৫৮তম অধ্যায়
প্রজারক্ষার প্রশংসা-রক্ষার উপায়
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ। রক্ষাই রাজধৰ্ম্মের সারাংশ। ভগবান বৃহস্পতি রক্ষার ন্যায় অন্য ধর্ম্মের প্রশংসা করেন নাই। রাজধৰ্ম্মপ্রণেতা ব্ৰহ্মবাদী ভগবান্ বিশালাক্ষ, মহাতপাঃ শুক্রাচার্য্য, সহস্রলোচন ইন্দ্র, প্রাচেতস মনু, ভগবান্ ভরদ্বাজ ও গৌরশিরামুনি সৰ্ব্বাপেক্ষা রক্ষাধৰ্ম্মেরই প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। এক্ষণে আমি রক্ষাবিধানের উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। গুপ্তচর ও ভৃত্যবর্গকে বিরক্ত না করিয়া যথাকালে বেতনদান, অসৎপথাবলম্বী না হইয়া যুক্তি অনুসারে প্রজাগণের করগ্রহণ, সাধু ব্যক্তিদিগের সংগ্রহ, শৌর্য্য ও নৈপুণ্যপ্রকাশ, সত্যব্যবহার, প্রজার হিতচেষ্টা, সৎপথেই হউক আর অসৎপথেই হউক, শত্রুপক্ষের ভেদ, জীর্ণ গৃহাদির পুনঃসংস্কার, সময়ানুসারে দ্বিবিধ দণ্ডপ্রয়োগ, সাধু ও সঙ্কুলসম্ভূত ব্যক্তিগণের অপরিত্যাগ, শস্যাদিসংগ্রহ, সতত বুদ্ধিমান ব্যক্তিদিগের সহিত সহবাস, নিয়ত সৈন্যগণের হর্ষোৎপাদন, প্রজাদিগের তত্ত্বাবধারণ, নিয়ত কাৰ্য্যসাধনে তৎপরতা, কোষপরিবর্দ্ধন[ধনবৃদ্ধি], নগররক্ষা, পরপক্ষকর্ত্তৃক ভেদের আশঙ্কা, শত্রুমধ্যস্থিত প্রজাগণের তত্ত্বাবধারণ, ভৃত্যগণের কাৰ্য্য বিশেষরূপে পর্য্যবেক্ষণ, আত্মপুররক্ষা, শত্রুকে আশ্বাস-প্রদান, নিয়ত নীতিধৰ্ম্মের অনুসরণ, সতত উদ্যোগ ও অসৎলোকের সংসর্গ পরিত্যাগ করা এবং শত্রুগণের উপেক্ষা প্রদান না করাই রক্ষাবিধানের প্রধান উপায়।
পুরুষকারের উপকারিতা
“অতঃপর পুরুষকারের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বৃহস্পতি পুরুষকারকে রাজধর্ম্মের মূল বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। দেবরাজ ইন্দ্র পুরুষকারপ্রভাবেই অমৃতলাভ, অসুরসংহার ও দেবলোকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পদবী অধিকার করিয়াছেন। পুরুষকারসম্পন্ন বীরপুরুষ পণ্ডিতগণ অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। পণ্ডিতেরা উদ্যোগী ব্যক্তিকে প্রতিবাক্যে সন্তুষ্ট করিয়া উপাসনা করেন। যে রাজা পুরুষকারহীন, তিনি বুদ্ধিমান্ হইলেও নিৰ্ব্বিষ ভুজঙ্গের ন্যায় শত্রুগণের পরাভবের আস্পদ হইয়া উঠেন। বলবান্ ব্যক্তি শত্ৰু দুর্ব্বল হইলেও তাহাকে কদাচ অবজ্ঞা করিবে না। অগ্নি অল্পমাত্র হইলেও সমুদয় দগ্ধ এবং বিষ অণুমাত্র হইলেও লোকের প্রাণ বিনষ্ট করিতে পারে। শত্রু একাঙ্গমাত্র [হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতি এই চতুরঙ্গের মধ্যে যে কোন এক অঙ্গ] সেনাসমভিব্যাহারে দুর্গ আশ্রয় করিয়া সুসম্পন্ন ভূপালের দেশ উৎসন্ন করিতে পারে। রাজার গোপনীয় বাক্য, লোকসংগ্রহের বিষয়, জয়াদিলাভার্থে হৃদয়স্থ কুটিলভাব এবং হীনকাৰ্য্যসমুদয় সরলতাসহকারে প্রকাশ করা অকৰ্ত্তব্য। লোক বশীভূত করিবার নিমিত্ত ধৰ্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করাই শ্রেয়স্কর। একান্ত ক্রুর এবং নিতান্ত মৃদুস্বভাবসম্পন্ন ব্যক্তি অতি বিস্তীর্ণ রাজ্যভার বহন করিতে কদাচ সমর্থ হয়েন না। অতএব ক্রুরতা ও মৃদুতা উভয়ই অবলম্বন করা রাজার কর্ত্তব্য। প্রজাপালন করিবার নিমিত্ত যদি রাজার কোন বিপদ উপস্থিত হয়, তাহাও তাঁহার ধৰ্ম্মস্বরূপ। হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি এক্ষণে ভূপালগণের যেসমুদয় গুণকীৰ্ত্তন করিলাম, ঐরূপ গুণসম্পন্ন হওয়াই তাঁহাদিগের কর্ত্তব্য। তুমি আমার মুখে রাজধৰ্ম্মের কিয়দংশ শ্রবণ করিলে, এক্ষণে তোমার যে বিষয়ে সন্দেহ আছে, অবিলম্বে তাহার উল্লেখ কর।”
মহাত্মা শান্তনুতনয় এই কথা কহিলে ভগবান্ ব্যাস, দেবস্থান, অশ্মা, বাসুদেব, কৃপাচার্য্য, সাত্যকি ও সঞ্জয় তাঁহার নিকট রাজধৰ্ম্মশ্রবণে যারপরনাই প্রফুল্ল হইয়া তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদানপূৰ্ব্বক স্তব করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা যুধিষ্ঠির অপূৰ্ণলোচনে ও দীনভাবে ভীষ্মের চরণ স্পর্শ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “পিতামহ! এক্ষণে দিবাকর পার্থিব রস আকর্ষণ পূৰ্ব্বক অস্তাচলে গমন করিতেছেন; অতএব কল্য আপনাকে সংশয়সমুদয় জিজ্ঞাসা করিব।” অনন্তর যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব ও কৃপাচার্য্য প্রভৃতি মহাত্মা ব্রাহ্মণগণকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক ভীষ্মকে প্রদক্ষিণ করিয়া প্রফুল্লমনে রথারূঢ় হইলেন এবং অচিরাৎ স্রোতস্বতী দৃষদ্বতীর তীরে সমুপস্থিত হইয়া অবগাহন ও সন্ধ্যাবন্দনাদি কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানপুৰ্ব্বক হস্তিনাপুরে প্রবেশ করিলেন।