৫৯তম অধ্যায়
নলদেহে কলিপ্ৰবেশ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “কলি দ্বাপরকে এইরূপে বচনবদ্ধ করিয়া নলরাজের নিকট উপনীত হইল। তথায় প্রত্যহ ছিদ্রান্বেষণে তৎপর হইয়া বহুকাল অতিবাহিত করিল। অনন্তর একাদশ বর্ষ অতীত হইলে একদা নলরাজ মূত্রপরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল জলস্পর্শ করিয়া অপ্রক্ষালিত পদে সান্ধ্যোপাসনা করিতেছিলেন, এই অবকাশে কলি স্বাভিলষিত রন্ধ প্ৰাপ্ত হইয়া তাঁহাকে আশ্রয় করিল। কলি নলে আবিষ্ট হইয়া তদীয় ভ্রাতা পুষ্কর-সমীপে গমনপূর্ব্বক তাহাকে কহিল, চল নলের সহিত তোমাকে ক্রীড়া করিতে হইবে। তুমি মদীয় সাহায্যে অক্ষদ্যূতে নলরাজকে পরাজয়পূর্ব্বক রাজ্যপ্রাপ্ত হইয়া নিষধগণের উপর একাধিপত্য করিতে পরিবে।”
সহোদর পুষ্করসহ নলের অক্ষক্রীড়া
“পুষ্কর কলিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ভ্রাতৃসন্নিধানে গমন করিলেন। এদিকে কলিও উৎকৃষ্ট অক্ষরূপ ধারণ করিয়া পুষ্করের নিকট উপস্থিত হইল। পুষ্কর অক্ষত্ৰীড়ার্থ ভ্রাতাকে পুনঃ পুনঃ উত্তেজনা করায় মনস্বী নলরাজ অসহিষ্ণু হইয়া দময়ন্তীর সমক্ষে সময় নিরূপণপূর্ব্বক দ্যূতক্ৰীড়ায় প্রবৃত্ত হইলেন। তিনি হিরণ্য, সুবর্ণ, যান, বাহন ও বসন প্রভৃতি যে কিছু সম্পত্তি পণ করিলেন, কলির প্রভাবে সকলক্ষেত্রে পরাজিত হইতে লাগিলেন। বন্ধুবান্ধবগণ তাঁহাকে দ্যূতমদে একান্ত উন্মত্ত দেখিয়া নিবারণ করিবার নিমিত্ত কত প্রকার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না।
“অনন্তর মন্ত্রিপ্রমুখ পৌরজনেরা দ্যূতরোগগ্ৰস্ত রাজাকে সন্দর্শন ও দুর্ব্যবসায় হইতে নিবারণ করিবার অভিলাষে আগমন করিলেন। তখন সারথি, দময়ন্তী-সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিল, “দেবি! কাৰ্য্যকুশল পৌরজনেরা রাজদর্শনার্থী হইয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন। আপনি একবার মহারাজকে সংবাদ প্ৰদান করুন যে, তাহার ব্যসনে অসহিষ্ণু ধর্ম্মাৰ্থদৰ্শী প্রকৃতি-সকল সাক্ষাৎকার লাভবাসনায় আগমন করিয়াছেন।” দময়ন্তী সারথির প্রার্থনায় শোকাবেগে নিতান্ত অভিভূত ও দুঃখে একান্ত কাতর হইয়া গদগদ বাক্যে রাজাকে নিবেদন করিলেন, অয়ি নাথ! রাজভক্তিপরায়ণ মন্ত্রিপুরস্কৃত পৌরজনেরা তোমাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত সমুপস্থিত হইয়াছেন, অতএব তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করা তোমার সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য।” রুচিরাপাঙ্গী [মনোহর ভূভঙ্গীবিশিষ্টা] রাজ্ঞী এবংবিধ বিলাপ ও পরিতাপ করিয়া বারংবার এই বিষয়ে অনুরোধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু রাজা কলিকর্ত্তৃক এরূপ আবিষ্ট হইয়াছিলেন যে, মহিষীকে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিতে পারিলেন না। তখন পুরবাসী ও মন্ত্রিবর্গ, রাজা একেবারে অকর্ম্মণ্য ও উৎসন্ন হইয়াছেন বিবেচনা করিয়া, দুঃখিতচিত্তে লজ্জানম্র-মুখে স্ব স্ব ভবনে প্রত্যাগমন করিলেন। হে যুধিষ্ঠির! এইরূপে বহুকাল পৰ্য্যন্ত নলরাজ ও পুষ্করের দ্যূতক্রীড়া হইতে লাগিল, কিন্তু প্ৰতিবারই পুণ্যশ্লোক নলনরপতি পরাজিত হইয়াছিলেন।