পঞ্চাশত্তম অধ্যায়
পরীক্ষিতের শাপরহস্য
অমাত্যগণ কহিলেন, “মহারাজ! ক্ষুৎপিপাসার্ত্ত রাজা পরীক্ষিৎ এইরূপে সেই মুনির স্কন্ধে মৃতসর্প নিক্ষেপ করিয়া স্বনগরে প্রত্যাগমন করিলেন। উক্ত ঋষির মহাবীর্য্যসম্পন্ন অতি কোপনস্বভাব শৃঙ্গী নামে এক গোগর্ভসমুদ্ভুত পুৎত্র ছিলেন। ঋষিকুমার প্রজাপতির আরাধনানন্তর তদীয় অনুমতি লইয়া ব্রহ্মলোক হইতে ভূলোকে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক সখার সন্নিধানে নিজ পিতার অপমান-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন। তাঁহার সখা কহিলেন, ‘বয়স্য! তোমার পিতা একতানমনে ধ্যান করিতেছিলেন, এই অবসরে রাজা পরীক্ষিৎ আসিয়া অকারণে তাঁহার স্কন্ধদেশে এক মৃতসর্প নিক্ষেপপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়াছেন।’ মহারাজ! শৃঙ্গী অল্পবয়স্ক হইয়াও প্রাচীনপ্রায় ছিলেন। তিনি সখার মুখে নিজ পিতার এইরূপ অপমান-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র ক্রোধে অধীর হইয়া আচমনপূর্ব্বক আপনার পিতাকে এই অভিসম্পাত করিলেন, ‘যে ব্যক্তি নিরপরাধে আমার পিতার স্কন্ধে মৃতসর্প নিক্ষেপ করিয়াছে, দুর্বিবষহবীর্য্যসম্পন্ন [অসহনীয় শক্তিযুক্ত] নাগরাজ তক্ষক আমার বাক্যানুসারে সপ্তাহের মধ্যে সেই পাপাত্মকে ভস্মসাৎ করিবে।’ ঋষিকুমার এই অভিশাপ দিয়া সখাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বয়স্য! অদ্য আমার তপঃপ্রভাব দেখ।’ পরে শৃঙ্গী পিতার নিকট আগমনপূর্ব্বক স্বদত্ত শাপ-বৃত্তান্ত সমুদয় নিবেদন করিলেন। তখন সেই সদাশয় মুনিবর নিরুপায় ভাবিয়া সুশীল, গুণসম্পন্ন গৌরমুখ-নামক শিষ্যকে এই কথা বলিয়া আপনার পিতার নিকট প্রেরণ করিলেন, ‘আমার পুৎত্র আপনাকে অভিশাপ দিয়াছে, নাগরাজ তক্ষক আসিয়া সপ্তাহের মধ্যে স্বকীয় তেজোদ্বারা আপনাকে দগ্ধ করিবে; অতএব হে মহারাজ! আপনি অদ্যাবধি সাবধান হউক।’ গৌরমুখ রাজগোচরে উপনীত হইয়া বিশ্রামান্তে ঋষিবাক্য আদ্যোপান্ত নিবেদন করিলেন। হে মহারাজ! আপনার পিতা এই ভয়ঙ্কর বাক্য শ্রবণ করিয়া তক্ষকের ভয়ে সতত সাবধানে রহিলেন।
অনন্তর সেই সপ্তম দিবস উপস্থিত হইলে মহর্ষি কাশ্যপ রাজার নিকটে আগমন করিতেছিলেন। ব্রাহ্মণবেশধারী নাগরাজ তক্ষক পথিমধ্যে তাঁহার সন্দর্শন পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনি এত সত্বরে কোথায় যাইতেছেন এবং কি মনে করিয়াই বা যাইতেছেন?’ মহর্ষি কাশ্যপ কহিলেন, ‘হে দ্বিজ! শুনিলাম, অদ্য নাগরাজ তক্ষক কুরুরাজ পরীক্ষিৎকে দংশন করিবেন, আমি তাঁহাকে আরোগ্য করিব বলিয়া অতি সত্বর তথায় গমন করিতেছি। আমি সম্মুখে থাকিলে তক্ষক তাঁহাকে দগ্ধ করিতে পারিবেন না।’ দ্বিজরূপী তক্ষক কহিলেন, ‘মহর্ষি! আমিই সেই তক্ষক। আমি তাঁহাকে দংশন করিলে তুমি কিছুতেই প্রতীকার করিতে পারিবে না। বৃথা কেন কর্ম্মভোগ করিবে? তুমি আমার অদ্ভুত বীর্য্য দেখ।’ এই বলিয়া নাগরাজ পুরোবর্ত্তী এক বটবৃক্ষে দংশন করিলেন। বনস্পতি দংশনমাত্রেই ভস্মবশেষ হইল; মহর্ষিও বিদ্যাবলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে পুনর্জ্জীবিত করিলেন। তখন তক্ষক বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘ঋষে! তুমি কি অভিলাষে তথায় গমন করিতেছ?’ এই বলিয়া তাঁহাকে নানা প্রকার প্রলোভন দেখাইতে লাগিলেন। কাশ্যপ প্রত্যুত্তর করিলেন, ‘আমি ধনলাভের প্রত্যাশায় তথায় গমন করিতেছি।’ তক্ষক কহিলেন, ‘রাজার নিকট যত ধনের আকাঙ্ক্ষায় যাইতেছ, আমি তদপেক্ষা অধিক দিতেছি, তুমি নিবৃত্ত হও।’ তদীয় এতাদৃশ প্রমোদকর-বাক্য শ্রবণ করিয়া কাশ্যপ আপনার অভিলাষানুরূপ অর্থ গ্রহণপূর্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। ব্রাহ্মণ নিবৃত্ত হইলে তক্ষক ছদ্মবেশে প্রবেশ করিয়া স্বীয় দুঃসহ বিষবহ্নি দ্বারা প্রাসাদোপবিষ্ট ধার্ম্মিকবর ত্বদীয় পিতাকে ভস্মাবশেষ করিলেন। তৎপরে আপনি পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন। মহারাজ! এই নিদারুণ বৃত্তান্ত আমরা যেরূপ দর্শন ও শ্রবণ করিতেছি, তাহা আদ্যোপান্ত সমুদয় নিবেদন করিলাম; এক্ষণে আপনার পিতার ও মহর্ষি উতঙ্কের পরাভব বিবেচনা করিয়া যাহা সমুচিত হয়, অবিলম্বে সম্পাদন করুন।”
রাজা জনমেজয় পিতার লোকান্তরগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে অমাত্যগণ! তক্ষক যে বটবৃক্ষকে ভস্মসাৎ করিয়াছিল, কশ্যপ তাহাকে পুনর্জ্জীবিত করেন, এই অদ্ভুত কথা তোমরা কাহার নিকট শুনিয়াছিলে? বোধ হয়, পন্নগাধম তক্ষক মনে মনে এই বিবেচনা করিয়াছিল যে, আমি রাজাকে দংশন করিলে কাশ্যপ মন্ত্রবলে তাঁহার প্রাণরক্ষা করিতে পারিবেন সংশয় নাই; সুতরাং আমাকে সর্ব্বলোকের উপহাসাম্পদ হইতে হইবে, অতএব এই ব্রাহ্মণকে পরিতুষ্ট করিয়া প্রতিনিবৃত্ত করাই শ্রেয়ঃকল্প। সে যাহা হউক, এক্ষণে আমি এক উপায় অবধারণ করিয়াছি, তদ্দ্বারা তাহাকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান করিব। কিন্তু বল দেখি, কাশ্যপ ও তক্ষকে এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত নির্জ্জন অরণ্যমধ্যে ঘটিয়াছিল, ইহা কে প্রত্যক্ষ করিয়াছে এবং কি প্রকারেই বা তোমাদিগের কর্ণগোচর হইল? আমি এই সমস্ত বিষয় উত্তমরূপে জানিয়া সর্পকুল সংহার করিব।”
মন্ত্রিগণ কহিলেন, “মহারাজ! আমরা তক্ষক ও কাশ্যপের এই অদ্ভুত বৃত্তান্ত যাঁহার নিকট শুনিয়াছিলাম, শ্রবণ করুন। এক ব্রাহ্মণ শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ করিবার নিমিত্ত সেই বটবৃক্ষে আরোহণ করিয়াছিলেন। তক্ষক ও কাশ্যপ উভয়েই তাহা জানিতে পারেন নাই। তক্ষকের বিষানলে বৃক্ষের সহিত ঐ ব্রাহ্মণের কলেবরও ভস্মাবশেষ হয়; কিন্তু কাশ্যপের অলৌকিক মন্ত্রবলে উভয়েই পুনরুজ্জীবিত হইয়াছিল। পরে সেই ব্রাহ্মণ আসিয়া আমাদিগকে এই সংবাদ প্রদান করেন। মহারাজ! যে দেখিয়াছে ও আমরা যেরূপ শুনিয়াছি, তাহা নিবেদন করিলাম, এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য হয়, করুন।”
তাহা শ্রবণ করিয়া রাজা জনমেজয় অতিশয় সন্তপ্ত হইলেন এবং রোষভরে করে করে পরিপেষণ [এক হস্তে অপর হস্তের ঘর্ষণ] করিতে লাগিলেন। অনন্তর দীর্ঘ ও উষ্ণ নিশ্বাস ত্যাগ এবং অশ্রুমোচনপূর্ব্বক কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বনে থাকিয়া মন্ত্রীদিগকে কহিলেন, “হে অমাত্যগণ! পিতার পরাভববৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া যাহা অবধারণ করিলাম, বলিতেছি, শ্রবণ কর। দুরাত্মা তক্ষক শৃঙ্গীকে উপলক্ষ্যমাত্র করিয়া পিতার প্রাণহিংসা করিয়াছে। এক্ষণে তাহার সমুচিত প্রতিফল দিতে হইবে। যদি কাশ্যপ আসিতেন, তাহা হইলে পিতা অবশ্যই জীবিত থাকিতেন, কিন্তু তক্ষক এরূপ দুরাত্মা যে, তাঁহাকে অর্থ দিয়া প্রতিনিবৃত্ত করিয়াছে। যদি পিতা কাশ্যপের প্রসাদে ও মন্ত্রীদিগের মন্ত্রণাবলে জীবনলাভ করিতেন, তাহাতে তক্ষকের কি ক্ষতি হইত? তাহার এ অত্যাচার আর কিছুতেই সহ্য হয় না। অতএব এক্ষণে আমি আমার আপনার, তোমাদিগের ও উতঙ্কের সন্তোষের নিমিত্ত পিতার বৈরনির্য্যাতনে দৃঢ়নিশ্চয় করিলাম।”