ওরা অন্য বোটে জোজোকে নিয়ে এসেই তার চোখ বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে নীচে শুইয়ে ফেলে একজন তার দুটো পা চাপিয়ে রাখল জোজোর বুকের ওপর।
এদের এত সাংঘাতিক নিষ্ঠুরতা দেখে জোজো একেবারে হতবাক হয়ে গেছে। নরেন্দ্র আংকলকে মেরেই ফেলল? কাকাবাবু অনেক সময় গুন্ডা-বদমাশদের সামনেও ঠাট্টা ইয়ার্কি করে, কিন্তু এ একেবারে জীবন-মরণের ব্যাপার।
জোজো ভাবল, এরা হয়তো তাকেও মেরে ফেলবে। কাকাবাবু যদ্দিন ডিমেলোকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে না পারেন … এরা তিনদিন সময় দিয়েছে। তা হলে আর তিনদিন অন্তত জোজোর আয়ু আছে। তিনদিন মানে বাহাত্তর ঘণ্টা, এর মধ্যে জোজো একটুও ঘুমোবে না। তার আয়ুর একটা মিনিটও সে নষ্ট করতে চায় না।
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে যে-ভাষায় কথা বলছে, তা কিছুই বুঝতে পারছে
জোজো। কতক্ষণ ধরে বোটটা চলছে, তাও সে আন্দাজ করতে পারছে না। এইরকম সময়ে এক-একটা মুহূর্তকেও খুব লম্বা মনে হয়।
সে মনে মনে এক, দুই গুনতে লাগল। গুনতে গুনতে এক হাজার হয়ে গেল। তার মানে মোলো মিনিট, চল্লিশ সেকেন্ড। এখনও বোট চলছে। সে আবার গুনতে শুরু করল এক থেকে। এইভাবে সময় কাটবে। আর ওরা তাকে কতটা দূরে নিয়ে যাবে, তাও আন্দাজ করা যাবে।
তার বুকের ওপর পা রেখেছে, ক্রমশই তা বিষম ভারী লাগছে। এরা যদি তিনদিন বাদে খুন করেই ফেলতে চায়, তা হলে কীভাবে মারবে? গুলি করে, না গলা টিপে? গুলিই ভাল, তাতে বেশি ব্যথা লাগবে না, তারপরই সে মনে মনে আর্তনাদ করে উঠল, না, না, না, আমি মরতে চাই না। কিছুতেই মরব না। আমাকে পালাতে হবে। সন্তু আর কাকাবাবু নিশ্চয়ই আমাকে বাঁচিয়ে দেবেন।
সে আবার এক, দুই গুনতে শুরু করল। প্রায় আড়াই হাজার গোনার পর বোটটা থেমে গেল। জোজো ভাবল, এবার তাদের নামতে হবে।
কিন্তু নামার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। লোকগুলো উত্তেজিতভাবে কী যেন বলাবলি করছে।
বোটটা থেমে থাকলে তো সময়ের দূরত্ব বোঝা যাবে না। আর গুনে লাভ নেই।
খানিক বাদে বোটটা আবার চলতে শুরু করল। বোধহয় ওরা দিক ভুল করেছিল।
আরও প্রায় আধঘণ্টা বাদে বোটটা থামল আবার। এবার ওদের একজন। জোজোর জামার কলার ধরে দাড় করিয়ে দিয়েই মাথার ওপর দিয়ে একটা প্লাস্টিকের থলে গলিয়ে দিল।
জোজো কিছুই দেখতে পাবে না।
বোট থেকে যেখানে নামতে হল, সেখানে হাঁটুজল। জোজোর জুতো আর প্যান্ট ভিজে গেল খানিকটা।
খানিকটা জল ভেঙে পাড়ে উঠে আবার হাঁটতে হল কয়েক মিনিট। জোজো অন্ধের মতন হাঁটছে, একজন তার কাধ ধরে আছে।
এক জায়গায় তার মাথা ঠুকে গেল। সেটা কোনও গাছের সঙ্গে না কীসের সঙ্গে, তা বোঝা গেল না।
তারপর এক জায়গায় থেমে জোজোর মাথা থেকে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগটা তুলে নেওয়া হল।
আগের দিন দেখা সেই লম্বা লোকটিই সম্ভবত এদের মধ্যে মোটামুটি ইংরিজি জানে।
সে জোজোকে বলল, ওরে ছেলে, তুমি এই ঘরে থাকবে, তোমার হাত ও মুখ বাঁধা থাকবে। খাওয়ার সময় খুলে দেওয়া হবে। এ বাড়ির বাইরে দুটো ডোবারম্যান কুকুর ছাড়া থাকে। পালাবার চেষ্টা করলে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।
সবাই বেরিয়ে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল বাইরে থেকে।
প্রথমেই একটা ব্যাপারে জোজো নিশ্চিন্ত হল। এরা খাবার খেতে দেবে। সে খিদে সহ্য করতে পারে না। খুব ভাল করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরুনো হয়েছিল, এখনও অবশ্য তার খিদে পায়নি।
ঘরটাও খারাপ নয়।
সাধারণত অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দিদের আটকে রাখা হয়। এ ঘরে বেশ আলোহাওয়া আছে। পুরনো আমলের বাড়ি, ওপরের দিকে রয়েছে স্কাইলাইট। একটা
জানলা খোলা। সেটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বড় বড় গাছ। নারকোল গাছই বেশি।
জোজো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, এই ঘরেই তাকে থাকতে হবে কিছুদিন। সন্তুও আসতে চেয়েছিল, ইস, কেন যে ওরা সন্তুকে আসতে দিল না। দুজনে থাকলে বেশ সময় কেটে যেত।
ঘরের মধ্যে একটা খাট আছে, আলমারি আছে। কিন্তু চেয়ার-টেবিল নেই। জোজো খোলা জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। আরও দুটো জানলা আছে। বন্ধ। বাইরে কুকুরের গম্ভীর ডাক শোনা গেল একবার, কিন্তু কুকুরটাকে দেখা গেল না।
গাছগুলোর তলায় অনেক শুকনো পাতা খসে পড়ে আছে, অনেকদিন পরিষ্কার করা হয়নি। তাই দেখে জোজোর মনে হল, ওটা বাগান, না জঙ্গল? যদি বাগান। হয়, তা হলে কেউ ব্যবহার করে না।
এবার সে ঘরটার চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল, ওপরের দিকে কোণে কোণে ঝুল জমে আছে। বিছানায় যে চাদরটা পাতা, তার ওপরেও ধুলো। এ ঘরটাতেও কেউ অনেকদিন থাকেনি।
তা হলে কি এটা একটা খালি বাড়ি?
অন্য দুটো জানলার ছিটকিনি এত টাইট হয়ে আছে যে, জোজো অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারল না। তার হাত বাঁধা, বেশি জোর দিতেও পারছে না। সরু লোহার চেন দিয়ে হাত বেঁধেছে, কুকুরের গলার চেনের মতন।
দাঁত দিয়ে সেই বাঁধন খোলার চেষ্টা করেও বুঝল, লাভ নেই। একটা ছোট্ট তালা লাগানো আছে।
কখন খেতে দেবে? বাইরের দিকে রোদের রং দেখলে মনে হয়, একটা-দেড়টা বাজে। এতক্ষণে তাদের রাবার দ্বীপে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। লছমন রাও আর তারিক আলি মিলে অনেক কিছু রান্না করত।
কাঠের আলমারিটায় তালা নেই, একটু টানাটানি করতেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে প্রায় কিছুই নেই। তলার দুটো তাকে কয়েকটা কম্বল আর বালিশ, ওপরে দিকে কয়েকটা গেলাস আর প্লাস্টিকের থালা আর খালি সোডার বোতল।
একটাও বই নেই? কাউকে আটকে রাখতে অন্তত কয়েকখানা বই পড়তে দেওয়া উচিত। জোজো শুনেছে, জেলের কয়েদিদেরও পড়ার জন্য বই দেওয়া হয়। কেউ কেউ তো জেলে থাকতে থাকতেই পরীক্ষায় পাশ করে।
একটা গাড়ির আওয়াজ পেতেই জোজো ছুটে গেল জানলার কাছে।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা নীল রঙের মারুতি ভ্যান এই দিকেই আসছে। এ বাড়ির কাছাকাছি এসে থামল।
সে গাড়ি থেকে প্রথমে নামলেন একজন বৃদ্ধ লোক, তারপর যোলো-সতেরো বছর বয়েসি একটি মেয়ে। বৃদ্ধটি সুটপরা, চোখে কালো চশমা। আর মেয়েটির মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, পরে আছে শালোয়ার-কামিজ।
ওদের দুজনকে দেখলে গুন্ডা-ডাকাতদের দলের লোক বলে মনেই হয় না। জোজো জানলার গ্রিলে মুখটা চেপে ধরল। তার তো শব্দ করার উপায় নেই, জানলার বাইরে হাত বার করতেও পারবে না।
যদি ওরা তাকে দেখতে পায়।
মেয়েটি এদিকে তাকাল না, বৃদ্ধটির সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল।
হাত বাঁধার চেয়েও মুখ বাঁধার জন্য জোজোর কষ্ট হচ্ছে বেশি। কতক্ষণ সে একটাও কথা বলতে পারেনি। কথা বলার সঙ্গী না পেলেও সে গুন গুন করে গান গাইতে তো পারত।
সারাটা দুপুর কেটে গেল, তবু খাবার এল না। এখন জোজোর পেটের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। এ কী, লম্বা লোকটা যে বলে গেল, খাবার সময় হাত আর মুখ খুলে দেবে? ভুলে গেল নাকি!
খাটটা ছাড়া আর বসার কোনও জায়গা নেই। এক সময় জোজো বসল, খিদেতে অবসন্ন হয়ে তার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হল।
জোজো এক মিনিটও ঘুমোবে না ভেবেছিল, এরই মধ্যে ঘুম এসে গেল তার।
কুকুরের ডাকে তার ঘুম ভাঙল। ধড়মড় করে উঠে বসে জানলা দিয়ে দেখল, বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধে হয়ে এল, অর্থাৎ সারাদিন সে খায়নি। খিদেটা বেড়ে গেল আরও।
কুকুরের ডাকটা কাছে এগিয়ে আসছে। এবার কেউ চাবি দিয়ে দরজা খুলল।
লোকটিকে চিনতে পারল জোজো। এ সেই ভিকো। লম্বা লোকটির সঙ্গে ছিল। তবে এ লোকটি কোনও কথা বলে না।
ভিকোর হাতে কোনও অস্ত্র নেই। একটা বড় বাটি আর জলের বোতল। কুকুরটাকে বসিয়ে রাখল ঠিক দরজার পাশে।
জোজো এমনিতেই কুকুরকে ভয় পায়। এই কুকুরটার হিংস্র মুখ দেখেই ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। কুকুরটা গ-র-র-গ-র-র শব্দ করল দুবার।
ভিকো ঘরের মধ্যে বাটি আর জলের বোতল মেঝেতে নামিয়ে রেখে
জোজোর একটা হাত আর মুখের বাঁধন খুলে দিল।
মুখটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে জোজো বলল, উঃ বাঁচলুম। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ!
ভাই, তোমরা তো এ ঘরের দরজাই বন্ধ করে রাখছ, তা হলে শুধু শুধু হাত আর মুখ বাঁধার দরকার কী?
ভিকো তার কথা বুঝল কি না কে জানে, একটুক্ষণ জোজোর দিকে তাকিয়ে থেকে আঙুল দিয়ে বাটিটা দেখাল।
তার মানে, জোজোকে ওর সামনেই এখুনি খেয়ে নিতে হবে। তারপর সে বাটিটা নিয়ে যাবে। আবার হাত, মুখ বাঁধবে বোধহয়।
জোজো বলল, বাথরুম! একবার বাথরুম যাব। লোকটি সে কথাও গ্রাহ্য না করে আবার আঙুল দেখাল বাটিটার দিকে।
জোজো বলল, হাত না ধুয়ে খাব কী করে? তা ছাড়া খুব হিসি পেয়েছে!
এবারও ভিকো তার কথায় পাত্তা দিল না দেখে জোজো পেট ধরে উঃ উঃ শব্দ করল। হাত দিয়ে বাইরেটা দেখাল।
এবার ভিকো বুঝল। জোজোর এক হাতে তখনও চেন বাঁধা, সেটা ধরে টেনে জোজোকে ঘরের বাইরে নিয়ে এল। কুকুরটার পাশ দিয়েই বেরোতে হল জোজোকে, সেটা গর গ-র-র গ-র-র করে উঠল আবার। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল জোজো।
পালাবার চেষ্টা করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কুকুরটা এক মিনিটের মধ্যে তাকে কামড়ে দিয়ে শেষ করে দিতে পারে। আর ভিকোর যা চেহারা সে তুলে আছাড় দিতে পারে জোজোকে।
বাইরে একটা লম্বা বারান্দা। পাশে একটা উঠোন, সেখানে অনেকগুলো টবে আগে ফুলগাছ ছিল, এখন সব কটা গাছ মরে গেছে।
বারান্দার মাঝখান দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়, সেখানে একটা আলো জ্বলছে।
বারান্দায় শেষ প্রান্তে বাথরুম। তার মধ্যে জোজোকে ঢুকিয়ে দিয়ে ভিকো দাঁড়িয়ে রইল বাইরে।
বাথরুমটা বেশি বড় নয়, একটা মাত্র জানলা। এ জানলায় গ্রিল নেই, বহু পুরনো আমলের মোটা মোটা গরাদ। জোজো হাত দিয়ে দেখল, কোনও সাধারণ মানুষ সে গরাদ ভাঙতে পারবে না। এখান থেকেও পালাবার সাধ্য তার নেই।
একটু দেরি হতেই দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল ভিকো।
বেরিয়ে আসার পর ঘরের দিকে যেতেই পায়ের শব্দ শোনা গেল সিঁড়িতে। সেই বৃদ্ধ আর কিশোরী মেয়েটি নেমে আসছে। ওরা এ বাড়িতেই থাকে নাকি?
এবার মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হল জোজোর। মেয়েটির চোখে যেন অবাক অবাক ভাব। বৃদ্ধটিও থমকে দাঁড়িয়ে জোজোকে দেখতে লাগলেন।
ওরা কি জানে না যে জোজোর মতন একজনকে বন্দি করে রাখা হয়েছে এ বাড়িতে? গুন্ডাদের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক?
জোজো হঠাৎ চেঁচিয়ে নিজের নামটা জানাতে গেল। কিন্তু মাই নেম ইজ বলার পরেই সে কাঁধের ওপর একটা বিরাট রদ্দা খেয়ে চুপ করে গেল। দুপা গিয়ে আবার সে চিৎকার করল, আই অ্যাম আ প্রি- আবার রদ্দা।
এবারের রদ্দায় চোখে সর্ষে ফুল দেখে জোজো মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিল, ভিকো তাকে টানতে টানতে নিয়ে এল ঘরের মধ্যে। ভেজিয়ে দিল দরজাটা।
এরপর সে জোজোকে জোর করে বসিয়ে দিল বাটিটার সামনে।
অর্থাৎ এখন খেতেই হবে।
বাটিটা অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মোড়া। সেটা খুলতে দেখা গেল, তার মধ্যে রয়েছে ছখানা হাতে গড়া রুটি আর খানিকটা উঁড়সের ঘাট আর কয়েকখানা আলু ভাজার মতন কিছু। সেগুলো মোটাসোটা, আসলে আলু নয়, কাচকলা ভাজা।
ব্যস, এই খাবার? এরা এত কৃপণ কেন? গুন্ডামি-ডাকাতি করে তো অনেক টাকা রোজগার করে, বন্দিদের একটু ভাল খেতে দিতে পারে না?
সে ভিকোর দিকে একবার তাকাল। একে কিছু বলে লাভ নেই। কোনও উত্তর দেবে না। সত্যিই বোবা কি না কে জানে!
কাকাবাবু অনেকবার বলেছেন, হাতের সামনে খাবার পেলে অবহেলা করবে
। যা খাবারই হোক পেট ভরে খেয়ে নিতে হয়। কেন না, পরে আবার কিছু খাওয়া যাবে কি না কে জানে!
সাড়ে চারখানা রুটির বেশি খেতে পারল না জোজো। উঁড়সের তরকারির স্বাদটা টকটক, খেতে মন্দ নয়, কিন্তু কঁচকলা ভাজা মোটেই মুখে রুচল না জোজোর।
বোতলের একটু জল খরচ করে সে হাত ধুয়ে নিল। ভিকো আবার তার মুখ ও হাত বেঁধে দিল আগের মতন। কুকুরটা সব দেখছে।
আবার দরজা বন্ধ হওয়ার পর জোজো দৌড়ে গিয়ে দরজায় কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, কেউ কিছু বলছে কি না।
সেই বৃদ্ধ আর কিশোরী মেয়েটি তাকে দেখেও কোনও সাড়াশব্দ করল না। তার হাত চেন দিয়ে বাঁধা, দৈত্যের মতন চেহারা ভিকোর, তার কাধে অত জোরে ঘুসি মারল, তবু বাধা দিল না একটুও। তার মানে, ওরাও এই দলেরই।
বৃদ্ধটির বেশ ব্যক্তিত্ব আছে, মনে হয় সমাজের উঁচু মহলের মানুষ। আর মেয়েটি কী সুন্দর, ফরসা মুখোনিতে সারল্য মাখা, এরাও গুন্ডা-বদমাশদের সঙ্গে যুক্ত থাকে? ছিঃ!
এরকম সন্ধেবেলা খাবার আনার মানেটাও জোজোর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। রাত্তিরে আর কিছু দেবে না। সারাদিনে একবেলা খাবার। সত্যি, এরা এত কৃপণ! নিজেরা নিশ্চয়ই দুবেলাই খায়।
আচ্ছা, এখানে তার বদলে যদি সন্তু থাকত, তা হলে সে কী করত?
সন্তু আগেও কয়েকবার বন্দি হয়েছে, নিজে নিজেই ঠিক বেরিয়ে এসেছে। কাকাবাবু বলেন, সন্তুকে ধরে রাখার সাধ্য কারুর নেই।
এখান থেকে কী ভাবে বেরোত সন্তু?
সন্তু অবশ্য কুকুর দেখলে ভয় পায় না। তা হলেও, এরা কুকুরদের ট্রেনিং দিয়ে রাখে, কারুর দিকে লেলিয়ে দিলে কুকুর তো তাকে কামড়াবেই।
খাওয়ার সময়ই একমাত্র দরজা খোলে। এই দরজা কিংবা জানলা ভাঙার ক্ষমতা সন্তুরও হত না। তা হলে?
সন্তু কিছু-না-কিছু চেষ্টা করতই।
সন্তু ক্যারাটে জানে। ভিকো নামের লোকটার গায়ে যতই জোর থাক, আচমকা ক্যারাটের প্যাঁচ মারলে ভিকোও ঘায়েল হয়ে যাবে। আর কুকুরটার দিকে যদি খাবারের বাটিটা এগিয়ে দেওয়া হয়? কুকুরটা তখন খাবার খেতেই ব্যস্ত থাকবে। ডোবারম্যান কুকুর কি নিরামিষ খায়? সেই না কথায় আছে, খিদে পেলে বাঘেও ঘাস খায়। সুতরাং কুকুরটার কতটা খিদে পেটে থাকে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
জোজো সন্তুর মতন ক্যারাটে জানে না বটে, কিন্তু জোজোর জলের বোতলটা দিয়ে ভিকোর মাথায় মারলে নিশ্চয়ই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে।
তারপরেই তার খেয়াল হল, জলের বোতলটা কাচের নয়, প্লাস্টিকের। এটা দিয়ে মারলে এমন কিছু লাগবে না।
নাঃ, অপেক্ষা করা ছাড়া জোজোর আর কিছুই করার নেই।
চুপ করে বসে বসে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করা যায়? জোজো কখন ঘুমিয়ে পড়ল তার খেয়াল নেই।
তার ঘুম ভাঙল মেঘের ডাক শুনে।
রাত্রে নিশ্চয়ই বৃষ্টি হয়েছে, জানলা দিয়ে জলের ছাট এসে পড়েছে মেঝেতে। তাতেও জোজোর ঘুম ভাঙেনি। এখন আবার বৃষ্টি নামবে মনে হয়।
খাট থেকে নেমে জোজো জানলার কাছে গিয়ে একবার দেখল। বাইরে গাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
জোজোর মনে পড়ল, একটা দিন খরচ হয়ে গেল। আর মাত্র দুদিন। তারপর কী হবে?
এরা সকালে কিছু খেতে দেবে না? জলও তো লাগবে, এক বোতল মাত্র জল, কাল রাত্রেই ফুরিয়ে গেছে। তা ছাড়া হিসিটিসি কোথায় করবে? এ কী অন্যায় কথা। কাউকে বন্দি করে রাখবে বলে কি সাধারণ সুযোগ-সুবিধেগুলোও দেবে না।
জোজো গিয়ে দরজার গায়ে জোরে জোরে ধাক্কা মারতে লাগল। প্রথমে কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া গেল না। যেন কাছাকাছি আর কেউ নেই। কিন্তু ডাকতে তো হবেই। ধাক্কা দিতে দিতে জোজোর কাধ ব্যথা হয়ে গেল।
মিনিটদশেক বাদে খুলে গেল দরজাটা। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই সুন্দরী কিশোরীটি। কোঁকড়া কোঁকড়া চুল ঘেরা তার ফরসা মুখোনিতে তখনও যেন ঘুম মাখা।
সে জোজোর দিকে তাকিয়ে তেলুগু ভাষায় কী যেন বলে গেল, জোজো তার এক বর্ণ বুঝল না।
বুঝলেও তো সে উত্তর দিতে পারত না।
মেয়েটি এবার ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, হু আর ইউ!
রাগে জোজোর গা জ্বলে গেল। তার যে মুখ বাঁধা, তা দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটা? ন্যাকা না হাবাগোবা? মনে মনে সে বলল, আমি যে জন্তু নয়, একজন মানুষ, তাও বুঝতে পারছ না?
এরপর মেয়েটি পরিষ্কার বাংলায় বলল, তোমাকে দেখে বাঙালি মনে হচ্ছে!
মেয়েটির মুখে বাংলা কথা শুনে দারুণ চমকে উঠল জোজো। এই শত্ৰুপুরীতে বাংলা বলা?
তারপরই জোজোর বুকের মধ্যে যেন লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। আরে, এ তো রাধা! আগেরবার দেখা হয়েছিল। ও বাঙালি নয়, কিন্তু বাংলা জানে। এই দু তিন বছরের মধ্যে ও অনেকটা বড় হয়ে গেছে, তাই ঠিক চিনতে পারেনি।
রাধাও তাকে চিনতে পারছে না কেন? একদিন অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। অবশ্য রাত্তিরবেলা। এর মধ্যে জোজোর চেহারার কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে? শুধু নাকের নীচে গোঁফের আভাস দেখা দিয়েছে, সেও কাকাবাবুর মতন গোঁফ রাখবে ঠিক করেছে।
মেয়েটির সঙ্গে কথা বলার উপায় নেই। সে মনে মনে চিৎকার করে বলতে লাগল, রাধা, রাধা, তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি জোজো, সেই যে কাকাবাবুর সঙ্গে, সমুদ্রের ধারে—
বড় হয়ে এ মেয়েটি ডাকাতদের দলে যোগ দিয়েছে? নইলে ও জোজোর মুখের বাঁধন খুলে দিচ্ছে না কেন?
রাধাও শেষ পর্যন্ত ডাকাত? ছি ছি ছি ছি।
এই সময় আবার কুকুরের ডাক শোনা গেল। কুকুরের চেন ধরে নিয়ে আসছে। ভিকো। তার আগেই আর একজন মহিলা চলে এলেন। এর বয়েস অনেক বেশি, অন্তত পঞ্চাশ তো হবেই, সকালবেলাতেই খুব সাজগোজ করা, ঠোঁটে লিপস্টিক।
সেই মহিলা এসে নিজেদের ভাষায় কী যেন বকুনি দিল রাধাকে। রাধাও উত্তর দিল তেড়েফুঁড়ে। শুরু হয়ে গেল দুজনের ঝগড়া।
কুকুরটা স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জোজোর দিকে। জোজো এক পাও এগোতে সাহস করল না।
হঠাৎ ঝগড়া থামিয়ে মহিলাটি ভিকোকে কী যেন আদেশ করলেন।
ভিকো অমনি জোজোর কাধ ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। এক জায়গায় নামতে হল সিঁড়ি দিয়ে। মাটির তলাতেও ঘর আছে মনে হয়। একটা সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে অনেকখানি টেনে নিয়ে গিয়ে ভিকো ওকে ঠেলে দিল একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে।
এ জায়গাটা একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঠিক আসল বন্দিশালার মতন।