৫২তম অধ্যায়
নলোপাখ্যানপর্ব্বাধ্যায়-পার্থবিরহে পাণ্ডবদৌর্ম্মনস্য
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন! মহাত্মা পার্থ অস্ত্ৰলাভার্থ ইন্দ্ৰলোকে প্রস্থান করিলে পাণ্ডবেরা কি করিয়াছিলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাত্মা পার্থ অস্ত্ৰলাভার্থ ইন্দ্রলোকে প্রস্থান করিলে পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর সহিত কাম্যকবনে বাস করিতে লাগিলেন। একদা তাহারা কৃষ্ণার সহিত একান্ত দুঃখিত মনে নবীন তৃণাচ্ছন্ন নির্জ্জনপ্রদেশে উপবেশনপূর্ব্বক ধনঞ্জয়বিরহজনিত-সন্তাপে নিতান্ত ব্যাকুলচিত্ত হইয়া বাষ্পপূর্ণকণ্ঠে পার্থকে উদ্দেশ করিয়া শোকপ্রকাশ করিতে লাগিলেন। ক্ৰমে ক্ৰমে তদ্বিয়োগজনিত দুঃখ প্রবল হইয়া তাঁহাদিগকে একান্ত অভিভূত করিতে লাগিল।
এই অবসরে ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! পাণ্ডবদিগের মধ্যে অর্জ্জুনই আপনার নির্দেশানুসারে ইন্দ্ৰলোকে প্রস্থান করিয়াছে। সেই অর্জ্জুনেই আমাদিগের প্রাণ সমৰ্পিত আছে। অর্জ্জুন বিনষ্ট হইলে সমস্ত পাঞ্চাল, সাত্যকি, বাসুদেব ও আমরা পুত্রদিগের সহিত অবশ্যই বিনষ্ট হইব। ধর্ম্মাত্মা অর্জ্জুন অস্ত্ৰলাভ করা সাতিশয় ক্লেশের বিষয় পৰ্য্যালোচনা করিয়াও কেবল আপনার আদেশানুসারে তদুদেশে প্রস্থান করিয়াছে, ইহা অপেক্ষা এক্ষণে দুঃখের বিষয় আর কি আছে?
হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! অর্জ্জুনের বাহুবল আশ্রয় করিয়ােই আমরা রণস্থলে শত্রুদিগকে পরাজিত ও পৃথিবীকে অধিকৃত বিবেচনা করি। আমি তাহার প্রভাব জানিয়াই তৎকালে সভামধ্যে সৌবলসহ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে সংহার করি নাই। আমরা ভুজবীৰ্য্যসম্পন্ন হইয়াও কেবল বাসুদেবের নির্দেশ অপেক্ষায় ক্ৰোধসংবরণ করিয়া রহিয়াছি। এক্ষণে আমরা কৃষ্ণের সাহায্যে কৰ্ণ প্রভৃতি শত্ৰুগণকে হনন করিয়া স্বীয় বাহুবলে সসাগরা বসুন্ধরাকে শাসন করিতে পারি। আমরা মহাবলপরাক্রান্ত হইয়াও কেবল আপনার দূতক্রীড়ার দোষে ঈদৃশ দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়াছি; ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা বালক হইয়াও এক্ষণে সামন্তদত্ত ধনলাভে বলিষ্ঠ হইয়াছে।
কৌরবসহ ভীমসেনের আশু সমরবাসনা
“হে রাজন! আপনার ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম প্রতিপালন করাই আবশ্যক কিন্তু বনবাসী হওয়া ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম্ম নহে। পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, রাজ্যরক্ষা করাই ক্ষত্ৰিয়ের প্রধান ধর্ম্ম, আপনিও তদ্বিষয়ে সম্যক অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন; অতএব রাজ্যশাসনারূপ ক্ষত্রধর্ম্ম হইতে বিচলিত হইবেন না। আমরা এক্ষণে বন হইতে প্রতি গমনপূর্ব্বক জনার্দ্দনকে আনয়ন করিয়া দ্বাদশ বৎসর অতীত হইবার পূর্ব্বেই ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে সংহার করিব। আমি সৌবলসমভিব্যাহারী সৈন্যব্যূহপরিবৃত ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ, কর্ণ ও অন্যান্য প্রতিযোদ্ধাদিগকে বলপূর্ব্বক শমনসদনে প্রেরণ করিব। এইরূপে সমুদয় প্রশমিত হইলে আপনি পুনরায় বনে আগমন করিবেন। ইহা করিলে আর দোষ হইবার সম্ভাবনা নাই। অনন্তর আমরা বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা সঞ্চিত পাপরাশি হইতে বিনিমুক্ত হইয়া সুরসদনে গমন করিব। যদি ধর্ম্মপরায়ণ আপনি বালিশ [জড়—কর্ত্তব্যে অনবহিত], দীর্ঘসূত্রীও [চিরক্রির—আজকাল করিয়া সময়ক্ষেপকারী] না হয়েন, তাহা হইলে এইরূপ ঘটনা হইতে পারে। “হে মহারাজ! ইহা নির্ণীত আছে যে, কপটাচারী ব্যক্তিকে ছলদ্বারা বিনাশ করিলে পাপের আশঙ্কা নাই, আর ধার্ম্মিকেরাও ধর্ম্মতঃ ঐরূপ কহিয়া থাকেন। এক্ষণে আমাদিগকে এক বৎসর অতিকষ্টে অতিবাহিত করিতে হইবে; কিন্তু বেদবাক্যে নিরূপিত আছে যে, এক অহোরাত্ৰ সংবৎসর তুল্য, আপনি যদি উহা প্রমাণ বোধ করেন, তবে আর এক দিবস। অতীত হইলেই ত্ৰয়োদশ বৎসর পরিপূর্ণ হয়; তাহা হইলে সানুচর দুৰ্য্যোধনের নিধনকাল উপস্থিত হইবে, সন্দেহ নাই। আপনি দ্যূতাসক্ত হইয়া যেরূপ কাৰ্য্য করিয়াছেন, তদানুসারে আমরা এই অজ্ঞাতচৰ্য্যায় বিনষ্টপ্রায় হইয়াছি; সুতরাং এক্ষণে দুৰ্য্যোধন সসাগরা ধরার একাধিপত্য করিতেছে।
“পৃথিবীতে এমন নির্জ্জন স্থান নাই, যথায় বাস করিলে সেই দুষ্টমতি দুৰ্য্যোধন চরদ্বারা আমাদিগের অনুসন্ধান করিতে অসমর্থ হইবে। যদি সেই নীচপ্রকৃতি দুৰ্য্যোধন কোন প্রকারে এই বনবাসবৃত্তান্ত অবগত হইতে পারে, তাহা হইলে পুনর্ব্বার কোন প্রকার ছল করিয়া আমাদিগকে প্ৰব্ৰাজিত [নির্ব্বাসিত-দেশান্তরিত] করিবে। আর যদি আজ্ঞাতবাসের নিয়মিত কাল অতীত হইলে জানিতে পারে, তবে পুনরায় আপনাকে দূতক্রীড়ার নিমিত্ত আহ্বান করিবে; অনন্তর আপনি দূতে আসক্ত হইলে সেই পাপমতি আপনাকে রাজ্যচ্যুত করিয়া, পরিশেষে পুনরায় বনবাসী করিবে।
“মহারাজ! যদি আপনি আমাদিগকে দীনভাবাপন্ন করিতে বাসনা না করেন, তাহা হইলে অনন্যকর্ম্ম হইয়া যাবজ্জীবন বেদপ্রতিপাদ্য ধর্ম্ম প্রতিপালন করুন। কপটাচারীকে ছলপূর্ব্বক সংহার করিবে, ইহাই ব্যবস্থাপিত আছে। যেমন হুতাশন সমীরণসহকারে তৃণরাশিকে ভস্মাবশেষ করে, সেইরূপ আমি বলপূর্ব্বক দুৰ্য্যোধনকে বিনাশ করিব। আপনি এ বিষয়ে অনুমোদন করুন।”
যুধিষ্ঠিরকর্ত্তৃক—ভীম-সান্ত্বনা—সহসা বৃহদশ্ব ঋষির আগমন
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীমের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া মস্তকাম্রাণপূর্ব্বক সাস্তুনা করিয়া কহিলেন, “হে মহাবাহো! ত্ৰয়োদশবর্ষ অতীত হইলে অৰ্জ্জুনের সহিত তুমি অবশ্যই পাপমতি দুৰ্য্যোধনকে বিনাশ করবে। তুমি বলিতেছ, কাল আগত হইয়াছে, কিন্তু আমি উহা বলিতে অসমর্থ; কারণ, অণুমাত্র মিথ্যাও আমার হৃদয়ে বাস করিতে পারে না। তুমি অনুচরবর্গের সহিত পাপপরায়ণ দুৰ্য্যোধনকে ছলপ্রকাশ না করিয়াও বিনাশ করিতে পরিবে।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে এইরূপ কহিতেছেন, এই অবসরে মহর্ষি বৃহদশ্ব তথায় উপস্থিত হইলেন। ধর্ম্মরাজ কুন্তীনন্দন ভগবান বৃহদশ্বকে অভ্যাগত দেখিয়া শাস্ত্রানুসারে মধুপৰ্কদ্বারা অৰ্চনা করিলেন। অনন্তর তাহাকে সুখাসীন ও গতক্লম [বিশ্রান্ত-পথশ্রমরহিত] বিবেচনা করিয়া দীনবাক্যে কহিতে লাগিলেন, “ভগবান! নিকারপর [অনিষ্টপরায়ণ] ও অক্ষকোবিদ ধূর্তেরা আমাকে আহ্বান করিয়া দ্যূতপ্রসঙ্গে আমার রাজ্য ও সমস্ত ধন অপহরণ করিয়াছে। আমার অক্ষাবিদ্যায় দক্ষতা নাই; এ নিমিত্ত ঐ পাপাত্মারা ছলপূর্ব্বক আমার প্রাণপ্ৰিয়া ভাৰ্য্যাকে সভায় আনয়ন করিয়াছিল। পরে পুনরায় আমাকে দ্যূতে পরাজয় করিয়া অজিন পরিধাপনপূর্ব্বক নিদারুণ অরণ্যবাসে প্রেরণ করিয়াছে। আমি এক্ষণে সেই দ্যূতবিষয়ক অতি কঠোরবাক্য শ্রবণপূর্ব্বক একান্ত দুঃখিত। মনে অরণ্যে বাস করিতেছি। দ্যূতারম্ভ অবধি বন্ধু-বান্ধবেরা যে-সকল কথা কহিয়াছিলেন, তাহা অদ্যাপি আমার হৃদয়-মন্দিরে জাগরূক হইয়া প্রতিদিন যামিনীযোগে স্মৃতিপথারূঢ় হইয়া থাকে। যে অর্জ্জুনের প্রতি আমরা জীবন সমর্পণ করিয়াছি, সেই মহাত্মা সমরবিজয়ী অর্জ্জুন ব্যতিরেকে আমরা গতাসুর ন্যায় কালযাপন করিতেছি। আমি কোন্দিন গৃহীতাস্ত্র প্রিয়বাদী অর্জ্জুনকে পুনরাগত দেখিতে পাইব? হে ভগবন! আপনি এই ভূমণ্ডলে কি মাদৃশ হতভাগ্য কোন রাজাকে দর্শন বা শ্রবণ করিয়াছেন? আমার বোধ হইতেছে যে, আমা অপেক্ষা দুঃখী আর কেহই নাই।”
অর্জ্জুনবিরহকাতর যুধিষ্ঠির-প্রশ্নে ঋষির সদৃষ্টান্ত উত্তর
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! আপনি কহিতেছেন যে, “আমা অপেক্ষা দুঃখিত ব্যক্তি আর কেহই নাই’ ; এ স্থলে আমি আপনার অপেক্ষাও দুঃখী অপর ধরাপতির উপাখ্যান আরম্ভ করিতেছি, শ্ৰবণ করুন।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন! যদি আমার তুল্য দুরবস্থাগ্রস্ত কোন রাজা থাকেন, তবে বলুন; শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইতেছে।”
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! এক্ষণে আপনার অপেক্ষা দুঃখিত এক ক্ষিতিপালের উপাখ্যান আরম্ভ করিতেছি, আপনি ভ্ৰাতৃবর্গের সহিত অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন। নিষধদেশে বীরসেননামে এক মহীপাল ছিলেন; তাঁহার নল নামে ধর্ম্মার্থকোবিদ এক পুত্র জন্মে। সেই নলরাজ স্বীয় ভ্রাতা পুষ্করকর্ত্তৃক ছলপূর্ব্বক দ্যূতে পরাজিত হইয়া দুঃখিতমনে ভাৰ্য্যার সহিত বনবাসী হইয়াছিলেন। তৎকালে বন্ধুবান্ধব, ভ্রাতা, দাস ও রথ প্রভৃতি কিছুই তাহার সমভিব্যাহারে ছিল না, কিন্তু আপনি দেবতুল্য মহাবীর ভ্রাতৃবর্গ ও ব্ৰহ্মকল্প ব্ৰাহ্মণগণকর্ত্তৃক পরিবৃত হইয়া রহিয়াছেন, অতএব এক্ষণে শোকাকুল হইবেন না।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! আমি আপনার মুখে মহাত্মা নলরাজের চরিত্ৰ সবিস্তরে শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক উহা বৰ্ণন করুন।”