জন্মেজয় বলে, মুনি কহ বিবরণ।
যত আসি জন্ম নিল কিসের কারণ।।
মুনি বলে, মাণ্ডব্য নামেতে মুনিবর।
সত্যবন্ত ধর্ম্মশীল তপেতে তৎপর।।
বহুকাল তপ করে বৃক্ষমূলে বসি।
ঊর্দ্ধবাহু মৌনব্রতী সদা উপবাসী।।
হেনমতে বহুকাল আছে মুনিবর।
দৈবে এক দিন তথা নগর ভিতর।।
চুরি করি নগরেতে চোরগণ যায়।
নগর-রক্ষকগণ পাছে পাছে ধায়।।
পলাইতে নাহি পারে যত চোগণ।
মুনির আশ্রমে প্রবেশিল সর্ব্বজন।।
নানাদ্রব্য নগরেতে যে করিল চুরি।
মুনির আশ্রমেতে রাখিল সব পূরি।।
তার পাছে এল যত রাজচরগণ।
মুনিরে দেখিয়া জিজ্ঞাসিল ততক্ষণ।।
এই পথে আগে আগে চোরগণ এল।
দেখিয়াছ মহাশয় কোন্ পথে গেল।।
কিছু না বলিল মুনি ছিল মৌনব্রতে।
হেনকালে দ্রব্য দেখে সেই আশ্রমেতে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে তথা দেখে চোরগণ।
চোরগণে ধরি তবে করিল বন্ধন।।
রাজ-চরগণ তবে করিল বিচার।
জানিল সকল কর্ম্ম এই বামনার্।।
লোকেরে বঞ্চনা করি তপের আরম্ভ।
ইহারে বন্ধন কর না কর বিলম্ব।।
চোরগণ সহিত বান্ধিয়া নিল তাঁরে।
চোর ধরিলাম বলি জানায় রাজারে।।
রাজা দিল আজ্ঞা, শূলে দেহ সর্ব্বজনে।
নগর-বাহিরে শূলে দিল ততক্ষণে।।
মাণ্ডব্যেরে শূলে ছিল চোরের সহিতে।
বহুদিন আছে মুনি বসিয়া শূলেতে।।
একদিন মুনিগণ দেখিল তাঁহারে।
দেখিয়া বিষম চিন্তা হৈল সবাকারে।।
মুনিগণ মিলি তবে সে শূল ধরিল।
অনেক যতনে উপাড়িতে না পারিল।।
জিজ্ঞাসিল মুনিগণ মাণ্ডব্যের প্রতি।
কোন্ পাপে মুনি তব এতেক দুর্গতি।।
মাণ্ডব্য বলিল, আমি বহু পাপকারী।
কোন্ পাপে হেন শাস্তি, বলিতে না পারি।।
মুনিগণ কথা কহে, শুনিল ভূপতি।
শূলেতে আছয়ে মুনি, রাজা ভীত অতি।।
মন্ত্রী সহ তথা আইলেন শীঘ্রগতি।
অশেষ-বিশেষে মুনিবরে করে স্তুতি।।
না জানিয়া কর্ম্ম হেন করিনু দুষ্কর।
অধম দেখিয়া মোরে ক্ষম মুনিবর।।
রাজা তাঁরে নানাবিধ করিল বিনয়।
দয়া করি মুনিরাজ হইল সদয়।।
তবে নরপতি সেই শূল উপাড়িল।
মুনি-অঙ্গ হৈতে শূল কাড়িতে নারিল।।
অনেক যতন কৈল না হৈল বাহির।
দেখিয়া বিস্ময়চিত্ত হৈল নৃপতির।।
বাহিরে যতেক ছিল কাটিয়া ফেলিল।
ভিতরে যে কিছু ছিল ভিতরে রহিল।।
তথাপিহ দুঃখ মন নাহিক মুনির।
নাহিক বেদনা চিত্তে প্রফুল্ল শরীর।।
মুনিগর্ভে যুক্ত শূল লোকে অসম্ভ্যাব্য।
সেই হৈতে নাম হইল অণীমাণ্ডব্য।।
একদিন মুনিবর ভাবিল অন্তরে।
কোন্ পাপে ধর্ম্ম শাস্তি দিলেন আমারে।।
ধর্ম্মস্থানে ইহা হেতু জানিতে যুয়ায়।
কোন্ পাপে হেন শাস্তি করিল আমায়।।
তবে মুনিবর গেল ধর্ম্মের সদন।
কহিল তাঁহারে সব নিজ বিবরণ।।
কহ ধর্ম্মরাজ মোরে কারণ ইহার।
কোন্ দোষে হেন গতি করিলে আমার।।
ধর্ম্মরাজ বলে, তুমি বালক-বয়সে।
বালক সহিত ছিলা বাল্যক্রীড়া-রসে।।
একদিন ক্ষুদ্র এক পতঙ্গ ধরিলা।
ঈষীকাতে তার গুহ্যে তুমি শূল দিলা।।
তাহার উচিত শাস্তি পাইলে আপনি।
যাহা করি তাহা ভুঞ্জি কহে বেদবাণী।।
এত শুনি মহাক্রোধে বলে তপোধন।
মম তপোবল আমি দেখাই এখন।।
অল্প দোষে হেন শাস্তি, এ তব বিচার।
তাহাতে বালক-বুদ্ধি, কি জ্ঞান আমার।।
বাল্যকালে অল্প দোষে অন্যায় তোমার।
এমত করিলে তবে মজিবে সংসার।।
এই হেতু নরলোকে শূদ্রযোনি মাঝ।
অবশ্য লভিবে জন্ম শুন ধর্ম্মরাজ।।
অদ্যাবধি আমি এই দণ্ডের কারণ।
করিতেছি এইরূপ নিয়ম স্থাপন।।
পাঁচ বর্ষ পর্য্যন্ত যতেক করে পাপ।
তোমার সদনে তার নাহিক সন্তাপ।।
এত বলি মুনিরাজ চলিল আশ্রম।
তাঁর শাপে শূদ্রযোনি পাইলেন যম।।
পরম পণ্ডিত, বুদ্ধি ধর্ম্মের আচার।
কুরুতে বিদুর-রূপে যম-অবতার।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম কহে সাধু পিয়ে কর্ণ ভরি।।