০৫. কায়ীরা চিন্তিত মুখে বলল

কায়ীরা চিন্তিত মুখে বলল, দূর সমুদ্রে একটা সাদা ইয়ট দেখা গেছে।

কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল, কে দেখেছে?

তাহা পরিবার মাছ ধরতে গিয়েছিল, তারা এসে বলেছে।

কোন দিকে যাচ্ছে?

এখন বোঝা যাচ্ছে না।

নিহন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞেস করল, কায়ীরা, ইয়টে করে স্থলমানবেরা কেন এসেছে বলে মনে হয়?

কায়ীরা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আনন্দ করতে এসেছে। স্ফুর্তি করতে এসেছে।

তারা কেমন করে স্ফুর্তি করে?

ইয়টের ডেকে বসে তারা খায়-দায় আনন্দ করে। নাচানাচি করে। মাঝে মধ্যে শিকার করে।

কী শিকার করে?

পাখি, মাছ, ডলফিন। একবার শুনেছিলাম-

কী শুনেছিলে?

কায়ীরা ইতস্তত করে বলল, আমি ব্যাপারটায় কখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি নি। ভাসা ভাসাভাবে শুনেছি

কী শুনেছ?

তারা নাকি দুই-একজন মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। আমাদের মতো মানুষ।

নিহন চমকে উঠে বলল, আনন্দ করার জন্যে তারা মানুষ মারে?

আনন্দ করার জন্যে মেরেছে নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল আমি জানি না। যে কলোনির মানুষকে মেরেছে তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথা হয় নি।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, কায়ীরা।

বল।

আমাদের কি একটু সতর্ক থাকা দরকার?

হ্যাঁ।

কীভাবে সতর্ক থাকব?

ওদের কাছাকাছি হতে চাই না।

যদি কাছাকাছি চলে আসে?

আসার কথা নয়। কায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, কখনো আসে না। কিন্তু তারপরও যদি চলে আসে আমরা সরে যাব। নৌকায় ডলফিনে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সরে যাব।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আমি কি সবাইকে একটু সতর্ক করে রাখব? এখনই না। শুধু শুধু ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা একটু দেখি ইয়টটা কোন দিকে যায়।

কায়ীরা নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি ইয়টটাকে চোখে চোখে রাখতে পারবে?

পারব, কায়ীরা।

একেবারেই কাছে যাবে না। অনেক দূরে থাকবে।

ঠিক আছে। অনেক দূরে থাকব।

মনে রেখ ওরা কিন্তু বাইনোকুলার দিয়ে অনেক দূরে দেখতে পাবে।

নিহন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ জানি।

তা হলে তুমি যাও। সঙ্গে কতজনকে নিতে চাও?

যত কম নেওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো হয় একা গেলে, যদি নিতেই হয় তা হলে আর একজন।

আমি যাব নিহনের সঙ্গে আমি। কিশোরী গলার স্বর শুনে সবাই ঘুরে তাকাল, নাইনা নামের ছিপছিপে মেয়েটি সবাইকে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

কায়ীরা মুখের হাসি গোপন করে বলল, তুমি?

হ্যাঁ, কায়ীরা আমি।

তুমি এই কাজের জন্য খুব ছোট।

না কায়ীরা- নাইনা তার কুচকুচে কালো চুল কঁকিয়ে প্রতিবাদ করে বলল, আমি ছোট না। আমি সমুদ্রের তল থেকে এনিমম তুলে এনেছি। আমার ডলফিন কিকি আমাকে নিয়ে এক শ কিলোমিটার চলে যেতে পারে, আমি হাঙর শিকার করেছি, নীল তিমির দুধ দুয়েছি।

ব্যস! ব্যস! অনেক হয়েছে- কায়ীরা হেসে নাইনাকে থামিয়ে দিল। বলল, আমাদের কিছু নিয়মকানুন আছে। ছোট কিংবা বড় বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ না- কার কতটুকু অভিজ্ঞতা সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

আমাকে যদি যেতে না দাও আমার অভিজ্ঞতা হবে কেমন করে?

ঠিক আছে, আমি অনুমতি দিচ্ছি।

নাইনা আনন্দের একটা শব্দ করতে যাচ্ছিল, কায়ীরা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল, বলল, তুমি যেহেতু যথেষ্ট বড় হও নি আমার অনুমতি যথেষ্ট নয়। তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া তোমাকে পাঠানো যাবে না!

নাইনা একটা হতাশার মতো শব্দ করে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা তার মায়ের দিকে তাকাল, চোখে-মুখে একটা করুণ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, মা

নাইনার মা বলল, তুই এতটুকুন মেয়ে কোথায় একটু লেখাপড়া করবি, ঘরের কাজ শিখবি তা না দিনরাত দস্যিপনা। সমুদ্রের পানি ছাড়া আর কিছু বুঝিস না।

নাইনা প্রতিবাদ করে বলল, কে বলেছে আর কিছু বুঝি না। আমি ত্রিঘাত সমীকরণ শেষ করেছি মা। আমি আমার ক্লাসে জীববিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। আমি নীল তিমির চর্বি থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করতে পারি। সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে কাপড় বুনতে পারি।

ঠিক আছে, বাবা ঠিক আছে। নাইনার মা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, তুই যেতে চাইলে যা। কিন্তু খুব সাবধান।

নাইনা এবার আনন্দের মতো একটা শব্দ করল। নিহন নাইনার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, নাইনা! আমি তোমার কাজকর্মের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না। যে কাজ থেকে সবাই সরে থাকতে চায় তুমি সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও! কারণটা কী?

নাইনা দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার মাথাটা মনে হয় একটু খারাপ!

নাইনার মা বলল, হ্যাঁ। আসলে তা-ই। তোর আসলেই মাথা খারাপ। তারপর নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি আমার এই মাথা খারাপ মেয়েটাকে একটু দেখে রেখ।

নিহন মাথা নেড়ে বলল, আমি দেখে রাখব। তুমি চিন্তা কোরো না।

তোমার ওপর বিশ্বাস করে আমি যেতে দিচ্ছি। অন্য কেউ হলে আমি তার সাথে আমার এই পাগলী মেয়েকে যেতে দিতাম না। আমি জানি, তুমি নাইনাকে দেখে রাখবে।

.

খুব ভোরবেলা রওনা দিয়ে নিহন আর নাইনা দুপুরবেলার দিকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামল। ডলফিন দুটো ক্ষুধার্ত, তাদের ছেড়ে দিয়ে দুজনে পানিতে শুয়ে থাকে। জলমানব শিশুদের জন্ম হয় পানিতে, তারা হাঁটতে শেখার আগে পানিতে ভেসে থাকতে শেখে। নিহন সমুদ্রের প্রায় উষ্ণ পানিতে নিশ্চল হয়ে শুয়ে নাইনাকে ডাকল, নাইনা।

বল।

ক্লান্ত হয়ে গেছ?

নাইনা ডলফিনের পিঠে বসে সমুদ্রের পানির ভেতর দিয়ে এত দূর এসে সত্যিই একটু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে এটি স্বীকার করতে চাইল না। বলল, না নিহন। ক্লান্ত হই নি!

নিহন হেসে বলল, খানিকক্ষণ হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নাও। তারপর কিছু একটা খাও।

নাইনা পানি থেকে মাথা বের করে বলল, আচ্ছা নিহন, আমরা যে রকম পানিতে ভেসে থাকতে পারি স্থলমানবেরা নাকি সে রকম ভেসে থাকতে পারে না?

পারে। তবে সেটা শিখতে হয়। তারা সেটাকে বলে সাঁতার কাটা। সাঁতার কেটে পানিতে ভেসে থাকতে হলে তাদের হাত-পা নাড়তে হয়।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আমরা যে রকম পানিতে শুয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারি, তারা সে রকম পারে না?

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, তারা পারে না।

কেন পারে না?

আমি ঠিক জানি না। মনে হয় পানিতে থাকার জন্য আমাদের ফুসফুস আকারে বড় হয়ে গেছে, বেশি বাতাস বুকের ভেতর থাকে বলে আমাদের ভেসে থাকা সোজা। তা ছাড়া সমুদ্রের পানিতে লবণ, সেজন্য আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশি-

নাইনা অবাক হয়ে বলল, স্থলমানবের পানিতে লবণ নেই?

না। তাদের পানি বৃষ্টির পানির মতো!

কী আশ্চর্য! নাইনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমার মাঝে মধ্যে খুব স্থলমানবদের দেখার ইচ্ছা করে।

নিহন শব্দ করে হেসে উঠে বলল, এর চেয়ে বল আমার একটা হাঙরের মুখের ভেতর মাথাটা ঢোকাতে ইচ্ছে করে! সেই কাজটাই বরং সহজ আর নিরাপদ।

তোমার কী মনে হয় নিহন? আমরা কি ইয়টের ভেতর স্থলমানদের দেখতে পাব?

উঁহু। আমরা অনেক দূরে থাকব। দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইয়টটা কোন দিকে যায় আমরা শুধু সেটা লক্ষ করতে এসেছি।

নাইনা একটু আদুরে গলায় বলল, আমরা কি একটু কাছে গিয়ে দেখতে পারি না?

না, নাইনা। নিহন গম্ভীর গলায় বলল, আমরা কিছুতেই কাছে যাব না। দূরে থাকব। অনেক দূরে।

নাইনা কোনো কথা বলল না, নিঃশব্দে পানিতে দুই হাত-পা ছাড়িয়ে শুয়ে রইল, তার খানিকটা আশাভঙ্গ হয়েছে। সে ভেবেছিল ইয়টের খুব কাছে গিয়ে স্থলমানবদের দেখবে। তারা কেমন করে হাসে কথা বলে শুনবে। স্থলমানবদের নিয়ে তার অনেক কৌতূহল।

 কিছুক্ষণের মধ্যেই ডলফিন দুটো ফিরে এল, সমুদ্রের তলদেশ থেকে তারা ভরপেট খেয়ে এসেছে। শুশু তার মুখ দিয়ে ঠেলে নিহনকে জাগিয়ে তোলে। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে তার চোখে ঘুম নেমে এসেছে সে জানে না। শুও কিছু একটা বলল, কথাটি কী নিহন ঠিক ধরতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, কী বলছ শুশু?

সাদা বড়।

সাদা বড় কিছু দেখেছ?

শুশু মাথা নাড়ল। বলল, ঝিক ঝিক ঝিক।

ও আচ্ছা! নিহন বুঝতে পারে, ডলফিন দুটো ইয়টটা দেখে এসেছে। শুওকে ধরে বলল, ইয়টটা দেখেছ?

হ্যাঁ।

কোন দিকে যাচ্ছে?

শুশু এবং কিকি মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল ইয়টটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাচ্ছে। নিহন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তাদের ভাসমান দ্বীপটি উত্তরে, ইয়ট সেদিকে যাচ্ছে না।

নাইনা বলল, চল, ইয়টটা দেখে আসি।

চল। নিহন আবার নাইনাকে মনে করিয়ে দেয়, মনে আছে তো, আমরা কিন্তু বেশি কাছে যাব না।

মনে আছে নিহন, মনে আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ডলফিনের পিঠে চেপে নিহন আর নাইনা পানি কেটে ছুটে যেতে থাকে। বহু দূরে যখন ধবধবে সাদা ইয়টটা দেখা গেল তারা দুজন তখন থেমে গেল। নিহন। বলল, আর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখান থেকে দেখি।

নাইনা অনুনয় করে বলল, আর একটু কাছে যাই?

না নাইনা। আর কাছে নয়।

নাইনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে।

ডলফিন দুটোকে ছেড়ে দিয়ে তারা চুপচাপ পানিতে শুয়ে থাকে। বহু দূরে ইয়টটাকে আবছা দেখা যাচ্ছে, পানিতে একটা চাপা গুমগুম শব্দ শোনা যায়। ডলফিন দুটো ছাড়া পেয়ে তাদের ঘিরে ছোটাছুটি করতে থাকে, ছোট বাচ্চাদের মতো সেগুলো মাঝে মধ্যে পানি থেকে ঝাঁপ দিয়ে উপরে উঠে যায়। ডলফিন খুব হাসিখুশি প্রাণী। মানুষের কাছাকাছি থাকলে মনে হয় তারা আরো বেশি হাসিখুশি থাকে।

নিহন আর নাইনা পানিতে শুয়ে নিঃশব্দে ইয়টটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখান থেকে মনে হচ্ছে সেটা খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছে কিন্তু দুজনেই জানে এটা খুব দ্রুত পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে।

নিহন হঠাৎ পানি থেকে মাথা বের করে আনে। নাইনা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে নিহন?

ইয়টটার ইঞ্জিন বন্ধ করেছে।

কেন?

জানি না। এখানে থেমে যাচ্ছে।

নাইনা চোখ বড় বড় করে তাকাল, সত্যি?

হ্যাঁ। নিহন তীক্ষ্ণ চোখে ইয়টটার দিকে তাকিয়ে থাকে, অনেক দূরে বলে ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তার মুখে হঠাৎ দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল, সেটা নাইনার দৃষ্টি এড়াল না। নাইনা জানতে চাইল, কী হয়েছে নিহন?

বহু দূর থেকে ছোট ছোট কয়েকটা ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

কিসের ইঞ্জিন?

বুঝতে পারছি না। স্থলমানবদের কত রকম যন্ত্রপাতি আছে-তার কোনো একটা হবে।

কেন এর শব্দ হচ্ছে?

এখনো বুঝতে পারছি না। ইয়টটা থেমে গেছে। এখানে নোঙর ফেলবে মনে হয়।

হঠাৎ করে শুশু এবং কিকি ভুশ করে তাদের কাছাকাছি ভেসে উঠল। দুটি ডলফিনই উত্তেজিত গলায় কিছু একটা বলতে থাকে, তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নিহন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে শুশু?

আসছে। আসছে।

নিহন অবাক হয়ে বলল, কী আসছে?

এক দুই তিন চার।

চারজন?

শুশু এবং কিকি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। চারজন আসছে।

নিহন এবার ভালো করে তাকাল এবং দেখতে পেল বহু দূর থেকে চারটি কালো বিল্টুর মতো কিছু একটা সমুদ্রের পানিতে ফেনা তুলে ছুটে আসছে।

নাইনা জিজ্ঞেস করল, ওগুলো কী?

জানি না। মনে হয় কোনো ধরনের জলযান। সমুদ্রের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে।

কোথায় আসছে?

নিহন মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। আমার মনে হয় আমাদের সরে যাওয়া উচিত।

নাইনা একটু অনুনয় করে বলল, একটু দেখি। আমি কখনো স্থলমানব দেখি নি।

তোমার ডলফিনের উপর উঠে বস। যদি পালাতে হয় যেন দেরি না হয়।

নাইনা কিকির উপর উঠে বসে। কিকি পানির উপর একবার লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে চাইল, কিন্তু নাইনা অনেক কষ্ট করে তাকে শান্ত করে রাখল।

নাইনা এবং নিহন একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এবং দেখতে দেখতে চারজন স্থলমানব চারটা সাগর-স্কুটারে করে তাদের খুব কাছাকাছি চলে এল। নাইনা ফিসফিস করে নিহনকে বলল,দেখেছ, দুজন ছেলে দুজন মেয়ে।

হ্যাঁ।

নাইনা উত্তেজিত গলায় বলল, কী সুন্দর পোশাক দেখেছ?

দেখেছি।

ওদের হাতে কালো মতন ওটা কী?

নিহন বলল, আমি জানি না।

নাইনা বলল, দেখেছ ওরা কালো মতন জিনিসটা হাতে তুলে নিচ্ছে!

হ্যাঁ।

ওরা চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে কেন?

নিহন বলল, ওরা আমাদের ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করছে!

কেন? ওরা কেন আমাদের ঘিরে ফেলতে চাইছে?

হঠাৎ করে নিহনের কাছে পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায়, সে ভয়ার্ত মুখে নাইনার দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ নাইনা! সর্বনাশ!

কী হয়েছে?

এই মানুষগুলো আমাদের মারতে আসছে।

নাইনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?

হ্যাঁ। নিহন লাফিয়ে শুর উপর উঠে বলল, পালাও! নাইনা, পালাও।

উত্তেজনায় শুশু নিহনকে নিয়ে পানি থেকে লাফিয়ে উঠে গেল এবং ঠিক তখন তারা। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কর্কশ গুলির শব্দ শুনতে পেল। শিসের মতো শব্দ করে গুলিগুলো তাদের কানের কাছ দিয়ে ছুটে যায়। নিহন আতঙ্কিত চোখে নাইনার দিকে তাকাল, কিকির পিঠে বসে সে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। পানি থেকে ভেসে উঠে সে আবার ডুবে গেল, আবার ভেসে উঠে আবার ডুবে গেল।

স্থলমানব চারজন তাদের সাগর-স্কুটার নিয়ে ছুটে যাচ্ছে, চলন্ত স্কুটার থেকে গুলি করা সহজ নয়, এক হাতে হ্যান্ডেলটা ধরে রেখে অন্য হাতে গুলি করতে হয়। গুলিগুলো তাই বেশিরভাগই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিহন শুশুকে ধরে ফিসফিস করে বলল, সোজা যাও শুশু।

ভয়। শুশু ভয়।

কোনো ভয় নেই। আমি আছি।

তুমি আছ?

হ্যাঁ।

নাইনার পিছু পিছু দুজন স্থলমানব ছুটে যাচ্ছে, নিহন শুশুকে নিয়ে তাদের পিছু ছুটে যেতে থাকে। সাগর-স্কুটারের গতি খুব বেশি, ডলফিনকে নিয়ে সেটাকে ধরে ফেলা সম্ভব নয়। নিহন তবু চেষ্টা করল। স্কুটারে প্রপেলর থাকে ধারালো প্রপেলর সেখানে সাগলে সে কিংবা শুও জখম হয়ে যাবে, তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে।

নিহন দেখল একজন স্থলমানব হাতের অস্ত্রটা ওপরে তুলেছে, গুলি করবে। নাইনাকে দেখা যাচ্ছে তার রক্তহীন, ফ্যাকাসে ভয়ার্ত মুখ। তার ডলফিনটাও অনভিজ্ঞ, কী করবে বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে পানি থেকে লাফিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। স্থলমানবটা ট্রিগার টেনে ধরতেই কান ফাটানো শব্দে গুলি বের হতে থাকে–নিহন তখন শুশুকে নিয়ে স্কুটারের। ওপর দিয়ে লাফিয়ে যায়, হ্যাঁচকা টান দিয়ে সে তার হাতের অস্ত্রটা টেনে নেওয়ার চেষ্টা করল। স্থলমানবটা এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তাল হারিয়ে সে পানিতে পড়ে যায়, নিয়ন্ত্রণহীন স্কুটারটা সমুদ্রের পানিতে গর্জন করে দুবার ঘুরপাক খেয়ে নিশ্চল হয়ে যায়। স্থলমানবটি পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে, অন্য একজন তখন তাকে সাহায্য করতে তার কাছে ছুটে আসতে থাকে।

নিহনের দিকে অন্য একজন স্থলমানব ছুটে আসছে-একটি মেয়ে, হাতের উদ্যত অস্ত্র তার দিকে তাক করে রেখেছে, চোখের দৃষ্টি কী ভয়ঙ্কর। নিহন সেই মেয়েটির দৃষ্টি দেখে হতবাক হয়ে যায়, এটি কি ক্রোধ, জিঘাংসা, নাকি ঘৃণা? সে কী করেছে? এই মেয়েটি কেন তাকে হত্যা করতে চায়? কেন তার জন্য এই ঘৃণা?

কানের কাছ দিয়ে গুলি ছুটে যেতে শুরু করেছে, নিহন শুশুকে নিয়ে লাফ দিয়ে মেয়েটির ওপর দিয়ে পার হয়ে গেল। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ, সাগর-স্কুটারের ইঞ্জিনের কান ফাটানো গর্জন, পানির ঝাপটা তার মধ্যে হঠাৎ নিহন নাইনার আর্তচিৎকার শুনতে পায়। নাইনা কি গুলি খেয়েছে। এখন তা হলে কী হবে?

নিহন শুশুর পিঠে থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, শুগু, নাইনার কাছে যাও।

যাই। নিহন যাই।

পানির নিচে ডুব দিয়ে শুশু নিহনকে নাইনার কাছে নিয়ে যায়, কাছাকাছি যাওয়ার আগেই সে পানির মধ্যে রক্তের গন্ধ পেল। নাইনা বিস্ফারিত চোখে কিকির দিকে তাকিয়ে আছে। নাইনা নয়, নাইনার ডলফিন কিকির শরীর গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নিহন চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, নাইনা। কী হয়েছে?

কিকি! আমার কিকি!

ছেড়ে দাও কিকিকে। ছেড়ে দাও।

নাইনা অবুঝের মতো বলল, না। আমি ছাড়ব না। আমার কিকি মরে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে আমার কিকি।

নিহন ধমক দিয়ে বলল, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও কিকিকে, তুমি তা না হলে বাঁচতে পারবে না।

নিহন হাত বাড়িয়ে নাইনাকে কাছে টেনে আনে, সঙ্গে সঙ্গে কিকি পানিতে ডুবে যেতে থাকে। এখন তারা দুজন মানুষ এবং একটা ডলফিন। তাদের বিরুদ্ধে চারজন মানুষ, তাদের কাছে আছে শক্তিশালী সাগর-স্কুটার, আছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এই স্থলমানবদের সঙ্গে তারা কেমন করে পারবে? নিহন জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দেয়। কী হবে সে জানে না, কিন্তু যেভাবেই হোক নাইনাকে রক্ষা প্রতে হবে। নাইনার মা বিশ্বাস করে তার সঙ্গে নাইনাকে পাঠিয়েছে। যেভাবে হোক তার নাইনাকে রক্ষা করতে হবে। করতেই হবে।

নিহন নাইনাকে ধরে রেখে বলল, নাইনা তুমি শুশুকে নিয়ে পালাও।

আর তুমি?

আমি পরে আসছি।

কীভাবে আসবে?

নিহন অধৈর্য হয়ে বলল, আমি তার ব্যবস্থা করব। তুমি এখন পালাও।

 নিহন নাইনাকে শুশুর পিঠে বসিয়ে তার শরীরে খারা দিয়ে বলল, যাও। শুশু যাও।

শুশু মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি?

আমি পরে যাব।

মানুষ খারাপ।

হ্যাঁ। নিহন মাথা নাড়ল, মানুষগুলো খারাপ। দেরি কোরো না, পালাও।

শুশু নাইনাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিহন এখন একা পানিতে ভেসে আছে। যে মানুষটি পানিতে পড়ে গিয়েছিল সে আবার তার সাগর-স্কুটারে উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্য সবাই এখন এগিয়ে আসছে। নিহন বুকভরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে পানিতে ডুবে যায়। ডুবসাঁতার দিয়ে সে পানির নিচে দিয়ে যেতে থাকে, ওপর দিয়ে সাগর-স্কুটারগুলো যাচ্ছে। শক্তিশালী প্রপেলরে পানি কেটে যাওয়ার সময় বাতাসের বুদুদে ওপরটুকু ঢেকে যাচ্ছে। ইঞ্জিনের গর্জনে পানি কেঁপে কেঁপে উঠছে।

নিহন পানির নিচে অপেক্ষা করে, ঠিক মাথার ওপর দিয়ে একটা সাগর-স্কুটার যাবার সময় সে লাফিয়ে নিচে থেকে সেটাকে ধরে ফেলে। স্কুটারটা সঙ্গে সঙ্গে কাত হয়ে যায়, নিহন টান দিয়ে নিজের শরীরটা স্কুটারের ওপরে তুলে নেয়। সাগর-স্কুটারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা হতচকিত হয়ে নিহনের দিকে তাকিয়ে আছে, নিহন তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে স্কুটারের নিয়ন্ত্রণটা নেওয়ার চেষ্টা করল। লাভ হল না, স্কুটারটা কাত হয়ে পানিতে পড়ে গেল। মানুষটা স্কুটার ধরার চেষ্টা করল, পারল না, হাত থেকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটা পড়ে গেছে পানিতে ডুবে গেছে সাথে সাথে। নিহন মানুষটিকে নিয়ে পানিতে পড়ে যায় মানুষটির শরীরে লাইফ জ্যাকেট তাই ভেসে উঠছিল, কিন্তু নিহন তাকে টেনে পানির নিচে নিয়ে যায়!

মানুষটি পানির নিচে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, চোখেমুখে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক এসে ভর করেছে। নিহন দেখতে পায় তার নাক-মুখ দিয়ে কিছু বাতাসের বুদ্বুদ বের হয়ে আসছে। নিহন একবার নিঃশ্বাস নিয়ে যেরকম দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে এই মানুষটি সেটা পারে না। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মানুষটি ছটফট করছে বাতাসের জন্য, তার বুকটা মনে হয় ফেটে যাবে! নিহন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এই অসহায় মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে ইচ্ছে করলেই সে তাকে মেরে ফেলতে পারে। তাকে কি সে মেরে ফেলবে? এই নিষ্ঠুর মানুষটিকে কি মেরে ফেলাই উচিত না?

কিন্তু নিহন মানুষটিকে মারল না, শেষ মুহূর্তে তাকে ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিতেই মানুষটি প্রাণপণে উপরে উঠে গিয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। গলা দিয়ে পানি ঢুকে যায় আর সে খকখক করে কাশতে থাকে। নিহন নিজেও ধীরে ধীরে উপরে ভেসে আসে। অন্য স্থলমানবগুলো তাকে ঘিরে ফেলছে। সে তাকিয়ে থাকে, দেখে আরো বেশ কয়েকটি সাগর-স্কুটার আসছে। সেখানে আরো মানুষ, তাদের হাতে আরো অস্ত্র।

নিহন এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল সে এই স্থলমানবদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে পারবে না। যে কোনো মুহূর্তে একঝক গুলি এসে তাকে ঝাজরা করে দেবে। তার সময় শেষ হয়ে এসেছে।

নিহন তবুও সাবধানে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। নাইনাকে সে বাঁচিয়ে দিয়েছে। নাইনার মাকে কথা দিয়েছিল পাগলী মেয়েটিকে দেখে রাখবে, সে সেই কথা রেখেছে। নিহন পানিতে ভেসে ভেসে একঝাক গুলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।