সঞ্জয় বলেন, রাজা শুন সাবধানে।
ধনু ঊর্দ্ধে নিয়া পার্থ কহে নারায়ণে।।
দুই দল মধ্যে রথ রাখ নারায়ণ।
যতেক বিপক্ষগণে করি নিরীক্ষণ।।
কার সনে যুঝিব, মারিব কারে বাণ।
ক্ষণেক রাখহ রথ পুরুষ-প্রধান।।
এত শুনি রথ স্থির কৈলা নারায়ণ।
যতেক বিপক্ষ পার্থ করে নিরীক্ষণ।।
পিতৃতুল্য পিতামহ ভীষ্ম মহাবীর।
মন্মথ জিনিয়া মূর্ত্তি সুন্দর শরীর।।
বদন পঙ্কজ পূর্ণচন্দ্র অখন্ডিত।
করি-কর ভুজ নাসা গৃধিনী-নিন্দিত।।
শিরীষ জিনিয়া তাঁর সুকোমল তনু।
কাঞ্চন পর্ব্বতশৃঙ্গ-গর্জ্জিত সুজানু।।
দেখিয়া করুণা হৈল পার্থের হৃদয়ে।
তবে পুনঃ নিরীখয়ে দ্রোণ মহাশয়ে।।
শ্যাম তনু নাসা হনু ভুজ করি-কর।
কোটি শশি-মুখরুচি বদন সুন্দর।।
রম্ভাতরু জিনি ঊরু আঁখি মনোহর।
হরিকাটি জিনি কটি নাভি সরোবর।।
শিরীষ কুসুম-তনু বিশাল বদন।
দেখিয়া বিস্মিত-তনু হইল অর্জ্জুন।।
তবে অশ্বত্থামা কৃপ প্রতীপ নন্দন।
একে একে কুরুগণে কৈল নিরীক্ষণ।।
জ্ঞাতি বন্ধু বান্ধব মাতুল গুরুজন।
একে আরোধিক রূপ সবেতে সমান।।
যুঝিবারে আইল গুরু জ্ঞাতি বন্ধুগণ।
কোন্ শক্তি এ সবারে করিব নিধন।।
যদি কদাচিৎ আমি মারব সবারে।
মোর সম নিদারুণ নাহিক সংসারে।।
মোর সম পাপী তবে নাহি অতিশয়।
এতেক ভাবিয়া কৃষ্ণে কহে ধনঞ্জয়।।
অবধানে জগন্নাথ শুন নিবেদন।
যুঝিবারে আইল আমার বন্ধুগণ।।
কারে অস্ত্র মারিব যুঝিবে কোন্ বীর।
শোকেতে আকুল হৈল আমার শরীর।।
অঙ্গ মোর হৈল শ্লথ বল নাই তনু।
শরীর লোমাঞ্চ হৈল কাঁপে বক্ষ জানু।।
জ্ঞাতি বন্ধু বধিব রাজ্যের অভিলাষে।
যুদ্ধে কার্য্য নাহি, পুনঃ যাব বনবাসে।।
এত বলি অধোমুখে বসিলা অর্জ্জুন।
হাত হৈতে খসিল গাণ্ডীব শর তূণ।।
অর্জ্জুনের মুখ দেখি দেব নারায়ণ।
পার্থ প্রতি কহে প্রভু প্রবোধ-বচন।।
জ্ঞাতি-বন্ধু বধ হেতু ভয় হয় মন।
অহঙ্কারে আপনারে না জান অর্জ্জুন।।
উপস্থিত যুদ্ধকালে করহ এমন।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি হয়ে বিচক্ষণ।।
যোগতত্ত্ব কহি কিছু শুনহ অর্জ্জুন।
শুনিলে মনের ভ্রান্তি হইবে খণ্ডণ।।
কাহার শকতি কারে মারিবারে পারে।
কর্ম্ম অনুসারে ভোগ ভুঞ্জয়ে সংসারে।।
আমার মায়েতে বন্দী এ সব সংসার।
আমাতে উৎপত্তি স্থিতি, আমাতে সংহার।।
সত্ত্বগুণে রক্ষা আমি করি যে পালন।
রজোগুণে সৃষ্টি তমোগুণেতে নিধন।।
কাল নামে পুরুষ আমার মূর্ত্তি ধরে।
কালেতে ভুঞ্জয়ে ভোগ, কালেতে সংহারে।।
আমার বিভূতি হয় এ তিন ভুবন।
সর্ব্বঘটে আত্মরূপে থাকি অনুক্ষণ।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম দুই মূর্ত্তি আমার স্বরূপে।
সর্ব্বত্র সমান আমি হই বিশ্বরূপে।।
এত শুনি অর্জ্জুন বিস্ময় হৈল মনে।
জিজ্ঞাসিল গোবিন্দেরে করুণ বচনে।।
বিভূতি বিস্তার দেব কিরূপ তোমার।
শুনিবারে ইচ্ছা মোর ইহার বিচার।।
এত শুনি হাসি বলে দেবকী-কুমার।
একচিত্ত হয়ে শুন বিভূতি আমার।।
সর্ব্বঘটে স্থিতি মোর সর্ব্বত্র সমান।
শুন পার্থ যেইরূপে আমি বিদ্যমান।।
রুদ্রগণ মধ্যে আমি দেব পশুপতি।
নক্ষত্রগণের মধ্যে নাম অভিজিতি।।
ঐরাবত নাম মোর হস্তিগণ মাঝে।
যক্ষগণ মধ্যেতে কুবের মহারাজে।।
পশুগণে মধ্যে হই স্বরূপে কেশরী।
আদিত্যের মধ্যে নাম ধরি যে প্রহরী।।
বসুগণে বিশ্বাবসু ধরি আমি তনু।
কপিগণ মধ্যে আমি নাম ধরি হনু।।
দেবগণ মধ্যে আমি ইন্দ্র দেবরাজ।
বরুণ-স্বরূপ আমি জলচর মাঝ।।
ঋষিতে নারদ আমি, মুনিগণে প্রকাশ।
সেনাপতিগণের মধ্যে মরুত স্বরূপ।।
অগ্নিমধ্যে নাম আমি ধরি বৈশ্বানর।
অসুরেতে হিরণ্যক্ষ অসুর প্রবর।।
রাক্ষসগণের মধ্যে নাম বিভীষণ।
ভক্তগণ মধ্যে নাম প্রহ্লাদ ধারণ।।
মাস মধ্যে নাম আমি ধরি যে অঘ্রাণ।
পুষ্প মধ্যে পারিজাত নাম নিরূপণ।।
যজ্ঞ মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ অনুপাম।
ক্ষত্রগণ মধ্যেতে ভরত মোর নাম।।
শিল্পিগণ মধ্যে নাম বিশ্বকর্ম্মা ধরি।
মায়া মধ্যে নাম মোর বন্ধুগণে মারি।।
ছয় ঋতু মধ্যেতে বসন্ত নাম মোর।
দৈত্যগণ মধ্যে বিরোচনের কোঙর।।
অহিংসা স্বরূপ নাম ধর্ম্ম মধ্যে ধরি।
স্থান মধ্যে নাম মোর বৈকুণ্ঠ-নগরী।।
পর্ব্বতগণে মধ্যে সুমেরু স্বরূপ।
এই সব কথা কহি যোগ অনুরূপ।।
মণিরত্ন মধ্যেতে কৌস্তুভ নাম মোর।
ধাতুদ্রব্য মধ্যেতে সুবর্ণ নাম ধর।।
এইরূপ বহুবিধ আমার বিভূতি।
গণনা করিতে পারে কাহার শকতি।।
এত শুনি সন্তুষ্ট হলেন ধনঞ্জয়।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল করিয়া বিনয়।।
কিরূপে তোমার ধ্যান করে যোগিগণ।
কহ শুনি জনার্দ্দন যোগের লক্ষণ।।
গোবিন্দ বলিল, সখা শুন একমনে।
বড়ই দুষ্কর লভে যোগিগণ ধ্যানে।।
দ্বিজকুলে জন্মি গুরু উপদেশ লবে।
গৃহাশ্রমে ধন্ধ ছাড়ি অরণ্যে পশিবে।।
আপন উদ্যান ব্যানে শোধিবে শরীর।
আমাতে আরোপি মন চিত্ত করি স্থির।।
গোকর্ণ প্রমাণ স্থান করি পরিষ্কার।
মনোময় কল্পিত বিবিধ উপহার।।
হস্তপদ প্রক্ষালন করি আচমন।
পূর্ব্বমুখে আসন করিবে নিরূপণ।।
যথা যোগশাস্ত্র মতে করিয়া আসন।
যেরূপে করিবে ধ্যান শুনহ অর্জ্জুন।।
পূর্ব্বভিতে দক্ষিণে বা উত্তর মুখেতে।
করিবে আসন দিব্য নির্ণয় যেমতে।।
পাবক স্তম্ভবায়ু করিবে সেচন।
পূর্ব্বেতে পূরক বায়ু করিবে রেচন।।
দক্ষিণে রেচক বায়ু করিবে রোধন।
উত্তরে কুম্ভক বায়ু করি নিঃসারণ।।
এইরূপে প্রাণ বায়ু করিবে শাসন।
এই সব যোগতত্ত্ব করিলে শ্রবণ।।
এইরূপ আমার চিন্তিবে তদন্তর।
দ্বিভুজ পদ্মাক্ষ বক্ষঃস্থলে রত্নহার।।
শ্রীবৎস লাঞ্ছন আমি পীতাম্বরধারী।
কিরীট কুণ্ডল কর্ণে বিচিত্র কবরী।।
বনমালা বিকশিত কণ্ঠে মণিহার।
ত্রিভঙ্গ ললিত অঙ্গ মুক্তি-অবতার।।
এই দিব্যরূপ ধ্যানে আমারে চিন্তিবে।
অবহেলে যোগী তবে ভবপার হবে।।
সূক্ষ্মরূপ আমার চিন্তিবে অনুপাম।
গবাক্ষ মার্ত্তণ্ডগত রজোগুণ ধাম।।
এসরেণু প্রমাণ সুন্দর কলেবর।
সুচারু যে সূক্ষ্মমূর্ত্তি শঙ্খচক্রধর।।
কিরীট কুণ্ডল দিব্য বনমালাধারী।
নূপুর কঙ্কণ করে শোভিত মুরারি।।
এই দিব্য সূক্ষ্মরূপ চিন্তিবে আমার।
সূক্ষ্মরূপ চিন্তিলেই হেলে হবে পার।।
এত শুনি পুনরপি কহেন অর্জ্জুন।
কহিলে গোবিন্দ তুমি অপূর্ব্ব কথন।।
কর্ম্মযোগ ক্রিয়াযোগ কিরূপ তোমার।
কর্ম্মযোগ করি যোগী কিরূপে হয় পার।।
কি কর্ম্ম করিয়া নর ভজিবে তোমারে।
কর্ম্মযোগ কহ প্রভু করিয়া বিস্তারে।।
গোবিন্দ বলেন সখা কর অবধান।
অনন্ত কর্ম্মের যোগ নাহি পরিমাণ।।
কিছু অল্প কহি শুন হৈয়া সাবহিত।
সংসারী জনের এই কর্ম্মের বিহিত।।
দ্বিজকুলে জন্মি বেদ করিবে পঠন।
আত্মধর্ম্ম রাখিয়া ভজিবে নারায়ণ।।
পূর্ব্বভিতে সমভাবে করিবে চিন্তন।
কারো সনে বিরোধ না করিবে কখন।।
শত্রু-মিত্র ভাব না করিবে কদাচন।
পুত্র মিত্র বন্ধুগণে করিবে পালন।।
যে যে ইচ্ছা করে বন্ধু মিত্র ভ্রাতৃগণ।
তাহা দিয়া তার মন করিবে তোষণ।।
যজন যাজন আদি করিবে বন্দন।
নিত্য ভিক্ষা করিবে বুঝিয়া মহাজন।।
ত্রিসন্ধ্যা করিয়া স্নান গায়ত্রী জপিবে।
এইরূপে বিপ্রগণ আমারে ভজিবে।।
ক্ষত্রকুলে জন্মিয়া শাসিবে ভূমণ্ডল।
বন্ধু বান্ধব আদি পালিবে সকল।।
সমুচিত বিধানে পালিবে প্রজাগণ।
কারো সনে দ্বন্দ্ব না করিবে কদাচন।।
দেবযজ্ঞ পিতৃযজ্ঞ সতত করিবে।
একান্ত ভকতি করি আমারে ভজিবে।।
এইরূপে কতকাল রাজত্ব করিবে।
তিন ভাগ আয়ুক্ষয় যাবত নহিবে।।
অবশেষে পুত্রে রাজা দিয়া রাজ্যভার।
ভার্য্যাসহ প্রবেশিবে অরণ্য ভিতর।।
বাণপ্রস্থ ধর্ম্ম তবে করি আচরণ।
ফলমূলাহরী হবে তপস্বী-লক্ষণ।।
যোগাসন করিয়া ত্যজিবে কলেবর।
দিব্যরথে চড়ি যাবে ইন্দ্রের নগর।।
সহমৃতা হবে তার ভার্য্যা গুণবতী।
পতি সহ ইন্দ্রপুর করিবে বসতি।।
কতকাল পত্নীসহ স্বর্গভোগ করি।
পুনরপি আসি জন্ম আসি লবে মর্ত্ত্যপুরী।।
রাজকুলে জন্ম আসি লবে দুইজন।
সেইরূপে ভোগ পুনঃ করিবে বর্জ্জন।।
এইরূপে ক্রমে ক্রমে ভজিবে আমারে।
বহুকাল পরে সেই যাবে স্বর্গপুরে।।
বৈশ্যকুলে জন্মি মাত্র অতিথি-সেবন।
শূদ্রকুলে মহাধর্ম্ম দ্বিজ-পরায়ণ।।
দাস ভাব করিয়া সেবিবে দ্বিজগণে।
সর্ব্বকর্ম্ম সমর্পিবে ব্রাহ্মণ চরণে।।
অবিদ্য সবিদ্য বেদহীন দ্বিজগণ।
তথাপি আমার তনু জানিহ অর্জ্জুন।।
এই গৃহাশ্রমে ধর্ম্মাধর্ম্ম-নিরূপণ।
চতুর্ব্বিধ পরকাল করিলে লক্ষণ।।
এত শুনি অর্জ্জুন বিস্ময় হৈয়া মনে।
করযোড়ে পুনঃ জিজ্ঞাসিলা নারায়ণে।।
যোগধর্ম্ম তুমি নাথ কহিলে আপনে।
অচিরে তোমারে যোগী পায় যোগধ্যানে।।
বহুকাল সেবি পায় গৃহাশ্রমা জনে।
তোমাতে ভকত যেই সে পায় কেমনে।।
এত শুনি হাসিয়া বলেন জনার্দ্দন।
আমাতে করিলে যোগী তনু মন ধন।।
আমা বিনে যোগীগণ না জানয়ে আন।
আমি গতি আমি পতি আমি ধন প্রাণ।।
তেকারণে অল্পকালে লভে ত আমায়।
জন্ম জন্মান্তরে গৃহাশ্রম ধর্ম্ম পায়।।
এত শুনি পুনরপি বলিল অর্জ্জুন।
কিরূপ তোমার ভক্তি, ভকতি লক্ষণ।।
গোবিন্দ বলেন সখা শুন একমনে।
অনন্ত আমার ভক্তি ভকতি লক্ষণে।।
সর্ব্বজন হিত আমি করি অনুক্ষণ।
সর্ব্বজীবে সমভাব আমার করণ।।
সাত্ত্বিক ভকতি যেই জানিহ নিশ্চয়।
আমাতে বিভিন্ন তার কদাচিত নয়।।
গো-ব্রহ্ম-ভয়ার্ত্তে যেই করয়ে রক্ষণ।
সর্ব্বকর্ম্ম আমারে যে করে সমর্পণ।।
আমাতে অর্পিত চিত্ত সেবয়ে শরীর।
ভকত উত্তম সেই সর্ব্বগুণ ধরি।।
পুণ্যতীর্থে সদা যেই করয়ে ভ্রমণ।
আমার মন্দির সদা করয়ে মার্জ্জন।।
সর্ব্বজীবে তোষে ধন-বাক্য-ব্যবহারে।
উত্তম ভকত সেই বলিনু তোমারে।।
বৃত্তি দিয়া ব্রাহ্মণে স্থাপয়ে যেই জন।
অন্নজল দান দিয়া তোষে দুঃখিগণ।।
ভকত উত্তম সেই জানহ অর্জ্জুন।
এইরূপ বহুবিধ ভক্তের লক্ষণ।।
যতেক ভকতি আর ভক্তের লক্ষণ।
একে একে যোগধর্ম্ম কৈল নারায়ণ।।
ক্রমে ক্রমে তাঁরে পার্থ যত জিজ্ঞাসিল।
বিবরিয়া জগন্নাথ সকলি কহিল।।
অষ্টাদশ অধ্যায় ভারত যোগসার।
বহুবিধ ভক্তিযোগ-মার্গ ব্যবহার।।
কহিয়া তুষিল কৃষ্ণ অর্জ্জুনের মন।
তাহা কি লিখনে যায় অসংখ্য কথন।।
ভীষ্মপর্ব্বের কথা অমৃত-লহরী।
কাহার শকতি তাহা বর্ণিবারে পারি।।
শ্রুতমাত্র কহি আমি পাঁচালির ছন্দ।
রসিক সজ্জন হেতু সুধা মকরন্দ।।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া পয়ার।।