৫৮তম অধ্যায়
ভীমতাড়িত দুর্য্যোধনের পলায়ন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন সেই ভূপতিসমুদয় মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয়কে সংগ্রামক্ষেত্রে দেখিয়া ক্রোধান্বিতচিত্তে বহুসহস্র রথ লইয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক তাহার রথের উপর অসংখ্য শর, নিশিত শক্তি, গদা, পরিঘ, প্রাস, পরশু, মুদগর ও মুষলসমুদয় নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন কনকভূষণ শরনিকরদ্ধারা মুহূৰ্তমধ্যে ভূপতিগণের সেই শরবৃষ্টি নিরাকৃত করিলেন। সমরদর্শনার্থ সমাগত দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ, উরগ, রাক্ষসগণ অর্জ্জুনের অসাধারণ হস্তলাঘবদর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহাকে সাধুবাদ প্ৰদান করিতে লাগিলেন। এ দিকে গান্ধার ও সৌবলগণ মহতী সেনার সহিত সাত্যকি ও অভিমন্যুকে অবরোধ করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত সৌবলগণ ক্ৰোধাভরে নানাবিধ অস্ত্র পরিত্যাগপূর্ব্বক সাত্যকির রথ তিল তিল করিয়া ছেদন করিলে মহাবীর সাত্যকি সত্বর অভিমন্যুর রথে আরোহণ করিলেন। এইরূপে সেই বীরপুরুষদ্বয় একরথে অবস্থানপূর্ব্বক সন্নতপর্ব্ব সুতীক্ষ্ণ শরনিকরদ্ধারা সুবলনন্দনের সৈন্যসমুদয় ছেদন করিতে লাগিলেন। এ দিকে ভীষ্ম ও দ্রোণ কঙ্কপত্রবিভূষিত সুতীক্ষ্ন সায়কসমুদয়দ্বারা পরমযত্নসহকারে ধর্ম্মরাজের সেনাগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে, মহারাজ ধর্ম্মরাজ ও মাদ্রীনন্দনদ্বয় দ্রোণাচাৰ্য্যের সৈন্যগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন দেবাসুর যুদ্ধের ন্যায় ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। মহাবীর ভীম ও ঘটোৎকচ মহৎ কর্ম্ম সম্পাদন করিতে লাগিলেন। দুৰ্য্যোধন তাঁহাদের উভয়ের অভিমুখীন হইলে মহাবল পরাক্রান্ত হিড়িম্বাতনয় ঘটোৎকচ ভীমসেন অপেক্ষা অধিকতর সংগ্ৰাম করিয়া অদ্ভুত বলবিক্রম প্রদর্শন করিলেন। মহাবীর ভীমসেন ক্রোধভরে হাসিতে হাসিতে দুর্য্যোধনের হৃদয়ে নিশিত সায়ক বিদ্ধ করিলে, মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেই শরাঘাতে একান্ত নিপীড়িত হইয়া মূৰ্ছাপন্ন ও রথে নিপতিত হইলেন। সারথি তাঁহাকে সংজ্ঞাশুন্য দেখিয়া সত্বর রথ লইয়া পলায়ন করিল।
“এইরূপে মহারাজ দুৰ্য্যোধন মুর্চ্ছাপন্ন ও সংগ্রাম হইতে অপনীত হইলে কৌরবসৈন্যগণ ভগ্ন হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। ভীমসেন তাহাদের উপর নিশিত শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ও ধর্ম্মানন্দন যুধিষ্ঠির ভীষ্ম ও দ্রোণের সমক্ষেই সুতীক্ষ্ন সায়কসমুদয়দ্বারা তাহাদের সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। হতাবিশিষ্ট সৈন্যগণ প্রাণভয়ে ইতস্ততঃ পলায়ন করিল; ভীষ্ম ও দ্রোণ তাহাদিগকে নিবারণ করিতে পারিলেন না, উঁহারা বারংবার তাহাদিগকে নিষেধ করিলেন, কিন্তু তাহারা নিতান্ত ভীত হইয়াছিল, তাহাদের বাক্যে কৰ্ণপাত না করিয়া তাঁহাদের সমক্ষেই পলায়ন করিতে লাগিল। এইরূপে সহস্ৰ সহস্ৰ রথী পলায়নপরায়ণ হইলে একরথস্থ মহাপ্রভাব সাত্যকি ও অভিমন্যু সুবলনন্দনের সেনাসমুদয় সংহার করিতে লাগিলেন। তৎকালে ঐ মহাবলপরাক্রান্ত বীরপুরুষদ্বয়ের অমাবস্যাগত সূৰ্য্য ও চন্দ্রের ন্যায় শোভা পাইল ।
“ঐ সময়ে মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধাভরে নীরদের [মেঘের] বারিবর্ষণের ন্যায় কৌরবসৈন্যগণের উপর বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ অর্জ্জুনের শরে একান্ত ব্যথিত হইয়া মহাবেগে ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। দুৰ্য্যোধনহিতৈষী মহাবল ভীষ্ম ও দ্ৰোণ কৌরব সৈন্যগণকে পলায়নপরায়ণ অবলোকন করিয়া ক্ৰোধান্বিতচিত্তে তাহাদিগকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাযুদ্ধে দুৰ্য্যোধনও লব্ধসংজ্ঞ হইয়া সেই সমন্তাৎ পলায়মান সৈন্যগণকে নিবৃত্ত করিতে আরম্ভ করিলেন। তৎকালে যে যে মহারথ দুৰ্য্যোধনকে দেখিতে পাইলেন, তাঁহারা সকলেই নিবৃত্ত হইলেন। অন্যান্য লোকসমুদয় তাঁহাদিগকে নিবৃত্ত হইতে দেখিয়া কেহ কেহ পরস্পর স্পৰ্দ্ধা, কেহ কেহ বা লজ্জাবশতঃ পলায়নে পরাঙ্মুখ হইয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে কৌরবসৈন্যগণ পুনরাবর্ত্তন করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহাদের বেগ চন্দ্ৰোদয়কালীন পারপূৰ্য্যমা [সহসা পরিপূর্ণ] সাগরবেগের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল।
পরাজিত দুর্য্যোধনের ভীষ্মের প্রতি কটূক্তি
“মহারাজ দুৰ্য্যোধন সেইসমুদয় সৈন্যগণকে প্রতিনিবৃত্ত নিরীক্ষণ করিয়া সত্বর শান্তনুতনয়ের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে পিতামহ! আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ করুন। আপনি, সপুত্ৰ সবান্ধব মহাস্ত্ৰবিৎ দ্রোণ এবং মহাধনুৰ্দ্ধর কৃপ জীবিত থাকিতে যে কৌরব সৈন্যগণ পলায়ন করিতেছে, ইহা নিতান্ত বিষদৃশ বোধ হইতেছে; পাণ্ডবগণকে সামান্য প্রতিপক্ষ বলিয়া উপেক্ষা করা উচিত নয়। হে পিতামহ! আপনি, দ্রোণাচাৰ্য্য, অশ্বত্থামা ও কৃপ এই কৌরবসৈন্যগণকে নিহন্যমান দেখিয়াও যখন উপেক্ষা করিতেছেন, তখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, পাণ্ডবগণকে অনুগ্রহ করাই আপনার উদ্দেশ্য। যদি আপনার এইরূপ অভিপ্রায় ছিল, তাহা হইলে আপনি কি নিমিত্ত আমাকে পূর্ব্বে বলেন নাই? তাহা হইলে আমি কদাপি পাণ্ডবগণ, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতাম না। আমি কেবল আপনার ও দ্রোণাচাৰ্য্যের বাক্যানুসারে কর্ণসমভিব্যাহারে কাৰ্য্যচিন্তা করিয়া সমরে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছি। যাহা হউক, এক্ষণে যদি আমি সংগ্রামে আপনার ও দ্রোণাচাৰ্য্যের পরিত্যাজ্য না হই, তাহা হইলে আপনার স্ব স্ব বিক্রমানুরূপ যুদ্ধ করুন।”
“মহাবীর ভীষ্ম দুৰ্য্যোধনের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া বারংবার হাস্য করিয়া ক্রোধভরে নয়নদ্বয় বিঘূর্ণনপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন! পাণ্ডবগণ ইন্দ্ৰাদি সুরসমূদয়েরও অজেয়; এই হিতকর বাক্য আমি পূর্ব্বে তোমাকে বারংবার কহিয়াছি। যাহা হউক আমি বৃদ্ধ এক্ষণে আপনার সাধ্যানুসারে সমরকাৰ্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতেছি; তুমি সবান্ধবে অবলোকন কর। আমি অদ্য সসৈন্য সবান্ধব পাণ্ডবগণকে সৰ্ব্বলোকসমক্ষে নিবারণ করিব।” হে মহারাজ! মহাবীর ভীষ্ম এই কথা কহিলে আপনার পুত্ৰ শঙ্খধ্বনি ও ভেরীবাদন করিতে আদেশ করিলেন। পাণ্ডবগণও সেই সুমহৎ ধ্বনি শ্রবণ করিয়া শঙ্খ, ভেরী ও মুরজ বাদন করিতে লাগিলেন।”