কদিন ধরে রোজ বিকেলে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করছে। আজ ব্যতিক্রম। সারাদিন আকাশ ছিল ঘন নীল। মেঘের ছিটাফোঁটাও ছিল না। এখন সাড়ে ছাঁটার মতো বাজে, এখনো আকাশ পরিষ্কার। গাছের মাথায় মাথায় ঝকঝকে রোদ।
রূপা এই সময় তার মার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জানালায় পর্দা দেয়া। পর্দা দেয়া থাকলেও পর্দার ফাঁক দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। ঠিক সাড়ে ছাঁটায় রূপার মাস্টার সাহেব তাদের বাড়ির গেটে হাত রাখেন। হাত রাখার আগে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে বিরক্ত চোখে তাকান। এই দৃশ্য দেখতে রূপার বড় ভালো লাগে।
তার কী যে হয়েছে! রোজ দুপুরের পর থেকেই এক ধরনের অস্বস্তি। অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা : যদি না আসেন! যতই বিকেল হতে থাকে আশঙ্কা ততই বাড়তে থাকে। এক সময় বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ এত বেশি হয় যে মনে হয় সবাই শুনে ফেলছে। সাড়ে ছটার পর অবধারিতভাবে এই শব্দ কমে যায়। নিজেকে তখন খুব ক্লান্ত লাগে। সারাদিন খুব পরিশ্রমের কোনো কাজ করলে কাজের শেষে যে রকম ক্লান্তি, অনেকটা সে রকম ক্লান্তি।
এই যে ব্যাপারগুলি তার মধ্যে হচ্ছে এটা কি অন্যায়? অন্যায় তো বটেই, তবে খুব বেশি অন্যায় নিশ্চয়ই না। সে তেমন কিছু তো করে না। স্যার যা পড়তে বলেন পড়ে। যে অঙ্ক করতে বলেন করে। বাড়ির কাজ করে। মাঝে মাঝে অবশ্যি সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়–তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এই সময় শরীরে এক ধরনের ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বমি বমি ভাব হয়। তখন সামনে থেকে উঠে গিয়ে বমি করতে হয়। তবে এই ব্যাপারগুলি ঘনঘন হয় না। ঘনঘন হলে সবার চোখে পড়ত। ভাগ্যিস কিছুদিন পর পর হয়।
রূপা তার স্যারকে গত ছমাসে গভীর মনোযোগে লক্ষ করেছে। এত মনোযোগ দিয়ে এর আগে সে কাউকেই লক্ষ করে নি। ভবিষ্যতেও করবে না। কারণ করার প্রযোজন নেই। রূপার ধারণা এই মানুষটিকে সে যতটা ভালো জানে অন্য কেউ তা জানে না, এমনকি মানুষটা সি জেও এতটা জানেন না।
মানুষটা কি জানেন যে তিনি মাঝে মাঝে অসম্ভব অন্যমনস্ক হয়ে যান? হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই জানেন। তবে অন্যমনস্ক হবার আগ মুহুর্তে তিনি কী করেন তা-কি জানেন? না, জানেন না। এটা জানে শুধু রূপা। এই মানুষটা যখন বঁ হাত দিয়ে খুব শান্ত ভঙ্গিতে মাথার চুল ভাজ করতে থাকেন তখন বোঝা যাবে তিনি অন্যমনস্ক হতে শুরু করেছেন। অন্যমনস্ক অবস্থায় মানুষটা কী ভাবেন তা রূপার খুব জানার ইচ্ছা।
রোজই ভাবে জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করা হয় না। শেষ মুহুর্তে লজ্জা লাগে। তবে একদিন সে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবে। হয়তো আজই করবে।
মানুষটা রূপাকে খুবই বাচ্চা মেয়ে বলে মনে করেন। এটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি রূপা যখন কিছু বলে তখন তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে শোনেন এবং রূপার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেন। রূপা প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। খুব যে গুছিয়ে মিথ্যা বলে তাও না, অথচ মানুষটা তা বিশ্বাস করেন। রূপার তখন খুব খারাপ লাগে।
একবার রূপা বলল, মশা যে খুব বুদ্ধিমান প্ৰাণী তা কি স্যার আপনি জানেন?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, জানি না তো! খুব বুদ্ধিমান হবার তো কথা না। ক্ষুদ্র প্ৰাণীর মস্তিষ্কের পরিমাণ অতি অল্প।
স্যার মস্তিষ্ক অল্প হলেও মশা খুব বুদ্ধিমান। আমি পরীক্ষা করে বের করেছি।
মানুষটা এতে খুব উৎসাহিত বোধ করলেন। তার চোখ চকচক করতে লাগল। মাথা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো, আবেগশূন্য কণ্ঠস্বরেও খানিকটা আবেগ চলে এলো। তিনি ছেলেমানুষি কৌতূহল নিয়ে বললেন, কী পরীক্ষা?
রূপার লজ্জা লাগছে। কারণ এখন সে যা বলবে তার পুরোটাই ডাহা মিথ্যা। অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছে।
পরীক্ষাটা করেছি। আমার মামাতো বোনকৈ দিয়ে। মামাতো বোনের নাম ইয়াসমিন। আমার দুই বছরের ছোট। সে মশারি খাটিয়ে ঘুমুতে পারে না, তার নাকি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি একদিন লক্ষ করলাম, যখন সে জেগে থাকে তখন মশা খুব কম কামড়ায়। যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন খুব বেশি কামড়ায়। বুদ্ধিমান বলেই তারা অপেক্ষা করে কখন মানুষটা ঘুমিয়ে পড়বে। আরাম করে রক্ত খাওয়া যাবে। ঠিক না স্যার?
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এমন হেলাফেলা করে হয় না রূপা। আরো সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। যেমন ধর, ঘুমুবার আগে ঘণ্টায়। কটা মশা কামড়াচ্ছে। ঘুমুবার পর কাঁটা। একজনকে দিয়ে পরীক্ষা করলেও হবে না। অনেককে দিয়ে করতে হবে। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জি স্যার।
তবে তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে মশার মনে মৃত্যুভয় আছে। মৃত্যুভয় আছে বলেই জাগ্ৰত মানুষকে কামড়াচ্ছে না। মৃত্যুভয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। শুধুমাত্র নির্বোধদেরই মৃত্যুভয় থাকে না।
স্যার আমার কিন্তু মৃত্যুভয় নেই। আমি কি নির্বোধ?
এইসব কথা এখন থাক। ফিজিক্স বইটা খোল তো।
ফিজিক্স পড়তে আমার ভালো লাগে না স্যার।
ফিজিক্স পড়তে ভালো লাগে না? তুমি এইসব কী বলছ? খুবই অন্যায় কথা বলছি। তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, কার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব?
তোমার নিজের কাছে।
আচ্ছা স্যার ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। এবং নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম।
বই খোল, থার্ড চেপ্টার বের কব–স্থির বিদ্যুৎ।
রূপা নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে থার্ড চেপ্টার বের করল। মানুষটা হাত নেড়ে নেড়ে স্থির বিদ্যুৎ বুঝাচ্ছেন। এমনভাবে বুঝাচ্ছেন যেন স্থির বিদ্যুৎ তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। রূপা পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আবার বমি বমি লাগছে। মাথা ঘুরছে। কেন এ রকম হয়? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কী আছে এই মানুষটার মধ্যে, কেন তাকে এত ভালো লাগে?
ছটা চল্লিশ বাজে।
এখনো মানুষটার দেখা নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঝড়-বৃষ্টি কিছুই নেই। এ রকম তো হবার কথা নয়। রূপার কেমন যেন লাগছে। গা কাঁপছে, ঘাম হচ্ছে। মাথার ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তাদের উঠোনে অনেক গাছপালা। গাছপালার জন্যেই রাস্তা দেখা যায় না। রূপার মনে হলে গেটের কাছে দাঁড়ালেই সে দেখবে লম্বা মানুষটা মাথা নিচু করে দ্রুত আসছেন। দেরি করার জন্যে রূপা আজ কিছু কঠিন কথা শোনাবে। অবশ্যই শোনাবে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই আজ দেরি করবেন কেন?
রূপা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার অনেকখানিই দেখা যায়। রাস্তায় লোকজন আছে কিন্তু ঐ মানুষটা নেই। রূপার মনে হলো খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে তারপর যখন সে তাকাবে তখনই মানুষটাকে দেখতে পাবে। অবশ্যই পাবে। সে দীর্ঘ সময় চোখ বন্ধ করে রইল, এক সময় চোখ মেলল। রাস্তা ফাঁকা, কেউ নেই।
সন্ধ্যা মিলাচ্ছে, আকাশ গাঢ় রক্তবর্ণ। রূপা এখনো গেটের বাইরে। রূপার মা এক সময় বারান্দায় এসে বিস্মিত গলায় বললেন, ভরসন্ধ্যায় বাইরে কেন রে মা?
রূপা জবাব দিল না।
আয, ঘরে আয়।
রূপা ঘরে ঢুকাল। রূপাব মা বললেন, তোর কী হয়েছে? তোকে এমন লাগছে কেন? চোখ লাল।
রূপা ক্লান্ত গলায় বলল, মনে হয় আমার জ্বর আসছে।
কই, গা তো ঠাণ্ডা!
শরীরটা ভালো লাগছে না মা।
যা শুয়ে থাক।
আচ্ছা। স্যার এলে বলবে, আজ আমি পড়ব না।
বলব।
রূপা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল। তার প্রতি মুহুর্তেই মনে হতে লাগল–এই বুঝি সার এসেছেন।
স্যার এলেন না, তবে বাত দশটায় রূপার বড় ভাই রফিক তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে খুলনা থেকে বিনা নোটিশে এসে উপস্থিত হলো। সে তিন বছর পর গ্রামের বাড়িতে এসেছে। তার দ্বিতীয় মেয়ে রুবাবাকে এ বাড়ির কেউ দেখে নি। সেই মেয়ে এখন ফড়ফড় করে কথা বলে। যা দেখছে সে দিকেই ডান হাতের পাঁচ আঙুল বাড়িয়ে বলছে, এটা কী? বড় মেয়ের নাম জেবা। এই মেয়ে নিঃশব্দবতী, তার মুখে কোনো কথা নেই। রূপার মা ছেলেকে এবং ছেলের বেঁকে জড়িয়ে ধরে ক্রমাগত কাঁদছেন। রূপারও অসম্ভব ভালো লাগছে। সে ভাইয়ের ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বাগানে হাঁটছে। মেয়েটি এক সময় আকাশের চাঁদের দিকে হাতের পাঁচ আঙুল মেলে বলল, এটা কী?
রূপা বলল, এটা চাঁদ। দেখেছ কত সুন্দর!
কয়েকটা জোনাকি উড়ে গেল। রুবাবা বলল, এটা কী?
এর নাম জোনাকি। এরা চাঁদের কণা গায়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কী সুন্দর তাই না রুবাবা?
একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছিল। রুবাবা বলল, এটা কী?
রফিক এক সময় বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তার পেছনে পেছনে বাড়ির সবাই। রফিক তার মাকে বলল, রূপা তো মা পরীর মতো সুন্দর হয়েছে। আশ্চর্য!
ভাইয়ের কথা শুনে রূপার চোখে কেন জানি পানি এসে গেল।
রফিক বলল, এই রূপা! অন্ধকারে বাগানে ঘুরছিস? সাপখোপ আছে না?
রূপা হালকা গলায় বলল, অন্ধকার কোথায়? দেখছি না। কত বড় চাঁদ। দিনের মতো আলো।
রূপার বাবা বাড়িতে নেই। মামলার ব্যাপারে নেত্রকোনা গিয়েছেন। কয়েকদিন সেখানে থাকবেন। তাকে খবর দেবার জন্য রাতেই লোক গেল। একজন গোল ঘাটে। মাছ কিনতে।
ঘাটে বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। বেপারিরা ঢাকায় চালান দেবার জন্যে কিনে এনে জড়ো করে।