৫. ইগোর উপসাগরে
প্রথম বাজিটার কিস্তি তো মাৎ হ’লো, কাজ কিন্তু তখনও ফুরোয়নি। মউল যদিও পেঙ্গুয়িন টিলার কাছের খাড়িটায় নোঙর ফেলেছিলো, কিন্তু খোলা সমুদ্রের ক্ষিপ্ত ঢেউয়ের হাত থেকে পুরোপুরি রেহাই পায়নি। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঝড় বইলে মউলের আর বাঁচোয়া নেই। কন্গ্রে তা জানতো। সে মৎলব ক’রে রেখেছিলো পরদিন ভাটার টান শুরু হ’লেই সে ঐ খাড়ি ছেড়ে চ’লে যাবে। কিন্তু তার আগে খুঁটিয়ে দেখে নিতে হবে মেরামত করবার কিছু আছে কি না। সাগরপাড়ি দেবার আগে এটা তো জানা চাই যে সেই ধকল সইবার মতো অবস্থায় আছে কি না জাহাজটা।
কন্গ্রে আর সের্সান্তে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সবকিছু পরীক্ষা ক’রে দেখলে। তাদের সাহায্য করলে ভার্গাস নামে একজন চিলেনো। ভালপারাইসোর জাহাজ তৈরির কারখানায় আগে সে ছুতোরের কাজ করতো ব’লে জাহাজের কাঠামো সম্বন্ধে তার প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা। তাছাড়া, মউল তো ছিলো ভালপারাইসোরই জাহাজ, না কী!
জাহাজটা মোটামুটি অটুটই আছে। তবে সামান্য যা টুকিটাকি ত্রুটি ছিলো, তার পরিমাণও কম কিছু নয়। ঐ ছোটোখাটো মেরামতিতেই দিন সাতেক কেটে যাবে বলে মনে হ’লো ভার্গাসের—অর্থাৎ কাল এখান থেকে মউলকে নড়ানো মোটেই ঠিক হবে না। এ-কথা শুনে কন্গ্রে রেগে গিয়ে বিচ্ছিরি একটা খিস্তি করলে ভাগ্যকে, তার সাঙ্গোপাঙ্গরাও ব্রেশ হতাশ হ’য়ে পড়লো, এত চেষ্টা ক’রে স্কুনারটিকে পেঙ্গুয়িন টিলার কাছে আনা হলো, আর এখন সেটাকে ঠিকমতো কাজে লাগানো যাবে না! মজাটা এই যে যদ্দিন তারা মউলকে দ্যাখেনি তদ্দিন তাদের কোনো হতাশা ছিলো না, বরং মনের মধ্যে এই আশাটাই ছিলো যে শিগগিরই একদিন কোনো-একটা জাহাজ তারা দখল ক’রে নিতে পারবে। এখন প্রায় কোনো চেষ্টা বিনাই একটা স্কুনার যেই তারা পেয়ে গেছে, এখন আর তাদের একটুও তর সইছে না।
কন্গ্রে তার স্যাঙাৎদের মন-খারাপ আলোচনায় বাধা দিয়ে বললে, ‘এ-সব ছোটোখাটো দোষত্রুটি সারিয়ে নেয়া যে উচিত, তা মানি। মউলের এখন যা দশা, তাতে তার উপর কোনো আস্থা রাখা যায় না। সম্ভবত সেইজন্যেই তার মাঝিমাল্লারা এটাকে এভাবে ফেলে রেখেই নৌকায় করে পালিয়ে গিয়েছে, যদি-র কথা কে বলতে পারে? তেমন মারাত্মক কোনো ঝড়তুফান হলেই জাহাজটি টুকরো-টুকরো হ’য়ে যেতে পারে। প্যাসিফিক আইল্যাণ্ডস এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে। জাহাজটাকে যদি সারাই না-ক’রে নিয়ে সাগর-পাড়ি দিতে যাই তাহ’লে পথে ডুবে মরারই সম্ভাবনা। তবে, এ-সব দোষ ত্রুটি সারানো যাবে—আমরা এ-সব মেরামত করে নেবোই।
ভার্গাস বললে, ‘কিন্তু মেরামত করবো কোথায়? এখানে ফাঁকা জায়গায়, খাড়ির মধ্যে? যে-কোনো সময়ে এখানে ঝড় উঠতে পারে। একবার ঝড়ের পাল্লায় পড়লে এর আর বাঁচোয়া নেই। ‘
আরেকটি চিলের লোকও সে-কথায় সায় দিলে : ‘কোনোমতেই এখানে মেরামতের কাজ চালানো যাবে না। অন্য-কোনো জায়গা বেছে নিতে হবে।’
কন্গ্রে দৃঢ় স্বরে জানালে ‘বেশ, আমরা এখান থেকে মউলকে ইগোর উপসাগরে নিয়ে যাবো।’
কন্গ্রে যা খুলে বললে, তাতে তার পরিকল্পনামতো জায়গাটিতে মউলকে নিয়ে যেতে আটচল্লিশ ঘণ্টা তো লাগবেই। লাগে লাগুক। কন্গ্রের পরিকল্পনা অন্তত তাদের মনে আস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে। পরদিন জোয়ারের সময়ে যাতে নির্দিষ্ট জায়গাটিতে চ’লে-যাওয়া যায় তারই প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেলো।
আলোকরক্ষীদের উপস্থিতিটাকে তারা আমলই দিলে না—সে নিয়ে তারা মাথা ঘামাতে রাজি নয়। কন্গ্রে অল্প কথায় তার পরিকল্পনাটা অন্য বোম্বেটেদের বুঝিয়ে বললে, ‘স্কুনারটি প্রস্তুত হবার সঙ্গে-সঙ্গে, যাত্রা শুরু করার আগে, আমি আবার ইগোর উপসাগরের ভার নেবো ব’লে ঠিক করেছি।’
তারপর সে সের্সান্তেকে যখন একান্তে পেলে, তখন প্ল্যানটা সে খুলে বললে, ‘আমি কিন্তু আমার মত পালটাইনি, শুধু একটু সংশোধন করেছি মাত্র। দ্বীপের ভেতরে গা ঢাকা দিয়ে না-থেকে, সরাসরি সমুদ্রপথ দিয়েই, ঘুরে গিয়ে আমরা উঠবো সেখানে, স্কুনারটি খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গি ক’রেই নোঙর ফেলবে। কেউ কোনো সন্দেহ করতে পারবে না যে আমরা ভালপারাইসো থেকে আসিনি, বরং সাগরপাড়ি দেবার সময় বিপদে প’ড়ে একটা জাহাজ অল্পক্ষণের জন্যে দ্বীপে আশ্রয় নিতে এসেছে ভেবে আমাদের স্বাগতই করা হবে। আর তারপর…..’
কন্গ্রের না-বলা কথাটা বুঝে নিতে কোনোই অসুবিধে হ’লো না সের্সান্তের—সে তাকে এত ভালো ক’রে চেনে যে যেন তার মনের কথাও পড়তে পারে।
এই জ্যান্ত শয়তান দুটি যে-ষড়যন্ত্র করেছে, তার সাফল্য সম্বন্ধে তাদের মনে কোনো সন্দেহই ছিলো না। বরং সম্ভাবনাটা এ-কথাই বলে যে তারা অনায়াসেই তাদের কাজ হাসিল করে নিতে পারবে।
যাত্রার প্রস্তুতিতেই সারাটা বিকেল কেটে গেলো। প্রথমে জাহাজে তোলা হ’লো প্রয়োজনীয় রসদ। তার পরেও হাতে অঢেল সময় আছে দেখে এখানকার গুহায় নিয়ে-আসা যাবতীয় জিনিশ জাহাজটিতে নিয়ে গিয়ে বোঝাই করা হ’লো। তাড়াহুড়ো ক’রেই মাল তোলার কাজটা তারা সারলে। বিকেল চারটে নাগাদ মালবোঝাই জাহাজটি নোঙর তোলবার জন্যে প্রস্তুত হ’য়ে রইলো।
তক্ষুনি যাত্রা করা যে চলতো না, তা নয়। কিন্তু রাতের বেলায় সমুদ্রের এদিকটায় জাহাজ চালাবার মতো মাথাব্যথা ছিলো না কন্গ্রের। হিশেব-টিশেব ক’রে সে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলো যে তাদের গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছুতে তিরিশ ঘণ্টার বেশি লাগবে না।
আস্তে-আস্তে সন্ধে ক’রে এলো। আবহাওয়া মোটামুটি শান্তই। সূর্য ডুবে গেলো বটে, কিন্তু কুয়াশা না-পড়ায় আকাশ ও সমুদ্রের দিকে তাকাতে কোনোই অসুবিধে হচ্ছিলো না। দিগন্তে যেখানে আকাশের গায়ে মিশেছে সমুদ্র, সূর্যাস্তর শেষ স্বর্ণরশ্মি সেখানে এক অপূর্ব মায়াজাল রচনা করেছিলো; রাত্রিটা মনে হ’লো শান্তই কাটবে। বেশির ভাগ লোকই জাহাজের ডেকে রাত কাটালে, কেউ-কেউ বার্থে। কন্গ্রে কাপ্তেনের চেয়ার দখল ক’রে বসলো, আর সের্সান্তে লেফটেনান্ট। রাতে অবিশ্যি কন্গ্রে বারকয়েক ডেকে এসে হাওয়ার গতি খেয়াল ক’রে দেখলে। না, সবকিছু ঠিকই আছে। ঝড়-তুফানের কোনো ভয় নেই।
সূর্যোদয়টাও হ’লো অপূর্ব জোতির্ময়। বছরে খুব কম দিনই এ-রকম সূর্যোদয় হয়। আকাশ যেন টলটলে নীল, স্বচ্ছ আর নির্মল, যেন তাতে নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের ছায়া পড়েছে।
একটা নৌকোয় ক’রে কন্গ্রে তীরে এলো। উদ্দেশ্য, একটা টিলার ওপর উঠে সমুদ্রের ওপর চোখ বোলাবে। প্রভাতী সূর্যের সোনালি আলোয় সুনীল নির্মল প্রশান্ত সমুদ্র ঝিকিয়ে উঠেছে। দক্ষিণ দিকের সমুদ্র এমনিতে শান্তই, তবে প্রণালীতে ঢোকবার মুখটায় জল খানিকটা উদ্দাম, কারণ ততক্ষণে ভোরের টাটকা হাওয়া দ্রুত বেগে বইতে শুরু করেছে। সমুদ্রের কোথাও কোনো জলপোতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে যে মউলের এই স্বল্পকালীন যাত্রায় অন্য-কোনো জাহাজের সঙ্গে দেখা হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
সবকিছু সরেজমিন তদন্ত ক’রে কন্গ্রে ঠিক করলে দ্বীপের পশ্চিম উপকূল দিয়েই কেপ ওয়েবস্টার, সেভারেল পয়েন্ট প্রভৃতি অন্তরীপ ঘুরে তাদের গন্তব্যস্থলে যাবে। তারপর সে টিলা থেকে নেমে পরিত্যক্ত গুহার ভেতর ঢুকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলো, কোনোকিছু তাদের নজর এড়িয়ে গেছে কিনা।
তখন বেলা সাতটার একটু বেশি। ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে। মউল নোঙর তুললো। তারপর উত্তর-পুব থেকে আসা অনুকূল হাওয়ায় ভর করে এগুবার চেষ্টা করতে লাগলো। দশ মিনিটের মধ্যেই খাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বারদরিয়ায় পড়লো মউল, আর তরতর করে এগিয়ে চললো।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেন্ট বার্থোলোমিউর পাহাড় ঘুরে অনুকূল হাওয়ায় গা এলিয়ে পুবদিকে চলতে লাগলো মউল।
এদিকে কंগ্রে আর সের্সান্তে তো মউলের হালচাল দেখে খুব খুশি, কন্গ্রে ইচ্ছে করলে সন্ধের আগেই হয়তো অনায়াসে ইগোর উপসাগরের প্রবেশ মুখে গিয়ে পৌঁছুতে পারতো। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিলো উপকূলের কোথাও থেমে গিয়ে পরদিনের সূর্যোদয় অব্দি অপেক্ষা করা। কাজেই তেমন তাড়া নেই ব’লে ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ-ছ মাইল বেগেই সে জাহাজ চালাবার ব্যবস্থা করলে।
সারাদিনের মধ্যে কোনো জাহাজই তারা দেখতে পেলো না সমুদ্রে, সন্ধের সময় তারা এসে পৌঁছুলো ওয়েবস্টার অন্তরীপের পুবদিকে, অর্থাৎ দিব্যি চমৎকার ভাবেই তাদের যাত্রার প্রথমার্ধ সমাপ্ত হ’লো। স্কুনারটি তীর থেকে খানিকটা দূরে নোঙর ফেললো।
আবহাওয়া আগের দিনের মতোই শান্ত ছিলো ব’লে জলদস্যুদের মলব সিদ্ধ হবার পুরো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাত দশটার সময় হাওয়ার বেগ থেমে গেলো, তারপর ফের ভোর যখন ফুটি-ফুটি তখন আরেকটা নতুন দিনের বার্তা বহন ক’রে আনলে টাটকা জোরালো হাওয়া। সূর্যের প্রথম আলো ফোটবার সঙ্গে-সঙ্গেই নোঙর তোলবার ব্যবস্থা করলে কন্গ্রে। মউল ফের ভেসে চললো তার নতুন লক্ষ্যের দিকে। কন্গ্রে কিন্তু মউলকে পুরোদমে চালায়নি, তীরের মাইল খানেক দূর দিয়ে অর্ধগতিতেই চলেছে মউল। এদিককার উপকূল কী-রকম তারা কেউই তা জানতো না বলেই অজানা তীরের গা ঘেঁষে চলবার সাহস করেনি কনগ্ৰো।
বেলা দশটার সময় তারা গিয়ে ব্লসম উপসাগরের মুখে পড়লো। এবারে জলের তোড়ের কাছে আত্মসমর্পণ ক’রে দেয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর ছিলো না। এখানে সমুদ্র যেন ফুঁসছে, তারই মধ্যে দিয়ে খুব সাবধানে স্কুনারটিকে চালাতে লাগলো তারা। বিকেল চারটের সময়ে দিগ্দশিকায় মাপজোক ক’রে কন্গ্রে আবিষ্কার করলে যে অনুকূল হাওয়া পাবে ব’লে তারা গন্তব্যস্থল থেকে বেশ খানিকটা দূরেই এসে পড়েছে। তখন সে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে সরাসরি ইগোর উপসাগরের দিকে জাহাজ চালাবার হুকুম দিলে। পয়েন্ট সেভারে তখন জাহাজ থেকে মাইল চারেক উত্তর-পশ্চিমে। দূরে তখন দেখা যাচ্ছে, ছায়ার মতো, সান্ হুয়ান অন্তরীপের উপকূল।
এখান থেকে পৃথিবীর একেবারে শেষ সীমানার আলোকস্তম্ভটির চূড়ায় চোখ পড়লো কন্গ্রের। কাপ্তেনের কামরায় যে-টেলিস্কোপটি ছিলো তাতে চোখ লাগিয়ে সে বাতিঘরের দিকে তাকালে। একজন আলোকরক্ষীকে দেখতে পেলে সে, আলোকরক্ষীটি লণ্ঠন-ঘরে ব’সে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।
তখনও সূর্যাস্ত হ’তে তিন ঘণ্টা বাকি। কন্গ্রে ঠিক করলে রাত ঘনিয়ে আসার আগেই সে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছুবার চেষ্টা করবে।
আলোকরক্ষীরাও যে মউলকে দেখতে পেয়েছিলো, সেটা বলাই বাহুল্য। প্রথমে যখন বাস্কেথরা তিনজনে স্কুনারটিকে দেখতে পেলে, ভাবলে যে সেটা সম্ভবত ফকল্যাণ্ড আইল্যাণ্ড যাচ্ছে। কিন্তু একটু বাদেই স্পষ্ট বোঝা গেলো, স্টটেন আইল্যাণ্ডই তার লক্ষ্য।
অবশ্য, মউলকে আলোকরক্ষীরা দেখতে পেয়েছে কি পায়নি এ নিয়ে কন্গ্রে কোনোই মাথা ঘামায়নি। তার মাথায় যে-ফন্দি খেলে গিয়েছে তাতে তারা দেখতে পেলো কি পেলো না, এতে কন্গ্রের ব’য়েই গেলো। সে বরং যাত্রার শেষ পর্বের নমুনা দেখে সন্তোষই লাভ করছিলো। তবে এবার যাত্রা বিঘ্নসংকুল। যে-কোনো সময়ে এদিক-ওদিক ছড়ানো ডুবো পাহাড়ের চুড়োয় ঘা লেগে মউল ভেঙে টুকরো-টুকরো হ’য়ে যেতে পারে।
এবং হ’লোও তাই। লক্ষ্যে পৌঁছুবার একটু আগে তার এক স্যাঙাৎ চেঁচিয়ে জানালে যে জাহাজে একটা ছ্যাঁদা হয়েছে আর সেখান দিয়ে খোলের মধ্যে জল ঢুকছে। তবে ফুটোটা নেহাৎই ছোটো ব’লে বাঁচোয়া। ভার্গাস কোনোমতে তাড়াহুড়ো করে সে-জায়গাটা মেরামত করে দিলে। পরে অবশ্য আরো ভালো ক’রে সারিয়ে নিতে হবে, তবে আপাতত এতেই কোনোরকমে কাজ চ’লে যাবে।
সন্ধে ছ-টার সময় মউল আস্তে-আস্তে এসে ইগোর উপসাগরে ঢোকবার মুখটায় পৌঁছুলো। আর সাড়ে-ছটার সময় বাতিঘরের উজ্জ্বল আলোয় সমুদ্র আলো হ’য়ে উঠলো। সামনে যে অন্ধকার ঘনাচ্ছিলো, বাতিঘরের আলোয় তা দূর হ’য়ে গেলো। সবেমাত্র তৈরি হয়েছে এই বাতিঘর আর সরাসরি তার দিকে ছুটে আসছে চিলের একটি স্কুনার, বাতিঘরের জীবনের প্রথম জাহাজ-যার মালিক—বাস্কেথরা জানে না—এখন একদল বেপরোয়া জলদস্যু। ক্রমশ তীরের দিকে এগিয়ে আসছিলো মউল।
কন্গ্রের ঠিক পেছনেই ডেকে দাঁড়িয়েছিলো সের্সান্তে। সে বললে, ‘পরিকল্পনার প্রথম পর্ব তাহ’লে ভালোভাবেই শেষ হলো!’
কন্গ্রে বাঁকা ভাবে বিচ্ছিরি হেসে বললে, ‘বাকি পর্বগুলো আরো ভালোভাবে শেষ হবে। এ নিয়ে তুমি অযথা কোনো চিন্তা কোরো না।
মিনিট কুড়ি বাদে তীরের কাছাকাছি পৌঁছে নোঙর ফেলবার উদ্যোগ করতে লাগলো মউল।
আর তক্ষুনি তীরের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে-থাকা দুটি লোক অভিনন্দন জানালে মউলকে।…হ্যাঁ, ফিলিপ আর মরিস। মউলের কাছে যাবার জন্যে দড়ি-দিয়ে-বাঁধা নৌকাটা খুলে তারা জলে ভাসালে। বাস্কেথ তখন লণ্ঠনঘরে তার কাজে ব্যস্ত।
ঠিক যখন ঘড়-ঘড় আওয়াজ করে মউলের নোঙর পড়ছে, তখনই ফিলিপ আর মরিস লাফ দিয়ে মউলের ডেকে উঠে পড়লো। কন্গ্রে একটা ইশারা করলে। অমনি চকচকে ধারালো একটা কুড়ুল নেমে এলো মরিসের ঘাড়ে। কোনো আর্তনাদ করবারও অবসর পেলে না সে, তৎক্ষণাৎ সে ডেকের ওপর ছিটকে প’ড়ে গেলো। আর পরক্ষণেই একসঙ্গে দুটো রিভলভার গর্জে উঠলো, আর ফিলিপও বন্ধুর পাশে লুটিয়ে পড়লো। মরতে তাদের এক লহমারও বেশি লাগলো না।
বাস্কেথ তখন লণ্ঠনঘরের জানলার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। আচমকা বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো রিভলভারের শব্দ কানে পৌঁছুলো ‘তার- সহকর্মীদের এমন নৃশংস হত্যা দেখে সে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। কারা আছে এই জাহাজে? মিথ্যেমিথ্যি, অকারণে, কোনো কথা না-ব’লেই তারা ফিলিপ আর মরিসকে মারলো কেন? উত্তর খোঁজার মতো সময় তার নেই। এই অজ্ঞাতপরিচয় খুনেগুলো যদি তার সন্ধান পায়, তবে তার কপালেও অমনি অতর্কিত মৃত্যু আছে। খুনেগুলো কারা, তা সে জানে না, তবে তাদের অভিধানে দয়া ব’লে যে কোনো শব্দ নেই তা তো বোঝাই যাচ্ছে। হতভাগ্য ফিলিপ আর মরিস! তাদের বাঁচাবার জন্যে সে কিছুই করতে পারেনি। কী করবে, স্থির করতে না-পেরে বাস্কেথ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। চিলের ভালপারাইসো বন্দর থেকে আসা কোনো জাহাজের লোক কেন এভাবে আলোকরক্ষীদের খুন করবে, সেটা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছিলো না।
কতক্ষণ সে ও-রকম হতভম্বের মতো ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকিয়েছিলো জানে না, তবে সংবিৎ ফিতে পেতেই সে মনে-মনে তার কর্তব্য ঠিক ক’রে ফেললে। তার প্রথম এবং আশু কর্তব্য : যে-ক’রেই হোক এই খুনে শয়তানগুলোর হাত থেকে আত্মরক্ষা করা। হয়তো তাদের জানা নেই যে দ্বীপে তৃতীয় একজন আলোকরক্ষীও আছে। তবে সেটা তো ‘হয়তো’র কথা। আর না-যদি জেনেও থাকে, জানতে কতক্ষণ? জাহাজটি তীরে ভেড়াবার সঙ্গে-সঙ্গেই তারা বাতিঘরে ছুটে আসবে, বাতিঘরের আলোও নিশ্চয়ই নিভিয়ে দেবে, অন্ধকারের অভিশাপে ডুবিয়ে দেবে সমুদ্র। ফিলিপ আর মরিসকে তারা নিশ্চয়ই আগেকার কোনো শত্রুতার জন্যে মারেনি—মেরেছে নিশ্চয়ই তারা যে বাতিঘরের আলোকরক্ষী, সেই জন্যেই। তাদের আসল শত্রুতা নিশ্চয়ই এই আলোর সঙ্গে।
এটা ভাবতে তার প্রায় কোনো সময়ই লাগেনি। এক মুহূর্তও ইতস্তত না-ক’রে সে লণ্ঠনঘর থেকে নিচে নেমে এলো। নষ্ট করবার মতো একফোঁটাও সময় নেই তার হাতে। স্কুনারটি থেকে তখন জলে নৌকো ভাসাবার তোড়জোড় চলছে। অর্থাৎ, তার মৃত্যুদূতেরা এগিয়ে আসছে সুনিশ্চিত বাস্কেথ তাড়াতাড়ি গোটা কয়েক রিভলভার কোমরের বেল্টে গুঁজে একটা ব্যাগের মধ্যে প্রচুর গুলি-বারুদ, কিছু খাবার আর অন্য দু-একটা জরুরি জিনিশ ভ’রে হুড়মুড় করে বাতিঘরের লাগোয়া ঢালু জমিটায় নেমে পড়লো। যে ক’রেই হোক, অন্ধকারের মধ্যে তাকে গা ঢাকা দিতে হবে, এক্ষুনি।