৫৭তম অধ্যায়
উভয়পক্ষের বহু সৈন্যবিনাশ
সঞ্জয় বলিলেন, “হে রাজন! এইরূপে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ ব্যূহিত হইলে কালান্তক যমোপম অতিরথ ধনঞ্জয় শরনিকরে কৌরবপক্ষীয় রথরক্ষকগণকে সংহার করিয়া রাথীদিগকে নিধন করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় বীরগণ তদর্শনে উৎকৃষ্ট যশোলাভাভিলাষে প্ৰাণপণে পাণ্ডবপক্ষীয়গণের সহিত সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা একাগ্রচিত্ত হইয়া অনেকবার পাণ্ডবসৈন্যগণের শ্রেণীভঙ্গ করিলেন; পাণ্ডবগণও বারংবার কৌরবসৈন্যগণকে ছিন্নভিন্ন করিতে লাগিলেন। তৎকালে কৌরব ও পাণ্ডবগণের সৈন্যসমুদয় ইতস্ততঃ ধাবমান, ভগ্ন ও পরিবর্ত্তমান [ঘূর্ণ্যমান] হওয়াতে পরস্পরের ইতারবিশেষ বোধগম্য হইল না। রণসমুত্থিত ধূলিপটলে দিনকর ও সমুদয় দিগবিদিক সমাচ্ছন্ন হইল; কেবল অনুমান ও নামগোত্রোল্লেখদ্বারাই সংগ্রাম হইতে লাগিল। কৌরবগণের মহাব্যূহ দ্রোণাচার্য্যকর্ত্তৃক রক্ষিত ও পাণ্ডবগণের মহাব্যূহ ভীম ও অর্জ্জুনকর্ত্তৃক রক্ষিত হওয়াতে কেহই ঐ উভয় ব্যূহের অন্যতর ভেদ করিতে পারিলেন না। সৈন্যগণ সেনামুখ হইতে বহির্গত হইয়া সংগ্রাম করিতে লাগিল। উভয়পক্ষীয় রথ ও হস্তীসমুদয় পরস্পর মিলিত হইল। হয়ারোহিগণ নিশিত ঋষ্টি, প্রাস, নারাচ, শর ও তোমরদ্বারা বিপক্ষপক্ষীয় গজারোহীদিগকে, রথীরা কনকভূষণবাণদ্বারা রথীদিগকে, পদাতিগণ ভিন্দিপাল ও পরশুদ্বারা পদাতিগণকে এবং রথী গজের সহিত গজারোহীকে, গজারোহী ও অশ্বারোহী রথীকে, রথী রথীকে, পদাতি রথীকে, রথী পদাতিকে, গজারোহী অশ্বারোহীকে, অশ্বারোহী গজারোহীকে, গজারোহীরা পদাতিদিগকে, পদাতিগণ গজারোহীগণকে প্রাস, তোমার, শরপ্রভৃতি বিবিধ শাণিত অস্ত্রশস্ত্রদ্বারা নিপতিত করিতে লাগিল। রাশি রাশি ধ্বজ, কার্ম্মুক, তোমর, চিত্রকম্বল, মহার্ঘ কম্বল, প্রাস, গদা, পরিঘ, কম্পন, শক্তি, কবচ, কণপ [মুদগর], অঙ্কুশ, নির্ম্মল খড়্গ ও সুবৰ্ণপুঙ্খ বাণসমুদয় ইতস্ততঃ নিপতিত হওয়াতে রণক্ষেত্ৰ যেন মাল্যদামভূষিতের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। নর, অশ্ব ও হস্তিগণের কলেবর, মাংস ও রুধিরধারায় সমরভূমি অগম্য ও কৰ্দমিত হইয়া উঠিল। যুদ্ধক্ষেত্র নরশোণিতে সমুক্ষিত [সিক্ত] হওয়াতে রজোরাশি প্রশমিত ও চতুর্দ্দিক নির্ম্মল হইল। জগদ্বিনাশের চিহ্নস্বরূপ অসংখ্য কবন্ধ চতুর্দ্দিকে সমুত্থিত হইতে লাগিল এবং রথিগণ ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে প্রবৃত্ত হইল।
“তখন ভীষ্ম, দ্রোণ, জয়দ্ৰথ, পুরুমিত্র, বিকর্ণ ও শকুনিপ্রভৃতি সিংহতুল্য পরাক্রমশালী, সমরদুৰ্দ্ধৰ্ষ, মহাবীরগণ সমরে পাণ্ডবগণের সৈন্যগণকে ভগ্ন করিতে লাগিলেন। দেবগণ যেমন দানবগণকে বিদ্রাবিত করিয়াছিলেন, সেইরূপ ভীমসেন, ঘটোৎকচ, সাত্যকি, চেকিতান ও দ্রৌপদীতনয়গণ অন্যান্য ভূপতিগণে সমবেত হইয়া আপনার তনয়গণকেও তাড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে সেইসমুদয় নৃপতিগণ পরস্পরের আঘাতে রক্তোক্ষিত [রক্তাক্ত] হইয়া কুসুমিত কিংশুকতরুর ন্যায় বিরাজিত হইতে লাগিলেন। শত্রুবিজয়ী উভয়পক্ষীয় বৃহৎ বৃহৎ হস্তিসকল নভোমণ্ডলস্থিত গৃহসমুদয়ের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। হে মহারাজ! ঐ সময় দুৰ্য্যোধন সহস্র রথ লইয়া পাণ্ডবগণ ও রাক্ষস ঘটোৎকচের সহিত সংগ্রাম করিতে আগমন করিলেন। পাণ্ডবগণও মহতী সেনাসমভিব্যাহারে অরাতিনিপাতন ভীষ্ম ও দ্রোণের সম্মুখীন হইলেন; মহাবীর অর্জ্জুন ক্রোধান্বিতচিত্তে পার্থিব সমুদয়কে এবং অভিমন্যু ও সাত্যকি সুবলনন্দন শকুনির সৈন্যগণকে আক্রমণ করিলেন। হে রাজন! পরে আপনার ও পাণ্ডবগণের পক্ষীয় সৈন্যগণ পরস্পর জিগীষু হইয়া ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিল।”