তবে বহু দিনেতে পর্ণাদ নামধর।
দময়ন্তী নিকটে কহিল দ্বিজবর।।
ভ্রমিলাম বহু রাজ্য, কত লব নাম।
ঋতুপর্ণ নামে রাজা অযোধ্যায় ধাম।।
যেমন বলিলে তুমি, শানাইনু তায়।
না করিল প্রত্যুত্তর ঋতুপর্ণ রায়।।
সভায় বসিয়া যারা করিল শ্রবণ।
উত্তর না প্রদানিল মোরে কোন জন।।
বাহুক নামেতে এক রাজার সারথি।
বিনা অগ্নি পাক করে বিকৃত আকৃতি।।
শুনিয়া কহিল মোরে সকরুণ ভাষে।
কেমন আছে ভৈমী পুনঃ পুনঃ জিজ্ঞাসে।।
পশ্চাৎ আমারে সেই করিল উত্তর।
কুলস্ত্রীর ধর্ম্ম এই, শুন দ্বিজবর।।
সতী সাধ্বী পতিব্রতা নারী বলি তারে।
কদাচ পতির দোষ প্রকাশ না করে।।
মূর্খ কিম্বা ধনহীন যদি হয় পতি।
অধর্ম্ম অসৎ কর্ম্ম করে নিতি নিতি।।
সতী নারী পতি দোষ কখন না ধরে।
সে দোষ ঢাকিয়া পুনঃ গুণ ব্যক্ত করে।।
সার ধর্ম্ম হয় তার, এই সে বিধান।
স্বামী হৈতে অতি কষ্ট নারী যদি পান।।
তথাপি স্বামীর নিন্দা কদাচ না করে।
নিজকর্ম্ম নিন্দে কিম্বা নিন্দে আপনারে।।
শুনি তার বাক্যে আইলাম শীঘ্রগতি।
করহ উপায় যেই মনে লয় সতী।।
এত শুনি দময়ন্তী অশ্রুপূর্ণমুখী।
কহিল সকল কথা জননীরে ডাকি।।
শুন গো জননী মোর যদি হিত চাও।
সুদেব ব্রাহ্মণে শীঘ্র অযোধ্যা পাঠাও।।
পর্ণাদেরে কহে দিয়া বহু রত্ন গ্রাম।
নিজগৃহে গিয়া দ্বিজ করহ বিশ্রাম।।
যে করিলে তুমি, তাহা কেহ নাহি করে।
নল এলে বাঞ্ছা যাহা, দিব তো তোমারে।।
প্রণাম করিয়া দ্বিজে বিদায় করিল।
সুদেব ব্রাহ্মণে ডাকি বৈদর্ভী বলিল।।
অযোধ্যা নগরে বিপ্র যাহ একবার।
অসময়ে তুমি মম কর উপকার।।
এই পত্র দেহ গিয়া ঋতুপর্ণ প্রতি।
বিশেষিয়া রাজারে করাহ অবগতি।।
দময়ন্তী ইচ্ছিল দ্বিতীয় স্বয়ম্বর।
যতেক নৃপতি গেল বিদর্ভ নগর।।
বহুদিন হৈল স্বয়ন্বয়ের আরম্ভ।
যদি চাহ যাহ শীঘ্র না কর বিলম্ব।।
যদি রাজা বলে, তার স্বামী নল ছিল।
ইহা তবে কহিবে, না জানি কোথা গেল।।
জীয়ে বা না জীয়ে নল, না পাইল বার্ত্তা।
সে কারণে বৈদর্ভী ইচ্ছিল অন্য ভর্ত্তা।।
আজি রাত্রি প্রভাতে হইবে স্বয়ম্বর।
পারিলে তথায় শীঘ্র যাহ নৃপবর।।
নল সম নাহি লোক চালাইতে রথ।
নিমিষেতে যায় শত যোজনের পথ।।
নিশ্চয় জানিব তথা যদি নল স্থিত।
তবে শীঘ্র বার্ত্তা পেলে আসিবে ত্বরিত।।
এত শুনি চলিল সুদেব দ্বিজবর।
কত দিনে উপনীত অযোধ্যা-নগর।।
কহিয়া ভৈমীর কথা পত্রখানি দিল।
পত্র পেয়ে ঋতুপর্ণ বাহুকে ডাকিল।।
অশ্বতত্ত্ব জান তুমি সর্ব্বলোকে জানে।
বিদর্ভ যাইতে কি পারিবে রাত্রি দিনে।।
আজি নিশি প্রভাতে উদয়ে তিমিরান্তে।
ভীমপুত্রী ভৈমী বরিবেক অন্য কান্তে।।
এত শুনি নল রাজা হইল বিস্মিত।
দময়ন্তী করে হেন কর্ম্ম কদাচিত।।
মুর্হূর্ত্তেক নিজ চিত্তে করিয়া ভাবনা।
নিশ্চয় জানিল এই মিথ্যা প্রবঞ্চনা।।
কোন স্ত্রী এমন নাহি করে কোন দেশে।
তনয় তনয়া দুই আছয়ে বিশেষে।।
সতী সাধ্বী দময়ন্তী, ভক্তি যে আমায়।
আমার কারণে হেন করেছে উপায়।।
অসৎকর্ম্ম দ্যূতে আমি পশিলাম বনে।
তেঁই আমি মন্দ ভাষা শুনিনু শ্রবণে।।
মিথ্যা কথা ঋতুপর্ণ সত্য করি জানে।
সত্য কিম্বা মিথ্যা গিয়া জানিব সেখানে।।
এত চিন্তি নরপতি করিল উত্তর।
নিশাকালে লব রথ বিদর্ভ নগর।।
এত শুনি কহে রাজা হইয়া উল্লাস।
প্রসাদ যে চাহ তুমি, লহ মম পাশ।।
নল বলে, কার্য্য সিদ্ধ করিয়া তোমার।
তবে রাজা মাগিব প্রসাদ আপনার।।
এত বলি অশ্বশালে প্রবেশ করিল।
একে একে সকল তুরঙ্গ নিরখিল।।
দেখিতে শরীর কৃশ, সিন্ধুদেশী ঘোড়া।
বাছিয়া বাহির কৈল নল দুই যোড়া।।
ঘোড়া দেখি ঋতুপর্ণ আরক্ত লোচন।
বাহুকের প্রতি বলে কঠিন বচন।।
সহস্র সহস্র মম আছে অশ্বগণ।
পার্ব্বতীয় ঘোড়া সব পবন গমন।।
তাহা ছাড়ি হীনশক্তি দুর্ব্বলে আনিলে।
কেমনে বহিবে রথ, কিমত বুঝিলে।।
পরিহাস কর মোরে বুঝি অনুমানে।
পুনঃ পুনঃ কহে রাজা কঠিন বচনে।।
বাহুক বলিল, যদি যাইবে রাজন।
আমার বচনে কর রথে আরোহণ।।
ইহা ভিন্ন অন্য ঘোড়া না পারে যাইতে।
এত বলি চারি ঘোড়া যুড়িলেক রথে।।
চতুরঙ্গে সাজে তবে যত সৈন্যগণ।
ঋতুপর্ণ রাজা কৈল রথে আরোহণ।।
চালাইয়া দিল রথ বাহুক সারথি।
শূন্যেতে উঠিল ঘোড়া বায়ুবেগগতি।।
কোথায় রহিল রথ, কোথা সৈন্যগণ।
বিস্ময় মানিয়া রাজা ভাবে মনে মন।।
এই কি মাতলি যে সারথি পুরুহূত।
অশ্বিনীকুমার কিম্বা আপনি মরুৎ।।
হেন শক্তি নাহি কারো পৃথিবীমণ্ডলে।
মানুষের মধ্যে শক্তি ধরে রাজা নলে।।
নলরাজা বিনা আর নহিবেক আন।
বীর্য্য ধৈর্য্য ভাষা গুণ নলের সমান।।
কেবল দেখিতে পাই কুৎসিত আকার।
ছদ্মবেশে হইয়াছে সারথি আমার।।
এই মতে ঋতুপর্ণ করিয়া বিচার।
বন নদী গিরি আদি হইলেন পার।।
হেনকালে নৃপতির পড়িল উত্তরী।
বাহুকে বলিল রথ রাখ অশ্ব ধরি।।
উত্তরী লইতে রাজা পাছু পানে চায়।
বাহুক বলিল হেথা উত্তরী কোথায়।।
পঞ্চ যোজনের পথ উত্তরী রহিল।
শুনি ঋতুপর্ণ রাজা বিস্ময় মানিল।।
রাজা বলে, বাহুক শুনহ মোর বাণী।
আমি এক দ্রব্যসংখ্যা বিদ্যা ভাল জানি।।
গণিতে সর্ব্বজ্ঞ, নাহি আমার সমান।
এই বৃক্ষে পত্র ফল বুঝ পরিমাণ।।
পঞ্চ কোটি পত্র আছে দুই কোটি ফল।
এত শুনি বলে তবে মহারাজ নল।।
হেন বিদ্যা নাহি, যাহা আমি নাহি জানি।।
পরীক্ষিব তব বিদ্যা ফল পত্র গণি।।
রাজা বলে, চল শীঘ্র বিলম্ব না সয়।
নিকট হইল স্বয়ম্বরের সময়।।
স্বয়ম্বর হইতে আসিব নিবর্ত্তিয়া।
তবে মম বিদ্যা তুমি বুঝিবে গণিয়া।।
বাহুক বলিল যে কুণ্ডিন অল্প পথ।
না পোহাবে রজনী, লইব আমি রথ।।
মুহূর্ত্তেক রথ অশ্ব ধর নৃপবর।
ফল পত্র গণি আমি আসিব সত্বর।।
এতেক বলিয়া গেল অশ্বথের তল।
গণিয়া বুঝিল যে হইল পত্র ফল।।
বিস্ময় মানিয়া বলে নল নরপতি।
এই বিদ্যা আমারে বিতর মহামতি।।
এমত শুনিয়া রাজা বাহুক বচন।
ক্ষণেক চিন্তিয়া তবে বলিল রাজন।।
অশ্ববিদ্যা মন্ত্র যদি শিখাও আমারে।
আমি এ গণনা বিদ্যা শিখাব তোমারে।।
স্বীকার করিল নল, করাইব শিক্ষা।
তবে ঋতুপর্ণ কাছে লৈল মন্ত্রদীক্ষা।।
মহামন্ত্র দীক্ষা যদি লইলেন নল।
শরীরে আছিল কলি, হইল বিকল।।
একে কর্কোটর বিষ জর জর দহে।
অধিক রাজার মন্ত্রে কলি স্থির নহে।।
সেইক্ষণে অঙ্গ হৈতে হইল বাহির।
মুখেতে গরল বহে, কম্পিত শরীর।।
কলি দেখি নরপতি ক্রোধে কম্পকায়।
হাতে খড়্গ করি রাজা কাটিবারে যায়।।
কৃতাঞ্জলি করি কলি বলে সবিনয়।
মোরে না করিহ নাশ, শুন মহাশয়।।
দময়ন্তী-শাপে মোর সদা দহে অঙ্গ।
বিশেষে দহিল দংশি কর্কট ভুজঙ্গ।।
তোমা হৈতে দুঃখ রাজা বিশেষ আমার।
বুঝি ক্রোধ কর ক্ষমা, না কর সংহার।।
আমারে না মার তব হইবেক কাজ।
এই কীর্ত্তি রবে তব পৃথিবীর মাঝ।।
যেই জন তব কীর্ত্তি করিবে ঘোষণ।
তাহারে আমার বাধা নাহি কদাচন।।
আর এক কথা বলি শুন নরবর।
কহিতে তোমার কীর্ত্তি নাহি অবসর।।
কর্কোটক ঋতুপর্ণ দময়ন্তী নল।
নাম নিলে আমি নাহি যাব সেই স্থল।।
এত শুনি কলিরে ছাড়িল নরবর।
রথে চড়ি গেল দোঁহে বিদর্ভ নগর।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
শ্রবণে খণ্ডয়ে তাপ, ভবসিন্ধু তরি।।
কাশীরাম কহে প্রভু নীলশৈলারূঢ়।
দক্ষিণে অনুজাগ্র, সম্মুখে গরুড়।।