৫১তম অধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্রের অর্জ্জুনভীতি
“হে সঞ্জয়! যাহার যোদ্ধা ধনঞ্জয়, যাহার মিথ্যাবাক্য কখনও কাহারও শ্রুতিগোচর হয় নাই, ত্ৰৈলোক্যও সেই পাণ্ডুনন্দন যুধিষ্ঠিরের হস্তগত হইবে। নিরন্তর চিন্তা করিয়াও এমন লোক দেখিতেছি না, যে ব্যক্তি রথারোহণপূর্ব্বক গাণ্ডীবধন্বার সহিত যুদ্ধে অগ্রসর হইতে সমর্থ হয়। যখন ধনঞ্জয় কর্ণী, নালীক প্রভৃতি অস্ত্র নিক্ষেপ করিবে, তখন কেহই তাহার অভিমুখীন হইবে না। যদি বহুসমরজয়ী দ্রোণ ও কর্ণ তাহার সহিত যুদ্ধে গমন করেন, তাহা হইলে অন্যান্য লোক জয়-পরাজয় বিষয়ে সন্দিহান হইতে পারে; কিন্তু আমার মতে জয়লাভের সম্ভাবনা নাই; কেন না, কর্ণ কারুণ্যর সবংশবদ ও প্রমাদী; দ্রোণাচাৰ্য্য স্থবির ও উভয় পক্ষেরই আচাৰ্য্য; ওদিকে পার্থ সমর্থ, বলবান, দৃঢ়ধন্বা ও অক্লান্তপরাক্রম। ইহারা সকলেই অপরাজিত, সকলেই অস্ত্রবেত্তা, সকলেই শৌৰ্য্যশালী ও সকলেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ এবং সকলেই দেবাধিপত্য পরিত্যাগ করিতে পারেন, তথাপি জয় পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হন না; অতএব তুমুল সংগ্রাম সংঘটিত হইলে হয় দ্রোণ ও কর্ণের, না হয় ধনঞ্জয়ের বধ ব্যতিরেকে সে যুদ্ধের অবসান হইবে না; কিন্তু ধনঞ্জয়কে জয় বা বধ করিতে সমর্থ হয়, এমন কেহই নাই। আর যে ব্যক্তি মন্দকারীর বিপক্ষে বদ্ধপরিকর হইয়াছে, কি প্রকারেই বা তাহার ক্ৰোধ-শান্তি হইবে? অন্যান্য অস্ত্রবেত্তারা জয়লাভ করেন এবং পরাজিতও হইয়া থাকেন; কিন্তু ধনঞ্জয়ের কেবল জয়লাভই শ্রবণগোচর হইয়া থাকে। তিনি খাণ্ডবারণ্যে ত্ৰয়স্ত্রিশং [তেত্রিশ] বৎসর হুতাশনের তৃপ্তিসাধনকাৰ্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন ও তন্নিবন্ধন সমুদয় দেবগণকে পরাজিত করিয়াছেন। ফলতঃ, আমরা কখনই অর্জ্জুনের পরাজয় শ্রবণ করি নাই। সমশীল ও সমাচারসম্পন্ন হৃষীকেশ সংগ্রামসময়ে যাঁহার সারথি, তাঁহার জয়লাভ দেবরাজের জয়লাভের ন্যায় অনিবার্য্য হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। শ্রবণ করিয়াছি, এক রথে দুই কৃষ্ণ [কৃষ্ণার্জ্জুন-অর্জ্জুনেরও নামান্তর কৃষ্ণ] ও অধিগুণ [গুণারোপিত] গাণ্ডীবধনু—এই তিন তেজ একত্র মিলিত হইয়াছে। তাদৃশ রথী, তাদৃশ সারথি ও তাদৃশ ধনু যে আর কুত্ৰাপি বিদ্যমান নাই, ইহা দুৰ্য্যোধনের বশবর্ত্তী মন্দমতিরা অবগত নহে। প্রজ্বলিত বজ্র মস্তকে নিপতিত হইবামাত্র নিঃশেষিত হইয়া যায়, কিন্তু অর্জ্জুনের নিক্ষিপ্ত শরীসকল কোনক্রমে নিঃশেষিত হয় না। হে সঞ্জয়! আমি যেন দেখিতেছি, মহাবীর ধনঞ্জয় শরনিক্ষেপ, শরাঘাত ও শরবৃষ্টিদ্বারা সৈন্যগণের শরীর হইতে মস্তকগুলি পৃথক করিতেছে; তাহার গাণ্ডীবসমুখিত বাণময় প্রদীপ্ত তেজ আমার সেনাগণকে দগ্ধ করিতেছে এবং তাহারা সব্যসাচী[অর্জ্জুন]র রথনিনাদে ভয়বিহ্বল হইয়া ছিন্নভিন্ন হইতেছে। যেমন সমীরণ-সন্ধুক্ষিত [বায়ুদ্বারা উত্তেজিত] হুতাশন ইতস্ততঃ সঞ্চারণপূর্ব্বক প্রচুর কক্ষ [গৃহ] দাহ করে, সেইরূপ সেই তেজ আমার পুত্ৰগণকে ভস্মাবশেষ করিবে। যখন অস্ত্ৰবিশারদ কিরিটী [অর্জ্জুন] নিশিত শরসমূহ নিক্ষেপ করবেন, তখন তাহা বিধিসৃষ্ট সর্ব্বসংহৰ্তা অম্বুকের ন্যায় নিতান্ত অসহ্য হইয়া উঠিবে। যখন গৃহে অবস্থিতি করিয়া বারংবার শ্রবণ করিব যে, কৌরবগণ ছিন্নভিন্ন ও পলায়িত হইতেছে তখন নিশ্চয়ই বোধ হইবে, ভরতকুলের বিনাশকাল সমুপস্থিত হইয়াছে।”