৫ম অধ্যায়
কৃপ-কৌশলের বিফলতা—উপদেশে উপেক্ষা
কৃপাচার্য্য কহিলেন, “বুদ্ধিহীন ব্যক্তি সতত শুশ্রুষা-পরতন্ত্র [শাস্ত্রাদিশ্রবণে শ্রদ্ধাযুক্ত] ও জিতেন্দ্রিয় হইলেও সুচারুরূপে ধর্ম্মার্থজ্ঞান অবগত হইতে পারে না। আর বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিও বিনয়শিক্ষা না করিলে ধর্ম্মার্থ-নির্ণয়ে অসমর্থ হয়। দৰ্ব্বী [হাতা] যেমন নিয়ত সূপে [ব্যঞ্জনাদিতে] নিমগ্ন থাকিয়াও তাহার রসাস্বাদনে বঞ্চিত হয়, তদ্রূপ জড় ব্যক্তি সর্ব্বদা পণ্ডিতের উপাসনা করিয়াও ধর্ম্মজ্ঞ হইতে পারে না; কিন্তু জিহ্বা যেমন স্পৰ্শমাত্রেই সূপরসের আস্বাদ গ্রহণ করে, তদ্রূপ বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি অতি অল্পক্ষণ পণ্ডিতের উপাসনা করিয়াই ধর্ম্মের মর্ম্মগ্রহণ করিতে পারেন। গুরুশুশ্রুষাতৎপর বুদ্ধিমান জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা অচিরাৎ সর্ব্বশাস্ত্রজ্ঞ হয়েন, তাঁহারা কদাচ সর্ব্বসম্মত বিষয় লইয়া বিবাদে প্রবৃত্ত হয়েন না। দুর্বিনীত পাপাত্মা লোক সজ্জনের কল্যাণকর উপদেশ উল্লঙ্ঘন করিয়া মহাপাপে লিপ্ত হয়। সুহৃদগণ পাপ হইতে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিলে যাহারা তাঁহাদের বাক্যানুসারে পাপানুষ্ঠানে বিরত হয়, তাহারা সম্পদভাজন হইতে পারে, আর যাহারা সুহৃদের বাক্য উপেক্ষা করিয়া পাপকাৰ্য্যে বিরত না হয়, তাহারা নিশ্চয়ই শ্রীভ্রষ্ট হয়। লোকে ক্ষিপ্ত ব্যক্তিকে যেমন বিবিধ বাক্য দ্বারা শান্ত করে, তদ্রূপ বন্ধুগণ বিবিধ উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক আত্মীয়কে পাপকার্য্যে পরাঙ্মুখ করেন। যাহারা সুহৃদ্বাক্য উপেক্ষা করিয়া পাপপরাম্বুখ না হয়, তাহাদিগকে অবশ্যই অবসন্ন হইতে হয়। প্রাজ্ঞ লোকেরা বিজ্ঞ সুহৃদকে পাপনিরত দেখিলে যথাশক্তি বারংবার উপদেশ প্রদান করেন। অতএব হে দ্রোণতনয়! তুমি কল্যাণকর বিষয়ে মনোনিবেশ ও আত্মদমন করিয়া আমার বাক্য রক্ষা কর; নচেৎ নিশ্চয়ই তোমাকে অনুতাপ করিতে হইবে। প্রসুপ্ত, ন্যস্তশস্ত্র, রথহীন, বাহনহীন, শরণাগত ও মুক্তকেশ ব্যক্তিদিগকে বধ করা নিতান্ত ধর্ম্মবিরুদ্ধ। পাঞ্চালগণ আজ কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক মৃত ব্যক্তিদিগের ন্যায় বিচেতন হইয়া বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রাগত হইবে! যে পামর সেই অবস্থায় তাহাদিগের বিদ্রোহাচরণ, তাহাকে অগাধ নরকে মগ্ন হইতে হইবে, সন্দেহ নাই। তুমি ইহলোকে অস্ত্রবেত্তাদিগের অগ্রগণ্য বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছ, অণুমাত্র পাপও তোমাকে কখন স্পর্শ করিতে পারে নাই; অতএব কল্য সূর্যোদয় হইলে প্রকাশ্যযুদ্ধে শত্রুগণকে জয় করিও। তুমি গর্হিত কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে উহা শুক্লবস্ত্রে শোণিতপাতের ন্যায় নিতান্ত অপ্রীতিকর হইবে।
অশ্বত্থামার পাণ্ডবশিবির অভিমুখে যাত্রা
তখন অশ্বত্থামা কহিলেন, “মাতুল! আপনি যাহা কহিলেন, উহা যথার্থ বটে; কিন্তু পূর্বে পাণ্ডবগণ কর্ত্তৃক ধর্ম্মের সেতু শতধা বিদলিত হইয়াছে। দেখুন, দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন ভূপতিগণের ও আপনাদিগের সমক্ষেই তাঁহার প্রাণসংহার করিয়াছে; মহাবীর কর্ণের রথচক্র ভূতলে প্রোথিত হইলে অর্জুন সেই বিপদ্কালে সূতপুত্রকে নিহত করিয়াছে এবং শিখণ্ডীকে অগ্রসর করিয়া ন্যস্তশস্ত্র নিরায়ুধ ভীষ্মদেবের বিনাশে কৃতকার্য্য হইয়াছে; সাত্যকি প্রায়োপবিষ্ট মহাধনুর্দ্ধর ভূরিশ্রবাকে এবং ভীমসেন অন্যায় গদাযুদ্ধে দুৰ্য্যোধনকে নিপাতিত করিয়াছে। আজ দূতমুখে ভগ্নোরু রাজা দুর্য্যোধনের করুণ বিলাপ শ্রবণ করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। হে মাতুল! পাপাত্মা পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ এইরূপে বারংবার ধর্ম্মসেতু ভগ্ন করিয়াছে; আপনি কি নিমিত্ত সেই পামরদিগের নিন্দা করেন না? আমি এই রজনীতে পিতৃহন্তাদিগকে সুপ্তাবস্থায় নিপাতিত করিব, ইহাতে যদি আমার কীট অথবা পতঙ্গযোনিতে জন্মগ্রহণ করিতে হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ। সম্প্রতি আমি অভীষ্ট সাধনে নিতান্ত তৎপর হইয়াছি। এক্ষণে আমার নিদ্রা ও সুখ-বাসনা কোথায়? আজ আমাকে এই অধ্যবসায় হইতে নিরস্ত করিতে পারে, এরূপ লোক ভূমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করে নাই, করিবেও না।’
হে মহারাজ! প্রতাপান্বিত অশ্বত্থামা এই কথা বলিয়া রথে অশ্ব সংযোজনপূর্ব্বক বিপক্ষগণের শিবিরাভিমুখে যাত্রা করিলেন। মহাত্মা কৃতবর্ম্মা ও কৃপাচাৰ্য্য তদ্দর্শনে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে মহাবীর! তুমি কি অভিপ্রায়ে রথযোজনা করিলে, সত্য করিয়া বল। আমরা তোমার দুঃখে দুঃখিত ও সুখে সুখী হইয়া থাকি, অতএব আমাদের প্রতি কোন আশঙ্কা করিও না। তখন অশ্বত্থামা পিতৃবধবৃত্তান্ত স্মরণপূর্ব্বক কোপে কম্পিত হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আপনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন, ‘দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন নিশিত শরনিকরে সহস্র যোদ্ধার প্রাণ সংহার করিয়া আমার অস্ত্রত্যাগী পিতাকে নিপাতিত করিয়াছে। আজ আমি সেই বর্ম্মবিহীন পাপপরায়ণ দ্রুপদপুত্রকে নিহত করিব। দুরাত্মা ধৃষ্টদ্যুম্ন যাহাতে আমার হস্তে পশুর ন্যায় নিহত হইয়া শস্ত্রবিজিত লোকে গমন করিতে না পারে, তাহাই আমার উদ্দেশ্য। তোমরা বর্ম্ম ধারণ এবং কার্মুক ও খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক আমার সহিত আগমন কর।’ দ্রোণপুত্র এই বলিয়া বিপক্ষগণের অভিমুখে গমন করিতে লাগলেন। কৃপাচার্য্য এবং কৃতবর্ম্মাও তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তৎকালে সেই বীরত্রয়কে যজ্ঞস্থান সমিদ্ধ [যজ্ঞকুণ্ডে প্রজ্বলিত] হুতাশনত্রয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর তাহারা সেই সুপ্তজনপূর্ণ শিবির-সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। মহারথ অশ্বত্থামা কৃপাচার্য্য ও কৃতবর্ম্মাকে আমন্ত্রণপূর্ব্বক শিবিদ্বারে গমন করিয়া রথবেগ সংবরণ করিলেন।”