অনেক রাস্তায় চক্কর খেয়ে হাডসন নদীর ওপর ব্রিজ পার হয়ে নিউ জার্সির রাস্তা ধরলেন অঞ্জনা। অর্জুন প্রায়ই লক্ষ করছিল পেছনে কোনও গাড়ি আসছে কিনা তাদের অনুসরণ করে। একটা সময় সে নিঃসন্দেহ হল, না, কেউ নেই। এখন দুপাশে জঙ্গল, কিন্তু সুদৃশ্য জঙ্গল, মাঝখানের মসৃণ রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে। অঞ্জনা বললেন, জানো মা, আগে আমরা কুইন্সে থাকতাম। আটতলার ফ্ল্যাটে। চারপাশে লোকজন সবসময় ক্যাচম্যাচ করছে। এখন একেবারে ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছি। কিন্তু বাড়িটা বোধ হয় অলুক্ষুনে, নইলে ওর অ্যাকসিডেন্ট হল কেন?
অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে বাড়ির কী সম্পর্ক রে? তোরা এখানে এসে দেখছি আরও সংস্কারাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিস। যে-কোনও একটা ভুল অথবা গোলমালের জন্যে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। এখন তো ও ভাল আছে বলছিস। ছেলে কোথায়? সুধামাসি জিজ্ঞেস করলেন।
ও এতদিন ছিল। আর কামাই করা যাবে না বলে হস্টেলে চলে গিয়েছে।
একমাত্র ছেলে, তাকেও নিজের কাছে রাখিস না?
কী করব বলো? আমরা দুজনেই সকাল আটটায় বেরিয়ে সন্ধে ছটায় ফিরি। ও কার কাছে এতদিন থাকত? তোমাকে বলেছিলাম চলে এসো, তুমি
আসোনি। একা-একা জলপাইগুড়িতে যে কোন মায়ায় থাকো কে জানে?
মা এবং মেয়ের এসব কথাবার্তা অর্জুনের কানে ঢুকছিল না। সে জামার নীচে পরে থাকা লকেটটাকে ওপর থেকে স্পর্শ করল। এই লকেট দেখে জিম নামের লোকটা ওইরকম শ্রদ্ধা দেখাল কেন? এই লকেটের সঙ্গে ওর কী সম্পর্ক? জিম নিশ্চয়ই কোনও বেআইনি জিনিস দাঁতের ভেতর আটকে এদেশে নিয়ে এসেছে। সে ইচ্ছে করলে যে-কোনও নিরাপত্তাকর্মীকে খবরটা দিতে পারত। কেন দেয়নি তা অর্জুনের নিজের কাছেও স্পষ্ট নয়। যদি জিম ওটা ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলত তা হলে খবরটা দিয়ে সে বেশ বেকায়দায় পড়ে যেত। লোকটা শক্ত হয়ে গেলে তার কী লাভ হত! কিন্তু লকেটটা দেখার পর জিমের আচরণের কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না অর্জুন। কিন্তু এটা যে মূল্যবান জিনিস তাতে সন্দেহ নেই। অথচ এই জিনিস গোরক্ষনাথ অমল সোমের বাগানে গাছের তলায় পুঁতে রেখেছিল। অমলদা নিশ্চয়ই এর গুরুত্ব সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন না।
আমরা এসে গেছি অর্জুনবাবু। অঞ্জনা বললেন।
অর্জুন লক্ষ করছিল গাছপালা মাঠজঙ্গল পেরিয়ে মাঝে-মাঝেই গাড়ি জনবসতির পাশ কাটিয়ে এতক্ষণ ছুটে যাচ্ছিল। কোথাও ঘিঞ্জি বাড়িঘর নেই, মানুষের ভিড় নেই। এবার একটা পেট্রল পাম্প চোখে পড়ল। এরা অবশ্য বলে গ্যাসস্টেশন। তারপরেই রেললাইন পেল্লিয়ে দুপাশে সুন্দর ছবির মতো একতলা দোকান শুরু হয়ে গেল। বড়জোর দেড়শো গজ রাস্তার দুপাশে দোকান অথবা বার এবং রেস্টুরেন্ট। তারপর বাগানওয়ালা বাড়ি শুরু হয়ে গেল। এই সময় ফুটপাথে দু-একজন মানুষকে হাঁটতে দেখা গেল। অঞ্জনা ঘোষণা করলেন, এই আমাদের শহরের বাজারহাট করার জায়গা।
সুধামাসি বললেন, সে কী রে! আমার তো মনে হচ্ছিল ভৌতিক জায়গা, লোকজন নেই।
অঞ্জনা হাসলেন, শনি রবিবার এসে দেখো লোক গিজগিজ করছে। এদেশে সোম থেকে শুক্র কেউ অফিস আর বাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না। বাঁ দিকের নীলচে বাড়িটা আমাদের।
অর্জুন দেখল বাগান সামনে নিয়ে একটা দেড়তলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজি ছবিতে যেসব বাড়ি দেখা যায় ঠিক সেইরকম। অঞ্জনা গাড়ি থামিয়ে গেট খুলতে যেতেই সিট বেল্টের ফাঁক থেকে নিজেকে মুক্ত করে অর্জুন নীচে নামল। নুড়ি বিছানো প্যাসেজের দুপাশে সুন্দর ছাঁটা ভাল ঘাস। রাস্তার দুপাশে বড় বড় গাছ রয়েছে কিন্তু তার শুকনো পাতা ঘাসের গালিচার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই। অর্জুন কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে গিয়েছিল ঘাসের ওপর পা ফেলে, অঞ্জনা তাকে ডাকলেন, এই যে, এপাশে চলে আসুন। ওই বর্ডারটা ক্রশ করবেন না।
বর্ডার? অর্জুন হকচকিয়ে গেল।
আজ্ঞে সার। ওই অবধি আমাদের এলাকা, ওর ওপাশে পাশের বাড়ির। আপনি যেহেতু ওদের এলাকায় দাঁড়িয়ে আছেন এবং আপনাকে ওরা চেনে না অতএব কোনও মতলব আছে কিনা বুঝতে পারছে না, তাই এখনই পুলিশকে খবর দেওয়ার অধিকার ওদের আছে। আর খবর পাওয়ামাত্রই ছুটে আসা এ-দেশের পুলিশের প্রাথমিক কর্তব্য।
অর্জুন দ্রুত ফিরে এল, সে কী : আপনাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে সম্ভাব নেই?
থাকবে না কেন? তাই বলে অন্যের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকব কেন বিনা কারণে? অঞ্জনা গাড়ি ভেতরে নিয়ে গেলেন। অর্জুন দেখল দুটো বাড়ির মাঝখানে কোনও পাঁচিল নেই। শুধু ঘাস এমনভাবে কাটা আছে যে, রেখা তৈরি হয়ে জমি চিহ্নিত হয়েছে।
সুটকেস ভেতরে নিয়ে এলে সুধামাসি জিজ্ঞেস করলেন, পুরো বাড়িটা কি কাঠের?।
হ্যাঁ মা। ওদের কাছে গিয়ে পছন্দমতো বাড়ির অডার দিলে ওরা তৈরি বাড়ি রাস্তা দিয়ে টেনে এনে জমির ওপর বসিয়ে দিতে পারে। আমরা অবশ্য পছন্দমতো তৈরি করিয়ে নিয়েছি।
দীর্ঘ পথ উড়ে এলেও শরীরে যে ক্লান্তি জমে, তা টের পাচ্ছিল না অর্জুন। সুধামাসি একটু কাহিল হয়ে পড়লেও জামাইকে দেখতে তখনই হাসপাতালে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু অঞ্জনা তাঁকে নিষেধ করলেন! আজ বিশ্রাম নিয়ে আগামীকাল গেলেই হবে। ওদের সব ব্যবস্থা করে দিয়ে অঞ্জনা নিজে হাসপাতালে চলে গেলেন।
অর্জুন বাড়িটা ঘুরে দেখল। মাটির নীচের ঘরটিকে বলা হয় বেসমেন্ট। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটে মোড়া ঘরটি পছন্দ হল তার। কিন্তু এখানে নয়, তার থাকার জন্যে অঞ্জনা ওপরে যে ঘরটি ছেড়ে দিয়েছেন সেটি সুন্দর সাজানো। জানলার পরদা সরালে গাছগাছালি দেখা যায়। ঘরে দামি মডেলের টিভি এবং টেলিফোন আছে। এখানকার বাথরুমের মেঝেতেও কার্পেট পাতা থাকে। স্নানের জন্যে ছোট কাচের ঘরের ব্যবস্থা। আধুনিক সবরকম সুবিধে হাতের কাছে সাজানো।
ঘরে ফিরে গিয়ে স্নান সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ল অর্জুন। না, একটুও সম্ভাবনা নেই ঘুমের। এখন কলকাতায় প্রায় ভোর হয়ে আসছে। সময়ের হেরফের মানিয়ে নিতে হয়তো একটু দেরি হবে। সে রিমোট টিপে টিভি খুলল। এত চ্যানেলে একসঙ্গে অনুষ্ঠান হচ্ছে, লোকে দ্যাখে কী করে?
রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসে জানা গেল অঞ্জনাদির স্বামীর আর একটা অপারেশন হবে। সুধামাসি মাস তিনেকের মধ্যে ফিরতে পারবেন বলে মনে হয় না। অর্জুন হেসে বলল, আমার দায়িত্ব শেষ, এবার আমি ফিরে যাই সুধামাসি।
অঞ্জনা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, এ কী! বাড়িতে পা দিয়েই চলে যাওয়ার কথা বলছ কেন? এই দেশ ঘুরে দ্যাখো। এর আগের বার কি লস অ্যাঞ্জেলিসে গিয়েছিলে? তবে? ডিজনিল্যান্ড আর হলিউড না দেখে কেউ ফিরে যায়। তুমি কিছু চিন্তা কোরো না, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।
পাতলা কাঠের বাড়ি কিন্তু যারা থাকে তাদের কোনও দুশ্চিন্তা নেই। প্রতিটি বাইরের দরজায় চোর-ডাকাতের জন্যে অ্যালার্ম সেট করে অঞ্জনা শুয়ে পড়লেন সুধামাসির সঙ্গে। অর্জুনের ঘুম আসছিল না। একটার পর একটা চ্যানেল ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে মনের মতো ছবি খুঁজছিল সে। হঠাৎ একটা চ্যানেল টিপতেই একজন বৃদ্ধ কালো আমেরিকানকে দেখা গেল কথা বলছেন, সাপ সম্পর্কে আমাদের সাবধান হতে হবে। পৃথিবীতে অবশ্য যেসব সাপের খবর পাওয়া গিয়েছে তার অধিকাংশেরই বিষ নেই। যদি বিষ থাকত তা হলে আজকের পৃথিবীতে মানুষ খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে বিষধর সাপের নাম কী? বলতে বাধ্য হচ্ছি সবচেয়ে বিষধর সাপটি আজ পৃথিবীতে নেই। বিবর্তন তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। আফ্রিকার উগান্ডায় সেই মহাবিষধর সাপের রাজত্ব ছিল। কথিত আছে মানব সভ্যতার প্রথমদিকে একজন আফ্রিকান শিল্পী সেই সাপের অবিকল মূর্তি এমন হালকা কালো পাথরে নির্মাণ করেছিলেন যাকে কোনও ধাতু বলে ভুল হবে। তিনি মাত্র দুটো মূর্তি তৈরি করেন। সেই মূর্তির চোখে পাথর দেওয়া ছিল। অনেকের ধারণা, ওই পাথরের নীচে তিনি বিষধর সাপটির এক ফোঁটা বিষ রেখে দিয়েছিলেন। হয়তো এ সবই বানানো গল্প, কিন্তু যে কথা সত্যি, তা হল সাপ সম্পর্কে আমাদের সাবধান হতে হবে। সঙ্গে-সঙ্গে পরদায় লেখা ফুটে উঠল, বিষধর সাপের সন্ধান করুন। সাপটির নাম ব্লু-কোবরা।
এটা বিজ্ঞাপন না টিভি কোম্পানির ঘোষণা, বোঝা গেল না। তারপরেই পরদা জুড়ে ব্লু কোবরার ছবি দেখানো হল। কোনও শিল্পীর আঁকা ছবি। কিন্তু সেই ছবি দেখে চমকে উঠল অর্জুন। সে বুকে হাত দিল। মনে পড়ল স্নানের সময় লকেটটাকে খুলে রেখেছিল সে। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে টয়লেট বক্সের ওপর সে লকেটটাকে দেখতে পেল। লকেটটা হাতে নিয়ে আলোর সামনে আসতেই সে বুঝতে পারল অনেকটা মিল থাকলেও টিভির ছবির হুবহু কপি এটা নয়। টিভির ছবিতে সাপের লেজ কুণ্ডলী পাকিয়ে ডান দিকে পড়ে ছিল, এটার বাঁ দিকে। এর গায়ে উঁচু-উঁচু আঁশের মতো ছড়ানো, টিভির ছবিতে সেটা ছিল না। কিন্তু ভঙ্গি আর আকৃতিতে কোনও পার্থক্য নেই। অর্জুন টিভির দিকে তাকাল। সেখানে নাচগান শুরু হয়ে গেছে। অনেক যন্ত্র নিয়ে একজন কালো আমেরিকান গায়িকা চিৎকার করে গান গাইছে।
হাতে ধরা সাপের লকেটের দিকে তাকাল অর্জুন। এটা কি ব্ল্যাক কোবরা! গোরক্ষনাথ তাকে যে গল্প বলেছিল সেটাকে নেহাতই বুজরুকি বলে মনে হয়েছিল তার। এই লকেট পরে থাকা ড়ুবন্ত মানুষকে বিশাল সাপ সমুদ্রে ভাসিয়ে রেখেছিল এমন গল্প বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু টিভির ভদ্রলোক দর্শকদের কোন বিষধর সাপের সন্ধান করতে বলছেন? ব্লু-কোবরা তো অনেকদিন আগেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং সেটা বলাও হল। তা হলে কোন সাপকে খুঁজবে মানুষ? গোখরো, কেউটে, শঙ্খচূড় বিষধর সাপ এবং তাদের সঙ্গে মানুষ দিব্যি বেঁচে আছে। তাদের খুঁজতে নিশ্চয়ই ঘোষক উৎসাহ বোধ করেননি। ব্যাপারটা দুবোধ লাগছিল। এই সময় গান শেষ হতেই আবার সেই এক ঘোষণা শোনা গেল। যেভাবে টিভিতে বিজ্ঞাপন বারংবার দেখানো হয়, এও তেমন। বিষধর সাপের সন্ধান করুন, সাপটির নাম রু-কোবরা, বলার পর টিভির পরদায় কিছু সংখ্যা ফুটে উঠল। ওটা যে টেলিফোনের নাম্বার তা বুঝে অর্জুন দ্রুত একটা পত্রিকার পেছনে টুকে রাখল।
আবার গান শুরু হতে অর্জুনের মনে হল বিশেষ উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা প্রচারিত হচ্ছে। যারা বুঝতে পারবে তারা নিশ্চয়ই এই চ্যানেলটির দর্শক। কিন্তু এখন তার মাথা আর কাজ করছিল না। টিভি বন্ধ করে আলো নিভিয়ে
সে শুয়ে পড়ল।
শরীর যে কাহিল ছিল তা বোঝা গেল দরজায় শব্দ হওয়ার পর। এখন নটা বেজে গেছে। ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই দেখল সুধামাসি বাইরে যাওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে গেছেন।
কী রে? শরীর খারাপ লাগছে?
না, না। লজ্জিত হল অর্জুন।
তুই তা হলে বিশ্রাম নে। তোর জলখাবার তৈরি করে মাইক্রোওভেনের সামনে রাখা আছে, গরম করে নিস। পারবি না? খুব সোজা রে। আমরা দেশে কত ঝক্কি সামলে রান্না করি, আর এরা কত সুবিধে পায়। তা হলে আমি অঞ্জনার সঙ্গে হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসি?
ঠিক আছে। আমি না হয় বিকেলে যাব।
দাঁত মেজে পোশাক পালটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অর্জুন দেখল বাড়ি বালি, ওরা বেরিয়ে গেছে। খিদে পাচ্ছিল না তেমন। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল একটা ট্রের ওপর তার ব্রেকফাস্ট সাজানো আছে। এক প্যাকেট অরেঞ্জ জুস, একটা আপেল, ডিমের পোচ, দুটো টোস্ট, কর্নফ্লেক্স, দুধ, জ্যাম এবং চিনি সুন্দর করে সাজানো। তার পাশে একটা চিরকুটে লেখা, দুধ গরম করে নিয়ো। চা খেলে জল গরম করে টি ব্যাগ ব্যবহার কোরো।
কয়েক মিনিটের মধ্যে সে খাবার শেষ করে ফেলল। জুস এবং আপেল বাদ দিল। দেশে তার ওসব খাওয়ার অভ্যেস নেই, অসুস্থদেরই খেতে দেখেছে। কাপপ্লেট ধুয়ে পরিষ্কার করে সে নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানা ঠিক করল। আমেরিকায় প্রচুর বড়লোকও বাড়িতে কাজের লোক রাখে না। প্রথমত, তার খরচ খুব বেশি; দ্বিতীয়ত, অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকা ওরা পছন্দ করে না। তাই কলকাতায় যে কুটোটি নাড়েনি, আমেরিকায় গিয়ে তার সব কাজ না করে কোনও উপায় নেই।
বন্ধ টিভির দিকে তাকাতেই গতরাতের ঘটনা মনে পড়ল। অর্জুন পত্রিকার পেছনে লিখে রাখা নাম্বারটা পড়ল। এখানে একটা ফোন করলে কেমন হয়? সে পত্রিকাটা নিয়ে লিভিং রুমে চলে এল। টেলিফোনের নাম্বারগুলো টিপতেই ওপাশে রিং হল, গুডমর্নিং সার।
আপনারা কাল রাত্রে সাপের বিষয়ে যা বলেছেন তার বিশদ জানতে চাই।
কী জানতে চান?
আপনারা বলেছেন ব্লু-কোবরা পৃথিবীতে নেই। তা হলে কোন সাপ খুঁজবেন?
আপনার পরিচয়?
আমি সাপ নিয়ে গবেষণা করছি।
আমরা ব্লু-কোবরার যে ছবি টিভিতে দেখিয়েছি সেটা অনেকটা শোনা কথা এবং অনুমানের ওপর নির্ভর করে আঁকা। ব্লু-কোবরার কোনও ফোটোগ্রাফ থাকার প্রশ্ন নেই। জানা গিয়েছে তখনকার শিল্পী এই সাপের দুটো মূর্তি তৈরি করেছিলেন। আমরা সেই মূর্তির সন্ধান করছি।
দুটো মূর্তির সন্ধান করছেন?
একটি মূর্তি আমরা পেয়েছি। কিন্তু সেটা সত্যি কিনা প্রমাণিত হবে দ্বিতীয় মূর্তি পেলে।
কিন্তু সেটা যে আমেরিকায় থাকবে এমন ধারণা হল কেন?
ধারণা হওয়ার কারণ ঘটেছে।
তা হলে সাপ সম্পর্কে আপনারা সাবধান করছেন কেন?
ওই বিষধর সাপের মূর্তিটি কাছে রাখলে ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে বলেই সাবধান করা হচ্ছে। কিন্তু মহাশয়, অনুগ্রহ করে আপনার টেলিফোন নাম্বারটা বলবেন কী?
আমি একটা পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে কথা বলছি। লাইন কেটে দিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ল অর্জুন। এ-দেশে কি কোত্থেকে টেলিফোন এল চট করে খুঁজে বের করা যায়? যদি যায়, তা হলে তো ওরা এখানে পৌঁছে যেতে পারে। এই লোকগুলো ভাল না মন্দ তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তার মনে হল টেলিফোনটা এখান থেকে করা উচিত হয়নি। লোকগুলো যদি মন্দ হয় তা হলে সুধামাসিদের বিপদে ফেলা হবে।
কিন্তু এসব ছাপিয়ে ওর মনে যে ভাবনা প্রবল হল তা ওই সাপটিকে নিয়ে। সে ঘরে ফিরে সাপটিকে দেখল। নিশ্চয়ই দীর্ঘকাল ধরে এই সাপটির হদিস ওরা পায়নি। হয়তো এর কথা শুধু শুনে এসেছে। কারণ গোরক্ষনাথ এবং তার গুরুদেবের কাছে এই সাপটির মূর্তি পৌঁছেছে নিশ্চয়ই অনেক হাত ঘুরে। এয়ারপোর্টের সেই লোকটি যে এই সাপের লকেট দেখে ভক্তিতে গদগদ হয়েছিল তার কাছ থেকেই খবরটা পেতে পারে এরা। তা হলে সেই লোকটি এবং এরা একই দলের। আর লোকটা যখন বেআইনি জিনিস দাঁতের ভেতর নিয়ে এ-দেশে এসেছে তখন দলটা ভদ্রলোকের নয়। এখন কী করা যায়? অঞ্জনাদি এলে কি সব কথা বলে পুলিশকে জানিয়ে দেবে? অর্জুন আবার টেলিফোনের কাছে গেল। সেখানে অনেক টেলিফোন ভাইরেক্টরি সাজানো আছে। তার একটার পাতা খুলে লোক্যাল টেলিফোন অফিসের নাম্বার বের করে ডায়াল করল। ওপাশে সাড়া পেতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে করবেন না, একটু আগে আমাকে কেউ টেলিফোন করেছিল, উড়ো ফোন, কোন ফোন থেকে ওটা করা হয়েছিল সেটা আপনারা কি বলতে পারবেন?
অপারেটার বললেন, আগে থেকে আমাদের না জানানো থাকলে বলা সম্ভব নয়। আপনার যদি তেমন সমস্যা থাকে তা হলে এই নম্বরে ফোন করুন।
স্বস্তি হল কিছুটা। কিন্তু মন খুঁতখুঁত করতে লাগল। সে আবার ঘরে ফিরে গিয়ে লকেটটা নিয়ে বসল। সাপের মূর্তির পেছনদিকটাও মসৃণ নয়। খুব যত্নে তৈরি হয়েছে এটা। সে চোখদুটো দেখল। প্রথম থেকেই অন্য পাথর বসানো চোখদুটো তাকে আকর্ষণ করেছিল। এই চোখের ভেতরে সেই মহাবিষধর সাপের বিষ রাখা আছে? একখনও সম্ভব। যদি এর ভেতর গর্ত করাও থাকে তা হলে সেই তরল বিষ, এতদিনে উবে যাওয়ার কথা। চোখের পাথরটাকে খোলার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করল অর্জুন।
আর তখনই তার মেজরের কথা মনে পড়ল। মোটাসোটা দাড়িওয়ালা অনেকটা টিনটিনের হ্যাডকের মতো চেহারা, যে মানুষটি বিয়ে না করে সারাজীবন অভিযান করে বেড়াচ্ছেন। সেই কালিম্পং-এ সীতাহরণ রহস্য সমাধান করতে গিয়ে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। লাইটার রহস্য সমাধান করতে ওঁর সঙ্গে প্রথমবার আমেরিকায় এসেছিল সে।
ডায়েরি থেকে নাম্বার বের করে ডায়াল করল সে। সঙ্গে সঙ্গে হেঁড়ে গলায় ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসিতে সম্ভবত একই প্রশ্ন উচ্চারিত হল, সাতসকালে আপনি কে?
অর্জুন হেসে ফেলল, কেমন আছেন আপনি, আমি অর্জুন।
অ্যাঁ। ও ভগবান! আমি কি ঠিক শুনছি? অর্জুন? মধ্যম পাণ্ডব?
হ্যাঁ।
কোত্থেকে কথা বলছ?
নিউ জার্সি থেকে।
অ্যাঁ? আমেরিকায় এসেছ? আমাকে না জানিয়ে আমেরিকায়? এটা কেমন কথা হল? না, না, আমি কৈফিয়ত চাই।
হঠাৎ আসতে হয়েছে। জানাবার সময় পাইনি।
এক্ষুনি চলে এসো। এক্ষুনি।
কীভাবে যাব?
ও ভগবান! তুমি তো গাড়ি চালাতে পারবে না। কোথায় আছ? কোন শহরে?
ক্লোস্টার।
অ। বাস ধরে চলে এসো ওয়াশিংটন স্টেশনে। আমি সেখানে থাকব। ওখান থেকে আসতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। তা হলে আমি একঘণ্টা বাদে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।
না, না। এই মুহূর্তে বের হওয়া সম্ভব নয়। বাড়িতে আমি একা।
তাতে কী হয়েছে! এদেশে কেউ বাড়ি পাহারা দেয় না। মেজর বললেন, দুটো কাগজে একই নোট লেখো। বিশেষ কাজে আমার কাছে আসছ। আমার টেলিফোন নাম্বার লিখে দিয়ে। দেখবে ছোট চিরকুটের প্যাড আছে টেবিলে। প্রত্যেক বাড়িতেই থাকে। কাগজের মাথায় আঠা লাগানো আছে। সেটা ফ্রিজে আর দরজায় সেঁটে দিলেই ওরা দেখতে পাবে। কুইক। রিসিভার নামিয়ে রাখলেন মেজর।