৫৪তম অধ্যায়
আশ্বাসপ্রদানে দুৰ্য্যোধনের ধৃতরাষ্ট্র সান্ত্বনা
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ! ভীত হইবেন না এবং আমাদিগের নিমিত্ত শোক করিবেন না; আমরা শত্রুগণকে পরাজয় করিতে সমর্থ হইব। হে পিতঃ! যখন শ্রবণ করিলেন, পররাষ্ট্রবিমর্দী সেনাগণসমভিব্যাহারে মধুসূদন এবং কেকয়, ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রভৃতি রাজগণ ও অন্যান্য অনুযায়িবর্গ ইন্দ্রপ্রস্থের অনতিদূর হইতে বনবাসী পাণ্ডবগণের সমীপে সমাগত হইয়া কুরুগণের সহিত আপনার কুৎসা ও অজিনধারী যুধিষ্ঠিরের উপাসনা করিতেছে এবং আপনাকে সন্তান-সন্ততির সহিত উচ্ছিন্ন করিবার অভিলাষে রাজ্য প্রত্যাহরণ করা কর্ত্তব্য বলিয়া তাঁহাকে অনুরোধ করিতেছে, তখন আমি জ্ঞাতিক্ষয়ভয়ে ভীত হইয়া ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্যকে কহিলাম যে, যখন বাসুদেব আমাদিগের সমুচ্ছেদে সমুৎসুক হইয়াছেন, তখন বোধ হয়, পাণ্ডবগণ অবশ্যই সমরসময়ে অবস্থান করিবেন। কেবল বিদুর ও কুরুবৃদ্ধ ধৰ্মজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র ভিন্ন আপনাদের সকলকেই তাঁহার হস্তে বিধ্বস্ত হইতে হইবে। তিনি আমাদিগের সর্বোচ্ছেদ করিয়া যুধিষ্ঠিরকে একাধিপত্য প্ৰদান করিবেন। অতএব প্ৰণিপাত, পলায়ন আর শত্রুদিগের সহিত প্রতিযুদ্ধ করিয়া প্ৰাণপরিত্যাগ, এক্ষণে ইহার মধ্যে কি করা কর্ত্তব্য? প্রতিযুদ্ধ করিলে আমাদিগেরই নিয়ত পরাজয় হইবে; কারণ, সমুদয় ভূপতিই যুধিষ্ঠিরের বশবর্ত্তী; কিন্তু আমার প্রতি রাজ্যস্থ সমস্ত লোকই বিরক্ত ও সকল মিত্ৰ কুপিত হইয়াছে এবং সকল ভূপতি ও আত্মীয়গণ আমাকে ধিকৃত করিতেছেন। প্ৰণিপাত করিলে দোষ নাই; চিরকালের নিমিত্ত সন্ধিও হইতে পারে। কিন্তু আমি কেবল আপনার নিমিত্তই শোক করিতেছি, আপনি আমার নিমিত্ত দুঃসহ দুঃখ ও অশেষ ক্লেশ প্রাপ্ত হইতেছেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ৰগণ শক্রগণকে অবরুদ্ধ করিয়াছিল; এক্ষণে সেই সকল মহারথ শত্রু পাণ্ডবগণ যে অমাত্যসহ ধৃতরাষ্ট্রের কুলোচ্ছেদনপূর্ব্বক বৈরানিৰ্য্যাতন করিবে, ইহা আপনি আমার মঙ্গলের নিমিত্ত পূর্ব্বেই অবগত হইয়াছেন।
“হে তাত! দ্রোণ, ভীষ্ম, কৃপও আমাকে এবংবিধ চিন্তাধিকতার [অত্যন্ত চিন্তাকাতর] অবলোকন করিয়া কহিলেন, ‘হে রাজন! অরাতিগণের অনিষ্ট করিয়াছি বলিয়া কদাচ ভীত হইবেন না। আমরা সমরক্ষেত্রে দণ্ডায়মান হইলে তাহারা কোনক্রমেই জয়লাভে সমর্থ হইবে না। আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি শত্রুপক্ষের সমুদয় পার্থিব্যকে পরাভূত করিতে পারেন। অতএব সকলে চল, নিশিত শরপ্রহারে তাহাদিগের দর্পচূৰ্ণ করি।” পূর্ব্বে পিতামহ ভীষ্ম পিতার নিধনে একান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া একাকী একরথে সমস্ত ভূপতিকে পরাজিত ও তাঁহাদিগের ভূরি ভূরি ব্যক্তিকে নিহত করিলে অবশিষ্ট রাজারা ভীতিবশতঃ সেই দেবব্রতের [ভীষ্মের] শরণাপন্ন হইয়াছিলেন; সেই সুসমর্থ মহাপুরুষ যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আমাদিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন; অতএব শত্রুজয়ের নিমিত্ত ভয় পরিত্যাগ করুন। হে পিতঃ! এই অমিততেজাঃ বীরগণ তৎকাল অবধিই এই প্রকার কৃতনিশ্চয় হইয়া রহিয়াছেন।
“এই সমস্ত পৃথিবী পূর্ব্বে শক্রগণের বশীভুত ছিল বটে, কিন্তু এক্ষণে তাহারা সমরে আমাদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবে না; কেন না, শত্ৰুগণ নিস্তেজ ও তাহাদিগের সহায়গণ বিচ্ছিন্ন হইয়াছে; এ দিকে পৃথিবী আমার হস্তগত আছে এবং আমি যেসকল ভূপতিকে আনয়ন করিয়াছি, তাহারা আমার নিমিত্ত অগ্নি ও সমুদ্রে প্রবেশ করিতে পরাঙ্মুখ নহেন। আমার সুখই তাঁহাদিগের সুখ ও আমার দুঃখই তাহাদিগের দুঃখ। ইহারা আপনাকে দুঃখিত ও ভীত হইয়া শক্রগণের প্রশংসাসহকারে বহুবিধ বিলাপ করিতে দেখিয়া হাস্য করিতেছেন। ইহাদিগের এক একজন পাণ্ডবগণের সমকক্ষ। মহারাজ! সকলেই আপনি আপনাকে অবগত আছেন; অতএব আপনি উপস্থিত ভয় পরিত্যাগ করুন।
“মহারাজ! অন্যের কথা কি কহিব, দেবরাজও আমার সমগ্র সেনাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইবেন না; স্বয়ম্ভু ব্ৰহ্মাও হনন করিতে পারে না। যুধিষ্ঠির আমার সৈন্য ও প্রভাব অবলোকন করিয়া এরূপ ভীত হইয়াছে যে, নগর পরিত্যাগ করিয়া কেবল পাঁচখানি গ্রাম প্রার্থনা করিয়াছে। আপনি আমার সমুদয় প্রভাব অবগত হন নাই; এই নিমিত্ত বৃকোদরকে সমর্থ বলিয়া বোধ করিতেছেন; কিন্তু তাহা আপনার ভ্রান্তিমাত্র। পৃথিবীতে গদাযুদ্ধে আমার সমান এক্ষণে কেহই নাই; আর কেহ হয় নাই ও হইবেও না। আমি একাগ্রতা ও অতি দুঃখের সহিত গুরুকুলে বাস করিয়া বিদ্যার পরিপ্রাপ্ত হইয়াছি। অতএব আপনি এক্ষণে ভীম বা অন্যান্য ব্যক্তি হইতে ভীত হইবেন না। আমি যখন বলদেবের শিষ্য হইয়া তাঁহার পরিচর্য্যা করিতাম, তখন তাঁহার এই নিশ্চয় হইয়াছিল যে, গদাতে দুৰ্য্যোধনের সমান কেহই নাই। তিনি সামান্য লোক নহেন; পৃথিবীতে তাঁহা অপেক্ষা অধিকতর বলবান আর নয়নগোচর হয় না। ভীমসেন কদাপি আমার গদাপ্রহার সহ্য করিতে সমর্থ হইবে না। আমি ভীমসেনকে ক্ৰোধপূর্ব্বক একটি আঘাত করিব তাহাতেই তাহাকে তৎক্ষণাৎ শমনসদনে গমন করিতে হইবে। আমার বহুদিনের মনোরথ এই যে, একবার বৃকোদরকে গদাধর [গদাধারণপূর্ব্বক আমার পক্ষে সমাগত] অবলোকন করিব। আমি বৃকোদরকে গদাঘাত করিলে সে বিশীর্ণগাত্র ও গীতজীবন হইয়া ধরাতালে নিপতিত হইবে। অন্যের কথা কি কহিব, আমার গদাধর এক আঘাতে হিমালয়পৰ্বতও শতধারা সহস্রধারা বিদীর্ণ হইয়া যায়। বৃকোদর, বাসুদেব ও অর্জ্জুনও ইহা অবগত আছে যে, গদাযুদ্ধে দুৰ্য্যোধনের সদৃশ দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই। অতএব আপনার ভীমভয় দূরীভূত হউক, আপনি বিমনাঃ হইবেন না; আমি তাহাকে ব্যাপাদিত করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। আমি ভীমসেনকে বিনষ্ট করিলে পর অন্যান্য তুল্যরূপ অথবা উৎকৃষ্ট রথিসমূহ ধনঞ্জয়কে দূরে নিক্ষেপ করবে। হে তাত! ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, কৰ্ণ, ভূরিশ্রবা, প্ৰাগজ্যোতিষাধীশ্বর শল্য ও সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ— ইহাদের এক একজন পাণ্ডবগণকে সংহার করিতে সমর্থ একত্র মিলিত হইলে তৎক্ষণমাত্রেই তাহাদিগকে যমালয়ে প্রেরণ করিবেন। ভূপতিগণের সমগ্র সেনা যে একাকী ধনঞ্জয়কে জয় করিতে অসমর্থ হইবে, তাহাতে কোন কারণ নাই। সে ভীস্ম, দ্রোণ, অশ্বত্থামা ও কৃপের শরজালেই কালকবলে প্রবিষ্ট হইবে। ব্রহ্মর্ষিসদৃশ পিতামহ গঙ্গার গর্ভে শান্তুনুর ঔরসে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন। দেবগণও ইহার পরাক্রম সহ্য করিতে অসমর্থ কেহ। ইহার সংহারকর্ত্তা নাই। ইহার পিতা প্ৰসন্ন হইয়া ইহাকে বর প্রদান করিয়াছেন যে, ইচ্ছা না করিলে তোমার মৃত্যু হইবে না।” দ্রোণাচাৰ্য্যও ব্রহ্মর্ষি ভরদ্বাজের ঔরসে দ্রোণীমধ্যে উৎপন্ন হইয়াছেন। পরমাস্ত্রবিৎ অশ্বত্থামা ইহারই পুত্র এবং আচাৰ্য্য-প্রধান কৃপাচার্য্যও মহর্ষি গৌতম হইতে শরস্তম্ভে সমুদ্ভূত হইয়াছেন, অতএব বোধহয়, ইনিও অবধ্য। যাহার পিতা, মাতা ও মাতুল এই তিনজনই অযোনিজ, সেই শৌৰ্য্যশালী অশ্বত্থামা আমার পক্ষে অবস্থিতি করিতেছেন। এইসকল দেবকল্প মহারথীগণ সমরে দেবরাজকে ব্যথিত করিতে পারেন। ধনঞ্জয় ইঁহাদিগের প্রত্যেকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেও সমর্থ নয়। তাঁহারা একত্র হইয়া ধনঞ্জয়কে বিনষ্ট করিবেন।
“কৰ্ণ একাকী ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপের সমান; ইনি পরশুরামের নিকট অস্ত্ৰশিক্ষা করিয়া গৃহে প্রত্যাগমনের নিমিত্ত অনুমতি প্রার্থনা করিলে, তিনি তখন “তুমি আমার সমান হইয়াছ” বলিয়া ইহাকে অনুজ্ঞা করিয়াছিলেন। দেবরাজ শচীর নিমিত্ত এই মহাবীরের নিকট সহজাত রুচির কুণ্ডলদ্বয় প্রার্থনা করিয়াছিলেন। ইনি অতি ভীষণ অমোঘ শক্তিদ্বারা ধনঞ্জয়কে আক্রমণ করিলে সে কি আর জীবিত থাকিতে পরিবে?
“হে রাজন্! করতলন্যস্ত ফলের ন্যায় বিজয় আমার হস্তগত ও শক্রগণের পরাজয় অভিব্যক্ত আছে। কেন না, এই ভীষ্ম, একদিনে অযুত বারকে বিনষ্ট করেন; মহাধনুৰ্দ্ধর দ্রোণ, অশ্বত্থামা এবং কৃপও ইহার সমান এবং সংসপ্তক ক্ষত্ৰিয়গণ সামান্য বীর নয়। সব্যসাচীকে বধ করিবার নিমিত্ত যেসকল ভূপতি আনীত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের মনে একবার এমন সংশয় হয় না যে, হয় আমরা অর্জ্জুনকে সংহার করিব, না হয় অর্জ্জুন আমাদিগের সংহার করিবে। ফলতঃ তাঁহারা তাহাকে বধ করিতে স্থিরনিশ্চয় হইয়াছেন। তথাপি আপনি পাণ্ডবগণের ভয়ে কি নিমিত্ত ব্যথিত, হইতেছেন? ভীমসেন নিহত হইলে আর কে যুদ্ধ করিবে? যদি আপনি তাঁহাদের আর কাহাকেও অবগত থাকেন, বলুন। যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চভ্রাতা, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি তাহাদিগের সার যোদ্ধা; কিন্তু ঐ সকল যোদ্ধা অপেক্ষা আমাদিগের যোদ্ধা ভীস্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বৈকর্ত্তন, কৰ্ণ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, প্রাগজ্যোতিষাধিপতি শল্য, অবন্তীপতি জয়দ্ৰথ, দুঃশাসন, দুঃসহ দুর্ম্মুখ, শ্রুতায়ু, চিত্ৰসেন, পুরুমিত্র, বিবিংশতি, শল, ভূরিশ্রবা ও আপনার আত্মজ বিকর্ণ-ইঁহারা শ্রেষ্ঠ। তদ্ভিন্ন আমি একাদশ অক্ষৌহিণী আহরণ করিয়াছি, কিন্তু তাহাদিগের সপ্ত অক্ষৌহিণী ভিন্ন আর কিছুই নাই, অতএব কি নিমিত্ত আমাদিগের পরাজয় হইবে? বৃহস্পতি কহিয়াছেন, আপনার বল শক্রবল অপেক্ষা তিনগুণ অধিক হইলেই শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিবে। আমার সেনাও শত্রুসেনা অপেক্ষা তিনগুণ অধিক এবং তাহাদিগের সেনার মধ্যে বহু ব্যক্তি নির্গুণ; কিন্তু আমার সেনা বহুগুণ [বহুসংখ্যক] ও বহুগুণসম্পন্ন। হে তাত! আপনি আমার এইপ্ৰকার বলাধিক্য ও পাণ্ডবগণের ন্যূনতা অবগত হইলেন; এক্ষণে মোহাবিষ্ট হওয়া কোনক্রমেই আপনার উচিত নয়।”
পরপুরঞ্জয় দুৰ্য্যোধন পিতাকে এই প্রকার কহিয়া ও পাণ্ডবগণের বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত সমুচিত অবসর প্রাপ্ত হইয়া সঞ্জয়কে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন।