৫৪তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে কৃষ্ণের ভীষ্মসম্ভাষণ
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! মহাত্মা পাণ্ডবগণ সত্যপ্রতিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, ধর্ম্মপরায়ণ, শরসমাচিতকলেবর, মহাবলপরাক্রান্ত, শান্তনুতনয় ভীষ্মকে পরিবেষ্টন করিয়া সেই বীরসমাগমস্থলে কিরূপ কথোপকথন করিয়াছিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর নারদাদি মহর্ষিগণ, যুধিষ্ঠির প্রভৃতি হতাবশিষ্ট ভূপালসমুদয় এবং ধৃতরাষ্ট্র, কৃষ্ণ, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেব প্রভৃতি মহাত্মারা সেই কৌরবকুলধুরন্ধর, শরশয্যায় শয়ান, ভরতপিতামহ ভীষ্মের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে ভূতলে নিপতিত মাৰ্ত্তণ্ডের ন্যায় নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক অনুতাপ, করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় দিব্যদর্শনসম্পন্ন মহর্ষি নারদ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া সমস্ত পাণ্ডব ও হতাবশিষ্ট নরপতিদিগকে কহিলেন, “মহামতি ভীষ্ম, দিবাকরের ন্যায় অস্তগমনে উন্মুখ হইয়াছেন। এই মহাত্মা চারিবর্ণের বিবিধ ধর্ম্ম বিলক্ষণ অবগত আছেন; অতএব ইনি কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্বর্গারোহণ না করিতে করিতে তোমরা ইঁহাকে বিবিধ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া আপনাদের সন্দেহভঞ্জন কর।”
দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে ভূপালগণ ভীষ্মের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া পরস্পর পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির হৃষীকেশকে। সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মধুসূদন! তুমি ভিন্ন পিতামহকে জিজ্ঞাসা করে, এমন লোক আর কেহই নাই। অতএব তুমিই উঁহাকে ধর্ম্মবিষয় জিজ্ঞাসা কর; আমাদিগের মধ্যে তুমিই ধৰ্ম্মজ্ঞ।”
তখন ভগবান হৃষীকেশ ভীষ্মের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে রাজসত্তম! আপনি ত’ সুখে রজনী অতিবাহিত করিয়াছেন? আপনার জ্ঞানসকল ত’ প্রসন্ন ও আপনার জড়তা ত’ দূরীভূত হইয়াছে? আপনার শরীরের কোন গ্লানি বা মনের ব্যাকুলতা ত’ উপস্থিত হয় নাই?”
ভীষ্ম কহিলেন, “হে বাসুদেব! তোমার অনুগ্রহে আমার দাহ, মোহ, পরিশ্রম, গ্লানি ও রোগ সমস্তই দূরীভূত হইয়াছে। এক্ষণে আমি তোমার বরপ্রভাবে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান হস্তগত ফলের ন্যায় নিরীক্ষণ করিতেছি। বেদ ও বেদান্তোক্ত ধৰ্ম্ম, শিষ্টাচারপ্রথা, আশ্ৰমধৰ্ম্ম, রাজধৰ্ম্ম এবং দেশীয়, জাতীয় ও কুলাচরিত ধর্ম্ম সমস্তই আমার হৃদয়ে জাগরুক রহিয়াছে। যে স্থলে যাহা কীৰ্ত্তন করিতে হয়, আমি তৎসমুদয়ই কহিব। তোমার অনুগ্রহে আমার বুদ্ধি নিৰ্ম্মল ও চিত্তস্থ হইয়াছে। আমি তোমাকে ধ্যান করিয়া পুনরুজ্জীবিত হইয়াছি। এক্ষণে হিতাহিতসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতে পারিব; কিন্তু তুমি স্বয়ং কি নিমিত্ত রাজা যুধিষ্ঠিরকে হিতোপদেশ প্রদান করিলে না, তদ্বিষয়ে আমার সংশয় উপস্থিত হইতেছে; অতএব অবিলম্বে তাহা কীৰ্ত্তন কর।”
ভক্ত ভীষ্মের প্রতি কৃষ্ণের গৌরবপ্রদর্শন
বাসুদেব কহিলেন, “কুরুপিতামহ! আপনি আমাকে কীৰ্ত্তি ও কল্যাণের মূল বলিয়া জ্ঞাত আছেন। আমা হইতেই হিতাহিত কাৰ্য্যসমুদয় সম্ভূত হইয়া থাকে। অতএব চন্দ্রকে শীতাংশু[স্নিগ্ধকিরণ] বলিলে যেমন কেহই বিস্ময়াবিষ্ট হয় না, তদ্রূপ আমি যশস্বী হইলেও কেহই আশ্চর্য্য বোধ করিবে না। আমি তন্নিমিত্ত এক্ষণে আপনাকে সমধিক যশস্বী করিব বলিয়াই আমার সমুদয় বুদ্ধি আপনাতে সন্নিবেশিত করিয়াছি। যতদিন এই পৃথিবী বর্ত্তমান থাকিবে, লোকে ততদিন পর্য্যন্ত আপনার অক্ষয়কীৰ্ত্তির আন্দোলন হইবে। আপনি ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে যাহা কিছু উপদেশ প্রদান করিবেন, তাহা বেদবাক্যের ন্যায় চিরকাল আদৃত থাকিবে। যে ব্যক্তি আপনার বাক্যানুসারে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবে, সে পরলোকে সমুদয় পুণ্যের ফলভোগ করিবে। হে ভীষ্ম! এই সকল কারণবশতঃই আমি আপনাকে নির্ম্মল বুদ্ধি প্রদান করিয়াছি। আপনার যশঃ বিস্তারিত করাই আমার উদ্দেশ্য। যশই লোকের অক্ষয়কীৰ্ত্তিস্বরূপ। এক্ষণে যেসকল হতাবশিষ্ট নরপতি ধৰ্ম্মজিজ্ঞাসু হইয়া আপনার চতুর্দিকে আসীন রহিয়াছেন, আপনি উঁহাদিগকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করুন। আপনি বয়োবৃদ্ধ এবং শাস্ত্রজ্ঞান ও শুদ্ধাচারসম্পন্ন। রাজধৰ্ম্ম ও অপরাপর ধৰ্ম্ম কিছুই আপনার অবিদিত নাই। জন্মাবধি আপনার কোন দোষই লক্ষিত হয় নাই। নরপতিগণ আপনাকে সৰ্ব্বধৰ্ম্মবেত্তা বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। অতএব পিতার ন্যায় আপনি এই ভূপালগণকে নীতি উপদেশ প্রদান করুন। আপনি প্রতিনিয়ত ঋষি ও দেবগণের উপাসনা করিয়াছেন। এক্ষণে এই ভূপতিগণ আপনার নিকট ধৰ্ম্মবৃত্তান্তশ্রবণোৎসুক হইয়াছেন; অতএব আপনাকে অবশ্যই বিশেষরূপে সমস্ত ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতে হইবে। পণ্ডিতদিগের মতে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করা বিদ্বান্ ব্যক্তিরই কৰ্ত্তব্য। ক্ষমতা থাকিতে প্রশ্নের উত্তর প্রদান না করিলে নিতান্ত দোষী হইতে হয়; অতএব হে ধৰ্ম্মজ্ঞ! যখন আপনার পুত্র, পৌত্র প্রভৃতি সকলেই আপনাকে সনাতন ধর্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তখন উহাদিগকে ধর্ম্মোপদেশ-প্রদান আপনার নিতান্ত কর্ত্তব্য, সন্দেহ নাই।”