৫৮তম অধ্যায়
অব্যবস্থিতচিত্ত ধৃতরাষ্ট্রের পুনঃ কৃষ্ণার্জ্জুন-প্রশ্ন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাত্মা বাসুদেব ও ধনঞ্জয় যাহা কহিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত উৎসুক হইয়াছি; অতএব তাহাই কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আমি কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে যে প্রকার অবলোকন করিলাম। আর তাহারা যাহা কহিয়াছেন, তৎসমুদয় বলিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি নরদেব ধনঞ্জয় ও বাসুদেবের সহিত কথোপকথন করিবার নিমিত্ত সংযত ও কৃতাঞ্জলি হইয়া পদাঙ্গুলির উপর দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলাম। যে স্থানে অর্জ্জুন, বাসুদেব, দ্রৌপদী ও সত্যভামা অবস্থান করেন, তথায় কি অভিমন্যু, কি নকুল, কি সহদেব, কেহই গমন করেন না। আমি সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, বাসুদেব ও অর্জ্জুন উভয়ে মধুপানে মত্ত, চন্দনচর্চিত এবং উত্তম মাল্য, বস্ত্র ও দিব্য-আভরণে ভূষিত হইয়া অনেক রত্নশোভিত বিবিধ-আস্তরণমণ্ডিত কাঞ্চনময় আসনে আসীন হইয়া আছেন এবং কেশবের চরণযুগল অর্জ্জুনের উৎসঙ্গে এবং অর্জ্জুনের এক চরণ দ্রুপদনন্দিনীর অঙ্কে ও অন্য চরণ সত্যভামার অঙ্গে আরোপিত আছে। অনন্তর ধনঞ্জয় আমাকে অবলোকন করিয়া চরণদ্বারা তাঁহার কাঞ্চনময় পাদপীঠ প্ৰদান করিলেন, আমি তাহা করদ্বারা স্পর্শ করিয়া ভূতলে উপবেশন করিলাম। তিনি যখন পাদপীঠ হইতে পাদদ্বয় উত্তেলিত করেন, তখন তাঁহার চরণতলে শুভসূচক উৰ্দ্ধরেখা অবলোকন করিলাম। মহারাজ! শ্যাম কলেবর তরুণবয়স্ক শালতারুসমুন্নত ধনঞ্জয় ও বাসুদেবকে একাসনে সমাসীন নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ে নিতান্ত বিহ্বল হইলাম। মন্দাত্মা দুৰ্য্যোধন ভীষ্মদ্রোণের প্রশ্রয়ে এবং কর্ণের আত্মশ্লাঘায় ইন্দ্র ও বিষ্ণুসদৃশ ঐ উভয় বীরকে অবগত হইতে পারেন নাই। তৎকালে আমার নিশ্চয় বোধ হইল, এই দুই বীর যখন ধর্ম্মরাজের আজ্ঞাকারী, তখন তাঁহার সঙ্কল্প অবশ্যই সম্পন্ন হইবে।
সঞ্জয়কর্ত্তৃক কৃষ্ণার্জ্জুনমন্তব্য প্রকাশ
“আমি যথাবিধি সৎকৃত হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আবৃতকলেবর কৃতাঞ্জলিপুটে আপনার আদেশ নিবেদন করিলাম। তখন ধনঞ্জয় গুণকিণাঙ্কিত পাণিদ্বারা বাসুদেবের চরণদ্বয় অবনমিত করিয়া তাঁহার বক্তব্য বিষয় প্রকাশ করিতে কহিলেন। ইন্দ্ৰোপম সর্ব্বাভরণভূষিত বাসুদেব ইন্দ্ৰকেতুর [ইন্দ্ৰধ্বজ] ন্যায় উত্থিত হইয়া আমাকে সম্বোধন করিয়া আহ্লাদজনক অভিপ্ৰেতাৰ্থ প্রকাশের উপযোগী, ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের ভয়জনক, মৃদু অথচ নিদারুণ সদর্থসম্পন্ন এবং হৃদয়গ্রাহী বাক্য কহিতে লাগিলেন, “হে সঞ্জয়! আমাদের স্বাক্যানুসারে বৃদ্ধগণকে অভিবাদন ও যুবকগণকে কুশলজিজ্ঞাসা করিয়া কুরুপ্রধান ভীষ্ম ও দ্রোণাচাৰ্য্যের সমক্ষে মনীষী ধৃতরাষ্ট্রকে এরূপ কহিবে যে, রাজা যুধিষ্ঠির জয়লাভের নিমিত্ত ত্বরা করিতেছেন; অতএব আপনি এই সময় ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণাদানপূর্ব্বক বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান এবং পুত্র ও কলাত্ৰগণের সহবাসজনিত সুখ সম্ভোগ করুন। আপনাদিগের মহদভয়সমুপস্থিত হইয়াছে; আপনারা এক্ষণে সৎপাত্রে অর্থদান, অভিলষিত পুত্ৰলাভ ও প্রিয়জনের প্রতি প্ৰিয়াচরণ করুন। আমি দ্ৰৌপদীর নিগ্রহসময়ে অতি দূরে ছিলাম, তিনি যে সেই সময়ে
“হা গোবিন্দ!” বলিয়া রোদন করিয়াছিলেন, কিন্তু আমি সমুপস্থিত হইতে পারি নাই, সেই ঋণ ক্রমে ক্ৰমে পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে এবং তন্নিবদ্ধন যন্ত্রণাও আমার হৃদয় হইতে অপসারিত হইতেছে না। তেজোময় দুরাধর্ষ গাণ্ডীব যাঁহার ধনু এবং আমি যাঁহার সহায়, সেই সব্যসাচীর সহিত তোমাদের শত্রুতা। আমি ধনঞ্জয়ের সাহায্য করিলে কালপ্রেরিত [আসন্নমৃত্যু-যাহার মরণ নিকটবর্ত্তী] বা সাক্ষাৎ পুরন্দর ব্যতীত কোন ব্যক্তি ইঁহার সহিত সংগ্রাম করিতে প্রার্থনা করে? যিনি অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে পারেন, তিনি ক্রুদ্ধ হইলে বাহুদ্বারা ভূমণ্ডলকে বহন, সমুদয় প্রজাকে দহন ও দেবগণকেও স্বর্গভ্ৰষ্ট করিতে সমর্থ হয়েন। দেব, অসুর, মনুষ্য, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব ও সৰ্পের মধ্যে এমন বীর বিদ্যমান নাই যে, সমরসময়ে সব্যসাচীর সম্মুখীন হইতে পারে, তোমরা বহুবীর বিরাটনগরে একমাত্র ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক ছিন্নভিন্ন হইলে যে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিয়াছিলে, তাহাই অর্জ্জুনের পরাক্রমের যথেষ্ট দৃষ্টান্ত। একমাত্র ধনঞ্জয়ই বল, বীর্য্য তেজ, শীঘ্রতা, লঘুহস্ততা, অবিষাদ ও ধৈৰ্য্যের একমাত্র আধার।’ মহারাজ! যেমন বর্ষাকালে সহস্ৰলোচন আকাশে গর্জ্জনপূর্ব্বক বারিবর্ষণ করেন, সেইরূপ হৃষীকেশ ধনঞ্জয়কে উত্তেজিত করিয়া এইসকল বাক্য কহিলেন। অনন্তর মহাবীর কিরীটী তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া লোমহর্ষণ বচনসকল প্রয়োগ করিতে লাগিলেন।”