০৫. অনিশ্চিত জগৎ

অনিশ্চিত জগৎ

ঘুম থেকে উঠে খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন বৃদ্ধ রাউখ। কয়দিন থেকে তাঁর একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে। সব সময়েই মনে হয় কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এত বাস্তব অনুভূতি যে রাউখ একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিক না দেখে পারলেন না।

কী দেখছেন প্রফেসর রাউখ?

প্রফেসর রাউখৈর ছোট কম্পিউটারটি মিষ্টি স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কয়দিন থেকে দেখছি আপনি হঠাৎ হঠাৎ করে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-সেদিক দেখছেন। কী দেখছেন?

নাহ্‌, কিছু না।

বলুন না কী হয়েছে। কম্পিউটারটি অনুযোগের সুরে বলল, আপনি তো আমার কাছে কখনো কিছু গোপন করেন না।

বৃদ্ধ রাউখ মাথা চুলকে বললেন, ব্যাপারটা তোমাকে বোঝাতে পারলে বলতাম, কিন্তু তুমি ঠিক বুঝবে না। জিনিসটা নেহায়েত মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মানুষ লক্ষ

কোটি বছরের বিবর্তনের ফল, তাদের রক্তে কিছু কিছু আশ্চর্য জিনিস রয়ে গেছে, যার জন্যে মাঝে মাঝে তারা এমন কিছু অনুভব করে, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।

যেমন?

যেমন—প্রফেসর রাউখ একটু ইতস্তত করে বলেই ফেললেন, যেমন কয়দিন থেকে মনে হচ্ছে সব সময় আমার দিকে যেন কেউ তাকিয়ে আছে।

প্রফেসর রাউখের কম্পিউটারটি, যাকে তিনি শখ করে ট্রিনিটি বলে ডাকেন, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আশ্চর্য।

হ্যাঁ, আশ্চর্য।

ভারি আশ্চর্য।

হ্যাঁ, কিন্তু এটা নিয়ে তোমার ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই। আমরা মানুষেরা অনেক ধরনের পরস্পরবিরোধী জটিল জিনিস নিয়ে বেঁচে থাকি।

তা ঠিক।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা আসলে তত খারাপ নয়—তুমি যত খারাপ মনে কর তত খারাপ নয়। যাই হোক, নতুন কোনো খবর আছে?

ট্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তেমন কিছু নয়।

প্রফেসর রাউখ হাসার চেষ্টা করে বললেন, তার মানে খারাপ খবর। কী হয়েছে বলে ফেল।

আপনার মাসিক ভাতা কমিয়ে অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে।

প্রফেসর রাউখ ঘোট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। তিনি প্রথম সারির গণিতবিদ, তিনি চাইলে তাঁর নামে পৃথিবীতে দুটি ইন্সটিটিউট থাকত, প্রতিপ্রকর্ষ বলের উপর লেখা চমকপ্রদ সমীকরণটি তাঁর চিন্তাপ্রসূত, তাঁর সহকর্মী সেটিকে নিজের বলে ঘোষণা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ হিসেবে পরিচিত হয়েছে। অথচ তিনি অর্থাভাবে শহরের পুরাতন ঘিঞ্জি এলাকায় ছোট একটি ঘর ভাড়া করে দুস্থ শ্রমিকদের মতো কৌটার খাবার খেয়ে বেঁচে থাকেন। তাঁর সেরকম কোনো বন্ধু নেই, স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে নিঃসঙ্গ। ট্রিনিটির সাহচর্যের বাইরে তাঁর কোনো জগৎ নেই। তাঁর প্রয়োজন অতি অল্প, অথচ সেখানেও আবার হাত বসানো হল।

প্রফেসর রাউখ।

বল।

আপনি গ্যালাক্টিক হাইপারডাইরে উপর কাজটা করতে রাজি হয়ে যান।

প্রফেসর রাউখ মাথা নেড়ে বললেন, তা হয় না ট্রিনিটি। নিজের শখের কাজ করি বলে মনে হয় বেঁচে থাকা কত আনন্দের। যদি যুদ্ধ-কৌশলের উপর কাজ করি, তাহলে কি কখনো মনে হবে বেঁচে থাকা আনন্দের?

কিন্তু অন্য অনেকে তো করছে।

করুক। যদি সবাইও করে, তন্তু আমি করব না। জীবন বড় ছোট, সেটা নিয়ে ছেলেখেলা করতে হয় না।

ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখের প্রাতঃকালীন খাবারের আয়োজন করতে বের হয়ে গেল। প্রফেসর রাউখ চুপচাপ বিছানায় বসে রইলেন, তাঁর আবার মনে হতে থাকে, কেউ একজন তাঁর দিকে গকিয়ে আছে। তিনি মাথা ঘুরিয়ে তাকান, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিকে দেখেন। কেউ নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য, তাঁর তবু মনে হতে থাকে কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে, বিষণ্ণ দৃষ্টি, কাতর মুখ! কিছু একটা বলতে চায় মিনতি করে। মন খারাপ হয়ে যায় প্রফেসর রাউখের।

একটু বেলা হয়ে এলে প্রফেসর রাউখ কাজ করতে বসেন। অভ্যেসমতো প্রথম ঘণ্টাদুয়েক পড়াশোনা করে নেন। পৃথিবীর যাবতীয় গাণিতিক জার্নালের সারাংশ তাঁর কাছে পাঠানো হয়। এটি খরচসাপেক্ষ ব্যাপার, দুঃসহ অর্থাভাবের মাঝেও তিনি সেটা বন্ধ করেন নি। নূতন নূতন কাজকর্ম কী হচ্ছে, তার উপর চোখ বুলিয়ে নিজের পছন্দসই বিষয়গুলো খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। প্রতিভাবান নূতন কোনো গণিতবিদ বের হয়েছে কী না তিনি লক্ষ রাখেন। কমবয়সী ক্ষ্যাপা গোছের একজন গণিতবিদ হঠাৎ করে গণিতের জগতে একটা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে, এ-ধরনের একটা ছেলেমানুষি চিন্তা প্রায়ই তাঁর মাথায় খেলা করে।

প্রতিজগতের উপর প্রফেসর রাউখ অনেক দিন থেকে কাজ করছেন, সমস্যাটি জটিল এবং প্রতিবার তিনি এক জায়গায় এসে আটকে যাচ্ছেন। যে-ব্যাপারটি নিয়ে সমস্যা, সেটি একটি ছোট গাণিতিক সমস্যা, যার কোনো সমাধান নেই বলে বিশ্বাস করা হয়। এরকম পরিবেশে সাধারণত সমস্যাটা এড়িয়ে একটি সমাধান ধরে নিয়ে কাজ শেষ করা হয়। প্রফেসর রাউখ খাঁটি গণিতবিদ, তিনি কোনো কিছু এড়িয়ে যাওয়া পছন্দ করেন না, তাই গত পনের বছর থেকে তিনি এই ঘোট, গুরুত্বহীন, কিন্তু প্রায় অসম্ভব সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁর বর্তমান অর্থাভাবের সেটি একটি বড় কারণ।

প্রফেসর রাউখ কাগজ-কলম নিয়ে বসলেন। সমীকরণটি প্রায় কয়েক হাজার বার নানাভাবে লিখেছেন, আজকেও গোটাগোটা হাতে লিখলেন। নিরীহ এই সমীকরণটি যে কত ভয়ংকর জটিল হতে পারে, কে বলবে? প্রফেসর রাউখ সমীকরণটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, হঠাৎ তাঁর মনে হল, আজ হয়তো তার সমাধান বের করে ফেলবেন। কেন এরকম মনে হল তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।

গত কয়েকদিন থেকে তাঁর মাথায় একটা নূতন জিনিস খেলছে, সেটা আজ ব্যবহার করে দেখবেন। ঠিক কী ভাবে ব্যবহার করবেন এখনো জানেন না। নানারকম সম্ভাবনা রয়েছে, সবগুলো চেষ্টা করে দেখতে একটা জীবন পার হয়ে যেতে পারে তাই খুব ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হবে। প্রফেসর রাউখ অনামনন্ধভাবে কলমটি ধরে কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন।

ট্রিনিটি দুপুরবেলা প্রফেসর রাউখকে একগ্লাস দুধ দিয়ে গেল। বিকেলে এসে দেখল, তিনি সেই দুধ স্পর্শও করেন নি। প্রফেসর রাউ ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করতে পারেন না, তাঁর জন্যে সারাদিন অভুক্ত থাকা একটা গুরুতর ব্যাপার। ট্রিনিটি তাঁকে বিরক্ত করল না, কম্পিউটারের স্বল্পবুদ্ধিতে এই লোকটিকে পুরোপুরি অনুভব করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, এরকম অবস্থায় প্রফেসর রাউখকে একা একা কাজ করতে দিতে হয়।

 

প্রফেসর রাউখ যখন তাঁর টেবিল ছেড়ে উঠলেন তখন গভীর রাত, প্রচণ্ড ক্ষুধায় তাঁর হাত কাঁপছে। কিন্তু তাঁর মাথা আশ্চর্যরকম হালকা। তিনি বাথরুমে গিয়ে মুখে-চোখে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ট্রিনিটি হালকা স্বরে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।

বল।

আপনি সত্যি তা হলে সমাধান করেছেন?

হ্যাঁ ট্রিনিটি।

আমার অভিনন্দন প্রফেসর রাউখ।

অনেক ধন্যবাদ।

আমি জানতাম আপনি এটা সমাধান করতে পারবেন।

কেমন করে জানতে?

কারণ আপনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ।

প্রফেসর রাউখ শব্দ করে হাসলেন। ট্রিনিটি বলল, এটি করতে আপনার সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে।

জানি।

সমস্যাটি কি সত্যিই এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

যে-জিনিস আমরা জানি না সেটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না, সে হিসেবে এটার কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু এখন এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সত্যি?

হ্যাঁ।

আপনি নূতন কিছু শিখলেন প্রফেসর রাউখ?

শিখেছি।

কী?

বললে তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না।

করব, আপনি বলুন, আমি আপনার সব কথা বিশ্বাস করি।

শোন তা হলে, না বুঝলে প্রশ্ন করবে।

করব।

প্রফেসর রাউখ ট্রিনিটিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, আমাদের পরিচিত জগৎ হচ্ছে ত্রিমাত্রিক জগৎ, সময়টাকে চতুর্থ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের জগৎ চার মাত্রার? এমন কি হতে পারে, যে, জগৎটি আটমাত্রার এবং আমরা শুধুমাত্র চারটি মাত্রা দেখছি এবং বাকি চারটি মাত্রা দেখছি না? ঠিক সেরকম আরেকটি জগৎ রয়েছে, যেখানকার অধিবাসীরা শুধু তাদের চারটি মাত্রা দেখছে এবং আমাদের চারটি মাত্রা দেখছে না? তা হলে একই সাথে থাকবে দুটি জগৎ, একটি আমরা দেখতে পাব, আরেকটি পাব না।

প্রফেসর রাউখ অন্যমনস্কভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ সবই ছিল কল্পনার ব্যাপার। সেটার বাস্তব সম্ভাবনা প্রমাণ করা যায় শুধুমাত্র অঙ্ক কষে। আমি অনেক দিন থেকে এর ওপরে কাজ করছিলাম, আজ আমি সেটার সমাধান বের করেছি। কী দেখেছি জান?

কী?

দেখেছি, আমাদের জগতের বাইরে আরেকটি চতুর্মাত্রিক জগৎ রয়েছে। সেই জগৎ একই সাথে আমাদের পাশাপাশি বেঁচে রয়েছে। সম্ভবত সময়ের মাত্রা দুটি জগতেই এক, সে-অংশটুকু এখনো বের করা হয় নি।

ট্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, সেখানে গ্রহ-নক্ষত্র আছে। সেখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে?

এসব হচ্ছে খুঁটিনাটি ব্যাপার। কারো পক্ষে বলা খুব কঠিন, কিন্তু তা খুবই সাব।

পৃথিবীর মানুষ সেই জগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে?

প্রফেসর রাউখের মুখ হঠাৎ বিমর্ষ হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বললেন, মনে হয় পারবে না। আমার হিসেব যদি ভুল না হয়, তা হলে সেটার চেষ্টা করা হবে খুব ভয়ানক বিপদের কাজ।

কেন?

কারণটি খুব সহজ। আমাদের জগৎ আর সেই জগতের মাঝে শক্তির একটা বড় পার্থক্য রয়েছে। আমরা সেটা অনুভব করি না, সেই জগতেও সেটা অনুভব করে না। কিন্তু কোনোভাবে যদি দুই জগতের মাঝে একটা যোগাযোগ করে দেয়া যায়, তা হলে যে-জগতের শক্তি বেশি সেখানকার বাড়তি শক্তি পুরো জগৎটাকে ঠেলে অন্য জগতে পাঠিয়ে দেবে।

মানে? ট্রিনিটি বোঝার চেষ্টা করে, আপনি বলছেন, কেউ যদি যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে এখানে সম্পূর্ণ একটা নূতন জগৎ নূতন গ্রহ-নক্ষত্র হাজির হয়ে যেতে পারে?

প্রফেসর রাউখ অল্প মাথা নেড়ে বললেন, অনেকটা সেরকম। কিন্তু সেই ব্যাপারটা হয়তো তত খারাপ নয়, খারাপ হচ্ছে পদ্ধতিটা। যখন পুরো জগৎ একটি ছোট গর্ত দিয়ে বের হয়ে আসতে থাকবে-চিন্তা করতে পার, কী ভয়ানক বিপর্যয়?

তার মানে আপনি বলছেন, যে-জগৎটার শক্তি বেশি, সেটার ভয় বেশি, যে কোনো মুহূর্তে সেটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে?

কথাটা খানিকটা সত্যি। দুটি জগৎ রয়েছে এখানে, একটা নিশ্চিত জগৎ, আরেকটা অনিশ্চিত জগৎ। যেটা অনিশ্চিত, সেটা যে-কোনো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

আমাদের জগৎ কোনটি? যেটি নিশ্চিত সেটি, নাকি যেটি অনিশ্চিত, সেটি?

জানি না। সত্যি কথা বলতে কি, সেটা কোনোদিন জানা সম্ভব হবে কি না সেটাও আমি জানি না। কেউ যদি ছোট একটা পরীক্ষা করে বের করতে চায়, অনিশ্চিত জগৎটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

কী ভয়ানক।

হ্যাঁ, ভয়ানক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোনায় একটি ছোট ফুটো করে অন্য জগৎটিকে টেনে নিয়ে এসে ধ্বংস করে দেয়া যায়।

কী ভয়ানক। ট্রিনিটির যান্ত্রিক মস্তিষ্কের পুরো ব্যাপারটি অনুভব করতেও রীতিমতো কষ্ট হয়।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিতেই আবার সেই আশ্চর্য অনুভূতিটি হল, মনে হল কেউ যেন তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি অস্বস্তিতে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালেন, কোথাও কেউ নেই, কিন্তু কী বাস্তব অনুভূতি। নিজেকে শান্ত করে কোনোভাবে ঘুমানোর চেষ্টা করেন। মাথার কাছে একটা শিরা দপদপ করছে, সহজে ঘুম আসতে চায় না। কী সাঙ্ঘাতিক একটা জিনিস তিনি বের করেছেন, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ নেই, যার কাছে এটা নিয়ে গল্প করতে পারেন। আহা—আজ যদি তাঁর স্ত্রী বেঁচে থাকত। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর আগে মৃত স্ত্রীর কথা স্মরণ করে তিনি একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

ভোররাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল প্রফেসর রাউখের। কিছু-একটা হয়েছে কোথাও। তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না কি। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন তিনি, ঘরে নীল একটা আলো, কোথা থেকে আসছে এটি?

চোখ মেলে তাকালেন তিনি, তাঁর সামনে ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় মেঝে থেকে খানিকটা উপরে চতুষ্কোণ একটা জায়গা থেকে হালকা নীল রঙের একটা আলো বের হচ্ছে, ভালো করে না তাকালে দেখা যায় না।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর রাউখ। খুব ধীরে ধীরে আলোটি উজ্জ্বল হতে থাকে। আস্তে আস্তে সেখানে একজোড়া চোখ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ, সেই বিষণ্ণ চোখে একদৃষ্টিতে চোখ দুটি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।

প্রফেসর রাউখ কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখেন, আজীবন গণিতের সাধনা করে এসেছেন, যুক্তিতর্ক ছাড়া কিছু বিশ্বাস করেন না। নিজেকে বোঝালেন, আমি ভুল দেখছি, সারা দিন পরিশ্রম করে আমার রক্তচাপ বেড়ে গেছে, তাই চোখে বিভ্রম দেখছি। বিশ্রাম নিলে সেরে যাবে। আমি এখন চোখ বন্ধ করব, একটু পর যখন চোখ খুলব, তখন দেখব কোথাও কিছু নেই।

প্রফেসর রাউখ চোখ বন্ধ করে কয়েকটি দীর্ঘনিঃশ্বাস নিলেন, তারপর ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। চোখ খুলে দেখলেন নীলাত চতুষ্কোণ অংশটুকু এখনো আছে, চোখ দুটি এখনো একদৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু তাই নয়, তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটিতে এবার পলক পড়ল, প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখলেন, নীলাভ অংশটুকু ধীরে ধীরে আরো বড় হয়ে উঠছে, চোখ দুটির সাথে সাথে আস্তে আস্তে মুখের আরো খানিকটা দেখা যাচ্ছে—একজন বিষণ্ণ মানুষের চেহারা। করুণ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় উঠে বসেন, সাথে সাথে নীলাভ চতুষ্কোণের চোখ দুটিতে ভীতি ফুটে ওঠে। তাঁর কিছু একটা বলার চেষ্টা করে–তিনি বুঝতে পারেন না সেটি কি। প্রফেসর রাউখ বিছানা থেকে নেমে আসেন, সাথে সাথে চোখ দুটি আতঙ্কে স্থির হয়ে যায়, যন্ত্রণাকাতর একটি মুখ আবার তাঁকে কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করে। প্রফেসর রাউখ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে এক এগিয়ে যান, সাথে সাথে পুরো নীলাভ অংশটুকু দপ করে নিভে গেল।

প্রফেসর রাউখ বাতি জ্বালালেন, যেখানে চোখ দুটি ছিল সে-জায়গাটি খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। কোথাও কিছু নেই—তীর কেন জানি একটু ভয়-ভয় করতে থাকে। কেন এরকম অস্বাভাবিক জিনিস তিনি দেখলেন? প্রফেসর রাউখ ঘর থেকে বের হয়ে ডাকলেন, টনিটি।

ট্রিনিটি কোনো সাড়া দিল না, তখন তাঁর মনে পড়ল, খরচ বাঁচানোর জন্য আজকাল রাতে তাকে সুইচ বন্ধ করে রাখা হয়। তাকে জাগাবেন কী না কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বাইরে এসে বসলেন। পুরো ব্যাপারটা আবার চেষ্টা করলেন আবার। যেদিন থেকে গাণিতিক সমস্যাটার সঠিক সমাধানটি তাঁর মাথায় এসেছে, সেদিন থেকে তাঁর মনে হচ্ছে কেউ-একজল তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে দেখলেন, সত্যি কেউ-একজন তীর দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি দেখেছেন তিনি, নাকি চোখের বিভ্রম; সত্যি তো হতে পারে না, কিন্তু চোখের বিভ্রম কেন হবে? বয়স হয়েছে তাঁর, কিন্তু তাঁর মস্তিষ্কে তো এখনো কৈশোরের সজীবতা।

বৃদ্ধ প্রফেসর রাউখ বসে বসে ভোরের আলো ফুটে উঠতে দেখলেন, অকারণে তার মন খারাপ হয়ে রইল।

 

প্রাতঃরাশ করার সময় ট্রিনিটি প্রফেসর রাউখকে জানাল যে, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমি থেকে তাঁকে নেয়ার জন্যে গাড়ি পাঠানো হয়েছে। এক ঘণ্টার ভিতর তাঁকে যেতে হবে। শুনে প্রফেসর রাউখ একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, তাঁর সাথে বিজ্ঞান আকাদেমির কোনো যোগাযোগ নেই প্রায় দুই দশক।

প্রফেসর রাউখের হতচকিত ভাব দেখে ট্রিনিটি বলল, গতকাল আপনি যে সমস্যাটি সমাধান করেছেন, সম্ভবত সেটি বিজ্ঞান আকাদেমিকে অভিভূত করেছে।

প্রফেসর রাউখ চিন্তিত মুখে বললেন, তুমি ওদের জানিয়ে দিয়েছ?

না, আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে জানাই নি, কিন্তু গণিত জার্নালে একটা ছোট সারাংশ পাঠিয়েছি। সেটা তো আমি সব সময়েই পাঠাঁই। আপনি তো তাই বলে রেখেছেন।

হ্যাঁ, প্রফেসর রাউখ মাথা নাড়লেন, আমার ভুল হয়েছে। এই ব্যাপারটা আরো কিছুদিন গোপন রাখা উচিত ছিল, তোমাকে আমার বলে দেয়া উচিত ছিল।

আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ। ট্রিনিটি তার গলার স্বরে শঙ্কা ফুটিয়ে বলল, আমি খুবই দুঃখিত। আপনার কি কোন সমস্যা হবে?

জানি না। আমি বিজ্ঞান আকাদেমিকে পছন্দ করি না। তারা সবসময় জোর করার চেষ্টা করে। আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করি।

ট্রিনিটি ক্ষুন্ন স্বরে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর রাউখ।

তোমার দুঃখিত হবার কোনো কারণ নেই ট্রিনিটি। প্রফেসর রাউখ একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, গতকাল আমি যেসব কাজ করেছি, সেগুলো পুড়িয়ে ফেলতে পারবে?

সর্বনাশ! কী বলছেন! এত দিনের কাজ

ভয় পেয়ো না, প্রফেসর রাউখ মাথায় টোকা দিয়ে বললেন, সব এখানে রয়ে গেছে। যখন প্রয়োজন হবে, কাগজে আয় বের করে নিতে এবারে কোনো সময় লাগবে না।

 

সাদা একটা হলঘরে বসে আছেন প্রফেসর রাউখ। যদিও বিজ্ঞান আকাদেমির গাড়িতে চেপে তিনি এসেছেন, তাঁকে কিন্তু বিজ্ঞান আকাদেমির ভবনে না এনে সরকারি একটা ভবনে আনা হয়েছে। ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত, এখানে নানা ধরনের প্রহরা, ব্যাপারটি দেখে তাঁর মনে কেমন জানি একটা খটকা লাগতে থাকে।

আসবাবপত্রহীন শূন্য ঘরটিতে দীর্ঘ সময় একা একা বসে থাকার পর হঠাৎ করে কয়েকজন লোক প্রবেশ করে, কাউকেই তিনি চেনেন না। একজনকে মনে হল আগে কোথায় জানি দেখেছেন। কিন্তু কোথায় দেখেছেন ঠিক মনে করতে পারলেন না।

লোকগুলো তাঁকে ঘিরে বসে পড়ে। চেনা চেনা লোকটি খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকে মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনি আমাকে চিনতে

না। মনে হচ্ছে কোথায় দেখেছি, কিন্তু–

ভারি আশ্চর্য। আমি এদেশের রাষ্ট্রপতি রিবেনী।

প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সোজা হয়ে বসলেন। এই ভণ্ড প্রতারক লোকটির অসংখ্য নিষ্ঠুরতার গল্প প্রচলিত রয়েছে। ঢোক গিলে শুকননা গলায় বললেন, আমি দুঃখিত। আমি–

রাষ্ট্রপতি রিবেনী হাত তুলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমার কাছে খবর এসেছে, আপনি নাকি একটি অস্বাভাবিক আবিষ্কার করেছেন। শুনে খুশি হবেন, আপনার কাজ শেষ করার জন্য এই মুহূর্তে সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদদের নিয়ে একটা ইন্সটিটিউট খোলা হচ্ছে। আপনার নামে সেই ইন্সটিটিউটটি উৎসর্গ করা হবে।

একটি দেশের রাষ্ট্রপতির সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয় প্রফেসর রাউখের জানা নেই। তাই বাধা দেয়ার প্রবল ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও তিনি কাঠ হয়ে বসে রইলেন।

রাষ্ট্রপ্রতি রিবেনী মুখের ধূর্ত হাসিটি বিস্তৃত করে বললেন, আপনার কাজটুকু শেষ করুন। আপনার কী লাগবে আমাদের জানান। যত বড় কম্পিউটার চান, যতজন গণিতবিদ চান, শুধু মুখ ফুটে বলবেন।

প্রফেসর রাউখ শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে বললেন, আমার কাজ তো কিছু বাকি নেই, যে-জায়গাটাতে আটকে ছিলাম, গতরাতে শেষ হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি রিবেনীর চোখ এক মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, কিন্তু সেটা এক মুহূর্তের জন্যেই। মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বললেন, না, আপনার কাজ শেষ হয় নি। আপনার এখনো দুটি জিনিস বের করতে হবে। এক, আমাদের জগৎটি নিশ্চিত না অনিশ্চিত। দুই, নিশ্চিত এবং অনিশ্চিত জগতের মাঝে যোগাযোগ কেমন করে করা যাবে।

কিন্তু সেটা তো ভয়ানক বিপজ্জনক। ভয়ানক–

রিবেনী ধূর্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, সেটাই তো সবচেয়ে বড় কথা। আমরা যদি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই, তা হলে অনিশ্চিত জগৎকে আমরা হাতের মুঠোয় রাখব। যখন খুশি আমরা তাদের ধ্বংস করে দিতে পারব, তখন তাদের কাছে আমরা যা খুশি তাই দাবি করতে পারব। চিন্তা করতে পারেন, একটি পুরো জগৎ থাকবে আমাদের হাতের মুঠোয়। আমার হাতের আঁঠোয়।

প্রফেসর রাউখ অবাক হয়ে দেখলেন, ব্যাপারটা কল্পনা করে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠছে। বিষাক্ত সরীসৃপ দেখে যেরকম একটা ভয় হয়, হঠাৎ সেরকম একটা ভয় অনুভব করলেন প্রফেসর রাউখ। প্রায় মরিয়া হয়ে বললেন, কিন্তু আমরা যদি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী হই?

সেটা আপনাকে বের করতে হবে প্রফেসর রাউখা অনিশ্চিত জগৎ হলেই যে ব্যাপারটা অন্যরকম হবে, সেটা কেন ভাবছেন? তখন আমরা সারা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসব, কারণ ইচ্ছে করলে তখন আমরা এই পুরো জগৎ ধ্বংস করে দিতে পারব, কী প্রচণ্ড ক্ষমতা ভেবে দেখেছেন?

রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, কিন্তু সবার আগে আমাদের জানা দরকার আমরা কি নিশ্চিত জগতের অধিবাসী, নাকি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী। আর জানা দরকার, কেমন করে এই দুই জগতের যোগাযোগ করা যায়।

রাষ্ট্রপতি রিবেনী মুখের হাসিকে বিস্তৃত করে বললেন, আপনাকে এক সপ্তাহ সময় দেয়া হল।

প্রথমবার প্রফেসর রাউখ অনুভব করলেন, অসহ্য একটা ক্রোধ ধীরে ধীরে তাঁর শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, দীর্ঘদিন থেকে তাঁর এই অনুভূতিটির সাথে পরিচয় নেই। অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বললেন, যদি এক সপ্তাহে আমি সেটা বের না করি?

না শোনার ভান করলেন রাষ্ট্রপতি রিবেনী। মাথা নেড়ে বললেন, আপনি বড় গণিতবিদ, এক সপ্তাহে সহজেই বের করে ফেলবেন আপনি, তা ছাড়া আপনাকে সাহায্য করবে অসংখ্য প্রথম শ্রেণীর গণিতবিদ, অসংখ্য শক্তিশালী কম্পিউটার।

কিন্তু আমি যদি এটা করতে অস্বীকার করি?

প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি রিবেনীর মুখের মাংসপেশী শক্ত হয়ে যায়, আস্তে আস্তে বললেন, আপনি অস্বীকার করবেন না প্রফেসর রাউখ। আমার অনুরোেধ রাখতে কেউ অস্বীকার করে না—এখনো করে নি।

কিন্তু–

রিবেনী বাধা দিয়ে বললেন, তবু যদি আপনি অস্বীকার করেন, তা হলে আপনার মস্তিটা নিয়ে ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেব। আমাদের যা বের করার দরকার, সেটা খুব সহজেই বের করা যায় প্রফেসর রাউখ, আপনাকে আর কষ্ট করতে হয় না তা হলে।

অনেক কষ্ট করেও প্রফেসর রাউখ তাঁর আতটুকু লুকাতে পারলেন না। রাষ্ট্রপতি রিবেনী প্রফেসর রাউখের রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে অমায়িকভাবে হাসলেন। বললেন, আপনার মস্তিষ্ক এভাবে আমি নিতে চাই না, নেহায়েত আপনি যদি জোর করেন, তা হলে ভিন্ন কথা।

ঠিক এ-সময়ে সামরিক বাহিনীর দুজন উচ্চপদস্থ লোক এসে রাষ্ট্রপতি রিবেনীর কানে ফিসফিস করে কী-একটা বলল, সাথে সাথে রিবেনী উঠে দাঁড়ালেন, প্রফেসর রাউখকে কোনো সম্ভাষণ না জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পিছু পিছু অন্য সবাই। প্রফেসর রাউখ শূন্য ঘরে একা একা বসে রইলেন। তাঁর সমস্ত মুখ তেতো বিস্বাদ।

 

প্রফেসর রাউখ ঘরে নিজের বিছানায় দুই পা তুলে চুপচাপ বসে রয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের লোকজন এসে তাঁর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। সরকারি মহল থেকে তাদের উপর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, প্রায় অপরিচিত এই বৃদ্ধ লোকটিকে রাতারাতি মহামানবের পর্যায়ে তুলে নিতে হবে। প্রফেসর রাউখের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য নেই, তাঁর কলের পুতুলের মতো অন্যের নির্দেশ মেনে নেয়া ছাড়া কিছু করার ছিল না। তাঁর চোখের সামনে সংবাদপত্রের লোকেরা তাঁর সাদামাঠা জীবনের ওপর রং চড়িয়ে তাঁকে একটা অতিমানবিক আকর্ষণীয় ব্যক্তিতে পরিণত করে ফেলল।

রাত গভীর হয়ে এসেছে। প্রফেসর রাউখের চোখে ঘুম নেই। দু হাতে মাথা চেপে ধরে তিনি বিছানায় বসে অনেকটা আপন মনে বললেন, আমার বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ নেই। আমার সব শেষ হয়ে গেল। সব শেষ–

প্রফেসর রাউখ।

অপরিচিত একটা গলার স্বরে প্রফেসর রাউখ চমকে উঠে সামনে তাকান। ঘরের মাঝামাঝি আবার সেই চতুষ্কোণ নীলাভ আলো। তার মাঝে একজন মানুষের মুখমণ্ডল। মানুষটি বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। প্রফেসর রাউখ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলেন, তিনি কি সত্যি দেখছেন?

মানুষটি আবার ফিসফিস করে ডাকল, প্রফেসর রাউখ।

মানুষটির বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ প্রফেসর রাউখ সবকিছু বুঝে গেলেন। আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি আস্তে আস্তে বুক থেকে বের করে বললেন, তুমি অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী?

হ্যাঁ প্রফেসর রাউখ। নীলাভ চতুষ্কোণের ছায়ামূর্তি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমরা অনিশ্চিত জগতের অধিবাসী, আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

প্রফেসর রাউখ দেখলেন, ছায়ামূর্তির পিছনে আরো অনেক মানুষের চেহারা। খুব ধীরে ধীরে তার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে। আস্তে আস্তে বললেন, তোমরা তোমাদের অনিশ্চিত জগৎকে রক্ষা করার জন্য আমার কাছে এসেছ?

আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন প্রফেসর রাউখ।

কয়েক মুহূর্ত কী-একটা ভাবলেন প্রফেসর রাউখ, তারপর দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, অচিন্তনীয় শক্তির পার্থক্য তোমাদের সাথে আমাদের, সেই শক্তিকে আটকে রেখে তোমরা আমার সাথে যোগাযোগ করতে পার? আমার সাথে কথা বলতে পার?

পারি।

কী আশ্চর্য! তার মানে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে তোমরা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে আছ। অনেক অনেক এগিয়ে আছ।

আছি।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে বসে রইলেন প্রফেসর রাউখ। তারপর হঠাৎ তার এক আশ্চর্য সম্ভাবনার কথা মনে হল। একটু দ্বিধা করে প্রকাশ করে ফেলেন সেটা, তোমরা আমার উপর অনেক দিন থেকে জর রাখছ?

রেখেছি। সেজন্যে আমরা দুঃখিত। আমরা ক্ষমা চাইছি।

তোমরা জানতে আমি এই সমস্যার সমাধান করতে যাচ্ছি?

জানতাম। আমাকে ইচ্ছা করলে তোমরা থামাতে পারতে?

পারতাম।

প্রফেসর একটু দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে মেরে ফেলতে পারতে?

পারতাম প্রফেসর রাউখ।

তাহলে—তা হলে আগেই কেন তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে না?

আপনি স্বৈরাচারী শাসক নন প্রফেসর রাউখ, আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ। আপনাকে হত্যা করার অধিকার আমাদের নেই।

কিন্তু আমি যে-সমস্যাটা সমাধান করেছি, সেটা না করতে পারলে কেউ তোমাদের জগতের কথা জানতে পারত না। আমাকে থামিয়ে দিলে তোমাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা থাকত।

কিন্তু আপনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিতবিদ, আপনার গণিত সাধনায় আমরা কী ভাবে বাধা দিই? আপনার আনন্দে তো আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না।

কিন্তু আমি যেটা সমাধান করেছি, সেটার জন্য তোমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারত।

ছায়ামূর্তি গভীর আত্মবিশ্বাসে মাথা নাড়ে, না, পারত না। আমরা আপনাকে জানি। আমরা জানি, আপনি আপনার গবেষণালব্ধ জ্ঞান কখনো ধ্বংসের জন্যে ব্যবহার করবেন না।

প্রফেসর রাউখ একটু অস্থির হয়ে বললেন, কিন্তু সেটা তো আমার হাতে নেই, সেটা তো জানাজানি হয়ে গেছে।

আপনার সমাধানটি কারো হাতে নেই, আপনি নিজের হাতে সেটি নষ্ট করেছেন। সমাধানটি ছাড়া এই তথ্যটির কোনো মূল্য নেই। এই তথ্যটি আরেকটি কাল্পনিক সূত্র। আপনি ছাড়া আর কেউ সেই সমাধানটি করতে পারবে না।

কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, আমি যদি সেই সমাধানটি না করে দিই, আমার মস্তিষ্ক নিয়ে নেয়া হবে, আমাকে ভয় দেখিয়েছে রিবেনী। রিবেনীর অসাধ্য কিছু নেই–হঠাৎ প্রফেসর রাউখ থেমে গেলেন, বিষণ্ণ চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বুঝে গেলেন অনিশ্চিত জগতের অধিবাসীরা কী চাইছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে প্রফেসর রাউখ খুব ধীরে ধীরে বললেন, আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা কেন আমার কাছে এসেছ।

আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

প্রফেসর রাউখ একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমাদের দুঃখিত হবার কিছু নেই।

আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না প্রফেসর রাউখ।

আমি বুঝতে পারছি।

আপনার কথা আমরা আজীবন মনে রাখব। আমাদের জগৎ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার মতো মানুষ এই জগৎকে সুন্দর করে রেখেছে প্রফেসর রাউখ।

প্রফেসর রাউখ কিছু বললেন না। চতুষ্কোণের ভিতর থেকে ছায়ামূর্তি বলল, আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই।

আমাকে কী করতে হবে বল।

আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি চুপচাপ শুয়ে থাকুন।

প্রফেসর রাউখ বিছানায় শুয়ে চাদরটি নিজের শরীরে টেনে দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশে চাঁদ উঠেছে, তার নরম জ্যোৎস্না কোমল হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য, কখনো ভালো করে দেখেন নি! শেষ মুহূর্তে এই অস্বাভাবিক সৌন্দর্য দেখে হঠাৎ পৃথিবীর জন্যে গাঢ় বিষাদে তাঁর মন ভরে উঠছে।

চতুষ্কোণ নীলাভ জানালা থেকে তীব্র এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে প্রফেসর রাউখের দিকে।

 

রাষ্ট্রপতি রিবেনী হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বসেন। আশ্চর্য একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছে তাঁর। কারা যেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। বিশ্বজগতের প্রতি ক্ষমতার অপব্যবহারের জনা। কী আশ্চর্য স্বপ্ন।

রিবেনী চুপ করে বসে থাকেন, তাঁর হঠাৎ করে মনে হয় কেউ একজন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকান রাষ্ট্রপতি রিবেনী। কেউ কোথাও নেই, কিন্তু কী বাস্তব একটা অনুভূতি।

অকারণে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল তাঁর।