৫৫তম অধ্যায়
স্বয়ংবরসভাগত লোকপালগণের দৌত্যে নলের প্রতিশ্রুতি
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! নালরাজ “যে আজ্ঞা” বলিয়া তাহাদিগের বাক্য অঙ্গীকারপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কে? আর আমি যাহার দৌত্যকর্ম্ম স্বীকার করিলাম, ঐ মহাত্মাই বা কে এবং আপনাদিগের কোন কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে হইবে, তাহাও অনুগ্রহপূর্ব্বক আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বর্ণন করুন।’ নলকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ইন্দ্ৰ কহিলেন, “আমরা দেবতা; দময়ন্তীর নিমিত্ত মর্ত্যলোকে আগমন করিয়াছি। আমি ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্র; ইনি অগ্নি; উনি জলেশ্বর বরুণ; আর ইনি মনুষ্যের জীবনান্তকারী অন্তক। এক্ষণে তুমি দময়ন্তীর নিকট উপস্থিত হইয়া এই কথা নিবেদন করিবে যে, মহেন্দ্র প্রভৃতি লোকপালগণ ত্বদীয় করগ্ৰহণাভিলাষে সভায় আগমন করিতেছেন; তুমি তাহাদিগের অন্যতমকে পতিত্বে বরণ কর।” নিষধরাজ ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ আদিষ্ট হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, “হে লোকপালগণ! আপনাদিগের যেরূপ উদ্দেশ্য, আমিও সেই উদ্দেশ্য-সংসাধনাৰ্থ উপনীত হইয়াছি, এক্ষণে আমাকে সেই কর্ম্মসম্পাদনার্থ দূতরূপে নিয়োগ করা আপনাদিগের নিতান্ত অবিধেয়; আর যে পুরুষ স্বয়ং স্ত্রীরত্নলাভে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে, সে কদাচ অন্যের নিমিত্ত চেষ্টা করিতে পারে নাঁ। অতএব আপনারা এক্ষণে আমাকে ক্ষমা করুন।” দেবতারা কহিলেন, “হে নৈষধ! তুমি পূর্ব্বে অঙ্গীকার করিয়া এক্ষণে আবার কি নিমিত্ত অস্বীকার করিতেছ? তুমি অনতিবিলম্বে প্রস্থান কর।” নলরাজ কহিলেন, “হে লোকপালগণ! শত শত রক্ষকেরা ধৃতাস্ত্র হইয়া নিরন্তর দময়ন্তীর গৃহরক্ষা করিতেছে, আমি কিরূপে তথায় প্ৰবেশ করিব?” দেবরাজ কহিলেন, “হে নৈষধ! তুমি আমার প্রভাবে অনায়াসে তথায় প্রবেশ করিতে পরিবে, কোন শঙ্কা বা ভয় নাই।”
দেবানুজ্ঞায় নলের দময়ন্তী-সাক্ষাৎকার
“অনন্তর নিষাধাধিপতি নল “যে আজ্ঞা” বলিয়া দময়ন্তীনিকেতনে গমন করিলেন। তথায় উপনীত হইয়া দেখিলেন, দময়ন্তী সখীগণপরিবৃত হইয়া স্বীয় অঙ্গসৌন্দৰ্য্যদ্বারা দেদীপ্যমান হইতেছেন; বোধ হইল যেন, তিনি স্বকীয় তেজঃপ্রভাবে শশধরের বিমল প্রভাকে মলিন করিতেছেন। নলরাজ সেই সুকুমারী রাজকুমারীকে নয়নগোচর করিয়াই অনঙ্গশর জর্জ্জরীভূত হইলেন; কিন্তু সত্য-প্রতিপালনের নিমিত্ত তাহা তৎক্ষণাৎ সংবরণ করিলেন। অঙ্গনারা তাহাকে অবলোকন করিয়া সম্ভ্রান্ত ও তদীয় তেজঃপ্রভাবে অভিভূত হইয়া আস্তে-ব্যস্তে আসন হইতে উত্থিত হইল এবং বিস্ময়াবেশ প্রকাশ্যপূর্ব্বক প্রসন্নমনে পরস্পর তাহার বহুবিধ প্ৰশংসা করিতে লাগিল; কিন্তু তৎসন্নিধানে কেহই বাঙনিস্পত্তি না করিয়া কেবল মনে মনে তাঁহারই অৰ্চনা করিল। তাহারা নলের অদ্ভুত রূপলাবণ্য ও ধৈৰ্য্য-গাম্ভীৰ্য্যসন্দর্শনে মনে করিল, ইনি দেবতা বা যক্ষ অথবা গন্ধর্ব্ব হইবেন। কিন্তু কেহই তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না, প্রত্যুত তদীয় তেজঃপ্রভাবে অভিভূত হইয়া লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া রহিল।
“অনন্তর স্মিতপূর্ব্বাভিভাষিণী দময়ন্তী বিস্মিতমনে সহাস্যবদনে নলকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহাভাগ! আপনি কে আর কি নিমিত্তই বা এ স্থানে আগমন করিয়াছেন? আমি আপনাকে অবলোকন করিয়া মদনবাণে একান্ত আহত হইতেছি। এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, মহাশয়! সাতিশয় প্রচণ্ড প্ৰতাপ ও যমোপম প্রহরীরা নিরন্তর আমার গৃহরক্ষা করিতেছে, আপনি অলক্ষিত হইয়া কি প্রকারে এ স্থলে আগমন করিলেন?” নলরাজ কহিলেন, ‘হে কল্যাণি! আমি দেবদূত। দেবরাজ ইন্দ্ৰ, অগ্নি, বরুণ ও যম ইঁহারা তোমাকে অভিলাষ করেন, তুমি তাঁহাদিগের অন্যতমকে পতিত্বে বরণ করা। আমি তাঁহাদিগেরই প্রভাব বলে অলক্ষিত হইয়া পুরপ্রবেশ করিয়াছি। প্রবেশকালে আমাকে কেহই সন্দর্শন বা নিবারণ করে নাই। হে শোভনে! দেবগণ আমাকে এই নিমিত্তই প্রেরণ করিয়াছেন; এক্ষণে তুমি সবিশেষ বিবেচনা করিয়া যাহা ইচ্ছা হয়, কর।”