৫৩তম অধ্যায়
অপরিণামদৰ্শিতার জন্য সঞ্জয়ের তিরস্কার
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনি যে প্রকার কহিতেছেন, তাহা যথার্থ, ক্ষত্ৰিয়গণ যুদ্ধে গাণ্ডীবদ্বারা মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আপনি যে সব্যসাচীর বলবিক্রম অবগত হইয়াও কি নিমিত্ত পুত্ৰগণের বশবর্ত্তী হইয়াছিলেন, তাহা জানি না। আপনিই প্রথমে পাণ্ডবগণকে প্রতারিত করিয়াছেন, তবে যে এক্ষণে আপনার এ প্রকার বুদ্ধি উপস্থিত হইতেছে, বোধহয় ইহা চিরকাল থাকিবে না। যিনি সুহৃৎ, সম্যক সাবধানচিত্ত ও হিতকারী, তিনিই যথার্থ পিতা; কিন্তু যিনি অনিষ্টাচরণপরায়ণ, তিনি পিতা বলিয়া গণ্য হইতে পারেন না। মহারাজ! দূতকালে “এই জয় হইল, এই লাভ হইল, এই পাণ্ডবগণ পরাজিত হইল”। এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া আপনি বালকের ন্যায় আহ্লাদিত হইতেন এবং পাণ্ডবগণ পরুষবাক্যে তিরষ্কৃত হইলে আপনি উপেক্ষা করিয়াছিলেন। পশ্চাৎ যে তাঁহারা সমস্ত রাজ্য হস্তগত করিবেন, ইহা আপনি জানিতে পারিতেছেন না। কেবল কুরু ও জাঙ্গাল দেশ আপনার পৈতৃক রাজ্য, মহাবীর পাণ্ডবগণ তদ্ভিন্ন অখিল ভূমণ্ডল স্বভুজবীৰ্য্যে উপার্জ্জন করিয়া আপনাকে অর্পণ করিয়াছেন, আপনি তৎসমুদয় রাজ্য স্বোপার্জিত বলিয়া ভোগ করিতেছেন। “মহারাজ! আপনার পুত্ৰগণ গন্ধৰ্বরাজের হস্তে নিপতিত হইয়া অপার বিপদসাগরে মগ্ন হইয়াছিলেন; পার্থই তাঁহাদিগকে উদ্ধার করেন। যখন পাণ্ডবগণ দ্যূতে পরাজিত হইয়া অরণ্যে গমন করিতেছিলেন, তখন আপনি বালকের ন্যায় পুনঃ পুনঃ আনন্দপ্ৰকাশ করিয়াছিলেন। জীবজন্তুর কথা দূরে থাকুক, ধনঞ্জয় নিশিত শরসমূহ বর্ষণ করিলে সমুদ্রও শুষ্ক হইয়া যায়। তিনি সমুদয় ধনুৰ্দ্ধরের অগ্রগণ্য, গাণ্ডীবসকল শরাসনের প্রধান, কৃষ্ণ সর্ব্বভূতের শ্রেষ্ঠ, সুদৰ্শন সকল চক্রের উৎকৃষ্ট ও দীপ্যমান বানরকেতু [বানরধ্বজ-যাহার রথের ধ্বজা বানরচিহ্নিত] নিখিলকেতুর মধ্যে প্রসিদ্ধ। এইগুলি সেই শ্বেততুরঙ্গশালী স্যন্দনে একত্রিত হইলে উদ্যত কালচক্রের ন্যায় সেই রথ আপনার সমুদয়ই নিঃশেষিত করিবে। ভীম ও অর্জ্জুন যাঁহার যোদ্ধা, তিনি অদ্যই এই অখণ্ড ধরামণ্ডল অধিকার করিতে পারেন। দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি কৌরবগণ আপনার সেনাগণকে ভীমকর্ত্তৃক নিহতপ্রায় অবলোকন করিয়াই ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। আপনার পুত্ৰগণ ও তাঁহাদিগের অনুগামী ভূপতিগণ ভীম ও অর্জ্জুনের ভয়ে ভীত হইয়া কদাচ জয়লাভ করিতে পারিবেন না। “হে রাজন! পাঞ্চাল, কেকয়, শাম্বেয় ও শূরসেনগণ ধীমান পার্থের পরাক্রম অবগত হইয়া তাহাকেই আশ্রয় করিয়াছে; তাঁহারা এক্ষণে আর আপনাকে উপাসনা করিতেছে না, প্রত্যুত অবজ্ঞাই করিতেছে, আর তাঁহার প্রতি অনুরক্ত হইয়া আপনার পুত্ৰগণের বিরোধী হইয়াছে। সে যাহা হউক এক্ষণে আপনার শোক করা উচিত নয়; আমি ও বিদুর দূতক্ৰীড়াসময়েই কহিয়াছিলাম যে, পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন অবধ্য ধাৰ্মিকবর পাণ্ডবগণকে অন্যায় কর্ম্মদ্বারা ক্লেশ প্ৰদান ও দ্বেষ করিতেছে; অতএব তাহাকে ও তাহার অনুগত ব্যক্তিদিগকে সর্ব্বপ্রকার উপায়দ্বারা শাসন করা উচিত; কিন্তু তখন তাহা না করিয়া এক্ষণে অসমৰ্থ ব্যক্তির ন্যায় পাণ্ডবগণের নিমিত্ত বিলাপ করা নিরর্থক।”