০৫৩. সৃষ্টিসংহারবিষয়ে রুদ্রব্রহ্মার কথোপকথন

৫৩তম অধ্যায়

সৃষ্টিসংহারবিষয়ে রুদ্রব্রহ্মার কথোপকথন

রুদ্র কহিলেন, “হে প্রভু! প্রজাসৃষ্টি বিষয়ে তুমিই যত্ন করিয়াছিলে এবং তুমিই নানাবিধ ভূত সমুদায় সৃষ্টি করিয়া পরিবর্দ্ধিত করিরাছ। এক্ষণে সেই সকল প্রজা তোমার রোষানলে দগ্ধ হইতেছে। তদ্দর্শনে আমার অন্তঃকরণে করুণার সঞ্চার হইয়াছে; অতএব তুমি প্রসন্ন হও।

ব্ৰহ্মা কহিলেন, হে রুদ্র! সৃষ্টি সংহার বিষয়ে আমার অভিলাষ ছিলনা; কিন্তু পৃথিবীর হিত কামনায় আমার ক্রোধ উপস্থিত হইল। এই দেবী বসুন্ধরা দুৰ্ভর ভারে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ভূত সংহারার্থ আমাকে অনুরোধ করেন কিন্তু আমি এই অনন্ত জগতের সংহার কারণ কিছুই উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হইলাম না; এই নিমিত্ত আমার হৃদয়ে ক্রোধের আবির্ভাব হইল।

রুদ্র কহিলেন, হে জগন্নাথ! প্রসন্ন হও, বিশ্ব সংহারের নিমিত্ত সমুৎপন্ন ক্রোধ পরিত্যাগ কর; স্থাবর জঙ্গমাত্মক ভূত সকল বিনাশ করিও না। তোমার প্রসাদে ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান এই ত্রিবিধ জগৎ বিদ্যমান থাকুক। তুমি রোষাবিষ্ট হইয়া যে অগ্নি সৃষ্টি করিয়াছ, উহা নদী, প্রস্তর, বৃক্ষ, পল, তৃণ ও উলপ প্রভৃতি স্থাবর জঙ্গমাত্মক জগৎ ভস্মসাৎ করিতেছে। এক্ষণে প্রসন্ন হইয়া যাহাতে ক্রোধের উপশম হয়, ইহাই আমার অভিলষণীয় বর। হে দেব! সৃষ্ট পদার্থ সকল বিনষ্ট হইতেছে; অতএব তুমি তেজ সংহার কর; উহা তোমাতেই বিলীন হউক; হিতাভিলাষ পরতন্ত্র হইয়া প্রজাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত কর। এই সমস্ত প্রাণী যাহাতে বিদ্যমান থাকে, তাহার অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও, উৎপন্ন প্রজাসকল যেন নির্মূল না হয়। তুমি আমাকে লোক মধ্যে অধিদেব পদে নিযুক্ত করিয়াছ। হে ত্রিলোকানাথ! এই চরাচর বিশ্ব বিনাশ করিও না; তুমি প্রসাদোন্মুখ হইয়াছ বলিয়া তোমাকে এইরূপ কহিতেছি।

নারীরূপিণী মৃত্যু-মূর্ত্তির প্রাদুর্ভাব

অনন্তর লোক পিতামহ ব্রহ্মা প্ৰজাদিগের হিতানুষ্ঠানের নিমিত্ত পুনরায় অন্তরাত্মাতে স্বীয় তেজ ধারণ পূর্ব্বক অগ্নির উপসংহার করিয়া সৃষ্টি হেতু প্রবৃত্তিধর্ম্ম ও মোক্ষ হেতু নিবৃত্তিধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিলেন। তিনি যখন ক্রোধ জনিত হুতাশন সংহার করেন, তৎকালে তাঁহার সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার হইতে কৃষ্ণ, রক্ত ও পিঙ্গলবর্ণ রক্তজিহ্ব, রক্তাস্য ও রক্তলোচন, বিমল-কুণ্ডলালঙ্কৃত, বিবিধ ভূষণে বিভূষিত এক নারী প্রাদুভূত হইলেন। ঐ নারী নির্গত হইবা মাত্র ব্রহ্মা ও রুদ্রকে নিরীক্ষণ পূর্ব্বক হাস্য করিতে করিতে দক্ষিণ দিক্‌ আশ্রয় করিলেন। ব্রহ্মা তাঁহাকে মৃত্যু বলিয়া আহ্বান করিয়া কহিলেন, ‘তুমি আমার সংহার-বুদ্ধি প্রভাবে ক্রোধ হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছ; অতএব তুমি আমার নিয়োগ বশত কি জড় কি পণ্ডিত এই পৃথিবীস্থ সমুদায় প্রজাগণকে সংহার কর; তাহা হইলে তোমার মঙ্গল হইবে। কমললোচনা মৃত্যু ব্রহ্মার এই কথা শ্রবণ করিয়া কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করত মধুর স্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। পিতামহ ব্রহ্মা লোকের হিতসাধনার্থ তৎক্ষণাৎ অঞ্জলিপুটে তাঁহার নেত্ৰজল গ্রহণ করিয়া ঐ নারীকে নানা প্রকারে অনুনয় করিলেন।