০৫. কোনো আদি নেই কোনো অন্ত নেই

কোনো আদি নেই কোনো অন্ত নেই। কোনো শুরু নেই কোনো শেষ নেই। এক ফোটা আলো নেই, এক বিন্দু শব্দ নেই। তাপ নেই, স্পর্শ নেই, অনুভূতি নেই। আলাে বর্ণ শব্দ গন্ধ স্পর্শ উত্তাপহীন এই জগতে সে কতদিন থেকে আটকে আছে কে জানে। কত লক্ষ বছর সে এভাবে আটকে থাকবে? এই বিশাল শূন্যতা থেকে তার কোনো মুক্তি নেই?

কতকাল পার হয়ে গেছে কে জানে তখন হঠাৎ মনে হল বহুদূর থেকে কে যেন তাকে ডাকছে। সত্যি ডাকছে নাকি এটি কনা? কেউ কি তাকে ডাকতে পারে? সে কি কারো কথা শুনতে পারে?

সে আবার তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করল। এবারে সে স্পষ্ট শুনতে পায় কেউ একজন তাকে ডাকছে। বলছে, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ, সে শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু সে কেমন করে বলবে যে সে শুনতে পাচ্ছে? তার কথা বলার ক্ষমতা নেই। তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। তার মুখ নেই, কণ্ঠ নেই। তার সমস্ত চেতনা গভীর প্রত্যাশায় আকুলি-বিকুলি করে ওঠে কিন্তু সে কিছু করতে পারে না।

তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ?

কণ্ঠস্বরটি পরিচিত, বহু পরিচিত। নারী কণ্ঠ, সে কতবার এই কণ্ঠ শুনেছে। তার ভালবাসার মেয়ের কণ্ঠ কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরটি শুনে সে অমানুষিক আতঙ্কে শিউরে ওঠে। চিৎকার করে উঠতে চায়, তুমি? তুমি? তুমি?

হ্যাঁ। আমি।

তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। রিসার্চ ল্যাব তোমার মস্তিষ্ক থেকে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একটা ইন্টারফেসের সাথে একটা কমিউনিকেশন্স মডিউল লাগিয়ে দিয়েছে।

আমি কোথায়?

আমার ঘরে। আমার বসার ঘরে। টেবিলের উপর একটা কাচের জারে তরলের মাঝে ড়ুবে আছ। থলথলে কুৎসিত একটা মস্তিষ্ক দেখলে গা ঘিন ঘিন করে, কিন্তু তবু আমি রেখে দিয়েছি। এখান থেকে বৈদ্যুতিক তার বের হয়ে এসেছে ইলেকট্রনিক প্রসেসর হয়ে মাইক্রোফোনে এসেছে, স্পিকারে এসেছে। আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি, তোমার কথা শুনতে পারি।

কেন? তুমি কেন আমার কথা শুনতে চাও?

এমনি! একজন মানুষের যখন দেহ থাকে না শুধু মস্তিষ্ক থাকে তখন সে কেমন করে চিন্তা করে আমার জানার ইচ্ছে করে।

তুমি–তুমি এমন নিষ্ঠুর কেমন করে হতে পার?

ওগুলো পুরানো কথা। আপেক্ষিক কথা। দুর্বল মানুষের কথা। নিষ্ঠুরতা বলে আসলে কিছু নেই।

আছে।

ঠিক আছে তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষকে হত্যা করে সেটা কী নিষ্ঠুরতা?

হ্যাঁ। সেটি নিষ্ঠুরতা?

মানুষকে হত্যা করা বড় নিষ্ঠুরতা নাকি তার মস্তিষ্ককে একটা গ্লাসের জারে পুষ্টিকর তরলের মাঝে ড়ুবিয়ে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা বড় নিষ্ঠুরতা?

মানুষকে হত্যা করে তার মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখা অনেক বড় নিষ্ঠুরতা অনেক অনেক বড় নিষ্ঠুরতা-অনেক অনেক অনেক-

নারী কণ্ঠের উচ্ছল হাসির শব্দে সব কথা চাপা পড়ে গেল। মেয়েটি শুনতে পেল না অসহায় একটি মস্তিষ্ক থেকে হাহাকারের মতো করে ভেসে এলো, আর নিষ্ঠুরতার মাঝে আনন্দ খুঁজে পাওয়া হচ্ছে আরো বড় নিষ্ঠুরতা।