০৫. আইসল্যাণ্ডের সেই বৈজ্ঞানিক
তাড়াতাড়ি সামান্য কিছু গলাধঃকরণ করে সমুদ্র থেকে পাঁচ হাজার ফুট উপরে স্নেফেলের চুড়োয় পাথরের উপরে গা এলিয়ে দিলাম আমরা। সঙ্গে-সঙ্গেই চোখের পাতায় নেমে এলো একঝাঁক ঘুম। এমন গাঢ় ঘুম আমার অনেকদিন হয়নি। জেগে উঠে দেখি বেলা প্রায় দুপুর।
দিগন্তের অন্যান্য পাহাড়ের চুড়গুলিকে ছোটো-ছোটো প্রাচীরের মতো দেখালো। নদীগুলো যেন সরু সুতো। দক্ষিণ দিকের বরফ-ছাওয়া ভূমির উপরে রোদের রঙ ঝলমল করছে। পশ্চিম দিকে সমুদ্রের গাঢ় নীল রঙ। সবকিছুই দেখতে অপূর্ব লাগছিলো।
এমন সময়ে কাকামণি আর হান্স্ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওরা দুজনে সেই লোকদুটিকে বিদায় দিতে গিয়েছিলো। কাকামণি এসে পশ্চিম দিকে কুয়াশার মতো কী যেন একটা আঙুল দিয়ে দেখালেন। বললেন : ঐ দ্যাখ, গ্রীনল্যাণ্ড!।
অবাক হয়ে বললাম : গ্রীনল্যাণ্ড!
গ্রীনল্যাণ্ড তো এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। শখানেক মাইল দূরে মাত্র। যাক সেকথা।…আমরা এখন স্নেফেলের উপরে। দুটি চুড়োও দেখতে পাচ্ছি। একটা তো এইটে—যেটার উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি, অন্যটা ঐ যে। কোনটার কী নাম, সেটা এখন জানা দরকার। হাসের দিকে তাকালেন কাকামণি : আচ্ছা হ্যাঁ, আমরা যে চুড়োটার উপর দাঁড়িয়ে আছি, এটার নাম কী?
হাস্ উত্তর করলে : স্কার্টারিস।
আনন্দে কাকামণি অধীর হয়ে উঠলেন। তবে আর দেরি কিসের? এক্ষুনিই তোত নামা যেতে পারে?
আমার বুক একবার ভয়ে কেঁপে উঠলো। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। হাসকে কিন্তু একটুও বিচলিত দেখালো না। সে সহজভাবেই আমাদের ক্রেটারের দিকে নিয়ে চললো। আমি মুখ অন্ধকার করে চুপচাপ ওদের পিছন পিছন চললাম।
স্নেফেলের প্রধান ক্রেটারের মুখটা মাইলখানেক চওড়া। গভীরতা কম করেও দুহাজার ফুটের বেশি। পাগল না হলে মানুষ কখনো এমন সাংঘাতিক চিমনির মধ্যে নামবার কল্পনা করতে পারে? মুখের কাছ থেকে একটা রাস্তা অনেকদূর পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। হাসকে অনুসরণ করে সেই রাস্তা ধরে আমাদের অবতরণ শুরু হলো। ঠিক দুপুরবেলায় আমরা একটা চাতালের মতো প্রশস্ত জায়গায় এসে হাজির হলাম। সেখান থেকে দেখা গেলো, আগ্নেয়গিরির তিনটি জ্বালামুখ সর্বনাশের আভাস নিয়ে অন্ধকার মুখকে বিস্ফারিত করে আছে। এক-একটি মুখের পরিধি প্রায় একশো ফুট করে। স্নেফেল যেন আমাদের গ্রাস করবার জন্যেই এই গহ্বর তিনটে তৈরি করেছে। আমার এতো ভয় করলো, যে গহ্বরগুলোর কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকাতে পর্যন্ত সাহস হলো না।
কাকামণি তখন পাগলের মতো ছুটে-ছুটে মুখগুলো দেখছেন, আর আপনমনে কত-কী বকে চলেছেন। তার রকম-সকম দেখে এই প্রথম হাসকে পর্যন্ত একটু অবাক দেখালো, সে আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো তার কাণ্ড।
হঠাৎ কাকামণি তীব্র গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন। সেই তীব্র কণ্ঠস্বরে চারপাশ গমগম করে উঠলো। আমি তো হঠাৎ এমন চাচানো শুনে মনে করলাম, কাকামণি বুঝি-বা সেই তলহীন গহ্বরের মধ্যেই পড়ে গেছেন! তাকিয়ে দেখি, বড়ো একটা পাথরের সামনে গোল-গোল চোখে দাঁড়িয়ে আছেন উনি।
কাকামণির চোখে-মুখে এমন বিস্ময় দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলুম। তাড়াতাড়ি পাশে এসে দাঁড়াতেই কাকামণি আঙুল দিয়ে দেখালেন, সেই পাথরটার উপর কতকগুলি রুনিক হরফ খোদাই করা। কোনো-কোনো জায়গায় ক্ষয়ে গেলেও কোনোমতে পড়া গেলো। পাথরটার গায়ে লেখা : আর্ন্ সাক্ন্যুউজম্।