৫১তম অধ্যায়
কৃষ্ণের ভীষ্মনন্দন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন মহাত্মা ভীষ্ম বাসুদেবের বাক্যশ্রবণে বদনমণ্ডল ঈষৎ উন্নমিত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি জগতের সৃষ্টিসংহারের কর্ত্তা। কেহই তোমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ নহে। তুমি মোক্ষস্বরূপ। তুমি একাকী ত্রিলোকমধ্যে ত্রিকাল বিদ্যমান রহিয়াছ। তুমি সকলের পরম আশ্রয়। হে গোবিন্দ! তুমি আমাকে যে কথা কহিলে সেই বাক্যপ্রভাবে আমি স্বর্গ, মর্ত্ত্য ও পাতালে তোমার দিব্য ভাবসমুদয় এবং তোমার অবিনশ্বর রূপ প্রত্যক্ষ করিতেছি। তুমি মস্তকদ্বারা নভোমণ্ডল ও চরণযুগলদ্বারা বসুন্ধরা ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছ। তোমার পরাক্রমের ইয়ত্তা নাই। তুমি বায়ুর সাত পথ অবরোধ করিয়া রহিয়াছ। দিক্সকল তোমার বাহু, সূৰ্য্য, চক্ষু এবং শুক্র তোমার বলস্বরূপ; তোমার অতসীপুষ্পসদৃশ কৃষ্ণবর্ণ কলেবর পীতবস্ত্র-সমাবৃত হইয়া বিদ্যুদ্দামরঞ্জিত মেঘের ন্যায় সুশোভিত হইতেছে। হে পুরুষোত্তম! আমি তোমার পরম ভক্ত[আমি তোমাকে পরম ভক্তি করিয়া থাকি] এবং অভিলষিত গতিলাভার্থে আমার শরণাপন্ন হইয়াছি, এক্ষণে তুমি আমার শুভানুধ্যান কর।”
তখন মহাত্মা বাসুদেব ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “মহাত্মন! আপনি আমার একান্ত ভক্ত বলিয়াই আমি আপনাকে স্বীয় দিব্যকলেবর প্রদর্শন করিয়াছি। যে ব্যক্তি ভক্তিপরায়ণ নহে এবং যে ব্যক্তি ভক্তিপরায়ণ হইয়াও অতিশয় কুটিলস্বভাবসম্পন্ন হয়, আর যে ব্যক্তি অশান্তপ্রকৃতি, আমি তাহাদিগকে দর্শন প্রদান করি না। আপনি আমার পরমভক্ত, অতি সরলস্বভাব, সতত তপোনিরত, ইন্দ্রিয়নিগ্রহশীল ও অতি বদান্য; এই নিমিত্ত আমার দর্শনলাভ করিয়াছেন। আপনার নিমিত্ত যেসমুদয় শুভলোক বিদ্যমান রহিয়াছে, তথায় গমন করিলে আর পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইতে হইবে না। এক্ষণে আপনি আরও ষট্পঞ্চাশৎ[ছাপ্পায়] দিবস জীবিত থাকিবেন। পরে কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বীয় শুভকর্ম্মের ফল ভোগ করিবেন। প্রজ্বলিত হুতাশনসদৃশ বসু প্রভৃতি দেবগণ বিমানে আরোহণপূর্ব্বক প্রচ্ছন্নভাবে আপনার উত্তরায়ণের নিমিত্ত অপেক্ষা করিতেছেন। ঐ সময় উপস্থিত হইলেই আপনি অভীষ্ট লোক লাভ করিবেন। আপনার মুমূর্ষু দশা উপস্থিত হওয়াতেও জ্ঞানের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় নাই, এই নিমিত্তই আমরা সকলে ধৰ্ম্মসিদ্ধান্ত জ্ঞাত হইতে আপনার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছি। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির জ্ঞাতিশোকে হতজ্ঞান হইয়াছেন, অতএব আপনি ধৰ্মার্থযুক্ত কথা কীৰ্ত্তন করিয়া অবিলম্বে তাঁহার শোকাপনোদন করুন।”