বেশ দ্রুত গতিতেই অগ্রসর হচ্ছিলো রেজোলিউট। আবহাওয়া পরিষ্কার, বাতাস অনুকুল, সমুদ্রও শান্ত। উত্তমাশা অন্তরীপ পেরিয়ে মোজাম্বিক উপসাগর নির্বিঘ্নে অতিক্রম করে অবশেষে পনোররাই এপ্রিল জাহাজ এসে পৌঁছুলো জানজিবার বন্দরে।
জানজিবারের ইংরেজ রাজদূত রেজোলিউটেরই প্রতীক্ষ্ণ করছিলেন, নোঙর ফেলতেই তিনি সদলবলে জাহাজে এসে উঠলেন। অত্যন্ত উৎসাহ দেখালেন তিনি। ফার্গুসনের পরিকল্পনায়, সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। জাহাজ থেকে জেটি পর্যন্ত মাঝখানে যে একটুকরো কালো সমুদ্র রয়েছে, সেটুকু পেরিয়ে রাজদূত বা কন্সলের সঙ্গে ফাণ্ডসন তার সঙ্গীদের নিয়ে বন্দরে চলে এলেন।
বেলুনদুটিকে যখন তীরে নামানো হবে, এমন সময় গোল বাধলো। অনেক অনুসন্ধানের পর কন্সাল ব্যাপারটি সহজেই বুঝে নিলেন। ফার্গুসন প্রথমটা গণ্ডগোলের কারণ বুঝতে পারেননি, কন্সালই সবিস্তারে তাকে সব বুঝিয়ে দিলেন, বেলুন তীরে নামাতে গেলে ভীষণ মুশকিলে পড়তে হবে, কেননা এখানকার আদিবাসীরা তাতে ভয়ানকভাবে বাধা দেবে। তাদের ধারণা হলো, এই-যে বিধর্মী লোকগুলো বেলুন নিয়ে আকাশে উড়তে এসেছে, এটা হলো তাদের ধর্মবিরুদ্ধ কাজ-কাফেরদের এই স্পর্ধা তারা কিছুতেই সহ্য করবে না, হাতিয়ার নিয়ে বাধা দেবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। সূর্য আর চাঁদের উপাসক এরা। আর এই দুজন দেবতা থাকেন আকাশে, খ্রিষ্টানরা বেলুন নিয়ে আকাশে উঠে দেবতার আবাস অপবিত্র করে দিতে চাচ্ছে-এমন অলুক্ষুণে কাণ্ড যদি ঘটতে দেখা যায়, তাহলে তাদের বিষম অমঙ্গল হবে। এই আশঙ্কাতেই তারা ভীষণভাবে খেপে গিয়েছে।
তাহলে এখন কী করবো? ফার্গুসন একটু হতাশ হয়ে পড়লেন। দ্বীপের যেখানেই বেলুন নামাতে যাই না কেন, সেখানেও তো ঐ একই বিপদ বল্লম উঁচিয়ে তেড়ে আসবে। কাজেই সে-চেষ্টা করে তো কোনো লাভ নেই। আচ্ছা, ওদের কি কোনোরকমে বোঝাতে পারা যায় না যে আমরা দেবতার আবাসকে অপবিত্র করতে চাচ্ছি না—আমরা অন্য কারণে আকাশে উড়তে চাচ্ছি?
না, তা ওরা বুঝবে না। কোনো যুক্তি যদি থাকতো, তাহলে হয়তো বোঝানো যেতো। কিন্তু লোকে যেখানে হাজার বছরের জড় বিশ্বাস আঁকড়ে বসে আছে, সেখানে যত জোরালো যুক্তিই দিন না কেন, তা মোটেই কাজে আসবে না, সবই নিস্ফল হবে। তবে একটা কাজ হয়তো করা যায়। চিন্তিত স্বরে কন্সাল বললেন, অনেকক্ষণ ধরে এ-বিষয়ে আমি ভেবেছি। ঐ-যে সমুদ্রের মাঝখানে কালোর মাঝে সবুজ ফুটকির মতো ছোটো-ছোটো দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, তারই কোনো-একটায় গিয়ে বেলুন নামান। চারদিকে জাহজের নাবিকেরা কড়া পাহারা দেবে, আমিও কিছু লোক দেবো। সবাই যদি হুঁশিয়ার থাকে, তাহলে সম্ভবত আর কোনো ভয় থাকবে না।
কন্সালকে ধন্যবাদ জানালেন ফার্গুসন। তা-ই ভালো। খামকা কোনো ঝামেলায়–গিয়ে আমরা যাতে নির্বিঘ্নে আমাদের কাজ সারতে পারি, সেটাই আমাদের সর্বাগ্রে দেখা উচিত।
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই কাজ হলো। শামুকের মতো গুটিগুটি ঐরকম একটি দ্বীপের গায়েই রেজোলিউটকে ভেড়ানো হলো। চারদিকে বহুদিনের পুরোনো সব মস্ত গাছ ছায়া আর আড়াল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ফাঁকা জায়গায় বেলুনদুটিকে নামিয়ে দেয়া হলো। আশি ফিট উঁচু মস্ত দুটি মাস্তুল—একটা শক্ত লোহার তার জুড়ে দিয়ে তারই ওপর দড়ির সাহায্যে বড়ো বেলুনকে টেনে খাড়া করিয়ে তার তলায় ছোটো বেলুনটিকে ঝুলিয়ে দেয়া হলো; এই দুটো বেলুনের মধ্যে আবার যোগাযোগের ব্যবস্থা। আছে, সংযুক্ত করা হয়েছে শক্ত একটি লোহার নল, যার ভেতর দিয়ে বেলুনের ভেতর হাইড্রোজেন গ্যাস যাবে। এখন গ্যাস তৈরি করে তা দিয়ে বেলুনকে ভর্তি করতে হবে।
গ্যাস তৈরি করার জন্যে ফার্গুসন অনেকরকম যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলি লাগসইভাবে পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে গ্যাস বানানোর কল তৈরি করা হলো। গ্যাস বানানোর জন্য চাই সালফিউরিক অ্যাসিড, পুরোনো লোহার টুকরো, জল। সমস্ত ঠিকঠাক করতেই সারা দিন চলে গেলো। ফার্গুসন ঠিক করলেন, গ্যাস তৈরির কাজ শুরু হবে পরের দিন সকালে।
ঘুম যখন ভেঙে গেলো সূর্য উঠতে তখনও ঢের দেরি। রাতটা জাহাজেই কাটিয়েছিলেন ফার্গুসন। তার বিছানার কোল ঘেঁসেই গোল জানলা, জাহাজের ভাষায় তাকে বলে পোর্টহোল। পর্দা সরিয়ে তিনি বাইরে তাকালেন। কালো জলের একটুকরো মাঝখানটায় আর তার পরেই সবুজ দ্বীপ—এদিকে-ওদিকে তখনও অনেক আলোর ছিটে ছড়ানো রয়েছে। দ্বীপের তখনও ঘুম ভাঙেনি, যেন ঝিমুচ্ছে। ঘুম-চোখে শেষরাতের দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আলসেমি করার অবসর সত্যিই ছিলো না। এক্ষুনি তৈরি হতে হবে। বিছানার চাদর থেকে নিজেকে বার করে জামা-জুতোর মধ্যে শরীর গলিয়ে দিয়ে জাহাজের এ-গলি ও-গলি ঘুরে খাবার ঘরে এসে হাজির হলেন ফার্গুসন। সেখানে এর মধ্যেই কেনেডি আর জো এসে কফির টেবিলে হাজির, ক্যাপ্টেনও সঙ্গে আছেন; তাদেরও চোখ থেকে ঘুমের ছাপ মোছেনি, তবু চোখগুলো যেন চকচক করছে। কড়া কালো কফি নিয়ে বসলেন সবাই। প্রাতরাশ সারতে-না-সারতে অন্যরাও খাবার ঘরে এসে হাজির হলো। নিজেদের দায়িত্বের কথা মনে করে সকলেই শেষরাতে উঠে পড়েছে।
কাজ আরম্ভ হলো সকাল আটটায়। গ্যাস তৈরি হয়ে ধীরে-ধীরে বেলুনের ভেতর প্রবেশ করলো, আর ক্রমশ বেলুনের আকার বদলে যেতে লাগলো। প্রথমটায় তার আকার হলো গোল বৃত্তের মতো, তারপর তার তলার দিকটা সরু হয়ে পেটমোটা হয়ে গেলো—ওপর দিকটাও ঈষৎ চেপে এলো। যাতে ভারসাম্য বজায় থাকে সেইজন্যে প্রথমে কয়েকটা বস্তা নামিয়ে দেয়া হলো কার-এর মধ্যে, তারপর একে-একে সব জিনিশপত্র ভোলা হতে লাগলো। নোঙর, দড়ি, যন্ত্রপাতি, খাবার-দাবার, জলের পিপে, তাবু—সব তোলা হলো একের পর এক।
সব ব্যবস্থা করতে-করতেই বেলা পড়ে এলো। রোদের কড়া আঁচ কমে এলো, পশ্চিমদিককার গাছপালার আড়ালে লুকিয়ে গেলো উষ্ণ জঙ্গলের প্রবল সূর্য, কেবল রশ্মিজ্বলা দিগন্ত থেকে শেষ আলোর কয়েকটি রঙিন রেখা বাঁকাভাবে এসে পড়লো বেলুনের গায়ে।
কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো চারদিকে, নৌকোয় করে লোকলস্কর লাগিয়ে নজর রাখা হয়েছিলো উপসাগরের দিকেও। পাছে এ-দেশের আদি বাসিন্দারা দল বেঁধে আক্রমণ করে বসে, তাই এই খবরদারি।
মূল দ্বীপ জানজিবারে অবশ্য তারা নানা ধরনের হাতিয়ার নিয়ে বিচিত্র আওয়াজ করে দুর্বোধ্য ভাষায় তর্জন-গর্জন শুরু করে দিয়েছিলো। তাদেরই মধ্যে কয়েকজন নিশ্চয়ই প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলো, সেই অত্যুৎসাহীরা সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে ছোটো দ্বীপটায় সাঁৎরে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে নাবিকদের হাতে বাধা পেয়ে শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলো। সারারাত ধরে সমুদ্রের তীরে সেইসব কালো মানুষদের রাগি শোরগোল আর হুমকি শোনা গেলো।
সন্ধেবেলায় রেজোলিউট জাহাজে অভিযাত্রীদের বিদায় সংবর্ধনা জানাবার জন্যে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিলো। পরদিন সকালবেলায় বেলুন তার যাত্রাপথে রওনা হবে—সকলেই সেইজন্যে উত্তেজনায় ভেতরে-ভেতরে একধরনের চাপা অস্থিরতা বোধ করছিলেন। কেবল জো ছিলো স্থির ও নির্বিকার।
রাত থাকতেই সবাই ছোটো দ্বীপটায় চলে এলো। পূবদিক থেকে হাওয়া আসছে, সগর্বে আকাশে দুলছে বেলুন! ক্যাপ্টেন তার নাবিকদের নিয়ে বিদায় জানাতে এসেছিলেন, মূল দ্বীপ থেকে কন্সাল এসেছিলেন সদলে যাত্রার প্রাথমিক কাজ শেষ করে অভিযাত্রীরা সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন।
কেনেডি আর জো যখন ডক্টর ফার্গুসনের সঙ্গে ঝোলানো কার-এ গিয়ে উঠে বসলেন, তখন বেলা ন-টা। যে-নাবিকেরা দড়ি ধরে ছিলো তারা আস্তে-আস্তে হাতের মুঠো আলগা করে দড়ি ঢিলে করে দিলে, ধীরে-ধীরে আকাশের দিকে প্রায় কুড়ি ফিট উঁচুতে উড়ে গেলো বেলুনটি। ওপর থেকে ডক্টর ফার্গুসন চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, এই আকাশযানের একটি নাম দেয়া কর্তব্য আমাদের। ভিক্টরিয়া নামটাই আমার কাছে সবচেয়ে সংগত বলে মনে হচ্ছে।
নিচে থেকে সমস্বরে সকলে উল্লসিত কণ্ঠে রানী ভিক্টরিয়ার দীর্ঘ জীবন কামনা করে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠলো।
তারপর হঠাৎ প্রবল হাওয়া এলো, থরথর করে কেঁপে উঠলো বেলুন। ফার্গুসন বললেন, আর দেরি নয়, এবার রওনা হওয়া যাক। বিদায় জানালেন তিনি সকলকে।
সঙ্গে-সঙ্গে হাতের দড়ি ছেড়ে দিলে নাবিকেরা, হাওয়ার দমকা বেলুনটির ঝুঁটি ধরে একবার চর্কির মতো পাক খাইয়ে দিলে, তারপরেই দ্রুতবেগে বেলুন আকাশে উঠে গেলো। যাত্রীদের চোখে নিচের সবকিছু আচমকা একেবারে ছোটো হয়ে গেলো, সব যেন পুতুলের মতো, সব খুদে মাপের, কেবল জাহাজের উঁচু মাস্তুলে ব্রিটিশ পতাকা পংপং করে উড়ছে হাওয়ায়।
রেজোলিউট জাহাজের মস্ত চারটে কামান বিকটভাবে গর্জন করে উঠলো। তোপ দেগে অভিনন্দন জানানো হলো অভিযাত্রীদের।
পরক্ষণেই রেজোলিউটের মাস্তুলের পতাকাটি অভিযাত্রীদের চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেলো। শেষ যখন তাকে দেখা গিয়েছিলো, মনে হয়েছিলো একটি খেলনাজাহাজ যেন কালো জলের ওপর পড়ে আছে। জানজিবার দ্বীপটির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত উদঘাটিত হয়েছিলো একটি পুতুলের শহরের মতো, কালো মাটির ওপর কতগুলি রেখা আর বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশার মতো মাঠ-ঘাঠ-পথ, পিঁপড়ের সারির মতো মানুষজন।
আস্তে-আস্তে তা যখন মিলিয়ে গেলো, নিচে দেখা গেলো কালো সমুদ্রকেতার অস্থির, চঞ্চল, ফেনিল জল স্থির একটা বিশাল ছবির মতো পড়ে থাকলে যেন তলায়।