০৫. ইরিনা জেগে উঠে দেখল

ইরিনা জেগে উঠে দেখল একটি প্রকাণ্ড গােলাকৃতি ঘরের ঠিক মাঝখানে সে শুয়ে আছে। ঘরটি অদ্ভুত। চারদিকের দেয়াল থেকে অস্পষ্ট নীলাভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে, তাকালেই মন শান্ত হয়ে আসে। হালকা, প্ৰায় অস্পষ্ট সুর ভেসে আসছে। খুব করুণ কোনো সুর। ইরিনার মনে হল সে বোধ হয়। স্বপ্ন দেখছে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন খুব বাস্তব মনে হয়। স্বপ্ন দেখার সময় মনেই হয় না। এটা স্বপ্ন।

ইরিনা তোমার ঘুম ভেঙেছে?

ইরিনা তাকাল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে প্রায় সাত ফুট উঁচু দৈত্যাকৃতির একটি এনারিয়েড রোবট। এনারিয়েড রোবট ইরিনা আগে দেখে নি। স্কুলে যান্ত্রিক মানব অংশে এনারিয়েড রোবটির ওপারে একটা চ্যাপ্টার ছিল। সেখানে বলা হয়ছে— এনারিয়েড রোবট তৈরি হয় রিবো ত্ৰি সার্কিটে। আই সি পি পি ৩০০২৫। আই সি টেনার জংশন মুক্ত। সেই কারণেই এরা শুধু চিন্তাই করতে পারে না, উচ্চস্তরের লজিকও দেখাতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিবৃক্তির এরা সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে যেহেতু এরা কমী রোবট নয়, সেহেতু এদের ব্যবহার সীমাবদ্ধ। এইটুকু পড়ে কিছু বোঝা যায় না। রিবো ত্ৰি সার্কিট কি, টেনার জংশনই বা কি? কেউ জানে না। কে জানে হয়তো এককালে জানত। স্কুলের বইতে এনারিয়েড রোবটের বেশ কিছু ছবি আছে। ইরিনার মনে আছে তারা এদের নাম দিয়েছিল দৈত্য রোবট। কী বিশাল শরীর, ছবি দেখলেই ভয় লাগে। কিন্তু আশ্চৰ্য, একে দেখে ভয় লাগছে না। এর গলার স্বর কোমল, মমতা মাখা।

ইরিনা তোমার ঘুম ভেঙেছে?

দেখতেই তো পাচ্ছ ভেঙেছে, আবার জিজ্ঞেস করছি কেন?

রোবটটি ঠিক মানুষের মতো হাসল। চট করে হাসি থামিয়ে বলল, কিছু একটা নিয়ে কথা শুরু করতে হবে তো, তাই জিজ্ঞেস করছি। তুমি এখন কেমন আছ?

ভালো।

আমি কে তা জিজ্ঞেস করলে না।

তুমি একটি এনারিয়েড রোবট।

চমৎকার! আমাকে দেখে ভয় লাগছে না তো আবার?

না, ভয় লাগছে না। আমি কোথায়?

তুমি আছ নিষিদ্ধ নগরীতে। তোমাকে কৃত্রিম উপায়ে ঘুম পাড়িয়ে এখানে আনা হয়েছে।

ভালো কথা।

কি জন্যে ঘুম পাড়িয়ে এখানে আনা হল তা তো জিজ্ঞেস করলে না।

তোমাদের ইচ্ছা হয়েছে এনেছি।

তা কিন্তু নয়। তুমি এসেছ আকাশপথে। আকাশপথের বিমানগুলোর একটা সমস্যা আছে। অতিরিক্ত রকম দুলুনি হয়। চৌম্বক জ্বালানির এই একটা বড় অসুবিধা। উচ্চ কম্পনাঙ্কে প্লেন কাঁপে। মানুষের পক্ষে তা সহ্য করা মুশকিল। সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা। তোমাদের ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

ঠিক আছে। এনেছ ভলো করেছ।

তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্তা। আমি তোমার খাবারের ব্যবস্থা করছি।

আমি কিছুই খাব না।

তার কারণ জানতে পারি?

খেতে ইচ্ছা করছে না।

রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে রাখার ব্যাপারটা হাস্যকর। একজন ক্ষুধার্তা মানুষের খাদ্য প্রয়োজন। আমি খাবার নিয়ে আসছি।

রোবটাটি নিঃশব্দে চলে গেল। ইরিনা। এই প্ৰথমবারের মতো লক্ষ করল। রোবটটি গিয়েছে দেয়াল ভেদ করে। তার মানে এই অস্বচ্ছ দেয়াল কোনো কঠিন পদার্থের তৈরি নয়। বায়বীয় কোনো বস্তুর তৈরি। এ বস্তুর কথা ইরিনার জানা নেই। শুধু দেয়াল নয়, এই গোলাকার ঘরে এ রকম আরো জিনিস আছে, যা ইরিনা আগে কখনো দেখে নি বা বইপত্রে পড়ে নি। যেমন ঠিক তার মাথার ওপর বলের মতো একটা জিনিস বুলিছে। ইরিনা বুঝতে পারছে, এই জিনিসটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে। সে যখন নড়াচড়া করে, এটিও নড়াচড়া করে। সে যখন একদৃষ্টিতে তাকায় তখন বস্তুটির ঘূর্ণন পুরোপুরি থেমে যায়। একবার ইরিনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল, অমনি জিনিসটা অনেকখানি নিচে নেমে প্রবল বেগে ঘুরতে লাগল। নিঃশ্বাস নেয়া শুরু করতেই সেটি আবার উঠে গেল আগের জায়গায়।

ইরিনা, তোমার জন্যে খাবার এনেছি।

রোবটটির চলাফেরা নিঃশব্দ, কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে কে জানে। ইরিনা বলল, আমি তো বলেছি কিছু খাব না।

খাবে বৈকি। প্রথমে কফির কাপে চুমুক দাও। সত্যিকার কফি, বীনের কফি। সিনথেটিক কফি নয়। তোমার ভালো লাগবে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো চুমুক দাও।

ইরিনা নিজের অজান্তেই হাত বাড়িয়ে কফি নিল। তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল না, তবু জিজ্ঞেস করল, আমার মাথার ওপর যে যন্ত্রটা ঘুরছে, সেটা কি?

ওটা একটা মনিটর। তোমার যাবতীয় শারীরিক ব্যাপার মনিটর করা হচ্ছে। রক্তচাপ, রক্তের শর্করার পরিমাণ, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, নিও ফ্রিকোয়েন্স— সবকিছুই মাপা হচ্ছে।

কফি এমন কিছু আহামারি নয়। কেউ বলে না দিলে বোঝাই মুশকিল এটা সিনথেটিক কফি নয়। এই কফির একমাত্র বিশেষত্ব হচ্ছে, এর মধ্যে এক ধরনের আঠালো ভাব আছে, সিনথেটিক কফিতে যা নেই।

এই কফি কি তোমার ভালো লাগছে। ইরিনা?

না, ভালো লাগছে না। আমার সঙ্গে যিনি ছিলেন— মীর উনি কোথায়?

সে-ও ঠিক এরকম অন্য একটি ঘরে আছে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে আমার মতোই একটি এনারোবিক রোবট।

এখান থেকে আমরা কোথায় যাব?

কোথাও যাবে না। এখানেই থাকবে।

তার মানে কত দিন থাকব। এখানে?

যত দিন তোমার ডাক না পড়ে।

কে ডাকবে আমাকে?

নিষিদ্ধ নগরীর প্রধানেরা। যাঁরা নিষিদ্ধ নগরী চালাচ্ছেন। যারা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করছেন।

তারা কারা?

তাঁরা তোমার মতোই মানুষ। এই পৃথিবীতেই তাঁদের জন্ম।

ইরিনা বিস্মিত হয়ে বলল, মানুষ!

হ্যাঁ, মানুষ। তুমি কি ভেবেছিলে অন্যকিছু? এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান কোনো প্রাণের সৃষ্টি হয় নি।

তাহলে মানুষরাই নিষিদ্ধ নগরীর পরিচালক?

হ্যাঁ। তবে তাদের সঙ্গে তোমাদের সামান্য প্ৰভেদ আছে। তাঁরা অমর। তোমাদের মৃত্যু আছে, তাদের মৃত্যু নেই।

তুমি এসব কী বলছ!

আমি ঠিকই বলছি। মৃত্যু এইসব মানুষদের কখনো স্পর্শ করে না। করবেও না।

তোমার কথা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

বিশ্বাস করার চেষ্টা কারই ভালো। তুমি কি তোমার স্কুলের বইতে পড়নি রোবটারা মিথ্যা বলতে পারে না। তাদের সে রকম করে তৈরি করা হয় নি।

ইরিনা কফির কাপ নামিয়ে রেখে আগ্রহের সঙ্গে খাবার খেতে শুরু করল। সবই তরল এবং জেলি জাতীয় খাবার। ঝাঁঝালো ভাব আছে, তবে খেতে চমৎকার।

রোবটটি বলল, খেতে ভালো লাগছে?

হ্যাঁ লাগছে।

তোমার শরীরে প্রয়োজন এবং রুচি– এই দুটি জিনিসের ওপর লক্ষ রেখে খাবার তৈরি হয়েছে। তোমার খারাপ লাগবে না।

ইরিনা বলল, নিষিদ্ধ নগর সম্পর্কে কৌতূহল প্রকাশ করা নিষিদ্ধ কিন্তু আমি যা প্রশ্ন করছি, তুমি তার জবাব দিচ্ছি।

জবাব দিচ্ছি, কারণ তুমি নিষিদ্ধ নগরীতেই আছ। তোমার জন্যে নিষিদ্ধ নয়। কারণ তুমি এসব প্রশ্নের জবাব কখনো প্ৰথম শহরে পৌঁছে দিতে পারবে না। বাকি জীবনটা তোমার এ জায়গাতেই কাটবে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ তাই।

নিষিদ্ধ নগরীর মানুষরা কত দিন ধরে বেঁচে আছেন?

পাঁচশ বছরের মতো। তাদের জন্ম হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞের আগে।

তারা অনন্তাকাল বেঁচে থাকবেন?

হ্যাঁ থাকবেন।

তারা আমাকে কখন ডেকে পাঠাবেন?

তা তো বলতে পারছি না। হয়তো আগামীকালই ডেকে পাঠাবেন। হয়তো দশ বছর পর ডাকবেন। সময় তাদের কাছে কোনো সমস্যা নয় বুঝতেই পারছ।

তারা যদি দশ বছর পর ডাকেন, এই দশ বছর আমি কী করব?

অপেক্ষা করবে।

কোথায় অপেক্ষা করব?

এইখানে। এই ঘরে।

তুমি কী পাগলের মতো কথা বলছ! আমি এই জায়গায় দশ বছর অপেক্ষা করব?

আরো বেশিও হতে পারে। সময় তোমার কাছে একটা সমস্যা, তাদের কাছে কোন সমস্যা নয়। তবে ভয় পেও না, তোমার সময় কাটানোর ব্যবস্থা আমি করব। খেলাধুলা, গান-বাজনা, বইপত্র- সব ব্যবস্থা থাকবে।

ইরিনার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। কি বলছে ও! এ তো অসম্ভব কথা। রোবটটি তার যান্ত্রিক মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল, তোমার যখন নেহায়েত অসহ্য বোধ হবে, তখন আমরা তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। আরামের ঘুমা। ছয়, সাত বা আট বছর কাটিয়ে দেবে শান্তির ঘুমে।

ইরিনা বলল, এ রকম কি হয়েছে কখনো? কাউকে আনা হয়েছে প্রথম শহর থেকে, নিষিদ্ধ নগরীর কেউ তার সঙ্গে দেখা করে নি? সে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে আমার মতো এরকম ঘরে?

তা তো হয়েছেই। ঠিক এই মুহুর্তেই তোমার মতো আরো চারজন অপেক্ষা করছে। এই চার জনের দুজন অপেক্ষা করছে কুড়ি বছর ধরে। এখনো দেখা হয় নি। ওদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আমার মনে হয়। ঘুমুতে ঘুমুতেই ওরা এক সময় মারা যাবে।

আর বাকি দুজন?

ওরা এসেছে ছয় বছর আগে। এখন পর্যন্ত তারা ভালোই আছে। ঘুমেই আছে।

আমি কি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

না।

আমি কি মীরের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

না।

মীর কেমন আছে তা কি জানতে পারি?

না।

ইরিনা চিৎকার করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল দেয়ালে। যে দেয়াল তার কাছে বায়বীয় মনে হচ্ছিল, দেখা গেল তা মোটেই বায়বীয় নয়। ইস্পাতের মতো কঠিন। বরফের মতো শীতল।