কোথাকার জংলি, এরা?
অন্ধকারের মধ্যেই পায়ের তলায় একটা লোহার সিঁড়ি অনুভব করতে পারলুম। তারপরেই টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লুম ঘুটঘুটি অন্ধকার একটি ঘরে; শব্দ শুনে বোঝা গেলো মুহূর্তে পিছনের দরজা ঘটাং করে বন্ধ হয়ে গেলো।
বেশিক্ষণ কিন্তু অন্ধকারে থাকতে হলো না। খানিক পরে মাথার উপর একটি ফানুশের লণ্ঠনে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠলো, তারপর নিরেট ও মসৃণ দেয়ালের একটা অংশ দরজার মতো খুলে গেলো। একটু পরেই দুটি লোক ঘরে ঢুকলো।
তাদের মধ্যে একজন যে স্বয়ং নেতা, তা মুহূর্তেই বোঝা গেলো। অত্যন্ত ব্যক্তিত্বময় তার শরীর, যেন তা অস্বিতার প্রতিমূর্তি। শান্ত মুখের মধ্যে অদ্ভুত একটি দৃঢ়তার ছাপ রয়েছে, চোখের তারায় দুর্জয় সাহসের দীপ্তি। ঋজু তার ভঙ্গি, চলাফেরায় আভিজাত্যের স্বাক্ষর; মনে হয় বুঝি কোনো শেষ সম্রান্তের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালুম। পাণ্ডুর মুখবব, ঈষৎ বিষাদময়; দীর্ঘদেহী এই মানুষটিরও চওড়া কপাল আর কম্পমান আঙুল যেন কোনো গোপন আবেগের পরিচয় দেয়। স্বচ্ছ মর্মভেদী চোখে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন–যেন ওই দৃষ্টি দিয়েই তিনি আমাদের ভিতরটা তন্নতন্ন করে খুঁজে নিতে চাচ্ছেন।
ঘরের ভিতরকার থমথমে স্তব্ধতা আমিই ভাঙলুম। ফরাসী ভাষাতেই আমি আমাদের দুর্দশার কাহিনী বলে গেলুম। কোনো কথা না বলে তা তারা শুনে গেলো। সেই অভিজাতমণ্ডিত মানুষটির চোখে মুখে আগ্রহ ও কৌতূহলের ছাপ দেখতে পেলুম, কিন্তু তবু কেন যেন মনে হলো আমার ভাষা বোধহয় তার দুর্বোধ ঠেকছে।
আমি তাতে মোটেই দমে গেলুম না। আমার অনুরোধে নেড সেই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করলে ইংরেজিতে, তারপর কোনসাইল আলেমান ভাষায়। তখনও তাদের কোনো উচ্চবাচ্য করতে না দেখে শেষে ভাঙা-ভাঙা লাতিন ভাষারই শরণ নিলুম আমি। কিন্তু তারা তেমনি নির্বাকভাবে আমাদের লক্ষ্য করে গেলো কেবল। তারপর কি-এক অদ্ভূত ও অচেনা ভাষায় কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
তারা চলে যেতেই নেড বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়লো। কোথাকার জংলি এরা যে পৃথিবীর কোনো সভ্য ভাষাই বোঝে না?
নেভের গজরানি শেষ হবার আগেই আবার দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো একটি পরিচারক। অন্যদের মতো এরও মাথায় সিন্ধু-ভোঁদড়ের ললামের টুপি, সীলমাছের চামড়ার জুতো, আর কোন অচেনা কাপড়ের পোশাক! হুবহু সেই রকমই কতকগুলি কুর্তা ও পাতলুন সে রাখলে আমাদের সামনে। পোশাকগুলো যে আমাদের জন্যই, তা সে না-বললেও বুঝতে পারলুম; তৎক্ষণাৎ আমরা ভিজে পোশাক ছেড়ে এই নতুন ও অদ্ভুত পোশাক পরে নিলুম।
এর মধ্যে পরিচারকটি টেবিলের উপর খাদ্যসম্ভার সাজিয়ে দিয়ে গেছে। চিনেমাটি আর রুপোর রেকাবিতে সারি সারি সাজানো সেসব খাবার দেখে নেড বলে উঠলো! শাবাশ! এবার তাহলে কচ্ছপের যকৃৎ হাঙরের মুড়িঘন্ট আর কুকুর-মাছের ডিম ভাজা খেয়ে নিন—তাহলেই তো হয়।
কিন্তু নেডের এই গজরানির কোনো কারণ ছিলো না। খাবারের মধ্যে কয়েকটা কেবল অচেনা মাছ আছে। রুটি আর মদ না-থাকায় নেডের বিরক্তি চীৎকৃতভাবে প্রকাশ পেলো। আমার কিন্তু রান্নাটা সত্যি তোফা লাগলো। খাবার জলটাও বেশ টলটলে পরিষ্কার। ভোজবাড়ির খাওয়া হলো যেন আমাদের। আর ধাওয়ার পরেই চোখ ভরে ঘুম নেমে এলো। শুতে-না-শুতেই ঘুমিয়ে পড়লুম তিনজনে।