হস্তিনা-নগরে রাজা শান্তনু হইল।
ক্রমে তাঁর গুণরাশি পৃথিবী পূরিল।।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক রাজা মহা-ধনুর্দ্ধর।
মগৃয়া করিয়া ভ্রমে বনের ভিতর।।
জাহ্নবীর দুই তটে ভ্রমে রাজা একা।
পাইল দৈবাৎ তথা জাহ্নবীর দেখা।।
পদ্মের কেশর-বর্ণ সুসিক্ত বসনা।
রূপেতে নিন্দিত যত বিদ্যাধরাঙ্গনা।।
আশ্চর্য্য কন্যার রূপ শান্তনু দেখিয়া।
জিজ্ঞাসিল নরপতি নিকটেতে গিয়া।।
কে তুমি দেবের কন্যা অপ্সরী কিন্নরী।
কিম্বা নাগকন্যা হও কিম্বা বিদ্যাধরী।।
অনুপম রূপরাশি, বর্ণিতে না পারি।
তোমাতে মজিল মন, হও মোর নারী।।
কন্যা বলে, ভার্য্যা রাজা হইব তোমার।
একটী নিয়ম তবে আছে যে আমার।।
আমার নিয়ম যদি করিবে পালন।
তবে পরপতি আমি করিব বরণ।।
আপন ইচ্ছায় আমি করিব যে কাজ।
আমারে নিষেধ না করিবে মহারাজ।।
যে যদি বলিবে মোরে কোন কুবচন।
সে দিন হইতে নাহি পাবে দরশন।।
ত্যাগ করি তোমারে যাইব নিজ স্থান।
স্বীকার করিল রাজা তাঁর বিদ্যমান।।
যা কিছু তোমার ইচ্ছা কর নিজ সুখে।
কখন নিষেধ-বাক্য না আনিব মুখে।।
রাজার বচনে গঙ্গা স্বীকার করিল।
গঙ্গারে লইয়া রাজা হস্তিনা আইল।।
দিব্য রত্ন ভূষণ বসন আনি দিল।
যতনে ভার্য্যার মন তুষিতে লাগিল।।
অনুগত হইয়া থাকেন নরপতি।
মনোসুকে কেলি করে গঙ্গার সংহতি।।
মুনি-শাপে বসুগণ জন্ম নিল আসি।
জন্মিল গঙ্গার পুত্র লয়ে গঙ্গা গেল গঙ্গাজলে।
জলেতে ডুবিয়া মর পুত্র প্রতি বলে।।
দেখিয়া শান্তনু হৈল বিরস বদন।
ভয়েতে গঙ্গারে কিছু না বলে বচন।।
তবে কত দিনে আর এক পুত্র হৈল।
সেই মত করি গঙ্গা জলে ডুবাইল।।
পূর্ব্ব সর্ত ভয়ে রাজা কিছু নাহি বলে।
নিরন্তর দহে তনু পুত্র শোকানলে।।
এক দুই তিন চারি পাঁচ ছয় সাত।
একে একে গঙ্গাদেবী করিল নিপাত।।
পুত্রশোকে শান্তনুর দহে কলেবর।
কত দিনে হৈল জন্ম অষ্টম কুমার।।
পুত্র লৈয়া গঙ্গাদেবী যায় নিজ জলে।
ক্রুদ্ধ হৈয়া নরপতি গঙ্গা প্রতি বলে।।
কেমন মায়াবী তুমি এলে কোথা হৈতে।
তব সম নিন্দিতা না দেখি পৃথিবীতে।।
আপনার গর্ভে যেই জন্মিল কুমার।
কেমনে এমন পুত্রে করিলা সংহার।।
পাষাণ শরীর তব বড়ই নির্দ্দয়।
এত বলি কোলে নিল আপন তনয়।।
গঙ্গা বলে, পুত্র বাঞ্ছা কৈলে নরপতি।
পূর্ব্বের নিয়ম পূর্ণ হৈল মহামতি।।
তোমায় আমায় আর নাহি দরশন।
এ পুত্র পালিহ রাজা করিয়া যতন।।
এবে পরিচয় মম দিব নরপতি।
আমি হই জাহ্নবী ত্রিলোকে মোর গতি।।
আমার উদরে যত হৈল পুত্রগণ।
বশিষ্পের শাপে এই বসু অষ্টজন।।
মুনি-শাপে বসুগণ হইয়া কাতর।
আমারে মিনতি করি মাগিলেন বর।।
গর্ভেতে ধরিব বলি করি অঙ্গীকার।
সে কারণে হইলাম বণিতা তোমার।।
রাজা বলে, কহ শুনি পূর্ব্ব-বিবরণ।
বসুগণে বশিষ্ঠ শাপিল কি কারণ।।
গঙ্গা বলে, সেই কথা শুন নরপতি।
বরুণের পুত্র সে বশিষ্ঠ মহামতি।।
হিমালয়-পর্ব্বতে মুনির তপোবন।
নানা-ফল-ফুলেতে শোভিত তরুগণ।।
দক্ষকন্যা সুরভি সে কশ্যপ-গৃহিণী।
কামদুঘা ধেনু হৈল তাহার নন্দিনী।।
সেই ধনু প্রাপ্ত হৈল বরুণ-নন্দন।
বৎসের সহিত থাকে মুনির সদন।।
দৈবে একদিন তথা বসু অষ্টজন।
ভার্য্যার সহিত তথা করিল গমন।।
আপন আপন ভার্য্যা সহ অষ্টজনে।
ক্রীড়া করি ভ্রমে সবে মুনির কাননে।।
দিব্যবসু-ভার্য্যা কামদুঘা গবী দেখি।
একদৃষ্টে চাহে কন্যা অনিমিখ-আঁখি।।
সুন্দর দেখিয়া গবী কহিল স্বামীরে।
কাহার সুন্দর গবী দেখ বনে চরে।।
দিব্যবসু বলে এই বশিষ্ঠের গবী।
কশ্যপের অংশে জন্ম জননী সুরভি।।
ইহার যতেক গুণ কহনে না যায়।
এক পল দুগ্ধ যদি নরলোকে পায়।।
পান কৈলে জীয়ে দশ সহস্র বৎসর।
সুচির যৌবন থাকে, শরীর নির্জ্জর।।
স্বামীর বচন শুনি বলিল সুন্দরী।
এ গবীর দুগ্ধ যদি হয় হিতকারী।।
নরলোকে সখী এক আছয়ে আমার।
উশীনর-কন্যা জিতবতী নাম তার।।
তাহার কারণে তুমি গবী দেহ মোরে।
যদ্যপি থাকয়ে স্নেহ তোমার আমারে।।
বিনয় করিয়া কন্যা বলে বারে বারে।
স্ত্রীবশ হইয়া বসু ধরিল গবীরে।।
ভার্য্যা-বোলে গবী ধরে, পাছে না গণিল।
কামদুঘা ধেনু লয়ে নিজ গৃহে গেল।।
কতক্ষণে মুনিবর আইল আশ্রমে।
গবী না দেখিয়া মুনি তপোবন ভ্রমে।।
না পাইল গবী মুনি, ভ্রমিল বিস্তর।
গবীর বিহনে হৈল ব্যথিত অন্তর।।
ধ্যান করি দেখে তবে বরুণ-নন্দন।
জানিল হরিল গবী বসু অষ্টজন।।
ক্রোধেতে বশিষ্ঠ শাপ দিল ততক্ষণে।
মনুষ্য হইয়া জন্ম লহ অষ্টজনে।।
বশিষ্ঠ দিলেন শাপ, শুনি বসুগণে।
করযোড়ে স্তুতি করে মুনি বিদ্যমানে।।
মুনি বলে মোর বাক্য না হয় খণ্ডন।
বৎসরেক গর্ভবাসে রবে সাতজন।।
বৎসরে বৎসরে ক্রমে হইবে মুকতি।
সবে না হইবে তাহে একই সুকৃতি।।
তোমা সবা মধ্যে গবী নিল যেই জনে।
নরলোকে রহি মুক্ত হবে বহুদিনে।।
মুনিশাপে বসুগণ হইয়া কাতর।
স্তুতি করি আমারে মাগিল এই বর।।
জন্মমাত্র আমা সবে ডুবাইবে জলে।
অঙ্গীকার করিলাম তা সবার বোলে।।
সে কারণে ভার্য্যা আমি হৈলাম তোমার।
এই তো কুমার রাজা বসু-অবতার।।
মায়ের বিহনে পুত্র দুঃখিত হইবে।
সে কারণে আমার সহিত পুত্র যাবে।।
পালিয়া সুতে পুনঃ যৌবন সঞ্চারে।
তোমারে আনিয়া দিব কত দিনান্তরে।।
এত বলি সুত লৈয়া হৈল অন্তর্ধান।
কান্দিতে কান্দিতে রাজা গেল নিজস্থান।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।