৫৬তম অধ্যায়
দময়ন্তীকে নলের পূর্ব্বপ্রতিশ্রুত দেববরণের অনুরোধ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! দময়ন্তী মনে মনে দেবগণকে নমস্কার করিয়া সহাস্যবদনে নলরাজকে কহিলেন, ‘মহারাজ! আমি আপনার একান্ত অধীন ও আমার যে সমস্ত ধনসম্পত্তি আছে, তাহা সকলই আপনার বোধ করিবেন। এক্ষণে আপনি আমাকে অনুগ্রহপূর্ব্বক যাহা আদেশ করিবেন, বিশ্বস্ত-মনে তাহা তৎক্ষণাৎ সম্পাদনা করিব। আমি হংসমুখে আপনার অনন্যসাধারণ গুণানুবাদ শ্রবণ করিয়া একান্ত সন্তপ্ত হইয়া কালব্যাপন করিতেছি। হে লোকনাথ! কেবল আপনার নিমিত্তই এই স্বয়ংবরের আয়োজন করিয়াছি, এক্ষণে আপনি যদি একান্ত প্ৰণয়পরাধীন এই অবলোকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে আপনার নিমিত্তই বিষ-ভক্ষণ, অগ্নি বা জলপ্ৰবেশ অথবা উদ্বন্ধনে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব সন্দেহ নাই।” নলরাজ দময়ন্তীর এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘সুন্দরি! লোকপালগণ বরণাভিলাষী হইয়া বিদ্যমান থাকিতেও তুমি কি কারণে মনুষ্যকে অভিলাষ করিতেছ? আমি সৃষ্টিস্থিতিকারক লোকপালগণের পদধূলিরও তুল্য হইতে পারি না; অতএব তুমি তাহাদিগকেই ভজনা কর। দেবগণের বিপ্ৰিয়াচরণ করিলে মনুষ্য মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়া থাকে; অতএব তুমি তাহাদিগকে পতিত্বে বরণ করিয়া আমার প্রাণরক্ষা করা। তুমি দেবগণকে বরণ করিলে উত্তম পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ, বিচিত্ৰ দিব্যমালা ও বহুবিধ উৎকৃষ্ট অলঙ্কার ধারণ করিতে পরিবে। দেখ, যিনি এই পৃথিবীকে একেবারে কবলিত করিতে সমর্থ হয়েন, কোন রমণী সেই হুতাশনকে প্রার্থনা না করে? যাহার দণ্ডভয়ে ভীত হইয়া প্রাণীগণ ধর্ম্মারাধনা করিয়া থাকে, কোন রমণী সেই দণ্ডধারকে অভিলাষ না করে? যিনি দৈত্যদানবগণের হন্তা, সুরসমূহের পাতা ও ধর্ম্মের রক্ষিতা হইয়া স্বৰ্গরাজ্য ভোগ করিতেছেন, কোন কামিনী সেই মহেন্দ্ৰকে বাসনা না করে? এক্ষণে আমি তোমাকে অনুরোধ করিতেছি, যদি ইচ্ছা হয়, তাহা হইলে আশঙ্কিত-মনে লোকপালগণের মধ্যে বরুণকে বরণ কর।”
দময়ন্তীর সানুনয় দেববরণ প্রত্যাখ্যান
“তদনন্তর দময়ন্তী শোকজনিত-বাষ্পবারিপারিপুত লোচনে দীনবচনে কহিলেন, “মহারাজ! দেবগণকে নমস্কার; সত্য বলিতেছি, আমি আপনাকেই পতিত্বে বরণ করিব’, ইহা বলিয়া কম্পিত্যকলেবরে কৃতাঞ্জলি হইয়া রহিলেন। তখন নলরাজ কহিলেন, “হে সুলোচনে! আমি দেবগণের দৌত্যকাৰ্য্য স্বীকার করিয়া তোমার নিকট আসিয়াছি; সুতরাং তাহাদিগের নিকট অঙ্গীকার ও তাঁহাদিগের নিমিত্ত যত্ন করিয়া এক্ষণে কিরূপে স্বাৰ্থসম্পাদনে প্রবৃত্ত হইব? যদি আমার দৌত্যধর্ম্ম রক্ষা করিয়া স্বার্থ-সাধনের কোনপ্রকার প্রতিবিধান করিতে সমর্থ হও, তাহা হইলে আমি তোমার পাণিগ্রহণে সম্মত হইতে পারি।” তখন দময়ন্তী বাষ্পাকুল-লোচনে গদগদ বচনে কহিলেন, “মহারাজ! এক্ষণে আমি এক নিরপায় [বিঘ্নরহিত] উপায় অবধারণ করিয়াছি, উহা দ্বারা আপনি নির্দোষ হইতে পরিবেন। আপনি ও পুরন্দর প্রভৃতি দেবগণ একত্র সমবেত হইয়া মদীয় স্বয়ংবর-সভায় আগমন করিবেন। অনন্তর আমি লোকপালগণ-সমক্ষে আপনারই গলদেশে বরমাল্য প্রদান করিব, ইহা হইলে আর দোষাদ্ভাবনের সম্ভাবনা থাকিবে না।”
দেবগণসমীপে নলের দময়ন্তী-অভিপ্রায় প্রকাশ
“নলরাজ বৈদর্ভীকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক পুনরায় সুরগণসন্নিধানে আগমন করিলেন। দেবগণ তাঁহাকে আগত দেখিয়া দময়ন্তীসংক্রান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “হে নল! তুমি কি দময়ন্তীকে দর্শন করিয়াছ? সে আমাদিগের বাক্যে যেরূপ প্ৰত্যুত্তর প্রদান করিয়াছে, তাহা আদ্যোপান্ত সমুদয় বর্ণন কর।” নলরাজ কহিলেন, “হে লোকপালগণ! আমি আপনাদিগের নির্দেশানুসারে স্থবিরদণ্ডধারি [বৃদ্ধদ্বারপাল]-পরিবৃত সুবিস্তীর্ণ কক্ষাসঙ্গত কুমারীপুরে প্রবেশ করিলাম। প্রবেশকালে আপনাদিগের প্রভাব বলে আমাকে দময়ন্তী ব্যতিরেকে আর কেহই নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় নাই। পরে আমি পুরমধ্যে দময়ন্তীর সখীগণকে অবলোকন করিলাম; তাহারাও তৎক্ষণাৎ আমাকে নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় বিস্ময়স্তিমিতলোচনে অবাক হইয়া রহিল। অনন্তর আমি দময়ন্তীসন্নিধানে আপনাদিগকে উল্লেখ করিয়া বিস্তর প্রশংসা করিলাম। দময়ন্তী আপনাদিগের গুণানুবাদ শ্রবণ করিয়াও আমাকে বরণ করিবে, এইরূপ কৃতসঙ্কল্প হইয়া কহিয়াছে যে, “আপনি দেবগণসমভিব্যাহারে আমার স্বয়ংবরসভায় আগমন করিবেন। আমি তাহাদিগের সমক্ষে আপনারই গলদেশে বরমাল্য প্ৰদান করিব। তাহা হইলে আপনাকে দোষভাগী হইতে হইবে না।” হে লোকপালগণ! আমাকে দময়ন্তী যে-সকল কথা কহিয়াছে, আমি তাহা অবিকল কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে আপনাদিগের যেরূপ অভিরুচি হয়, করুন।’ ”