চতুঃপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
আস্তীকের প্রতি মাতার আদেশ
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, তদনন্তর নাগরাজভগিনী জরৎকারু স্বীয় সন্তান আস্তীককে আহবান করিয়া বাসুকির বাক্যানুসারে কহিলেন, “পুৎত্র! আমার ভ্রাতা যে অভিপ্রায়ে আমাকে তোমার পিতৃহস্তে প্রদান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহার সময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব যাহা কর্ত্তব্য হয়, কর।” আস্তীক কহিলেন, “মাতঃ! মাতুল কি নিমিত্ত আপনাকে মদীয় পিতার হস্তে প্রতিপাদন [সৎকারপূর্ব্বক প্রদান] করিয়াছিলেন, আজ্ঞা করুন, জানিয়া প্রতিবিধান করিতেছি।” তখন বান্ধবহিতৈষিণী নাগভগিনী কহিলেন, “বৎস! শ্রবণ কর। সর্প-কুলজননী কদ্রু সপত্নী বিনতাকে পণে পরাস্ত করিয়া দাসীত্ব শৃঙ্খলে বদ্ধ করিবেন, এই অভিসন্ধিতে আপন পুৎত্রদিগকে আদেশ করেন, “তোমরা সত্বর যাইয়া উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের অঙ্গবেষ্টন করিয়া থাক, তাহা হইলে অশ্বাধিপের শুভ্রবর্ণ তিরোহিত হইয়া কৃষ্ণবর্ণ হইবে।” কিন্তু তন্মধ্যে কেহ কেহ মাতৃ-আজ্ঞায় অসম্মতি প্রকাশ করাতে কদ্রু ক্রোধভরে তাহাদিগকে এই বলিয়া অভিসম্পাত করিলেন, “তোমরা আমার আজ্ঞা-লঙ্ঘন করিলে, অতএব এই অপরাধে রাজা জনমেজয়ের সর্পসত্রে দগ্ধ ও পঞ্চত্ব-প্রাপ্ত হইবে।” সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মাও ‘তথাস্তু’ বলিয়া সেই শাপবাক্য অনুমোদন করিলেন। নাগরাজ বাসুকি প্রজাপতির সেই অনুমোদন বাক্য শ্রবণ করিয়াছিলেন। অনন্তর তিনি সমুদ্রমন্থনকালে ক্ষমা প্রার্থনা-বাসনায় দেবগণের শরণাগত হইলেন। দেবগণ দুর্লভ অমৃতলাভে হৃষ্টচিত্ত হইয়া আমার ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইলেন এবং নানা প্রকার স্তুতিবাক্যে কমলযোনিকে প্রসন্ন করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! ইনি নাগরাজ বাসুকি, ইনি জ্ঞাতিবর্গের নিমিত্ত অত্যন্ত কাতর হইয়াছেন; এক্ষণে কিরূপে মাতৃশাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন, আজ্ঞা করুন।”
জনমেজয়ের যজ্ঞে আস্তীকের আগমন
ব্রহ্মা কহিলেন, ‘জরৎকারু মুনি জরৎকারুনাম্নী যে স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করিবেন, তাঁহার গর্ভে এক সন্তান উৎপন্ন হইবেন, তিনিই সর্পগণকে মাতৃশাপ হইতে মোচন করিবেন।’ নাগরাজ বাসুকি এই কথা শ্রবণ করিয়া সর্পসত্র আরম্ভের কিয়ৎকাল পূর্ব্বে আমাকে তোমার পিতার হস্তে সম্প্রদান করেন। হে বৎস! তাহাতেই তুমি আমার গর্ভে জন্মগ্রহণ করিয়াছ। অধুনা সেই অভীষ্টসিদ্ধির সময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আসন্ন বিপদ্ হইতে মাতুলকুলের পরিত্রাণ করিয়া নাগরাজের আশালতা ফলবতী কর।’
আস্তীক ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া জননীর আদেশ গ্রহণ করিলেন এবং নানা প্রকার প্রবোধবাক্যে বাসুকিকে আশ্বাসিত করিয়া কহিলেন, ‘হে ভুজঙ্গেশ্বর! আমি নিশ্চয় বলিতেছি, তোমার শাপমোচন করিব এবং যাহাতে তোমার মঙ্গল হয়, তদ্বিষয়ে সর্ব্বতোভাবে যত্ন করিব। আর ভীত বা দুঃখিত হইবার প্রয়োজন নাই। আমি ভ্রমক্রমেও কদাপি মিথ্যা প্রয়োগ করি না। হে মাতুল! আমি অদ্যই সেই দীক্ষিত রাজা জনমেজয়ের নিকট গমন করিয়া আশীর্ব্বাদাদি দ্বারা তাঁহাকে পরিতুষ্ট করিব এবং যাহাতে যজ্ঞানুষ্ঠান রহিত হয়, তাহা করিব। আপনি আমার বাক্যে কিছুমাত্র সংশয় করিবেন না, নিশ্চিন্ত থাকুন।’
বাসুকি কহিলেন, ‘বৎস আস্তীক! আমি ব্রহ্মার এই গুরুতর দণ্ডের ভয়ে হতজ্ঞান হইয়াছি, দশদিক্ শূন্য দেখিতেছি এবং আমার চিত্ত উদ্বেগচঞ্চল হইতেছে।’ তখন আস্তীক কহিলেন, “আপনি সন্তাপ পরিত্যাগ করুন, আমি নিশ্চয় বলিতেছি, অচিরাৎ সেই প্রচণ্ড ব্রহ্মদণ্ডের নিরাকরণ করিব।” আস্তীক এইরূপ আশ্বাস বচনে বাসুকির মনোদুঃখ দূর করিয়া স্বয়ং সমস্ত ভারগ্রহণপূর্ব্বক সর্পগণের পরিত্রাণার্থ রাজা জনমেজয়ের সেই সর্ব্বাবয়বসম্পন্ন যজ্ঞে উপনীত হইলেন। তিনি তথায় যাইয়া দেখিলেন, তপোধন তদ্দর্শনে প্রীত হইয়া সেই স্থানে প্রবেশ করিতে বাসনা করিলেন। দ্বারপালগণ প্রবেশ করিতে না দেওয়াতে তিনি সেই যজ্ঞের নানা প্রকার গুণকীর্ত্তন করিতে লাগিলেন। অনন্তর যজ্ঞভূমিতে উপনীত হইয়া তাহার চতুষ্পার্শ্ববর্ত্তী সূর্য্যসদৃশ ঋত্বিক্ ও সদস্যগণের এবং রাজার ও হোমাগ্নির স্তব করিতে লাগিলেন।