৫৯তম অধ্যায়
নৃপতি দশরথের পুত্রশোককথা
নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! দশরথাত্মজ মহারাজ রামকেও মৃত্যু মুখে নিপতিত হইতে হইয়াছে। প্রজাগণ ঐ মহাত্মাকে স্ব স্ব ঔরস পুত্রের ন্যায় স্নেহ করিত। ঐ অসংখ্য গুণ সম্পন্ন, অমিত তেজা মহানুভব রাম পিতার নির্দেশানুসারে বনিতা সমভিব্যাহারে চতুর্দ্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়াছিলেন। তৎকালে ঐ মহাবীর জনস্থানে অবস্থান করত তত্ৰত্য তপস্বিগণের রক্ষাৰ্থ চতুর্দ্দশ সহস্র রাক্ষস বধ করেন। রাক্ষসরাজ রাবণ ঐ স্থানে তাঁহাকে লক্ষ্মণ সমভিব্যাহারে বিমোহিত করিয়া তাঁহার ভাৰ্য্যা জানকীকে অপহরণ করেন। মহাবল পরাক্রান্ত মহাবীর রাম রাবণের এই অপরাধে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সেই অরাতিগণের অনিজ্জিত, সুরাসুরের অবধ্য, দেব ব্রাহ্মণ কণ্টক পাপাত্মাকে সগণে বিনাশ করিয়াছিলেন। প্ৰজানুগ্রহকারী, দেবগণাভিপূজিত সুরর্ষিগণসেবিত মহাত্মা দাশরথির কীর্ত্তি অদ্যাপি ধরাতলে দেদীপ্যমান রহিয়াছে। ঐ সৰ্ব্বভূতানুকম্পী মহাত্মা বিবিধ রাজ্যলাভ করিয়া ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করত মহাযজ্ঞ ও ত্রিগুণ দক্ষিণ শত অশ্বমেধ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিয়া হবির্দ্বারা পুরন্দরের প্রীতি সাধন এবং অন্যান্য বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা ক্ষুৎপিপাসা পরাজয় পূর্ব্বক দেহিগণের সমুদায় রোগ নিবারণ করিয়াছিলেন। অসাধারণ গুণ সম্পন্ন সতত স্বতেজে দেদীপ্যমান দশরথতনয় রাম তৎকালে সমুদায় জীবগণকে অতিক্ৰমণ করিয়া শোভা পাইতে লাগিলেন। ঐ মহাত্মার রাজ্যশাসন সময়ে ভূমণ্ডলে ঋষি, দেবতা ও মনুষ্যগণের একত্র সহবাস হইয়াছিল; প্রাণিগণের বল এবং প্রাণ, অপান, উদান ও সমান বায়ুর হ্রাস হয় নাই; তেজ পদার্থ সকল দেদীপ্যমান হইয়াছিল; কোন অনর্থ ঘটনা হইত না; সমুদায় প্রজা দীর্ঘায়ু হইয়াছিল; কেহই যৌবনাবস্থায় কাল গ্রাসে পতিত হয় নাই; দেবগণ প্রীতি প্রফুল্লচিত্তে চতুর্ব্বেদ বিধানানুসারে বিবিধ হব্য, কব্য নিপুৰ্ত্ত ও হুত প্রাপ্ত হইতেন; দেশ মধ্যে দংশ, মশক ও হিংস্র সরী সপ সমুদায়ের সম্পর্ক ছিল না; সলিল মধ্যে কাহারও মৃত্যু হইত না; দহন অকালে দগ্ধ করিতেন না; কেহই অধর্ম্ম পরায়ণ, লুব্ধ বা মূর্খ ছিল না এবং সর্ব্ব বর্ণের সমুদায় প্রজা সজ্জনোচিত ইষ্ট কাৰ্যে তৎপর থাকিত।
ঐ সময় রাক্ষসগণ জনস্থানে স্বধা ও পূজা বিনষ্ট করিয়া ছিল, মহাত্মা দশরথতনয় তাহাদিগকে সংহার করিয়া পিতৃলোক ও দেবগণকে স্বধা ও পূজা প্রদান করেন। ঐ মহাত্মার রাজ্য সময়ে পুরুষগণ সহস্র পুত্র সম্পন্ন হইত ও সহস্র বৎসর জীবিত থাকিত। জ্যেষ্ঠগণ কনিষ্ঠগণ দ্বারা শ্রাদ্ধকৃত্য সম্পাদন করিত না। যুবা, শ্যাম, লোহিতাক্ষ, মত্ত মাতঙ্গ বিক্রম, আজানুলম্বিতবাহু, সিংহস্কন্ধ, সৰ্ব্বজন প্রিয়, মহাবল পরাক্ৰান্ত দাশরথি একাদশ সহস্র বৎসর রাজ্য করিয়াছিলেন। তাঁহার রাজ্যশাসন সময়ে প্রজাগণের রাম, রাম ব্যতীত প্রায় অন্য কোন কথা ছিল না এবং জগৎ নিতান্ত অভিরাম হইয়া ছিল। মহাত্মা রাম পরিশেষে আপনার দুই পুত্র ও ভ্রাতৃত্রয়ের ছয় পুত্রকে আট রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া জরায়ুজ, অণ্ডজ, স্বেদজ ও উদ্ভিজ এই চতুর্বিধ প্রজা লইয়া স্বর্গে গমন করেন।
হে সৃঞ্জয়! তোমা অপেক্ষা সমধিক তপ, সত্য, দয়া ও দানশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা অধিক পুণ্যবান মহাত্মা দাশরথিকেও কালগ্রাসে পতিত হইতে হইয়াছে; অতএব তুমি অযাজ্ঞিক অধ্যয়নাদি রহিত স্বীয় পুত্রের নিমিত্ত আর অনুতাপ করিও না।