ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

০৫. আস্তানা

০৫. আস্তানা

রেড ইন্ডিয়ানদের তাবুর চারপাশে দুদিন টহল দিল নেকড়ে-সুন্দরী আর তার বর একচোখে বুড়ো। দলবদ্ধ মানুষ যেখানে ডেরা বাঁধে, তার কাছাকাছি থাকা যে নিরাপদ নয়, সে কথা জানে একচোখো। কিন্তু কোন অজানা আকর্ষণের মোহে তার বউ ওই মানুষদের তাঁবুর আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে, তা বুঝতে পারে না সে- তবু নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই সে ঘুরতে থাকে বউ-এর পিছু পিছু।

দুদিন পরে এক সকালে নেকড়ে-সুন্দরীর মোহভঙ্গ হল। শান্ত বনানীর স্তব্ধতা ভঙ্গ করে গর্জে উঠল রাইফেল, একচোখের মাথার উপর দিয়ে সাঁ করে একটা বুলেট ছুটে গিয়ে একটা গাছের গুঁড়িকে বিদ্ধ করল। তৎক্ষণাৎ তীরবেগে স্থানত্যাগ করল স্বামী-স্ত্রী, অগ্নিবর্ষী রাইফেলের সাংঘাতিক মহিমা তাদের অজানা নয়…

আরও দুদিন ছোটাছুটি করার পর নেকড়ে-বউ সেই প্রার্থিত বস্তু খুঁজে পেল, যার জন্য হন্যে হয়ে সে পার হয়ে এসেছে দীর্ঘ বনপথ। একটা জমে-যাওয়া পাহাড়ে নদীর ধারে নিচু-ছাতের গুহাটাকে আবিষ্কার করে ভারি খুশি হল। নেকড়ে-বউ, এমন একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যই সে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

…ওই গুহার মধ্যেই একদিন জন্মগ্রহণ করল পাঁচটি বাচ্চা। একচোখো খুব অবাক হয়ে বাচ্চাগুলোকে ভালোভাবে দেখার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার বউ দাঁত খিঁচিয়ে তাকে এমন ধমক দিল যে, আত্মরক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে তাকে পিছিয়ে আসতে হল।

একচোখো তার দীর্ঘ জীবনে অনেকবারই বাচ্চাদের জন্ম নিতে দেখেছে। প্রত্যেকবারই সে আশ্চর্য হয়েছে, কিন্তু জন্মগ্রহণের রহস্যটা কখনোই সমাধান করতে পারেনি। নেকড়ে-সুন্দরী এই প্রথমবার মা হল। মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বন্যপশুর সহজাত অনুভূতি দিয়ে সে বুঝতে পারছিল বাপের সান্নিধ্য নেকড়ে শিশুদের পক্ষে নিরাপদ নয়। বাচ্চার উপর নেকড়ে-মার যথেষ্ট মমতা থাকলেও নেকড়ে-বাপ সুযোগ পেলে নিজের বাচ্চার রক্তমাংসে ক্ষুধানিবারণ করতে একটুও ইতস্তত করে না। অবশ্য একচোখোর তেমন কোনো দুরভিসন্ধি ছিল না, সে এই ছোটো ছোটো আজব জীবগুলোকে একটু ভালোভাবে দেখতে চেয়েছিল– কিন্তু বউ-এর আপত্তি দেখে সে পিছিয়ে গেল।

নেকড়ে শিশু একটু বড়ো না হওয়া পর্যন্ত নেকড়ে-মা বাচ্চা ছেড়ে কোথাও যায় না; অতএব তার পক্ষে শিকার সংগ্রহ করাও সেইসময় অসম্ভব। সেইজন্যেই তখন নেকড়ে-বাপ শিকার নিয়ে আসে নেকড়ে-মার জন্য। নেকড়ে-মা শিকারের ভাগ নেয় বটে, কিন্তু তার আস্তানার মধ্যে স্বামীকে ঢুকতে দেয় না কখনোই। বাচ্চারা বেঁচে থাকে মায়ের দুধ খেয়ে আর নেকড়ে-মা বাঁচে তার স্বামীর সংগৃহীত শিকারের মাংস ভক্ষণ করে।

যে পার্বতীর নদীর পার্শ্ববর্তী গুহায় আমাদের নেকড়ে-সুন্দরী তার বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল, সেই নদীটা গুহার থেকে পাঁচ-ছয় মাইল দুরে হঠাৎ পাহাড়ের ভিতর পথ করে দু-ভাগ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এখন আর নদীতে জল নেই, রয়েছে জমাট বরফের নিরেট পথ। বাঁ দিকের মসৃণ বরফ-ঢাকা পথের উপর দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একচোখো বুড়ো হঠাৎ একটা জানোয়ারের পায়ের ছাপ দেখতে পেল। পায়ের ছাপগুলো দেখে বুয়ে চমকে গেল- জানোয়ারটার থাবা তার থাবার চাইতে বড়ো। পদচিহ্নের মালিকের সঙ্গে শুভদৃষ্টি হয়ে গেলে তার ফল যে বিশেষ শুভ হবে না সেকথা খুব সহজেই বুঝতে পারল বুড়ো। অতএব বাঁদিকের বিপজ্জনক পথ ধরে না এগিয়ে ডানদিকের নিরাপদ পথটা ধরেই শিকারের খোঁজে এগিয়ে চলল সে।

কিছুক্ষণ পথ চলার পর সে একটা শজারুর সামনে এসে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে শজারুটা শরীর গুটিয়ে গোলাকার ধারণ করল এবং তার সর্বাঙ্গের কাঁটাগুলো এমনভাবে খাড়া হয়ে উঠল যে, সেই কাটার ব্যুহ ভেদ করে কোনো শত্রুর পক্ষেই তার দেহের উপর আক্রমণ চালানো সম্ভব নয়। ছোটোবেলায় একচোখোর নাকের উপরে একটা সজারু তার কটাবসানো লেজ দিয়ে আঘাত করেছিল। তার ফলে নাক নিয়ে তাকে ভুগতে হয়েছিল অনেকদিন। শৈশবের সেই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা সে কখনো ভোলেনি। একচোখো জানত শজারু যদি একবার গোল হয়ে যায়, তাহলে তাকে আঘাত করা অসম্ভব। তবে বৃত্তটা খুলে নেওয়ার সময় দেহের তলার দিকে আঘাত হানতে পারলে তাকে কাবু করা কঠিন নয়। অতএব যদি জন্তুটা বৃত্ত ভেঙে স্বাভাবিক হয় সেই আশায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল একচোখো বুড়ো…

অপেক্ষা করাই সার। পাক্কা আধঘণ্টা চুপচাপ বসে রইল একচোখো, শজারু তখনও স্থির হয়ে পড়ে আছে কাটা বসানো একটা গোলাকার বস্তুর মতো। অবশেষে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল একচোখো– অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে শজারু একবার গোলাকৃতি ধারণ করলে কখন যে বৃত্ত ভেঙে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে তা বলা যায় না। সুতরাং সময় নষ্ট না করে সে অন্য শিকারের সন্ধানে যাত্রা করল…

সন্ধ্যার দিকে একটা টার্মিগান পাখিকে সে ঘায়েল করল। মাটির উপর পড়ে-থাকা একটা। গাছের গুঁড়ির উপর বসেছিল পাখিটা, হঠাৎ তার সামনে এসে পড়ল একচোখো। টার্মিগান আত্মরক্ষার সুযোগ পেল না, ডানা মেলে শূন্যে ঝাঁপ দেওয়ার আগেই একজোড়া দাঁতালো চোয়ালের ফাঁদে সে বন্দি হল। রক্তের স্বাদ পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই বুড়ো খেতে শুরু করল। কিছুটা মাংস উদরস্থ করার পরই তার মনে পড়ে গেল গুহার ভিতর অপেক্ষমান উপবাসী সঙ্গিনীর কথা। পাখিটাকে মুখে নিয়ে সে পদচালনা করল গুহার দিকে। কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ এক অভাবিত দৃশ্য ভেসে উঠল তার চোখের সামনে–

শজারুটা ঠিক আগের মতোই কাঁটা উঁচিয়ে গোল হয়ে পড়ে আছে, আর তার সামনেই স্থির হয়ে বসে অপেক্ষা করছে একটা স্ত্রী-জাতীয় লিংক্স।

এখানে গল্প থামিয়ে লিংক্স নামে জন্তুটার একটু পরিচয় দিচ্ছি। কারণ, তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো ওই জন্তুটির সঙ্গে পরিচিত নও। লিংক্স এক ধরনের বনবিড়াল, অত্যন্ত হিংস্র ও বেপরোয়া। জন্তুটাকে দেখামাত্র মুখের শিকার মাটিতে ফেলে ঝোপের আড়ালে শুয়ে পড়ল একচোখে তার একটি মাত্র চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হল লিংক্স আর শজারুর দিকে।

অনেকক্ষণ কাটল। ঝোপের ভিতর কানা বুভো অনড় অচল, ঝোপের বাইরে ফাঁকা জায়গায় শজারু যেন একটা কাঁটাবসানো গোলকার বস্তু, তার সামনে নীরব নিস্পন্দ লিংক্স যেন একটা প্রাণহীন পাথরের মূর্তি কেউ নড়ছে না। হঠাৎ শজারুর শরীরটা নড়ে উঠল, খুব ধীরে ধীরে বৃত্তটাকে সে খুলে ফেলতে লাগল। কিন্তু গোলাকৃতি শরীরটা স্বাভাবিক আকার ধারণ করার আগেই সে লিংক্সকে দেখতে পেল; আর তৎক্ষণাৎ একটা নখরযুক্ত থাবা অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে আঘাত হানল। শজারুর পেটের মাংস ধারাল নখের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার শরীরটা যদি বৃত্ত ভেঙে স্বাভাবিক আকার ধারণ করত অথবা আর একমুহূর্ত পরে যদি শজারু তার শত্রুকে আবিষ্কার করত, তাহলে থাবাটা হয়তো নিরাপদেই ফিরে যেত; কিন্তু তা হল না কাটা বসানো লেজ পালটা আঘাত হানল, কয়েকটা কাটা বিধে গেল লিংক্সের থাবায়।

দারুণ ক্রোধে লিংক্সের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেল, সে ঝাঁপিয়ে পড়ল শজারুর উপর। হঠকারিতার ফল পেল সে তৎক্ষণাৎ- শজারুর কাটাবসানো লেজ চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল লিংক্সের মুখের উপর। তীব্র আর্তনাদ করে সরে গেল লিংক্স, তার নাকে বিধে গেছে অনেকগুলো কাটা!

শূন্যে লাফ মারতে মারতে বনের পথে অদৃশ্য হয়ে গেল আহত বনবিড়ালী। এইবার নির্ভয়ে শজারুর কাছে এগিয়ে গেল একচোখো বুড়ো। লিংক্সের থাবায় ভীষণভাবে আহত হয়েছিল শজারু। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে মৃত্যুবরণ করল। টার্মিগান পাখিটাকে তখনই খেয়ে ফেলল একচোখো, তারপর মৃত শজারুর দেহ মুখে নিয়ে ছুটল আস্তানার দিকে…।

শজারুটাকে পেয়ে খুব খুশি হল নেকড়ে-বউ। একবার সোহাগ করে সে স্বামীর ঘাড় চেটে দিল। কিন্তু পর মুহূর্তেই চাপা গর্জন করে জানিয়ে দিল শিকার পেয়ে সে সন্তুষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু বাচ্চাদের কাছে গেলে সে স্বামীর গায়ে দাঁত বসাতে একটুও দেরি করবে না।

একচোখো বোকা নয়, নেকড়ে সমাজের আইন সে জানে সে একবারও গুহার ভিতর যাওয়ার চেষ্টা করল না।

.

০৬. ধূসরবর্ণ নেকড়েশাবক

নেকড়ে-সুন্দরীর চারটি বাচ্চা হয়েছিল তাদের মায়ের মতন। মায়ের মতোই লাল রং-এর ছোঁয়া ছিল তাদের শরীরে। কিন্তু একটা বাচ্চা হল বাপের মতো ধূসর বর্ণের অধিকারি। শুধু গায়ের রং নয়, শরীরের গঠনেও বাচ্চাটার সঙ্গে তার বাপের যথেষ্ট মিল ছিল তাদের শরীরে। তবে বাপের যেমন একটা চোখ অন্ধ, বাচ্চার তা ছিল না– দুটি স্বাভাবিক চক্ষু নিয়েই জন্মগ্রহ করেছিল সে।

কুকুর-বিড়ালের বাচ্চার মতোই নেকড়েশিশু জন্মের সময় অন্ধ থাকে, কিছুকাল পরে তার চোখ ফোটে। প্রায় একমাস কাটল, নেকড়ে-সুন্দরীর বাচ্চারা এখন চোখ ফুটে দৃষ্টিশক্তির অধিকারি- মায়ের দুধে তাদের এখন খিদে মেটে না, তাদের এখন মাংস চাই। নেকড়ে-সুন্দরী কিছুটা হজম-হওয়া মাংস পেট থেকে উগরে ফেললে সেই উঞ্জীর্ণ মাংস খায় পাঁচটি নেকড়ে শাবক।

গুহার ভিতর অন্ধকার, বাইরে আলোর দেয়াল। সেই আলোর কাছে যাওয়ার নিয়ম নেই বাচ্চাদের। নেকড়ে-সুন্দরী কোনো বাচ্চাকে সেই আলোর দুনিয়াতে পা বাড়াতে দেয় না। ছাই-রঙা ধূসর বাচ্চাটার কাছে ঐ আলোর দেয়ালটা রহস্যময় মনে হয়। গুহার দেয়ালে নাক ঠেকালেই সে আঘাত পায়– সে বুঝেছে দেয়াল ভেদ করে যাতায়াত করা যায় না। কিন্তু তার বাপ একচোখো ওই আলোর দেয়াল ভেদ করে যখন-তখন কেমন করে অদৃশ্য হয়ে যায় সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। (এর মধ্যে একচোখোকে সে বাপ বলে জানতে পেরেছে। গুহার মধ্যে মায়ের মতো বাপও থাকে। তবে ভিতরের দিকে নয়, বাইরের দিকে আলোর দেয়ালের খুব কাছাকাছি। মাঝে মাঝে আলোর দেয়াল ভেদ করে সে কোথায় যেন চলে যায়, আবার ফিরে আসে তাদের জন্য মাংস নিয়ে।)।

বাচ্চারা বড়ো হয়ে উঠতে লাগল। হঠাৎ একসময়ে ঘনিয়ে এল বন্যজীবনের অনিবার্য বিপদ– দুর্ভিক্ষ! মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে গেল, সেইসঙ্গে বন্ধ হল মাংসের সরবরাহ। বাচ্চাগুলো না খেতে পেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম আর ভাঙল না। কিন্তু ছাইরঙা বাচ্চাটা বেঁচে রইল। খুব সামান্য হলেও কিছু কিছু শিকার নিয়ে আসছিল কানা বুড়ো। সেই মাংস খেয়ে কোনোরকমে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে আত্মরক্ষা করল ধূসর বাচ্চাটা।

তারপর একসময়ে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল একচোখো বুড়ো। বাচ্চাটা আর তাকে দেখতে পেল না। তার মা অবশ্য জানত একচোখো আর কোনোদিন ফিরবে না, কিন্তু সেই খবরটা বাচ্চাকে জানিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। খিদের জ্বালায় অস্থির হয়ে নেকড়ে-মা একদিন পাহাড়ে-নদীর বাঁদিকের শাখা ধরে এগিয়েছিল লিংক্সের আস্তানার দিকে। কারণ, ওই পথ ধরেই চলে গিয়েছিল একচোখোর পায়ের ছাপ। পথের শেষে একচোখোকে দেখতে পেয়েছিল নেকড়ে-মা। না, ঠিক একচোখোকে নয়– তার শরীরের কিছু অংশ নেকড়ে-মার চোখে পড়েছিল। সমস্ত জায়গাটা জুড়ে একটা সাংঘাতিক লড়াই-এর চিহ্ন ছিল। লড়াই জিতে লিংক্স যে তার নিজস্ব আস্তানায় ফিরে গিয়েছিল, পায়ের ছাপ দেখে তা বুঝতে পেরেছিল নেকড়ে-মা। সে আর অগ্রসর হতে সাহস পায়নি। লিংক্সের আস্তানার সামনে থেকেই সে ফিরে এসেছিল। সে জানত ওই আস্তানার মধ্যে কয়েকটা বাচ্চা আছে। লিংক্স অত্যন্ত বদমেজাজি জন্তু, বিশেষ করে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য মা-লিংক্স সব সময়ই মারমুখী হয়ে থাকে- নেকড়ে-সুন্দরী তাই আর এগোতে সাহস পায়নি। পাঁচ ছয়টা নেকড়ে মিলে একটা লিংক্সকে তাড়া করা যায়, কিন্তু এককভাবে ওই ভয়ংকর জানোয়ারের বিরুদ্ধে কোনো নেকড়েই লড়াই করতে চায় না।

তবু মায়ের প্রাণ বলে কথা– সন্তানের জন্য আহার সংগ্রহ করতে একদিন নেকড়ে-সুন্দরী হানা দিয়েছিল লিংক্সের আস্তানায়। কিন্তু সে সব কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।

.

০৭. শ্বাপদশিশুর দুনিয়া

বাচ্চাটা ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগল। তার মা এখন তাকে একা রেখে বাইরে চলে যায় শিকার সংগ্রহের জন্যে। বাইরের আলোর দেয়ালটা তাকে আকর্ষণ করে, কিন্তু এক অজানা ভয়ে সে আড়ষ্ট হয়ে থাকে- গুহার অন্ধকার আশ্রয় ছেড়ে ওই আলোর দেয়ালের দিকে পা বাড়াতে তার ভরসা হয় না।

অবশেষে একদিন ভয় ছাপিয়ে কৌতূহল বড়ো হয়ে উঠল। মায়ের নিষেধ অমান্য করে আলোর দেয়ালের ভিতর এসে দাঁড়াল ছাই-রঙা নেকড়ে-বাচ্চা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাচ্চাটার ছোট্ট জীবনে অনেকগুলো চমকপ্রদ ঘটনা ঘটল। প্রথমেই উঁচু জমি থেকে গড়িয়ে সে নীচে পড়ে গেল, ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। তারপর একটু সামলে নিয়ে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ হুড়মুড় করে গাছের গুঁড়ি বেয়ে একেবারে তার ঘাড়ের উপর এসে পড়ল একটা কাঠবিড়ালি। দুজনের মধ্যে কে বেশি ভয় পেয়েছিল বলা মুশকিল। তবে কাঠবিড়ালি পালিয়ে যেতেই বাচ্চাটার সাহস বাড়ল। তারপর একটা কাঠঠোকরা পাখিকে দেখে সে চমকে গিয়েছিল বটে, কিন্তু ভয় পেয়ে থেমে যায়নি; যে-রাস্তা ধরে সে চলছিল সেই রাস্তা ধরেই সে এগোতে লাগল। এরপর তার সামনে পড়ল একটা মুজ-বার্ড। ওই পাখিগুলো মুজ হরিণের পিঠে বসে তার গায়ের পোকা বেছে খায়। বাচ্চাটার এখন বেশ হিস হয়ে গেছে, সে থাবা বাড়িয়ে দিল পাখিটার দিকে। সঙ্গেসঙ্গে সে নাকের উপর এক দারুণ ঠোকর খেয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। পাখিটা তার চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ডানা মেলে শূন্যপথে উধাও হয়ে গেল।

বাচ্চাটা এতক্ষণে বেশ কিছু শিখেছে। জঙ্গলের পথে হাঁটা-চলার কায়দা সে আয়ত্ত করেছে, শিখেছে দূরত্ব মাপতে আর বুঝতে পারছে তার শারীরিক ক্ষমতার সীমা কতটুকু।

নিতান্তই আকস্মিকভাবে আরও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হল সে। মাটির উপর পড়ে-থাকা একটা গাছের গুঁড়ির উপর লুকানো ছিল টার্মিগান পাখির বাসা। বাসাটার ভিতর ছিল সাতটা বাচ্চা টার্মিগান। হঠাৎ পা ফসকে সেই বাসাটার ভিতর এসে পড়ল নেকড়ে-বাচ্চা। টার্মিগান পাখির বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে কিচির মিচির করে উঠতেই ঘাবড়ে গেল নেকড়েশাবক। তারপর যখন সে দেখল পাখির বাচ্চাগুলো তার চেয়ে অনেক ছোটো, তখন সে সাহস করে একটাকে মুখে তুলে নিল। তার দুই চোয়াল সজোরে বন্ধ হতেই কড়মড় শব্দে ভেঙে গেল নরম হাড় আর গরম রক্ত ঝরে পড়ল তার মুখের ভিতর। বাঃ, স্বাদটা তত বেশ! একে একে সাতটা টার্মিগান-বাচ্চাকেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলল নেকড়েশাবক।

খাওয়ার পর ঠোঁট চাটতে চাটতে নেকড়ে-বাচ্চা ঝোপের বাইরে আসতে চেষ্টা করল। সঙ্গেসঙ্গে একটা ঝড় যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। একজোড়া ডানার ক্রুদ্ধ ঝাঁপটা তাকে প্রায় অন্ধ করে দিল। আঘাতের পর আঘাতে বিপর্যস্ত বাচ্চাটা থাবার মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সন্তানের শোকে মা-টার্মিগান তখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে; ক্রমাগত ডানা দিয়ে সে আঘাত হানতে লাগল নেকড়ে শাবকের মুখে-চোখে, সর্বাঙ্গে। নিরুপায় বাচ্চাটা এবার প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার ছোটো ছোটো দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল মা-টার্মিগানের একটি ডানা।

একটা ডানা নেকড়েশাবকের মুখের মধ্যে বন্দি, অন্য ডানাটা দিয়ে বার বার আঘাত করে। নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল টার্মিগান পাখি, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না। পাখিটা যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করল, পটাপট ঠোকর মারতে লাগল বাচ্চাটার নাকে। এইবার রণে ভঙ্গ দিল নেকড়ে শিশু। লেজ গুটিয়ে সে ছুটল পিছন ফিরে, তার লক্ষ্য এখন ফাঁকা মাঠের উলটোদিকের ঝোপজঙ্গল। উলটোদিকের ঝোপটার কিনারে এসে সে বিশ্রাম গ্রহণের জন্য থামল। তার জিভ তখন বেরিয়ে পড়েছে মুখের বাইরে, ছোট্ট বুকটা ভীষণ জোরে উঠছে আর নামছে দ্রুত শ্বাস গ্রহণের ফলে এবং তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে চাপা কান্নার আওয়াজ। হঠাৎ আসন্ন বিপদের অনুভূতি তার চেতনায় আঘাত হানল। চটপট ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে। সঙ্গেসঙ্গে একটা ডানা-মেলা প্রকাণ্ড শরীর ছোঁ মেরে মাটির কাছে এসে আবার শূন্যপথে নিঃশব্দে উধাও হয়ে গেল। ডানার আঘাতে ছিটকে আসা বাতাসের ধাক্কা লাগল বাচ্চাটার দেহে, একটুর জন্য ব্যর্থ হয়ে গেল বাজপাখির নিশানা। বাচ্চাটা যখন ঝোপের মধ্যে শুয়ে কাঁপছে, সেইসময় উলটোদিকের ঝোপ থেকে ফাঁকা জায়গার উপর বেরিয়ে এল মা-টার্মিগান। সন্তানের শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল বলেই আকাশ পথে ভাসমান বিভীষিকার দিকে সে নজর দেয়নি। বাজ আবার ছোঁ মারল। এবার তার লক্ষ্য ব্যর্থ হল না– নখে বিদ্ধ টার্মিগানকে নিয়ে নীল আকাশের বুকে অন্তর্ধান করল বাজপাখি।

আর একটা মস্ত শিক্ষা গ্রহণ করল নেকড়ে শাবক। জীবন্ত প্রাণী মানেই জ্যান্ত খাবার। ছোটোখাটো প্রাণীকে শিকার করা নিরাপদ হলেও বৃহৎ আকারের কোনো প্রাণীকে আক্রমণ করলে বিপদ ঘটতে পারে। সুতরাং ছোটোখাটো দুর্বলকে মারো আর বড়োসড়ো সবলকে এড়িয়ে যাও- অরণ্যের এই অলিখিত আইনকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুঝতে পারল বাচ্চাটা।

আরও অনেক কিছুই জানতে বাকি ছিল তার। প্রতি মুহূর্তে বিপদের মুখোমুখি হয়ে বন্যজীবনের শিক্ষা গ্রহণ করছিল সে। পাহাড়ে নদীতে নেমে বাচ্চাটা দুরন্ত স্রোতে ভেসে গেল। কোনোরকমে বেঁচে গিয়ে সে বুঝতে পারল জল জীবন্ত প্রাণী নয়, কিন্তু প্রাণীর মতোই সে ছুটতে পারে তীব্র বেগে। তাছাড়া জল দেখলে নিরেট বলে মনে হলেও বস্তুটি আদৌ মাটির মতো নিরেট নয়। অর্থাৎ চোখে সব বস্তুর স্বরূপ নির্ণয় করা যায় না। অপরিচিত প্রত্যেক বস্তুকেই বাচ্চাটা অবিশ্বাস করতে শিখল।

এতো কিছু জানা-বোঝার পরেও আরও একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা তার জন্যে সেইদিন অপেক্ষা করছিল। ফেলে আসা গুহাটার সন্ধানে সে এগিয়ে চলছিল বনের ভিতর দিয়ে। মনে মনে অত্যন্ত নিরুপায় আর নিঃসঙ্গ বোধ করছিল সে। হঠাৎ একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার তাকে চমকে দিল। পরক্ষণেই তার সামনে ছিটকে উঠল হলুদ বিদ্যুৎরেখা?- নেকড়ে শাবক দেখল একটা বাচ্চা উইজেল তার সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে! (উইজেল বেজি-জাতীয় পশু। আকারে ছোটো হলেও এরা ভীষণ হিংস্র প্রাণী।) নেকড়ে বাচ্চা তার পূর্ব অভিজ্ঞতার ফলে জেনে গেছে যেসব প্রাণী আকারে ছোটো তারা দুর্বল এবং তাদের হত্যা করা খুবই সহজ। অতএব চটপট এগিয়ে গিয়ে উইজেল-বাচ্চাকে এক থাবা মেরে সে শুইয়ে দিল। সঙ্গেসঙ্গে তার কানের পর্দায় ঘা দিয়ে বেজে উঠলো তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার, সঙ্গেসঙ্গে ঘাড়ের উপর দারুণ আঘাত নিষ্ঠুর দংশনে ঘাড়ের মাংস ভেদ করে বসে গেছে মা-উইজেলের ধারাল দাঁত!

যন্ত্রণায় কাঁদতে কাঁদতে সে পিছিয়ে গেল এবং সেই অবস্থাতেই দেখতে পেল মা-উইজেল তার বাচ্চা নিয়ে পাশের ঝোপে প্রবেশ করছে। নেকড়েশিশু যতটা ব্যথা পেয়েছিল, তার চাইতে অনেক বেশি অপমানিত বোধ করেছিল। মা-উইজেল আকারে খুবই ছোটো, কিন্তু কী ভয়ংকর তার আঘাত করার ক্ষমতা নেকড়ের বাচ্চাটা তখনও জানে না বন্যজগতের চতুষ্পদ শিকারিদের মধ্যে আকারে ছোটো হলেও উইজেল অত্যন্ত হিংস্র, নিভকি ও প্রতিশোধপরায়ণ জীব। একটু পরেই ওই ক্ষুদ্রকায় পশুর ভয়ংকর স্বভাবের পরিচয় পেল নেকড়ের বাচ্চাটা।

মা-উইজেল আবার যখন ফিরে এল, তখনও নেকড়েশিশুর গলা থেকে চাপা কান্নার রেশ মিলিয়ে যায়নি। তীব্রকণ্ঠে বার বার চিৎকার করে উঠল মা-উইজেল, দারুণ আতঙ্কে খাড়া হয়ে উঠল বাচ্চাটার পিঠের লোম– বার বার দাঁত খিঁচিয়ে শত্রুকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল নেকড়ের বাচ্চা। বিদ্যুৎচমকের মতো একটা দীর্ঘ শরীর মাটি থেকে সাপের মতো ছিটকে উঠল এবং পরক্ষণেই মা-উইজেলের ধারাল দাঁতের কামড় বসল নেকড়েশাবকের গলায়। বাচ্চাটা লড়াই করার চেষ্টা করল, কিন্তু সে নিতান্ত অনভিজ্ঞ শিশু- কিছুতেই উইজেলের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। উইজেল জীবন্ত প্রাণীর দেহ থেকে রক্তপান করতে ভালোবাসে, ক্রমশ কঠিন থেকে আরও-কঠিন হয়ে চেপে বসতে লাগল তার নিষ্ঠুর দংশন বাচ্চাটার গলার উপর– কণ্ঠনালীর যেখানে প্রধান রক্তবাহী শিরা রয়েছে, সেইখানেই ধীরে ধীরে স্থির লক্ষ্যে বসে যেতে লাগল দাঁতের সারি।

ছাইরঙা বাচ্চাটার সেইদিনই মৃত্যু ঘটত, যদি না হঠাৎ অকুস্থলে এসে পড়ত নেকড়ে-সুন্দরী। ছেলের কান্না শুনে বহুদূর, থেকে ছুটে এসেছে সে। উইজেল এবার বাচ্চাকে ছেড়ে মায়ের গলা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। লক্ষ্য ব্যর্থ হল, গলার বদলে মা-নেকড়ের চোয়ালের উপর বসে গেল উইজেলের দাঁত।

যেমনভাবে মানুষ চাবুক চালায়, ঠিক সেইভাবেই সজোরে মাথায় এক ঝাঁকুনি দিল মা-নেকড়ে– সঙ্গেসঙ্গে চোয়ালের উপর থেকে খুলে গেল উইজেলের দাঁতের বাঁধন এবং ঝাঁকুনির বেগে তার দীর্ঘ শরীর ছিটকে উপরে উঠে গেল। উইজেল আর মাটিতে নেমে লড়াই করার সুযোগ পেল না– নেকড়ে-সুন্দরী শূন্যপথেই তাকে লুফে নিল দুই চোয়ালের ফাঁকে। পরক্ষণেই সশব্দে ভেঙে গেল রক্তলোলুপ প্রাণীটার অস্থিপঞ্জর, নেকড়ে-সুন্দরীর মুখের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল উইজেল।

এইবার ভোজের পালা। মা আর ছেলে ভাগাভাগি করে উইজেলের দেহটাকে খেয়ে ফেলল, তারপর গুহায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

০৮. খাদ্য ও খাদক

নেকড়ে-সুন্দরীর বাচ্চাটা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠতে লাগল। দুদিন বিশ্রাম নিয়েও সে আবার গুহার বাইরে ঘোরঘুরি শুরু করল। যে উইজেলটাকে নেকড়ে-সুন্দরী হত্যা করেছিল, তার ছোটো বাচ্চাটাকে হঠাৎ একদিন বনের মধ্যে দেখতে পেল নেকড়ে শাবক। সঙ্গেসঙ্গে বাচ্চটাকে মেরে খেয়ে ফেলল সে। এবার আর বনের মধ্যে পথ হারায়নি সে, তাদের আস্তানায় নিরাপদেই ফিরে এসেছিল নেকড়ে-শাবক।

ধীরে ধীরে নিজের শক্তি সম্বন্ধে সে সচেতন হয়ে উঠতে লাগল। টার্মিগান পাখি আর কাঠবিড়ালিদের এখন সে একটুও ভয় করে না। মুজ-বার্ড নামে মস্ত বড়ো পাখিগুলোকে দেখলে সে রাগে আগুন হয়ে যায়– নাকের উপর মুজ বার্ডের ঠোকরের ঘটনা সে তখনও ভুলতে পারেনি।

বিপদের সংকেত বুঝে সাবধান হতে শিখল সে। মাটিতে বাজপাখির ছায়া দেখলেই সে বুঝতে পারত শূন্য থেকে এখনই তার উপর ছোঁ মেরে নেমে আসবে উড়ন্ত মৃত্যু তৎক্ষণাৎ নিকটবর্তী ঝোপের মধ্যে সে গুঁড়ি মেরে শুয়ে পড়ত। তার মায়ের মতোই নিঃশব্দে মাটিতে গুঁড়ি মেরে চলতে শিখেছিল সে।

আবার এল দুর্ভিক্ষ। নেকড়ের বাচ্চা এর আগে শুধু খেলার ছলেই শিকার ধরত, কিন্তু এখন সে শিকারের সন্ধানে ছুটত পেটের জ্বালা শান্ত করার জন্যে। কাঠবিড়ালিরা যখন গাছ থেকে মাটির উপর নেমে আসত, তখন আড়াল থেকে অতর্কিতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত সে। মাঝে মাঝে মাটি খুঁড়ে গর্ত থেকে বুনোনা ইঁদুর ধরে সে উদরসাৎ করত। সবশেষে এমন একটা সময় এল যখন মাটিতে বাজের ছায়া দেখলে সে আর ঝোপের ভিতর আত্মগোপনের চেষ্টা করত না, ফাঁকা মাঠের উপর বসে মুখ তুলে শিকারি পাখিটাকে যুদ্ধে আহ্বান জানাত। সে জানত শূন্যে ভাসমান ওই পাখিটা যতই ভয়ানক হোক, সে-ও একটা খাদ্য নাগালের মধ্যে এলে ওই জীবন্ত ও উড়ন্ত খাদ্যকে হয়তো সে পেটের মধ্যে চালান দিতে পারবে। কিন্তু বাজ ওই বাচ্চাটার সঙ্গে লড়াই করার জন্যে মাটিতে নেমে আসতে রাজি হল না। নেকড়েশিশু এখন বেশ বড়ো হয়েছে, বাজ জানে তাকে শিকার করতে গেলে সে নিজেই হয়তো শিকারে পরিণত হবে। বাজের ভীরুতায় হতাশ হল নেকড়েশিশু, মুখ তুলে সে কেঁদে উঠল খিদের জ্বালায়।

হঠাৎ একদিন নেকড়ে-মা তার বাচ্চার জন্য মাংস নিয়ে এল। এমন সুস্বাদু নরম মাংস কখনো খায়নি বাচ্চাটা। এটা একটা লিংক্সের বাচ্চা, ছাইরঙা নেকড়ের বাচ্চাটার চাইতে সামান্যই ছোটো। নিজে একটুও না খেয়ে সমস্ত মাংসটাই ছেলেকে খেতে দিল নেকড়ে-সুন্দরী। বাচ্চাটা জানত না তার মা লিংক্সের অনুপস্থিতির সুযোগে তার ডেরায় ঢুকে অন্য বাচ্চাগুলোকে খেয়ে একটি বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে ছেলের জন্য। ভরপেট খাওয়ার পর ঘুম পেল- মার গা ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নেকড়েশাবক।

মায়ের গর্জন শুনে বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গেল। বাচ্চাটা কোনোদিন তার মাকে এমন ভয়ংকর হিংস্রভাবে দাঁত খিঁচিয়ে গর্জন করতে শোনেনি। গুহার মুখে মা-লিংক্সের চেহারাটা দেখতে পেল নেকড়ে শাবক। সঙ্গেসঙ্গে তার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও বন্য পশুর জন্মগত সংস্কার দিয়ে বাচ্চাটা বুঝতে পারল এক ভয়ংকর শত্ৰু উপস্থিত হয়েছে তাদের আস্তানায়।

নেকড়ে শাবক চটপট উঠে দাঁড়াল, তারপর বীরের মতো গর্জন করে দাঁত দেখাতে লাগল মায়ের পাশে এসে। মা কিন্তু ছেলের বীরত্বকে আমল দিল না, তাকে ঠেলে পিছনে সরিয়ে দিল। পরমুহূর্তেই লিংক্স আক্রমণ করল। গুহার ছাদ নিচু ছিল বলে বনবিড়ালি লাফিয়ে আসতে পারল না, হামাগুড়ি দিয়ে সে তেড়ে এল মা-নেকড়ের দিকে। তারপর শুরু হল লড়াই। নেকড়ের অস্ত্র শুধু দাঁত, লিংক্স তার দাঁতের সঙ্গে ধারাল নখগুলিকেও ব্যবহার করছিল ভীষণভাবে।

বাচ্চাটা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে লিংক্সের পিছনের একটা পা কামড়ে ধরল। তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো একটা থাবা আঘাত হানল বাচ্চাটার কাঁধের মাংস ছিঁড়ে হাড় বেরিয়ে পড়ল, সে আর্তনাদ করে ছিটকে পড়ল গুহার দেয়ালের উপর।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে নেকড়েশাবক আবার লিংক্সের একটা পিছনের ঠ্যাং কামড়ে ধরে ঝুলে পড়ল। লড়াই যখন শেষ হয়ে গেল, তখনও ঠ্যাংটা কামড়ে ধরে রেখেছে বাচ্চাটা— তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে অস্ফুট গর্জনধ্বনি।

মা-লিংক্স মারা পড়ল। কিন্তু নেকড়ে-সুন্দরীও ভীষণভাবে আহত হয়েছিল। একদিন একরাত সে নির্জীব হয়ে পড়ে রইল মৃত শত্রুর পাশে। পরস্পর রক্তপাতের জন্যে সে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে মাত্র কয়েকবার সে গুহার বাইরে গিয়েছিল তৃষ্ণা নিবারণ করতে সেইসময় সে চলাফেরা করেছে অতিকষ্টে। লিংক্সের নখ আর দাঁত তাকে ভীষণভাবে কাবু করে দিয়েছিল। এই একসপ্তাহ নেকড়ে-মা আর তার বাচ্চা মৃত লিংক্সের মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে নেকড়ে-মার ক্ষতগুলি কিছুটা শুকিয়ে এসেছিল, সে আবার বেরিয়ে পড়ল শিকারের সন্ধানে।

নেকড়ে-বাচ্চা তার কাঁধ নিয়ে বেশ কিছুদিন ভুগল। কয়েকদিন সে খুঁড়িয়ে চলল। অবশেষে একদিন আরোগ্যলাভ করল সে। এখন তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে। একটা সাংঘাতিক লড়াই-এর অভিজ্ঞতা তাকে সাহসী করে তুলেছে। বাচ্চাটা তার ভয়াবহ পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে এখন বুঝতে শিখেছে। সে জানতে পেরেছে জঙ্গলের রাজত্বে দুর্বলের স্থান নেই, এখানে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এক হিংস্র আইন– হয় খাও আর নয়তো খাদ্যে পরিণত হও।

.

০৯. আগুন যাদের হাতের মুঠোয়

চরম অভিজ্ঞতার তখনও বাকি ছিল–

বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বাচ্চাটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তার সামনে বসে আছে পাঁচটি আজব জীব!

এতদিন বনে বাস করলেও এমন অদ্ভুত প্রাণী আগে কখনো দেখেনি সে। তার ছোট্ট জীবনে এই প্রথম মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঘটল। দারুণ আতঙ্কে বাচ্চাটা অবশ হয়ে পড়ল, তার নড়াচড়া করার ক্ষমতা রইল না। মানুষরা তাকে দেখে গর্জন করল না, মারতে উঠল না, তারাও স্থির হয়ে বসে রইল শুধু পাঁচজোড়া তীব্র চক্ষু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

হঠাৎ একটি রেড ইন্ডিয়ান উঠে তার দিকে এগিয়ে এল, একটা হাত উপর থেকে নেমে এল তাকে ধরার জন্য। নিজের অজ্ঞাতেই নেকড়ে-বাচ্চার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল, ছোটো ছোটো সাদা দাঁতগুলো বেরিয়ে এলো হিংস্রভাবে এবং গলা থেকে বেরিয়ে এল চাপা গর্জন।

উদ্যত হাত থেমে গেল, লোকটি হেসে উঠে সঙ্গীদের উদ্দেশ করে বলল, দেখ, দেখ, হোয়াইট ফ্যাং (সাদা দাঁত)।

সঙ্গীরাও হেসে উঠল। লোকটি আবার বাচ্চাটাকে ধরতে হাত বাড়াল। নেকড়ে শাবক কুঁকড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে মাথার উপর নেমে আসা হাতটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তবুও হাতটা নেমে আসছে দেখে তার মাথার ভিতর যেন আগুন জ্বলে উঠল, দারুণ আক্রোশে এক কামড় বসাল সে হাতটার উপর। পরক্ষণেই মাথা আঘাত এসে পড়ল, বাচ্চাটা মাটিতে কাত হয়ে পড়ে কেঁদে উঠল আর্তস্বরে। আর লড়াই করার সাহস তার ছিল না, মাটির উপর উবু হয়ে বসে সে কেউ কেঁউ করে কাঁদতে লাগল। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রেড ইন্ডিয়ানরা হাসতে লাগল সশব্দে। হঠাৎ বাচ্চাটার কান্না আর মানুষের অট্টহাস্যের রোল ভেদ করে বাতাসে ভেসে এল একটা নতুন শব্দবনজঙ্গল ভেদ করে কে যেন ছুটে আসছে এইদিকে। বাচ্চাটা বুঝল তার মা আসছে তাকে রক্ষা করতে, নুতন উদ্যমে আর একবার তীব্র আর্তনাদ অভিযোগ জানিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে বুঝতে পেরেছে তার মা আসছে, এই অদ্ভুত প্রাণীগুলোকে মা নিশ্চয়ই শাস্তি দেবে। সে দেখেছে তার মা জঙ্গলের কোনো জীবকেই ভয় পায় না। লড়াইতে কখনো কারও কাছে পরাস্ত হয়নি তার মা। বাচ্চাটা সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল তার মার জন্য।

মূর্তিমান বিভীষিকার মতো বনজঙ্গল ভেদ করে অকুস্থলে দেখা দিল নেকড়ে-মা। নিদারুণ ক্রোধে তার মুখ বিকৃত, বেরিয়ে এসেছে ধারাল দাঁতের সারি এবং কণ্ঠভেদ করে বেরিয়ে আসছে হিংস্র গর্জনধ্বনি।

বাচ্চাটা ছুটে গেল মার কাছে। মানুষগুলো তাড়াতাড়ি কয়েক পদ পিছিয়ে গেল।

 হঠাৎ একটি লোক চেঁচিয়ে উঠল, কিচি!

চমকে উঠল নেকড়ে-মা। তার মুখের উপর থেকে মিলিয়ে গেল হিংস্র ক্রোধের আভাস। সে বিচলিত হল।

লোকটি আবার হাঁকল, কিচি! এইবার তার কণ্ঠে জাগল কর্তৃত্বের সুর, নেকড়ে-মা নিচু হল, তার পেট ঠেকাল মাটিতে।

এইবার লোকটি এগিয়ে এল, নির্ভয়ে হাত রাখল নেকড়ে-সুন্দরীর মাথায়। নেকড়ে-সুন্দরী গর্জন করল না, কামড়ানোর চেষ্টাও করল না, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল খুশির আওয়াজ লেজ নেড়ে সে বুঝিয়ে দিল মানুষদের সঙ্গে সে লড়াই করতে চায় না, বন্ধুত্ব করতে চায়।

বাচ্চাটা ভীষণ ভয় পেল- শেষ পর্যন্ত তার মা- যে-মা কাউকে ভয় পায় না সেই মা এই দু-পেয়ে জন্তুগুলোর বশ্যতা স্বীকার করে নিল! কী ভীষণ শক্তিশালী এই দু-পেয়ে জস্তুগুলো!

রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে গ্রে বিভার নামে মানুষটি তার সঙ্গীদের জানাল এই কিচি নামে কুকুরী একসময় তার ভাই-এর পোষ্য ছিল, দুর্ভিক্ষের সময় পালিয়ে গিয়ে জন্তুটা নেকড়ের দলে মিশেছিল এবং তার ফলেই ওই বাচ্চাটার জন্ম হয়েছে। গ্রে বিভার আরও বলল যে, একসময়ে এই কুকুরী ছিল তার ভাই-এর সম্পত্তি, এখন ভাই-এর অবর্তমানে এই কিচি এবং তার বাচ্চা উত্তরাধিকার সূত্রে তারই পোষ্য বলে গণ্য হবে। সঙ্গীরা গ্রে বিভারের দাবি মেনে নিল সানন্দে।

গ্রে বিভার বলল, বাচ্চার মা কুকুরী হলেও বাপ নিশ্চয়ই নেকড়ে। ওর চেহারায় কুকুরের চাইতে নেকড়ের সাদৃশ্য বেশি।

ধূসরবর্ণ নেকড়েশিশুর নামকরণ করল গ্রে বিভার হোয়াইট ফ্যাং বা সাদা দাঁত। এবার থেকে আমরাও বাচ্চাটাকে হোয়াইট ফ্যাং নামেই ডাকব।

গ্রে বিভার নেকড়ে-মার গলায় একটা দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে চলল। রেড ইন্ডিয়ানদের সবাই নেকড়ে-মাকে এখন কিচি নামে ডাকে। আমরাও ওই নামে তাকে উল্লেখ করব এখন থেকে। হোয়াইট ফ্যাং-এর গলায় দড়ির বাঁধন পড়েনি, তবু সে মায়ের পিছু পিছু চলল। এখনও মাকে ছেড়ে স্বাধীনভাবে চলার সাহস বা ক্ষমতা তার হয়নি।

রেড ইন্ডিয়ানদের সমাজে এসে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে হোয়াইট ফ্যাং। তবু দেখে প্রথমে সে ভয় পেয়েছিল, পরে বুঝেছিল ওটা ভয়ানক কোনো প্রাণী নয়;-ওটা হচ্ছে মানুষদের বাসস্থান এবং কুকুরদের ওখানে বাস করা তো দুরের কথা, প্রবেশ করারও অনুমতি নেই।

মানুষদের পোষা কুকুরদের দেখে হোয়াইট ফ্যাং তাদের সঙ্গে ভাব করতে এগিয়ে গিয়েছিল। ফল হল সাংঘাতিক। কুকুরগুলো দল বেঁধে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিচি প্রাণপণে লড়াই করেও ছেলেকে বাঁচাতে পারত না, কিন্তু গোলমাল শুনে মানুষরা ছুটে এসে দমাদ্দম ডান্ডা পেটা করে কুকুরের দলটাকে তাড়িয়ে দিল; আর হোয়াইট ফ্যাং নামে বাচ্চাটা বেঁচে গেল নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে। নেকড়েশাবক বুঝল অবাধ্য হলে মানুষরা শাসন করে বটে, কিন্তু বিপদে পড়লে তারা রক্ষা করে এবং রক্ষা করার মতো শক্তিসামর্থ্য তাদের আছে।

রেড ইন্ডিয়ানরা তখনও কিচিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারত না, ভাবত ছাড়া পেলে সে আবার জঙ্গলে পালিয়ে যেতে পারে। তাই তাকে খুঁটিরে সঙ্গে বেঁধে রাখা হত। ব্যাপারটা হোয়াইট ফ্যাং-এর ভালো লাগেনি; কিন্তু চুপচাপ মায়ের কাছে বসে থাকতেও তার খারাপ লাগত- অতএব মায়ের সান্নিধ্য ছেড়ে মানুষের আস্তানার চারদিকে টহল দিতে বেরিয়ে পড়ত সে।

একদিন মনের আনন্দে তাঁবুগুলোর আশেপাশে টহল দিতে দিতে তার দৃষ্টি পড়ল তারই মতন আর একটা বাচ্চা কুকুরের দিকে। এই কুকুর-বাচ্চার নাম লিপ-লিপ। সে এরই মধ্যে বাচ্চা কুকুরদের ভিতর দক্ষ যোদ্ধা হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিল, স্বভাবেও সে ছিল দস্তুর মতো কলহপ্রিয়, মারকুটে।

হোয়াইট ফ্যাংকে দেখেই এগিয়ে এলো লিপ-লিপ। নেকড়ে শাবক তারই মতো একটা বাচ্চাকে দেখে ভয় পায়নি। সে ভাব করার জন্য কুকুর বাচ্চার দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু লিপ-লিপ যখন তাকে আক্রমণ করল তখন সে-ও দাঁত খিঁচিয়ে প্রতি-আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কামড়ের পর কামড় খেয়ে কাবু হয়ে পড়ল হোয়াইট ফ্যাং। অবশেষে প্রাণের ভয়ে আর্তনাদ করতে করতে সে তীরবেগে রণক্ষেত্র ত্যাগ করে মায়ের কাছে আশ্রয় নিল নিতান্ত কাপুরুষের মতো।

কিচি তার বাচ্চার ক্ষতস্থান চেটে চেটে তাকে সান্ত্বনা দিল এবং বুঝিয়ে দিল মায়ের কাছে থাকলে তার বিপদ ঘটবে না। কিন্তু হোয়াইট ফ্যাং নামক নেকড়েশিশুর তখন চারপাশের দুনিয়া সম্পর্কে অপরিসীম কৌতূহল, মাকে ছেড়ে সে আবার বেরিয়ে পড়ল নতুন অভিজ্ঞতার সন্ধানে।

একটু পরেই তার চোখ পড়ল একটা মানুষের দিকে; ফাঁকা জায়গায় শুকনো ডালপালা সাজিয়ে বসে আছে গ্রে বিভার। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল হোয়াইট ফ্যাং। মানুষটা তাকে কিছু বলল না দেখে আর একটু এগিয়ে গেল সে। কিছুক্ষণ পরে একটা আজব ব্যাপার দেখে সে চমকে উঠল– গ্রে বিভারের হাতের তলায় শুকনো ডালপালার ভিতর থেকে কুয়াশার মতো অস্পষ্ট কী যেন একটা জিনিস বেরিয়ে আসছে। তারপরই একটা জীবন্ত বস্তু লাফিয়ে উঠে খেলা করতে লাগল শুকনো ডালপালার মধ্যে। সেই বস্তুটির রং সূর্যের আলোর মতো। আগুন সম্পর্কে বাচ্চাটার কোনো ধারণা ছিল না, সে সাগ্রহে এগিয়ে গিয়ে সেই কম্পিত অগ্নিশিখার ঘ্রাণ এবং স্বাদ গ্রহণ করার চেষ্টা করল নাক আর জিভের সাহায্যে। ফল হল সাংঘাতিক। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে গেল বাচ্চার নাক ও জিভ। দারুণ যন্ত্রণায় সে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দূর থেকে তার কান্না শুনে গর্জে উঠল কিচি, খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় লাফালাফি করতে লাগল ব্যর্থ আক্রোশে, কিন্তু বাঁধন ছিঁড়ে বাচ্চার কাছে আসার ক্ষমতা তার ছিল না।

বাচ্চাটার কাতর কান্না শুনে হাসিতে ফেটে পড়ল গ্রে বিভার। আশেপাশে যেসব লোক ছিল, তাদের ঘটনাটার কথা চিৎকার করে জানিয়ে দিল সে। সঙ্গেসঙ্গে চারদিক থেকে জেগে উঠল সমবেত কণ্ঠে অট্টহাস্যের কলরোল। আরও জোরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল হোয়াইট ফ্যাং, সঙ্গেসঙ্গে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বেজে উঠল বহুকণ্ঠের মিলিত হাস্যধ্বনি।

হঠাৎ কান্না থামিয়ে চুপ হয়ে গেল বাচ্চা-নেকড়ে। সে লজ্জা পেয়েছে, অপমানিত বোধ করেছে। জন্তুরা কখনো মানুষের হাসির খোরাক হতে চায় না। এই ব্যাপারটা তারা কেমন করে বুঝতে পারে জানি না, তবে মানুষের বিদ্রূপজড়িত হাসি শুনলে তারা অপমানিত বোধ করে হোয়াইট ফ্যাং বাচ্চা হলেও সহজাত সংস্কার দিয়ে বুঝল তার দুর্দশা দেখে মানুষগুলো আনন্দ পাচ্ছে, তৎক্ষণাৎ কান্না থামিয়ে সে ছুটল মায়ের কাছে।

কিচি বাচ্চাকে আদর করল, সান্ত্বনা দিল। ক্রমশঃ গাঢ় হল সন্ধ্যার ছায়া, এল রাত্রি। হোয়াইট ফ্যাং শুয়ে পড়ল মায়ের পাশে। পোড়া নাক আর জিভের জ্বালা তখন তাকে কষ্ট দিচ্ছিল, কিন্তু শরীরের কষ্টের চাইতেও মানসিক চঞ্চলতা তাকে অস্থির করে তুলেছিল। সে ভাবছিল দুপেয়ে মানুষ-জন্তুদের কথা কী অসম্ভব শক্তিমান তারা, সজীব ও নির্জীব, সচল ও অচল সব বস্তুর উপরই প্রভুত্ব করে তারা। তাদের হাতের ছোঁয়ায় মরা গাছের ডালপালার মধ্যে লাফিয়ে ওঠে জীবন্ত অগ্নিশিখা! আর কী ভীষণ জোরে কামড়ে দিতে পারে ওই আগুন! হোয়াইট ফ্যাং ভাবতে লাগল আগুন যাদের হাতের মুঠোয় তারাই তো সবচেয়ে শক্তিমান, সবচেয়ে ভয়ংকর– তারা নিশ্চয়ই দেবতা।