর মশমশ শব্দ তুলে দীর্ঘকায় এক আগন্তুক ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
ঘরের মধ্যে টেবিলের উপরে রক্ষিত প্রজ্বলিত টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিটা গিয়ে প্রায় যেন একই সঙ্গে আগন্তুকের উপর পড়ল।
আগন্তুক দু হাত তুলে নমস্কার জানালেন, নমস্কার। আমি আসছি সরকার-ভিলা থেকে। আমার নাম মধুসূদন সরকার।
চকিতে সকলের নামটা মনে পড়ে যায় যেন। মধুসূদন সরকার!
পক্ষকাল আগে সারদাবাবুর মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে ভৃত্য দশরথের মুখেই ঐ নামটি ওরা শুনেছিল।
অতএব নামটা তাদের অপরিচিত নয়—যদিও মানুষটা অপরিচিত।