০৫৪. ভীম-কলিঙ্গরাজযুদ্ধ

৫৪তম অধ্যায়

ভীম-কলিঙ্গরাজযুদ্ধ

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সেনাপতি কলিঙ্গ আমার পুত্ৰকর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া সৈন্যসমভিব্যাহারে কিরূপে অদ্ভুতকর্ম্ম, মহাবলপরাক্রান্ত, গদাপাণি, সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় ভীমসেনের সহিত সংগ্ৰাম করিলেন?”

সঞ্জয় কহিলেন, “নরনাথ! মহাবলপরাক্রান্ত কলিঙ্গ দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে সেনাগণসমভিব্যাহারে ভীমসেনের রথসমীপে ধাবমান হইলেন। অসাধারণ বলবিক্রমশালী মহাবীর বৃকোদর প্রভূত রথ, অশ্ব ও নাগসম্পন্ন অস্ত্রশস্ত্ৰসমবেত কলিঙ্গসেনাসমূদয়ের সহিত নিষাদতনয় কেতুমানকে আগমন করিতে দেখিয়া চেদিগণের সহিত তাঁহাদের সম্মুখীন হইলেন। তখন ক্ৰোধপরায়ণ শ্রুতায়ু ব্যুহিত সেনাগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া ভূপতি কেতুমানের সহিত ভীমসেনের সম্মুখীন হইলেন। নরপতি কলিঙ্গ বহুসহস্র রথিদ্বারা এবং মহাবীর কেতুমান নিষাদগণসমভিব্যাহারে অযুত গজদ্বারা ভীমসেনকে পরিবৃত করিলেন। ঐ সময় ভীমসেনের অগ্রগামী চেদি, মৎস্য ও করূষগণ ভূপতিসমূহসমভিব্যাহারে সহসা নিষাদগণকে আক্রমণ করিল। এইরূপে যোদ্ধৃগণ পরস্পর নিধনেচ্ছায় পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইয়া ভয়ানক যুদ্ধ আরম্ভ করিল।

“হে মহারাজ! সুররাজ ইন্দ্র যেমন দানবসেনাগণের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ মহাবীর ভীমসেন অরাতিসৈন্যগণের সহিত ঘোরতর সংগ্ৰাম করিতে লাগিলেন। যুদ্ধকালে সেই প্ৰভূত সৈন্যের কোলাহলধ্বনি সমুদ্রগর্জ্জনের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। যোদ্ধৃগণ পরস্পর ছেদন করাতে রণক্ষেত্ৰ একেবারে মাংসশোণিতময় হইয়া উঠিল। জিঘাংসাবৃত্তি প্রবল হওয়াতে বীরগণ কে আত্মীয় কে পর, তাহা বুঝিতে সমর্থ হইল না; অনেকে আত্মীয়গণকেই সংহার করিতে লাগিল। চেদিসৈন্যগণ অল্পসংখ্যক হইয়াও বহুসংখ্যক কলিঙ্গ ও নিষাদসৈন্যগণের সহিত তুমুল সংগ্রাম করিতে লাগিল এবং প্রাণপণে স্বীয় পুরুষকার প্রকাশপূর্ব্বক পরিশেষে নিতান্ত ব্যথিত হইয়া ভীমসেনকে পরিত্যাগ করিয়া যুদ্ধে নিবৃত্ত হইল। মহাবীর বৃকোদর এইরূপে সমুদয় চেদিগণকে নিবৃত্ত দেখিয়াও আপনার বাহুবলের উপর নির্ভর করিয়া কলিঙ্গদিগের নিকটবর্ত্তী হইয়া যুদ্ধ করিলেন; তিনি মুহুর্ত্তমাত্ৰও রথ হইতে বিচলিত হইলেন না; প্রত্যুত কলিঙ্গসৈন্যগণকে নিশিত শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন।

কলিঙ্গতনয় শক্ৰদেববধ

“এই সময়ে মহাবলপরাক্রান্ত কলিঙ্গ ও তাহার পুত্ৰ শত্রুদেব উভয়ে ভীমসেনের উপর শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর আপনার বাহুবলে নির্ভর করিয়া শরাসন বিধূনিত করিয়া কলিঙ্গের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন, কলিঙ্গের পুত্ৰ শত্রুদেব বহুসংখ্যক শর নিক্ষেপ করিয়া ভীমসেনের অশ্বসমুদয় বিনষ্ট করিলেন এবং তাঁহাকে বিরথ দেখিয়া অসংখ্য শর নিক্ষেপ করিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মেঘ যেমন বর্ষাকালে বারিবর্ষণ করে, তদ্রূপ মহাবল শক্ৰদেব ভীমের উপর বাণবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই অশ্ববিহীন রথে থাকিয়া শক্ৰদেবের উপর এক দৃঢ় গদা নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কলিঙ্গতনয় ভীমসেনের সেই ভীষণ গদাঘাতে নিহত হইয়া ধ্বজ ও সারথির সহিত ভূতলে নিপতিত হইলেন।

“মহারথ কলিঙ্গ পুত্রকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধাভরে বহু সহস্র রথদ্বারা ভীমের চতুর্দ্দিক আবরণ করিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর দারুণ কাৰ্য্য করিবার নিমিত্ত গদা পরিত্যাগপূর্ব্বক খড়্গ এবং সুবৰ্ণময় নক্ষত্র ও অৰ্দ্ধচন্দ্ৰসমূহে সুশোভিত সুদৃঢ় বার্ষভ [বৃষসম্বন্ধীয়] চর্ম্ম গ্ৰহণ করিলেন। মহাবল কলিঙ্গ বৃকোদরকে তদাবস্থ দর্শনে ক্ৰোধান্বিত হইয়া শরাসনজ্যা মার্জ্জনপূর্ব্বক নিধন করিবার মানসে তাঁহার উপর আশীবিষসদৃশ একশর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর বৃকোদর মহাবেগে সমাগত কলিঙ্গনিক্ষিপ্ত সেই নিশিত শর খড়্গদ্বারা দ্বিধা ছেদন করিয়া ফেলিলেন এবং কৌরবসৈন্যগণকে সন্ত্ৰাসিত করিয়া হৃষ্টচিত্তে চীৎকার করিতে লাগিলেন। মহাবল কলিঙ্গ ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমসেনের উপর সুশাণিত চতুৰ্দশ তোমর প্রয়োগ করিলেন। সেই সমুদয় তোমর শূন্যমার্গে সমুত্থিত হইবামাত্র মহাবীর ভীমসেন অসম্ভ্রান্তচিত্তে অসিদ্বারা ছেদন করিয়া ফেলিলেন।

ভীমহন্তে ভানুমানের নিধন

“মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর এইরূপে সেই কলিঙ্গনিক্ষিপ্ত তোমরসমুদয় ছেদনপূর্ব্বক ভানুমানকে লক্ষ্য করিয়া ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভানুমান ভীমসেনকে শরনিকরদ্বারা সমাচ্ছাদিত করিয়া নভস্তল প্ৰতিধ্বনিত করিয়া ঘোরতর নিনাদ করিতে লাগিলেন। বৃকোদর সংগ্রামস্থলে ভানুমানের সিংহনাদ সহ্য করিতে না পারিয়া ঘোরতর ধবনি করিতে লাগিলেন। কলিঙ্গসৈন্যগণ ভীমসেনের ভীষণ ধ্বনি-শ্রবণে অতিমাত্র বিত্ৰস্ত হইয়া তাঁহাকে অমানুষ [অলৌকিক বীর] বলিয়া বোধ করিতে লাগিল। মহাবীর ভীমসেন গভীর গর্জ্জন ও অসিহস্তে মহাবেগে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক ভানুমানের মহাগজের দন্ত ধারণ করিয়া তাহার পৃষ্ঠদেশে আরোহণ করিলেন। মহাবীর ভীমসেন মধ্যদেশে দণ্ডায়মান হওয়ায় গজরাজ সানুমান [সানুপ্রদেশ যুক্ত] পর্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। মহাবীর বৃকোদর এইরূপে করিপৃষ্ঠে আরূঢ় হইয়া খড়্গদ্বারা ভানুমানকে ছেদনপূর্ব্বক সেই হস্তীর স্কন্ধে খড়্গাঘাত করিলেন, কবিরাজ ভীমের খড়্গাঘাতে ছিন্ন স্কন্ধ হইয়া ঘোরতর নিনাদপূর্ব্বক ধরাতালে নিপতিত হইল। মহাবীর ভীমসেন হস্তী নিপতিত না হইতে হইতেই লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক তাহা হইতে অবতীর্ণ হইয়া খড়্গহস্তে অদীনভাবে রণস্থলে অন্যান্য গজসমুদয় নিপাতিত করিয়া ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন; তখন তাঁহাকে অগ্নিচক্রের [চতুর্দ্দিকে প্রজ্বলিত চক্রাকার অগ্নির] ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঐ কালান্তক যমোপম মহাবীর ভীম অশ্ব, গজ, রথসৈন্য ও পদাতিসমুদয়কে নিধন করিয়া তাহাদের মধ্যে শ্যেনের ন্যায় ভ্ৰমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। ভীম বহুসংখ্যক গজারূঢ় যোদ্ধৃগণের মস্তক ছেদন করিলেন এবং একাকী ক্ৰোধাভরে পাদচারে ভ্ৰমণ করিয়া বীরপুরুষগণকে মুগ্ধ করিতে লাগিলেন। বীরগণ মূঢ় হইয়া ঘোরতর নিনাদপূর্ব্বক মহাবীর বৃকোদরের প্রতি ধাবমান হইলেন। অরতিনিপাতন মহাবীর ভীমসেন রথিগণের রথেষা ও যুগসমুদয় ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সংহার করিয়া ভ্রান্ত [মণ্ডলাকৃতি], উদভ্ৰান্ত [ঊৰ্দ্ধে উৎপতন সহকৃত ভ্ৰান্ত], আবিদ্ধ [মণ্ডলাকারে দ্রুতধাবন], আপ্লুত [সর্ব্বদিকে কেবল উল্লম্ফন], প্রসূত [সকল দিকে প্রসারণ], প্লুত [একটিমাত্র দিকে উল্লম্ফন], সম্পতি [বেগযুক্ত] ও সমুদীৰ্ণ [সকল সৈন্যের বিরুদ্ধে এককালীন যুদ্ধোদ্যম] প্রভৃতি বিবিধ গতি প্ৰদৰ্শন করিয়া ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।

“কারিগণ ভীমসেনের ভীষণ খড়্গাঘাতে মর্ম্মভেদ হওয়াতে ঘোরতর চীৎকার করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইতে লাগিল। কোন কোন হস্তী দন্ত, শুণ্ড ও কুম্ভ ছিন্ন হওয়াতে ভীষণ ধ্বনি করিয়া ভূতলে নিপতিত হইয়া স্বপক্ষীয় সৈন্যগণকেও বিনষ্ট করিল। অসংখ্য তোমর, মহাপাত্ৰ [মাহুত] মস্তক, চিত্ৰকম্বল, কনকভূষিত বন্ধনরজ্জু, গ্ৰীবাবন্ধনরজ্জু, শক্তি, পতাকা, তূণীর, যন্ত্র [পাশ—রজ্জুশিকল প্রভৃতি], ধনু, অগ্নিদণ্ড [বৃহৎ ও স্থূল মশাল], তোত্র [হস্তীর কর্ণপ্রদেশে ব্যাথাজনক অঙ্কুশাকার অস্ত্র], অঙ্কুশ, ঘণ্টা ও সুবর্ণমণ্ডিত সি ছিন্ন ও নিপতিত হইতে দেখিলাম। হস্তিসমুদয় ছিন্নকলেবর ও ছিন্নশুণ্ড হইয়া পতিত হওয়াতে রণক্ষেত্ৰ যেন পর্ব্বতাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।

“মহাবীর বৃকোদর মহানাগসকল সংহার করিয়া অশ্ব ও অশ্বারোহীদিগকে নিহত করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে কৌরবসৈন্যগণের সহিত ভীমসেনের ঘোরতর সংগ্রাম হইল। বলগা, যোক্ত, বন্ধনরজ্জু, চিত্রকম্বল, প্রাস, ঋষ্টি, কবচ, চর্ম্ম ও বিচিত্র আভরণসমুদয় ইতস্ততঃ নিপতিত হওয়াতে রণস্থল যেন কুমদাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক রথিগণকে আক্রমণ করিয়া খড়্গাঘাতে তাহাদিগকে ধ্বজের সহিত পাতিত করিতে লাগিলেন, বিচিত্র গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক মহাবেগে ইতস্ততঃ ধাবমান ও উৎপতিত হইয়া তত্ৰত্য ব্যক্তিগণকে বিস্মিত করিলেন। কাহাকে পদাঘাতে নিহত, কাহাকে আকর্ষণপূর্ব্বক প্রোথিত, কাহাকে খড়্গাঘাতে ছেদিত, কাহাকে সিংহনাদে ভীষিত [ভয়বিহ্বল], কাহাকে বা ঊরুবেগে [অত্যন্ত বেগে] পাতিত করিতে লাগিলেন। অনেকে সেই মহাবলপরাক্রান্ত ভীমমূর্ত্তি ভীমসেনকে দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিয়া ভীষ্মের চতুর্দ্দিকে দণ্ডায়মান হইল।

কলিঙ্গরাজ-সত্য-সত্যদেব-কেতুমানাদি নিধন

“অনন্তর সেই মহতী কলিঙ্গসেনা পুনরায় ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইতে লাগিল। মহাবীর বৃকোদর কলিঙ্গসৈন্যের সম্মুখে কলিঙ্গাধিপতি শ্রুতায়ুকে দেখিয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর কলিঙ্গ ভীমসেনকে ধাবমান দেখিয়া তাঁহার বক্ষঃস্থলে নয় বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবলপাক্রান্ত বৃকোদর কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ুর শরাঘাতে অঙ্কুশাহত মহাগজের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। ক্রমে তাঁহার ক্রোধাগ্নি আহুত হুতাশনের ন্যায় দ্বিগুণ প্ৰজ্বলিত হইয়া উঠিল। ঐ সময় রথিশ্রেষ্ঠ অশোক ভীমসেনের সমীপে হেমবিভূষিত রথ আনয়ন করিলেন। অরতিনিসূদন মহাবীর ভীমসেন সেই রথে আরোহণপূর্ব্বক ‘থাক থাক’ বলিতে বলিতে কলিঙ্গের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত কলিঙ্গরাজ শ্রুতায়ু ক্রোধভরে পাণিলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক ভীমের প্রতি অসংখ্য শার নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। বীরবরাগ্রগণ্য বৃকোদর কলিঙ্গের কামুকনিঃসৃত শরের আঘাতে দণ্ডাহত সৰ্পের ন্যায় যৎপরোনাস্তি ক্রুদ্ধ হইয়া শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক লৌহময় সাতবাণে কলিঙ্গাধিপতিকে, দুইশরে তাঁহার দুই চক্ররক্ষক সত্যদেব ও সত্যকে ও নিশিত নারাচসমূহে কেতুমানকে শমনসদনে প্রেরণ করিলেন।

“তখন কলিঙ্গদেশীয় ক্ষত্ৰিয়সমুদয় বহুসহস্ৰ সৈন্যসমভিব্যাহারে ভীমসেনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া অসংখ্য শক্তি, গদা, খঢ়্গ, তোমর, ঋষ্টি ও পরশু প্রয়োগ করিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন মুহুর্ত্তমধ্যে সেই অস্ত্রবৃষ্টি নিরাকৃত করিয়া গদাহস্তে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া প্ৰথমে সপ্তশত, তৎপরে দ্বিসহস্ৰ কলিঙ্গসৈন্যকে কালকবলে নিক্ষিপ্ত করিলেন। তদ্দর্শনে তত্ৰত্য সমুদয় লোক বিস্ময়ান্বিত হইল। মহাবীর বৃকোদর এইরূপে পুনঃ পুনঃ কলিঙ্গসৈন্য বিনষ্ট করিতে লাগিলেন। অসংখ্য গজারোহী সৈন্য ভীমের হস্তে নিহত হইল। আরোহিবিহীন বাণাহত মাতঙ্গ গণ সৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক বাতাহত ঘনঘটার ন্যায় গর্জ্জন করিয়া ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিয়া স্বপক্ষীয় সৈন্যগণকেই বিনষ্ট করিতে লাগিল। ঐ সময় মহাবীর ভীমসেন খড়্গ গ্রহণপূর্ব্বক হৃষ্টচিত্তে শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। গ্রাহ যেমন বৃহৎ সরোবর আলোড়িত করিয়া কম্পিত করে তদ্রূপ কলিঙ্গসৈন্যসমুদয় ও বাহনগণ ভীমের ভীষণ শঙ্খনাদে কম্পান্বিত ও মোহাবিষ্ট হইতে লাগিল। অনন্তর মত্তবারণবিক্রম মহাবাহু বৃকোদরকে বিবিধ গতি প্রদর্শনপূর্ব্বক বিচরণ ও লম্ফপ্রদান করিতে দেখিয়া সমুদয় কলিঙ্গসৈন্য পুনরায় বিমুগ্ধ হইয়া উঠিল।

“এইরূপে ভীমকর্ম্মা ভীমসেনের প্রভাবে সমুদয় কলিঙ্গদেশীয় বীরগণ ভীত ও ইতস্ততঃ বিদ্রুত হইলে পাণ্ডবসেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন স্বীয় সৈন্যগণকে যুদ্ধ করিতে আদেশ করিলেন। শিখণ্ডী প্রমুখ যোদ্ধৃগণ সেনাপতির বাক্যানুসারে অসংখ্য রথিগণসমভিব্যাহারে ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির মেঘবৰ্ণ বিপুল করিসৈন্যসমভিব্যাহারে তাঁহাদের পশ্চাৎ অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপ সমুদয় সৈন্য সংগ্রামে প্রেরিত হইলে মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমসেনের পার্ষ্ণি গ্ৰহণ করিলেন। ভীম ও সাত্যকি ভিন্ন ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় আর কেহই নাই। মহাবল পাঞ্চালতনয় অরাতিনিপাতন মহাবল বৃকোদরকে কলিঙ্গ সৈন্যমধ্যে ভ্ৰমণ করিতে দেখিয়া হষ্টচিত্তে সিংহনাদ ও শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীমসেন ধৃষ্টদ্যুন্নের পারাবতবর্ণ অশ্বযুক্ত রথের রক্তকাঞ্চনধ্বজ অবলোকন করিয়া আশ্বাসযুক্ত হইলেন। কলিঙ্গসৈন্য ভীমের প্রতি ধাবমান হইয়াছে দেখিয়া মহাবীর দ্রুপদতনয় তাঁহার পরিত্রাণের নিমিত্ত ধাবমান হইলেন। মহাবীর সাত্যকি দূর হইতে ভীম ও ধৃষ্টদ্যুম্নকে কলিঙ্গসৈন্যগণের সহিত সংগ্রাম করিতে দেখিয়া সত্বর তথায় গমনপূর্ব্বক তাঁহাদের দুইজনের পার্ষ্ণি গ্ৰহণ করিলেন। মহাবীর ভীমসেন শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক অসংখ্য কলিঙ্গসৈন্য সংহার করিয়া রুধিরময়ী নদী প্রবাহিত করিলে, কলিঙ্গদেশীয় ও পাণ্ডবসৈন্যগণ সেই নদীতে সন্তরণ করিতে লাগিল। হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পক্ষীয় সৈন্যগণ ভীমসেনকে অবলোকন করিয়া কহিতে লাগিল, ‘ঐ সাক্ষাৎ কাল ভীমরূপে কলিঙ্গসৈন্যগণের সহিত সংগ্রাম করিতেছেন।’

ভীমসহ ভীষ্মের যুদ্ধ

“ঐ সময় মহাবীর শান্তনুতনয় সংগ্রামস্থলে সৈন্যগণের নিনাদ শ্রবণ করিয়া সৈন্যসমুদয় ব্যূহিত করিয়া ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীষ্মের রথসমীপে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক প্রত্যেকে তাঁহার উপর তিন-তিন বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ভীষ্ম যত্নশীল বীরত্রয়কে তিন-তিন বাণদ্বারা বিদ্ধ ও সহস্ৰশরদ্বারা মহারথগণকে নিবারিত করিয়া তীক্ষ্ণবাণে ভীমের অশ্বসমুদয় বিনষ্ট করিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন সেই অশ্ব-বিহীন রথে অবস্থানপূর্ব্বক মহাবেগে ভীষ্মের রথাভিমুখে শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবাহু শান্তনুতনয় সেই শক্তি দ্বিধা ছেদনপূর্ব্বক ভূতলে পাতিত করিলেন। তখন ভীমসেন অয়োময় [লৌহময়], মহাগদা গ্রহণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতীর্ণ হইলে পাঞ্চলতনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁহাকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া সর্ব্বসৈন্যগণসমক্ষে প্ৰস্থান করিলেন। ঐসময় মহাবীর সাত্যকি ভীমের প্রিয়ানুষ্ঠানবাসনায় তীক্ষ্ণ সায়কে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের সারথিকে বিনষ্ট করিলেন। ভীষ্মের সারথি নিহত হইবামাত্র অশ্বগণ বায়ুবেগে তাঁহাকে সংগ্রামস্থল হইতে অপনীত করিল।

“মহারথ ভীষ্ম রণস্থল হইতে অপসৃত হইলে মহাবীর ভীমসেন কক্ষদাহক [গৃহদাহী] বহ্নির ন্যায় প্রজ্বলিত হইয়া সমুদয় কলিঙ্গসৈন্য সংহারপূর্ব্বক সেনামধ্যে অবস্থান করিতে লাগিলেন। আপনার সৈন্যগণের মধ্যে কেহই তাঁহার প্রতাপ সহ্য করিতে পারিল না। তখন সেই মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডুতনয় পাঞ্চল ও মৎস্যগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক সাত্যকির সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। যদুশ্রেষ্ঠ সত্যবিক্রম সাত্যকি ধৃষ্টদ্যুন্নের সমক্ষে ভীমসেনকে হৃষ্ট করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে বৃকোদর! তুমি আমাদের সৌভাগ্যক্রমে কলিঙ্গরাজ, তাহার পুত্ৰ কেতুমান, শক্ৰদেব এবং কলিঙ্গসৈন্যসমুদয় সংহার ও স্বীয় ভুজবলে কলিঙ্গদিগের নাগাশ্বরথসঙ্কুল মহাপুরুষভূয়িষ্ঠ ও বীরগণে অভিব্যাপ্ত মহাব্যূহ মর্দ্দন করিয়াছ।” মহাবীর সাত্যকি ভীমকে এই কথা বলিয়া দ্রুতবেগে আপনার রথ হইতে তাঁহার রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন। পরে পুনরায় আপন রথে আরোহণপূর্ব্বক ভীমের সৈন্য লইয়া ক্ৰোধাভরে কৌরবসৈন্যকে সংহার করিতে লাগিলেন।”