৫৭ম অধ্যায়
উদ্যমাদির উৎকর্ষ-কীৰ্ত্তন
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! সৰ্ব্বদা উদ্যোগী হওয়া নরপতিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। উদযোগবিহীন রাজা কদাচ প্রশংসার পাত্র হইতে পারেন না। ভগবান্ শুক্রাচার্য্য কহিয়া গিয়াছেন যে, সর্পগৰ্ভস্থ মূষিকদিগের ন্যায় পৃথিবী অবিরোধী রাজা ও অপ্রবাসী ব্রাহ্মণকে গ্রাস করে। শুক্রাচার্য্যের এই কথা তোমার সর্ব্বক্ষণ স্মরণ করা কর্ত্তব্য। তুমি সন্ধি করিবার উপযুক্ত ব্যক্তিগণের সহিত সন্ধি ও বিরোধার্হদিগের [বিবাদের যোগ্য ব্যক্তিগণের] সহিত বিরোধ করিবে। যিনি স্বামী, অমাত্য, সুহৃৎ, কোষ, রাষ্ট্র, দুর্গ ও বল রাজ্যসম্পকীয় এই সাত অঙ্গের প্রতি অত্যাচার করেন, তিনি গুরুই হউন বা মিত্রই হউন, তাঁহাকে বিনাশ করা রাজার অবশ্য কৰ্ত্তব্য। পূৰ্ব্বে মরুরাজ বৃহস্পতির অনুমোদিত এই কথা কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন যে, গুরুও যদি কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য, গর্ব্বিত ও কুমার্গগামী[কুপথগামী] হন, তাঁহার দণ্ডবিধান অবিধেয় নহে। বাহুপুত্র মহারাজ সগর পুরবাসীদিগের হিতকামনায় জ্যেষ্ঠপুত্ৰ অসমঞ্জকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। অসমঞ্জ পুরবাসী শিশুগণকে আক্রমণ ও সরযূজলে নিমগ্ন করিয়া দিতেন, এই নিমিত্ত তাঁহার পিতা তাঁহাকে তিরস্কারপূর্ব্বক রাজ্য হইতে নির্বাসিত করিয়া দেন। মহর্ষি উদ্দালকও মহাতপাঃ প্রিয়পুত্র শ্বেতকেতুকে বিপ্রগণের সহিত মিথ্যা ব্যবহার করিতে দেখিয়া পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। লোকরঞ্জন, সত্যপ্রতিপালন ও সরল ব্যবহার করাই নরপতিদিগের সনাতন ধর্ম্ম। পরধন হরণ না করা ও যথাসময়ে দেয় বস্তু প্রদান করা ভূপালগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। পরাক্রমশালী, সত্যবাদী, ক্ষমাবান্ রাজা কদাপি সৎপথ হইতে বিচলিত হয়েন না। জিতেন্দ্রিয়, শাস্ত্রার্থে কৃতনিশ্চয়, চতুৰ্ব্বর্গে অনুরক্ত ও বেদমন্ত্রজ্ঞ হওয়া রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। প্রজারক্ষার্থে পরাত্মখ হওয়া অপেক্ষা ভূপতিদিগের গুরুতর পাপ আর কিছুই নাই। চারিবর্ণের ধর্ম্ম ও ধৰ্ম্মসম্মান রক্ষা করা রাজার নিতান্ত উচিত। অন্যের কথা দুরে থাকুক, আত্মীয়গণকেও বিশ্বাস করা নরপতিদিগের কর্ত্তব্য নহে। উঁহারা বুদ্ধিদ্বারা সতত নীতির গুণ দোষ নির্ণয় করিবেন। যে রাজা ত্রিবর্গতত্ত্বজ্ঞ হইয়া শত্রুরাজ্যের ছিদ্রান্বেষণ ও উৎকোচাদি-দ্বারা বিপক্ষপক্ষদিগকে স্ববশে আনয়ন করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ প্রশংসার পাত্র। যম ও বৈশ্রবণের ন্যায় কোষপূরণ, স্থিতি, বৃদ্ধি ও ক্ষয়সঞ্জাত গুণ-দোষের নির্ণয়, অনাথদিগের প্রতিপালন, প্রসন্নবদনে হাস্যমুখে বাক্যপ্রয়োগ, বৃদ্ধগণের শুশ্রূষা, আলস্য ও লোভপরাজয়, দুশ্চরিত্রদিগের দণ্ডবিধান, সৎপাত্রে ধনদান, ইন্দ্রিয়-পরাজয় এবং উপভোগ্য দ্রব্য উপভোগ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। সাধুদিগের নিকট হইতে অর্থগ্রহণ করা সচ্চরিত্র ভূপতিদিগের সমুচিত নহে। তাঁহারা অসৎলোকদিগের নিকট হইতে ধনগ্রহণ করিয়া সাধুদিগকে বিতরণ করিবেন। যাঁহারা সৎকুলসম্ভূত, দুর্দ্ধর্ষ, বীর, ভক্ত, অরোগী, শিষ্ট, শিষ্টসহবাসী, মানী, বিদ্যাবিশারদ [বিদ্যাপারগ], লোকতত্ত্বজ্ঞ, ধৰ্ম্মজ্ঞ, সাধু ও অচলের ন্যায় স্থিরবুদ্ধি এবং যাঁহারা পরকালের ভয় করেন ও কদাচ অন্যের অপমান করেন না, বুদ্ধিমান ভূপতি, তাঁহাদিগকেই সহায় করিয়া কেবল ছত্র[রাজচ্ছত্র] ও আজ্ঞা[বিচার-নিষ্পত্তির হুকুম] ব্যতীত আর সকল বস্তুতেই আপনার ন্যায় তাঁহাদিগের অধিকার রাখিবেন। ঐরূপ ব্যক্তিদিগের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে সমান ব্যবহার করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহা হইলে তাঁহাকে কদাচ দুঃখভোগ করিতে হয় না। যে রাজা অতিশয় সন্দিগ্ধ, লোকের সর্বাস্বপহারী, লুব্ধপ্রকৃতি ও কুটিলস্বভাব, তাঁহার স্বজনবর্গই তা*হাকে অচিরাৎ বিনাশ করে; আর যে রাজা বিশুদ্ধসত্ত্ব, পরচিত্তগ্রহণে [পরের মনোভাব বুঝিতে] সুপটু, তিনি বিপক্ষকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়াও কদাচ অবনতি প্রাপ্ত হয়েন না এবং একবার হীনদশাগ্রস্ত হইলেও পুনরায় উন্নতিলাভ করিয়া থাকেন। যে রাজা শান্তস্বভাব, ব্যসনশূন্য ও জিতেন্দ্রিয় এবং যিনি দণ্ডাৰ্হ ব্যক্তিকে অল্প দণ্ড প্রদান করেন, তিনি হিমাচলের ন্যায় সকলের বিশ্বাসভাজন হয়েন। যে রাজা প্রাজ্ঞ, বদান্য, পরচ্ছিদ্রান্বেষণ তৎপর, প্রিয়দর্শন, নীতিজ্ঞ, কার্য্যদক্ষ, ক্রোধহীন, সতত সুপ্রসন্ন, ক্রিয়াবান্ ও নিরহঙ্কার, যিনি কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়া তাহা সম্যকরূপে নির্ব্বাহ করেন এবং যাঁহার রাজ্যে নীতিজ্ঞ প্রজারা আপনাদের ঐশ্বৰ্য্য গোপনে না রাখিয়া পিতার গৃহে পুত্রের ন্যায় নির্ভয়ে সঞ্চরণ করে, সেই রাজাই সৰ্ব্বপ্রধান বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন। যে রাজার রাজ্যে প্রজাগণ স্ব স্ব কার্য্যে নিরত থাকে, আপনার শরীর অপেক্ষা শরীরসাধ্য ধৰ্ম্মে আদর প্রদর্শন করে, ভূপতির প্রযত্নে সুখপ্রণালীক্রমে প্রতিপালিত হইয়া তাঁহারই একান্ত বশীভূত হয়, পরপরাভবের প্রতি কিছুমাত্র চেষ্টা করে না এবং দানবিষয়ে সতত প্রবৃত্ত থাকে, তিনিই যথার্থ রাজা। যাঁহার অধিকারে কপট মায়া ও মাৎসর্য্যের প্রাদুর্ভাব নাই, সেই রাজাই সনাতন ধর্ম্মলাভ করিয়া থাকেন। যে রাজা পণ্ডিতগণের আদর করেন, যিনি অজ্ঞাত বস্তু জ্ঞাত হইতে সমুৎসুক হয়েন, যিনি পৌরজনের হিতানুষ্ঠাননিরত, সৎপথগামী ও ত্যাগশীল হইতে পারেন এবং যাঁহার চর, মন্ত্রণা ও অনুষ্ঠিত বা অননুষ্ঠিত কাৰ্য্যসমুদয় বিপক্ষগণের নিকট প্রচ্ছন্নভাবে থাকে, সেই রাজাই রাজ্যলাভের উপযুক্ত। রামচরিতমধ্যে মহাত্মা ভার্গব রাজাকে লক্ষ্য করিয়া এইরূপ কহিয়াছেন যে, প্রথমে রাজার আশ্রয়গ্রহণ করিয়া তৎপরে দারপরিগ্রহ ও ধনসঞ্চয় করিবে; কারণ, রাজা না থাকিলে ভাৰ্য্যা ও ধন রক্ষা করা নিতান্ত সুকঠিন। যাঁহারা রাজ্যলাভের অভিলাষ করেন, লোকরক্ষা ব্যতিরেকে তাঁহাদিগের উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম আর কিছুই নাই। ভূপালকৃত রক্ষাই লোকসকলকে সুশৃঙ্খল করিয়া রাখে। মহর্ষি প্রাচেতস মনু রাজধৰ্ম্মকীৰ্ত্তনকালে কহিয়া গিয়াছেন, মৌনাবলম্বী আচার্য্য, অধ্যয়নপরাঙ্মুখ ঋত্বিক, অরক্ষক রাজা, অপ্রিয়বাদিনী ভাৰ্য্যা, গ্রামপর্য্যটনোৎসুক[গ্রামভ্রমণে উৎসাহী] গোপাল ও বনগমনাভিলাষী নাপিতকে অর্ণব[সমুদ্র]মধ্যে ভগ্ন নৌকার ন্যায় অবিলম্বে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়স্কর।”