হেনমতে কুরুবংশে তিন পুত্র হৈল।
অহর্নিশি নানা দান, নানা যজ্ঞ কৈল।।
তিন পুত্রে ভীষ্ম বীর করেন পালন।
নানা-শস্ত্র-শাস্ত্র-বিদ্যা করান পঠন।।
কতদিনে দেখি সবে যৌবন সময়।
বিবাহ কারণ চিন্তে গঙ্গার তনয়।।
যদুবংশে সুবল নামেতে নৃপমণি।
গান্ধারী-নামেতে কন্যা তাঁহার নন্দিনী।।
ভগবানে আরাধিয়া কন্যা পায় বর।
একশত পুত্র হবে মতা-বলধর।।
বার্ত্তা পেয়ে ভীষ্মবীর দূত পাঠাইল।
সুবল-রাজারে দূত সকল কহিল।।
বিচিত্রবীর্য্যের পুত্র ধৃতরাষ্ট্র নাম।
কুরুবংশে বিখ্যাত, ভুবনে অনুপাম।।
তাঁর হেতু বরিবারে তোমার কুমারী।
ভীষ্মবীর পাঠাইল মোরে শীঘ্র করি।।
শুনিয়া গান্ধার-রাজ ভাবে মনে মনে।
কুরুকুল মহাবংশ বিখ্যাত ভুবনে।।
সকল সম্পন্ন দেখি, অন্ধমাত্র বর।
না দিলে কুপিত হবে ভীষ্ম কুরুবর।।
এতেক বিচার করি গান্ধার রাজন।
বিবাহের দ্রব্য করিলেন আয়োজন।।
হস্তী হয় রথ রত্ন শকটে পূরিয়া।
দাস দাসী গো মহিষ বিপুরল করিয়া।।
শকুনিরে সঙ্গে দিল বিপুল ব্রাহ্মণ।
চতুর্দ্দোলে কন্যা দিল করিয়া সাজন।।
গান্ধারী শুনিল, অন্ধ-বরে সমর্পিল।
আপন স্বকর্ম্ম ভাবি চিত্তে ক্ষমা দিল।।
শুক্ল পট্টবস্ত্র দেবী শতপুর করি।
আপন নয়ন-যুগ্ম বান্ধিল সুন্দরী।।
পতি-গতি অনুসারি মুদিল নয়ন।
পতিব্রতা গান্ধারী যে জগতে ঘোষণ।।
শকুনি যে চলিল ভগিনীর সংহতি।
হস্তিনা-নগরে উত্তরিল শীঘ্রগতি।।
ধৃতরাষ্ট্রে সমর্পিল ভগিনী-রতন।
নানা রত্ন-অলঙ্কারে করিয়া ভূষণ।।
হস্তী অশ্ব রথ রত্ন করি বহু দান।
শকুনি আপন দেশে করিল পয়াণ।।
জ্যেষ্ঠের বিবাহ দিয়া গঙ্গার নন্দন।
পাণ্ডুর বিবাহ হেতু সচিন্তিত মন।।
শূর নামে যাদব কৃষ্ণের পিতামহ।
কুন্তীভোজ-নৃপতিরে বড় অনুগ্রহ।।
পিতৃষ্বসা পুত্র কুন্তে অপুত্রক দেখি।
পালিবারে দিল কন্যা পৃথা শশীমুখী।।
পৃথারে আনিয়া বলে কুন্তি-নরপতি।
অতিথি-শুশ্রুষা তুমি কর গুণবতী।।
পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে কন্যা পূজে অতিথিরে।
কতকালে আইল দুর্ব্বাসা সেই ঘরে।।
মুনিরাজে দেখি কন্যা পাদ্য-অর্ঘ্য দিল।
আপনার হস্তে দুই পদ প্রক্ষালিল।।
রত্নময় খাটে তবে করায় শয়ন।
মিষ্টান্ন পক্কান্ন দিয়া করায় ভোজন।।
করযোড় করি কুন্তী মুনি-আগে রয়।
দেখিয়া সন্তুষ্ট হৈল মুনি মহাশয়।।
তুষ্ট হৈয়া বলিল দুর্ব্বাসা মহামুনি।
এক মন্ত্র দিব তোমা, লহ সুবদানী।।
মন্ত্র জপি যেই দেবে করিবে স্মরণ।
তোমার অগ্রেতে সে আসিবে ততক্ষণ।।
এত বলি মন্ত্র দিয়া গেল মুনিবর।
মন্ত্র পেয়ে পৃথা দেবী হরিষ অন্তর।।
পরীক্ষা করিতে মন্ত্র ভোজের নন্দিনী।
মন্ত্র জপি স্মরণ করিল দিনমণি।।
পৃথার স্মরণে তথা এল দিনকর।
সূর্য্য দেখি পৃথা হৈল বিরস-অন্তর।।
করযোড় করি কুন্তী প্রণাম করিল।
সবিনয়ে পৃথাদেবী বলিতে লাগিল।।
দুর্ব্বাসার মন্ত্র আমি পরীক্ষা কারণ।
শেষ না ভাবিয়া করি তোমারে স্মরণ।।
অপরাধ করিলাম অজ্ঞানে মোহিত।
বামাজাতি সদা দোষ ক্ষমিতে উচিত।।
সূর্য্য বলে, ব্যর্থ নহে মুনির বচন।
ব্যর্থ নহে কন্যা কভু মম আগমন।।
প্রথম লইয়া মন্ত্র ডাকিলা আমারে।
তব মন্ত্র ব্যর্থ হবে না ভজিলে মোরে।।
পৃথা বলে দেখ মম শৈশব বয়স।
করিলে কুৎসিত কর্ম্ম হবে অপযশ।।
দিনকর বলে, ভয় না করিহ মনে।
মোর হেতু দোষ তব না হবে ভুবনে।।
প্রবোধিয়া পৃথারে সে অনেক প্রকার।
বর দিয়া গেল সূর্য্য নিজ স্থানে তার।।
সূর্য্য-বরে কুন্তী-গর্ভে হইল নন্দন।
দেখিয়া ভোজের কন্যা সচিন্তিত মন।।
অকুমারী কন্যা আমি বিবাহ না হয়।
তাহে গর্ভ অসম্ভব লোক-লাজ ভয়।।
বয়সে বালিকা তাহে গর্ভ উদরেতে।
বেদনা যাতনা নারি প্রসব হইতে।।
এত ভাবি স্মরিলেন দেব দিননাথে।
পুত্র প্রসবিল কুন্তি কর্ণ-রন্ধ্র-পথে।।
কর্ণমূলে জন্ম হৈল তেঁই কর্ণ নাম।
নানা অস্ত্র শিক্ষা কৈল ভৃগুরামের স্থান।।
হেনমতে কুন্তী-গর্ভে হইল নন্দন।
জন্ম হইতে অক্ষয় কবচ বিভূষণ।।
শ্রবণে কুণ্ডল শোভে সূবর্ণ মণ্ডিত।
পুত্র দেখি পৃথাদেবী হইল বিস্মিত।।
লোকে খ্যাত হবে বলি হইলা বিরস।
কুলেতে কলঙ্ক রবে, লোকে অপযশ।।
এতেক চিন্তিয়া পৃথা পুত্র লৈয়া কোলে।
তাম্রকুণ্ড করি ভাসাইয়া দিল জলে।।
এক সূত নিত্য করে যমুনায় স্নান।
ভাসি যায় তাম্রকুণ্ড দেখে বিদ্যমান।।
ধরিয়া আনিয়া দেখে সুন্দর কুমার।
আনন্দে লইয়া গেল গৃহে আপনার।।
রাধা নামে ভার্য্যা তার পরমাসুন্দরী।
অপুত্রক আছিলা, পুষিল পুত্র করি।।
বসুসেন নাম তবে রাখিল তাহার।
দিনে দিনে বাড়ে যেন চন্দ্রের আকার।।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিশারদ হৈল মহাবীর।
অহর্নিশি আরাধন করয়ে মিহির।।
জিতেন্দ্রিয় মহাবীর ব্রতে অনুরত।
ব্রাহ্মণেরে দান বীর দেয় অবিরত।।
যেই যাহা চাহে, দিতে নাহি করে আন।
প্রাণ কেহ নাহি চায়, তাই রহে প্রাণ।।
তাহারে দেখিয়া সাধু দেব পুরন্দর।
পুত্র হিতে ধরিয়া ব্রাহ্মণ কলেবর।।
কুণ্ডল কবচ দান মাগিল তাহারে।
ততক্ষণে অঙ্গ কাটি দিল পুরন্দরে।।
সন্তুষ্ট হইয়া ইন্দ্র বলে লহ বর।
একাঘ্নী মাগিয়া নিল কর্ণ ধনুর্দ্ধর।।
একাঘ্নী নামেতে অস্ত্র জানে ত্রিভুবন।
যাহারে প্রহারে তার অবশ্য মরণ।।
নিজ হস্তে কর্ণ কাটি কুণ্ডল অর্পিল।
সেই হেতু কর্ণ নাম ইন্দ্র তাঁরে দিল।।
ভোজের নন্দিনী পৃথা রহে পিত্রালয়ে।
স্বয়ম্বর করিল সে যৌবন সময়ে।।
নিমন্ত্রিয়া আনাইল যত রাজগণে।
আইল সকল রাজা সেই নিমন্ত্রণে।।
বসিল সকল রাজা যা যেই স্থান।
মধ্যেতে বসিল পাণ্ডু ইন্দ্রের সমান।।
গ্রহগণ মধ্যে যেন শোভে দিনকর।
পাণ্ডুতেজে আচ্ছাদিল যত নৃপবর।।
পাণ্ডুরে দেখিয়া পৃথা উল্লসিত-মন।
গলে মাল্য দিয়া তারে করিল বরণ।।
ভোজরাজ, পাণ্ডুর করিল সুসম্মান।
নানারত্নে ভূষিয়া করিল কন্যাদান।।
রাজগণ চলি গেল যে যার নগরে।
কুন্তী লৈয়া পাণ্ডু এল আপনার ঘরে।।
পুরন্দর-কোলে যেন পুলোমা-নন্দিনী।
রজনীপতির কোলে শোভিতা রোহিণী।।
হস্তিনা-নগরে লোক হৈল হরষিত।
স্থানে স্থানে নগরে হৈল নিত্য-গীত।।
তবে কতদিনে পাণ্ডুর পুত্র না হৈল।
পুনঃ পাণ্ডুর বিভা হেতু ভীষ্ম চিন্তিল।।
হেনকালে শুনে শল্য নামে মদ্রেশ্বর।
পৃথিবীতে বিখ্যাত অতুল গুণধর।।
তাহার ভগিনী আছে পরমা সুন্দরী।
বার্ত্তা পেয়ে গেল ভীষ্ম তাহার নগরী।।
শল্য রাজা শুনিল ভীষ্মের আগমন।
আগুসরি নিজ গৃহে নিল ততক্ষণ।।
বিধিমতে গঙ্গাপুত্রে পূজিল তখন।
জিজ্ঞাসিল কোন্ কার্য্যে হেথা আগমন।।
ভীষ্ম বলে, তুমি রাজা বিখ্যাত সংসার।
বন্ধুত্ব করিতে ইচ্ছা হয়েছে আমার।।
তোমার ভগিনী আছে কহে সর্ব্বজন।
ভ্রাতার নন্দনে মম কর সমর্পণ।।
হাসিয়া যে বলে শল্য বিধি মিলাইল।
কে জানে এমন ভাগ্য আমার যে ছিল।।
একমাত্র নিবেদন আছয়ে আমার।
পূর্ব্বাপর আমার আছয়ে কুলাচার।।
ঠেলিতে না পারি, কৈল পিতামহ পিতা।
তোমারে কহিতে যোগ্য নহে সেই কথা।।
তব স্থানে ধন লই, নহি যে নির্ধন।
কেবল চাহি যে কুল ধর্ম্মের রক্ষণ।।
শল্যের বচনে ভীষ্ম বুঝিল কারণ।
কুল-ধর্ম্ম-রক্ষা হেতু কর্ত্তব্য যতন।।
ইন্দ্র প্রতি প্রজাপতি বলিল বচন।
দেবকর্ম্ম কুলধর্ম্ম না কর লঙ্ঘন।।
আপন কুলের ধর্ম্ম করিবে পালন।
নাহিক তাহাতে দোষ, বেদের বচন।।
এত বলি ভীষ্ম দিল অমূল্য রতন।
শত কুম্ভ পূর্ণ করি দিলেন কাঞ্চন।।
অশ্ব রথ গজ দিল বিচিত্র বসন।
ধনলাভে প্রীত হৈল মদ্রের নন্দন।।
নানারত্নে ভূষিয়া ভগিনী আনি দিল।
মাদ্রী লৈয়া ভীষ্মদেব নিজ দেশে গেল।।
পাণ্ডুর বিবাহে মহা উৎসব করিল।
দেখিয়া মাদ্রীর রূপ পাণ্ডু হৃষ্ট হৈল।।
যুগল বনিতা পাণ্ডু দেখিয়া সমান।
দুই ভার্য্যা সব ভাব নাহি ভেদ জ্ঞান।।
তবে পাণ্ডু কত দিনে সবার অগ্রেতে।
প্রতিজ্ঞা করিল দিগ্ বিজয় করিতে।।
পদাতি রথাশ্ব গজ চতুরঙ্গ দলে।
সাজিয়া পশ্চিম দিকে গেল মহাবলে।।
দশার্ণ-দেশের রাজা পূর্ব্ব অপরাধী।
তাহারে জিনিয়া পাইল বহু রত্ন নিধি।।
মগধ-রাজ্যেতে জিনি মদ্ররথ রাজা।
মিথিলা ঈশ্বর কাশীকৌঞ্চ মহাতেজা।।
জমদগ্নি-সম তেজে পাণ্ডু মহামতি।
একে একে জিনিল সকল নরপতি।।
তবে ত সকল রাজা একত্র হইয়া।
পাণ্ডুর সহিত যুদ্ধ করিল আসিয়া।।
না পারিয়া ভঙ্গ দিল যত নৃপবর।
পাণ্ডুরে পূজিয়া তবে দেয় রাজকর।।
হস্তী ঘোড়া রথ রথী বিবিধ রতন।
আর কত ধন দিল, না যায় গণন।।
রাজগণ জিনি পাণ্ডু লয়ে রাজকর।
আপনার রাজ্যে গেল হস্তিনা-নগর।।
পাণ্ডুর মহিমা যশে পৃথিবী পূরিল।
পূর্ব্বেতে ভরত রাজা যে কর্ম্ম করিল।।
পাণ্ডু প্রতি বড় প্রীতি গঙ্গার নন্দন।
আশীর্ব্বাদ করি করে মস্তক চুম্বন।।
তবে একে একে পাণ্ডু সবারে বন্দিল।
যতেক আনিল দ্রব্য ধৃতরাষ্ট্রে দিল।।
ধন পাইয়া ধৃতরাষ্ট্র করিল সম্মান।
নানা যজ্ঞ করিয়া করিল বহু দান।।
বহু অশ্বমেধ যজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র কৈল।
হস্তী হয় গো কাঞ্চন ভূমি দান দিল।।
ধৃতরাষ্ট্রে দিয়া পাণ্ডু রাজ্যে-অধিকার।
মৃগয়াতে রত সদা, বনেতে বিহার।।
কুন্তী মাদ্রী সহ রাজা সদা থাকে বনে।
যথা থাকে তথা যেন হস্তিনা ভুবনে।।
তবে কতদিনে ভীষ্ম বিদুর কারণ।
সুদেব রাজার কন্যা করিল বরণ।।
সুদেব রাজার কন্যা নামে পরাশরী।
রূপেতে নিন্দিত যত স্বর্গবিদ্যাধরী।।
মহা ধর্ম্মশীল এই বিদুর হইতে।
জন্মিল নন্দনগণ সে কন্যা-গর্ভেতে।।
পিতার সমান তারা অতি নম্র ধীর।
অসামান্য গুণশীল ধর্ম্মেতে সুস্থির।।
কুরুবংশবৃদ্ধি কথা যেই নর শুনে।
তার বংশ বৃদ্ধি হয় ব্যাসের বচনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত অর্ণবে।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।