ত্রিপঞ্চাশত্তম অধ্যায়
যজ্ঞে বৃতিগণের নাম
শৌনক জিজ্ঞাসা করিলেন, হে সূতাত্মজ! সর্পকুল-সংহর্ত্তা কুরুবংশাবতংস রাজা জনমেজয়ের সেই সর্পসত্রে কোন্ কোন্ ঋষি ঋত্বিক্ হইয়াছিলেন এবং নাগগণের বিষাদজনক সেই দারুণ যজ্ঞে কোন্ কোন্ ঋষিই বা সদস্য হইয়াছিলেন? হে বৎস! তুমি তৎসমুদয় বর্ণন কর। তাহা হইলে আমি সর্পসত্র-বিধানজ্ঞ মহর্ষিগণের নাম জানিতে পারিব।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, রাজা জনমেজয়ের যজ্ঞে যে-সকল মনীর্ষিগণ ঋত্বিক্ ও সদস্য ছিলেন, তাঁহাদিগের নাম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। অসাধারণ বেদবেত্তা চ্যবনবংশীয় সুবিখ্যাত চণ্ডভার্গব সেই মহাযজ্ঞে হোতাজ্ঞ ছিলেন। বৃদ্ধ সুবিদ্বান্ কৌৎস উদ্গাতা এবং জৈমিনি ব্রহ্মা ছিলেন। আর পিঙ্গল, অসিত, দেবল, নারদ, পর্ব্বত, আত্রেয়, কুণ্ডজঠর, কালঘট, বাৎস্য, শ্রুতশ্রবাঃ, কোহল, দেবশর্ম্মা, মৌদ্গল্য, সমসৌরভ প্রভৃতি অনেক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ-সকল তাহাতে সদস্য হইয়াছিলেন। ইঁহারা সকলে সেই সুমহান্ সর্পসত্রে আহুতি প্রদান করিতে আরম্ভ করিলে, অতি ভীষণাকার সর্প-সকল প্রজ্বলিত হোমানলে পতিত ও বিনষ্ট হইতে লাগিল। তাহাদিগের বসা ও মেদোদ্বারা শত শত কৃত্রিমসরিৎ প্রবাহিত হইল এবং পূতিগন্ধে চারিদিক ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল। অনলে পতিত ও পতনোন্মুখ গগনস্থ নাগগণের তুমুল আর্ত্তনাদে সেই প্রদেশ প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। নাগেন্দ্র তক্ষক রাজা জনমেজয়কে সত্রে দীক্ষিত শুনিয়া তৎক্ষণাৎ ইন্দ্রালয়ে গমন করিল এবং আত্মদোষের পরিচয় দিয়া পুরন্দরের শরণাগত হইল। দেবরাজ প্রসন্ন হইয়া তক্ষককে কহিলেন, “নাগেন্দ্র! তুমি ভীত হইও না, আমি তোমার নিমিত্ত পূর্ব্বেই পিতামহকে প্রসন্ন করিয়াছি; অতএব আর তোমার ভয়ের বিষয় কি? মনোদুঃখ দূর কর।”
উগ্রশ্রবাঃ শৌনককে কহিলেন, হে ব্রহ্মণ্! নাগেন্দ্র এইরূপে আশ্বাসিত হইয়া ইন্দ্রালয়ে পরমসুখে কালযাপন করিতে লাগিলেন। এদিকে সর্পকুল ক্রমে ক্রমে ভস্মাবশিষ্ট হইতেছে দেখিয়া, স্বজনহিতৈষী বাসুকি বন্ধুবান্ধবগণের বিরহে সাতিশয় কাতর, উদ্ভ্রান্তচিত্ত ও ক্ষণে ক্ষণে মূর্চ্ছিত হইতে লাগিলেন। অনন্তর নাগরাজ পরিবারবর্গের অত্যল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে দেখিয়া নিজ ভগিনীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভদ্রে! আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-সকল শোকানলে দগ্ধ হইতেছে, শরীর অবসন্ন ও দশদিক্ শূন্য বোধ হইতেছে, মন ও নয়ন নিতান্ত উদ্ভ্রান্ত হইতেছে এবং হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে। অধিক কি কহিব, বোধ হয়, বুঝি অদ্যই আমাকে সেই প্রদীপ্ত-দহনে দেহ সমর্পণ করিতে হইল। রাজা জনমেজয় আমাদিগকে সবংশে ধ্বংস করিবার নিমিত্তই সর্পসত্র আরম্ভ করিয়াছেন, সুতরাং আমাকেও যমসদনে গমন করিতে হইবে, সন্দেহ নাই। হে ভগিনী! আমি যে অভিপ্রায়ে তোমাকে জরৎকারুহস্তে প্রদান করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহার সময় উপস্থিত, অতএব আমাদিগের প্রাণরক্ষা করিয়া সেই চিরাকাঙ্ক্ষিত মনোরথ পরিপূর্ণ কর। পূর্ব্বে পিতামহের মুখে শ্রবণ করিয়াছি, আস্তীক জনমেজয়ের সর্পসত্র নিবারণ করিবেন। অতএব হে বৎস! অধুনা তুমি আমার ও আমার পরিজনবর্গের জীবনরক্ষার্থ অদ্বিতীয় বেদবেত্তা আপন পুৎত্রকে আদেশ কর।”