ইন্দ্রজিৎ লক্ষ্মণ দুজনে দরশন।
সন্ধান পূরিয়া বাণ মারেন লক্ষ্মণ।।
লক্ষ্মণ বলেন বেটা শুন ইন্দ্রজিৎ।
আজি তোরে দেখাইব শমন নিশ্চিত।।
লক্ষ্মণের বাক্য ইন্দ্রজিৎ নাহি শুনে।
লক্ষ্মণে এড়িয়া তখন বলে বিভীষণে।।
এক বীর্য্যে জন্ম খুড়া রাক্ষসের কুলে।
ধার্ম্মিক বলিয়া তোমা সর্ব্বলোকে বলে।।
পিতার সমান তুমি পিতৃ-সহোদর।
পিতার সমান সেবা করেছি বিস্তর।।
বন্ধুগণ ছাড়ি খুড়া আশ্রয় মানুষে।
বাতি দিতে না রাখিলে রাক্ষসের বংশে।।
এত সব মারিয়াছ ক্ষান্ত নাই মনে।
দিয়াছ সন্ধান বলে আমার মরণে।।
খাইলি রাক্ষসকুল হইয়া নিষ্ঠুর।
তোমারে দেখিলে পাপ বাড়য়ে প্রচুর।।
নির্গুণ সগুণ হয়, তবু বলে জ্ঞাতি।
জ্ঞাতি-বন্ধু মিলে লোক করয়ে বসতি।।
পর-কোলে দেখি খুড়া পরমাসুন্দরী।
আপনার ভাগ্যে নাই, কর ধড়ফরি।।
এত ভ্রাতৃষ্পুত্র মারি ক্ষমা নাহি তাতে।
কোন্ লাজে আসিয়াছ আমারে মারিতে।।
বানর কটক খুড়া করহ অন্তর।
যজ্ঞপূর্ণ করি আমি মেগে লই বর।।
এত বলি ইন্দ্রজিৎ করিছে আঁটুনি।
আজি তোমায় কেটে খুড়া ঘুচাইব শনি।।
বিভীষণ বলে বেটা বলিস্ বিপরীত।
ভালমতে জানে সবে আমার সে রীত।।
রাক্ষস-কুলেতে জন্ম নাহি কদাচার।
পরদ্রব্য না লই না করি পরদার।।
চৌদ্দ হাজার দেবকন্যা তোর বাপের ঘরে।
এত স্ত্রী থাকিতে তবু পরদার করে।।
হরে আনে পরনারী তপে তপস্বিনী।
শাপ গালি পাড়ে তবু না ছাড়ে কামিনী।।
কত শত মুনি ঋষি মেরে কৈল পাপ।
অন্ত নাহি যত পাপ, করে তোর বাপ।।
ত্রিভুবন সনে তোর বাপের বিবাদ।
কতকাল সবে পাপ পড়িল প্রমাদ।।
সর্ব্বদা না ফলে বৃক্ষ সময়েতে ফলে।
তোর বাপের ফল যে ফলিল এতকালে।।
নিকট মরণ তোর ওরে ইন্দ্রজিৎ।
সবান্ধবে লঙ্কা ছেড়ে যাহ এক ভিত।।
অগ্নির বরেতে বেটা জিনিস বারে বার।
অগ্নির নিকটে বর পাবে নাক আর।।
যজ্ঞপূর্ণ দিতে চাহ মরণের বেলা।
এখনি লক্ষ্মণ তোর কাটিবেন গলা।।
এত যদি দুইজনে হৈল গালাগালি।
হাতে ধনু আইল লক্ষ্মণ মহাবলী।।
লক্ষ্মণ বলেন বেটা দুষ্ট নিশাচর।
দেখ দেখি এখনি পাঠাব যমঘর।।
মারিতে এলাম তোরে লঙ্কার ভিতরে।
সর্ব্বদুঃখ ঘুচাব কাটিয়া আজি তোরে।।
পিতৃ-আগে কৈওগিয়া সংগ্রামের কথা।
আজিকার রণে যদি থাকে তোর মাথা।।
এত যদি লক্ষ্মণ তর্জ্জন করে বলে।
কুপিল যে মেঘনাদ অগ্নি হেন জ্বলে।।
অষ্টবীর বানর উঠিল তার রথে।
দুর্জ্জয় বানর সব লাগিল গর্জ্জিতে।।
সারথি সহিত রথ উলটিয়া ফেলে।
লাফ দিয়া ইন্দ্রজিৎ পড়ে ভূমিতলে।।
বিরথা হইল যদি রাবণ-নন্দন।
হরিষ হইয়া বাণ যোড়েন লক্ষ্মণ।।
দুজনার উপরে দুজনে বিন্ধে বাণ।
কেহ কারে নাহি পারে দুজনে সমান।।
ভয় পেয়ে ইন্দ্রজিৎ ভাবে মনে মন।
আপন কটকে বীর ডাকিল তখন।।
ইন্দ্রজিৎ বলে শুন যত নিশাচর।
রথসজ্জা করি আমি আসিব সত্বর।।
আজি নর-বানরে পাঠাব যমালয়।
ক্ষণেক থাকহ সবে না করিহ ভয়।।
এত বলি গোপনেতে করিল গমন।
অন্যেতে কি জানিবে, না জানে বিভীষণ।।
মায়াতে সে রথখান করিল নির্ম্মাণ।
বায়ুবেগে অষ্ট ঘোড়া রথের যোগান।।
গায়েতে বিচিত্র শানা, মাথায় টোপর।
হাতে ধনু প্রবেশিল রণের ভিতর।।
লক্ষ্মণ বলেন বেটা মায়ার নিদান।
দেখেছিলাম এক মূর্ত্তি এবে দেখি আন।।
মেঘনাদ-মায়া দেখি চিন্তিত লক্ষ্মণ।
হেনকালে লক্ষ্মণেরে কন বিভীষণ।।
বিভীষণ বলে তুমি না হও চিন্তিত।
এখনি মরিবে বেটা দুষ্ট ইন্দ্রজিৎ।।
মেঘনাদ যদি লুকায় মেঘের আড়েতে।
সহস্র চক্ষেতে ইন্দ্র না পায় দেখিতে।।
ইন্দ্রে বেঁধে এনেছিল লঙ্কার ভিতরে।
ব্রহ্মা আসি মাগিয়া লইল পুরন্দরে।।
মায়ারূপে গিয়াছিল লঙ্কার ভিতর।
মায়াতে সাজায়ে রথ আনিল সত্বর।।
রণেতে প্রবেশ আগে করুক ইন্দ্রজিৎ।
মারিব উহারে বন্দী করি চারিভিত।।
উপরেতে উঠে যদি পাইয়া তরাস।
হনুমান গিয়া রক্ষা করিবে আকাশ।।
অগ্নির কুমার নীল নানা মায়া ধরে।
সূক্ষ্মরূপে যাইয়া পাতাল রক্ষা করে।।
লঙ্কার যতেক সন্ধি বিভীষণ জানে।
যুড়িয়া লঙ্কার পথ রহে বিভীষণে।।
গগনে পর্ব্বত হাতে রহে হনুমান।
সম্মুখে লক্ষ্মণ বীর পূরিল সন্ধান।।
বিভীষণের যুক্তি না বুঝিল ইন্দ্রজিৎ।
মেঘনাদে বেড়ি বানর মারে চারিভিত।।
সম্মুখেতে বাণ-বৃষ্টি করেন লক্ষ্মণ।
লক্ষ্মণের বাণ গিয়া ছাইল গগন।।
অস্ত্র দেখি ইন্দ্রজিৎ পলায় তরাসে।
রথের সহিত যায় উঠিতে আকাশে।।
সারথি দেখিতে পায় বীর হনুমানে।
পবনবেগেতে রথ চালায় দক্ষিণে।।
লাভ দিয়া হনুমান পড়ে তার রথে।
চূর্ণ কৈল রথখান এক পদাঘাতে।।
ভাঙ্গিয়া রথের ধ্বজা ফেলে চারিভিতে।
অন্তরীক্ষে পলাইতে চাহে ইন্দ্রজিতে।।
শূন্যে যায় ইন্দ্রজিৎ দেখে হনুমান।
দুই পায়ে ধরি তারে দিল এক টান।।
অন্তরীক্ষে দুইজনে লাগে হুড়াহুড়ি।
ভূমিতলে পড়ে দোঁহে করে জড়াজড়ি।।
হেঁটে ইন্দ্রজিৎ পড়ে, হনু তারোপরে।
বুকে হাঁটু দিয়া তার গলা চেপে ধরে।।
শীঘ্র এস কপিগণ ডাকে হনুমান।
সবে মেলি ইন্দ্রজিতের বধহ পরাণ।।
হনুমান-বাক্যে কপি যায় তাড়াতাড়ি।
সকল বানর মিলে আসে রড়ারড়ি।।
কুপিল যে ইন্দ্রজিৎ বলে মহাবলী।
বানরগণেরে দেখি করে ঠেলাঠেলি।।
বানর উপরে বাণ করে বরিষণ।
কপিগণ পলায় সহিতে নারে রণ।।
ইন্দ্রজিৎ পলায়ে লঙ্কাতে যেতে চাহে।
চাপিয়া লঙ্কার দ্বার বিভীষণ রহে।।
বিভীষণ বলে বাছা আজি যাবি কোথা।
এখনি লক্ষ্মণ তোর কাটিবেন মাথা।।
শীঘ্র এস লক্ষ্মণ ডাকেন বিভীষণ।
ত্বরা করি দুষ্ট বেটার বধহ জীবন।।
বিভীষণ-বচনে লক্ষ্মণ আগুয়ান।
ইন্দ্রজিৎ-কাছে গেল পূরিয়া সন্ধান।।
দুজনে দেখিয়া বাণ যোড়ে দুই জনে।
দুজনে পড়িল ঢাকা দুজনার বাণে।।
চারিদিকে পড়ে বাণ নাহি লেখাজোখা।
দুইজনে বাণ মারে যার যত শিক্ষা।।
অমর্ত্ত সমর্ত্ত বাণ বাণ পদ্মাসন।
বিষ্ণুজাল ইন্দ্রজাল কাল হুতাশন।।
উল্কাবাণ বরুণবাণ বিদ্যুৎ খরশাণ।
গজেন্দ্র নক্ষত্র-যোগ জ্যোতির্ম্ময় বাণ।।
সূচীমুখ শিলীমুখ ঘোর দরশন।
সিংহদন্ত বজ্রদন্ত বাণ বিরোচন।।
দণ্ড ঐষিকাদি বাণ বাণ কর্ণিকার।
চন্দ্রমুখ সূর্য্যমুখ বাণ সপ্তসার।।
নীল হরিতাল বাণ বিকট শঙ্কর।
অর্দ্ধচন্দ্র ক্ষুরপার্শ্ব বাণ মনোহর।।
এত বাণ দুই বীরে করে অবতার।
দশদিক লঙ্কাপুরী বাণে অন্ধকার।।
দুজনে বরিষে বাণ দুজনে প্রবীণ।
বাণের কুহকে নাহি জানি রাত্রি দিন।।
লক্ষ্মণ অশক্ত হৈল প্রহারের ঘায়।
ব্রহ্মা বলে পুরন্দর করহ উপায়।।
ব্রহ্ম-অস্ত্র পুরন্দর করিলেন দান।
লক্ষ্মণ সে ব্রহ্ম-অস্ত্র পূরিল সন্ধান।।
বাণেরে বুঝায়ে কন ঠাকুর লক্ষ্মণ।
ব্রহ্মা ভাবি ব্রহ্মা তোমায় করিলা সৃজন।।
যদি রঘুনাথ হন বিষ্ণু-অবতার।
তবে তুমি ইন্দ্রজিতে করিবে সংহার।।
ইন্দ্রজিৎ-মাথা কাটি পাড় ভূমিতলে।
নির্ভয়েতে নিদ্রা যাক দেবতা সকলে।।
এত বলি ব্রহ্ম-অস্ত্রে পূরিলা সন্ধান।
অস্ত্র দেখি ইন্দ্রজতের উড়িল পরাণ।।
জাঠি শূল কত এড়ে অস্ত্র কাটিবারে।
লোহার পাবড়া মারে অস্ত্র নাহি ফিরে।।
অব্যর্থ ব্রহ্মার বাণ কেবা ধরে টান।
ইন্দ্রজিতের মাথা কাটি করে দুই খান।।
পড়িল যে ইন্দ্রজিৎ সংগ্রাম ভিতরে।
ধাইয়া বানরগণ রাক্ষসের মারে।।
পলায় রাক্ষসগণ গণিয়া প্রমাদ।
রামজয় বলি কপি ছাড়ে সিংহনাদ।।
পড়িল মস্তকসহ মুকুট কুণ্ডল।
ইন্দ্রজিতের মুণ্ড গড়াগড়ি ভূমিতল।।
ইন্দ্রজিতের কাটামুণ্ড উপরেতে চড়ি।
কোন কপি লাথি মারে কেহ মারে বাড়ি।।
কীল লাথি মারিয়া মস্তক করে গুঁড়া।
জীয়ন্তে না পারে কপি, মড়ার উপর খাঁড়া।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিত কবিত্বে বিচক্ষণ।
ইন্দ্রজিৎ-বধ গীত গান রামায়ণ।।