চতুর্থ পরিচ্ছেদ
০১.
প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল বাংলোতে ফিরতে।
হেঁটে আসতে আসতে ভাবছিলাম যা করেছি তা করার জন্য আমার পাগল হওয়া উচিত ছিল। সে আইকেনের কাছে সব বললেই আমার উপযুক্ত সাজা হবে। তার কথাগুলো যেন আমার মনে হাতুড়ির মত আঘাত করছিল।
সমুদ্র থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে একটা ছোট্ট বাগানের মধ্যে আমার বাংলো। সবচেয়ে কাছের বাড়িটার বড় রাস্তার সিকি মাইল দুরের বাড়িটা জ্যাক সিবোর্ন নামে এক ধনী দালালের বাড়ি। সে মাসখানেক আগে গ্রীষ্মের দিনগুলো কাটাতে এসেছিল।
আমার সদর দরজার সামনে একটা গাড়ি দেখলাম। আরও কয়েক পা এগিয়ে এসে বুঝলাম সেটা আমারই ক্যাডিলাক।
লুসিলি সামনে এসে, চেস…তোমার গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি।
কয়েক গজ ব্যবধানে আমরা দাঁড়িয়ে, লুসিলি আমি সত্যিই দুঃখিত। আমার মাথা খারাপ হয়েছিল গত হয়েছিল….।
এসব কথা আর বোলো না। আমি তোমাকে বাড়িতে রেখে আসব।
তার আগে কি ভিতরে যেতে পারি? তোমাকে কিছু বলা দরকার।
না। তোমাকে আমি বাড়িতেই রেখে আসব। আমাকে তুমি গাড়িতেই বলবে।
একবার কি ভিতরে যেতে পারি না?
গাড়ি চালাতে চালাতে আমরা কথা বলব। তোমাকে রেখে আসতে হবে…তাকে কাঁপতে দেখে আমি থেমে গেলাম। পড়ে যেতে দেখে লাফ দিয়ে এগিয়ে দু হাত দিয়ে তাকে ধরে নিলাম।
লুসিলি ভগবানের দিব্যি। কি হয়েছে?
সে আমার উপর ভর দিয়ে লুটিয়ে পড়ল। তাকে শুইয়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসে মাথাটা বুকের উপর তুলে নিলাম ও চেপে ধরলাম। তার মাথাটা নীচের দিকে হেলে পড়ল। তাকে এত সাদা দেখাচ্ছিল যে আমি ভয় পেয়ে গেলাম।
কিছুক্ষণ বাদে তার চোখের পাতা নড়ে উঠল। সে আমার মুখের দিকে চেয়ে উঠবার চেষ্টা করল।
আমি বললাম, সহজ ভাবে নাও। নড়বে না…..।
তার মাথাটা আমার কাঁধের উপর রাখল। তাকে তুলে নিয়ে সদর দরজার দিকে যেতে আমার কোন কষ্টই হচ্ছিল না।
এবার ঠিক হয়ে উঠব। আমাকে নামিয়ে দাও। অত্যন্ত দুঃখিত। আগে কখনই এরকম হয়নি।
আমি তাকে নামিয়ে চাবি দিয়ে দরজাটা খুললাম। আবার তাকে তুলে ধরে লাউঞ্জে নিয়ে এলাম। তাকে শুইয়ে দিয়ে বললাম, চুপ করে শুয়ে থাক।
সে ছাদের দিকে চেয়ে শুয়েছিল, তার চোখ দুটো মনে হচ্ছিল যেন কাগজে কাটা দুটো গর্ত।
তোমার জন্য কিছু পানীয় নিয়ে আসছি। আমার ব্যবহারের জন্য আমি খুবই দুঃখিত।
কিছু চাই না, বলে সে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
আমি লিকার ক্যাবিনেটে গিয়ে গ্লাসে একটু ব্রাণ্ডি ঢেলে নিয়ে এলাম।
খেয়ে নাও, সুস্থ হয়ে উঠবে।
সে মাথাটা সরিয়ে নিয়ে, না, চেস, আমি অত্যন্ত দুঃখিত। তোমার গাড়িটা ভেঙ্গে গিয়েছে। এ নিয়ে কাদাকাটার কোন দরকার নেই। গাড়ি ভেঙ্গে ফেলার জন্যে তোমাকে কাঁদতে হবে না।
তার মুখটা এত জীর্ণ দেখাচ্ছিল। সে বলল, আমি ভাঙ্গতে চাইনি। গাড়িটা আমি আর ধরে রাখতে পারলাম না। বিরাট জোরে শব্দ হল। দরজায় একটা বিরাট দাগ পড়েছে ও সামনের লোহার গার্ডটায় টল খেয়েছে।
কি বলতে চাইছ? তুমি কি কোন মানুষকে ধাক্কা দিয়েছ?
দিব্যি খেয়ে বলছি দোষ আমার নয়, সে পিছন থেকে এসে চিৎকার করে উঠল। চিৎকার করার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না যে সে ওখানে ছিল।
কে? কে চিৎকার করেছিল?
পুলিশের সেই লোকটা। একটা মোটর সাইকেলে চেপে ছিল। সে ঠিক গাড়িটার পাশে এসে চিৎকার করে উঠেছিল….।
ভয় পেও না। শুধু বল কি ঘটেছিল।
সে চিৎকার করতেই গাড়িটা কেঁপে ওঠে এবং তাকে গিয়ে আঘাত করে….। সে কাঁদতে শুরু করল।
তার হাত দুটো নিজের হাঁটুর উপর রেখে টিপতে লাগলাম।
কাঁদলে কোন ফল হবে। তাকে ধাক্কা দেওয়ার পর কি হল?
জানি না। সোজা বেরিয়ে আসি। পিছন ফিরে চাইনি।
তুমি দাঁড়াও নি বলছ?
না, দারুণ ভয় পেয়েছিলাম।
গাড়ি চালিয়ে সোজা এখানে চলে আসি।
সে কি আঘাত পেয়েছিল?
জানি না।
কোথায় এটা ঘটে?
সমুদ্র তট থেকে উপরে আসার পথের উপর।
তাকে আর চীৎকার করতে শুনেছিলে?
না। গাড়ির পাশে ভয়ানক জোরে শব্দ হয়েছিল। আধঘণ্টার বেশী তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
খুব জোরে চালাচ্ছিলে?
হ্যাঁ।
আমি একবার গাড়িটা দেখে আসি, বলে উঠে ড্রয়ার থেকে একটা ফ্ল্যাশ লাইট নিলাম। সোজা গাড়ির কাছে এসে বুঝলাম যে গাড়ির সামনের ফেণ্ডারের ধারটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সামনে আলোটা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেছে। ফেণ্ডার বেঁকে গিয়েছে। দরজায় একটা গভীর খাঁজের সৃষ্টি হয়েছে এবং লম্বা হয়ে একটা আঁকাবাঁকা দাগ পড়েছে।
গাড়ীর পিছনের ফেণ্ডারের ধারটায় রক্তের দাগ ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় চকচক করে উঠল। দুরের চাকার সাদা বৃত্তটাতে থকথকে রক্ত লেগে ছিল। সেদিকে চেয়ে ভয়ে আমার রক্ত হিম হল।
মনে হল সে মোটর সাইকেলটাকে পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে চালককে ফেলে দিয়ে পিছনের চাকা দিয়ে তাকে মাড়িয়ে দিয়েছে। এসবের পরেও থামে নি।
ফ্লাশলাইটটা নিভিয়ে আমি পিছন দিকে এলাম। সম্ভবতঃ আরোহী লোকটা এই মুহূর্তে রক্তাপ্লুত অবস্থায় রাস্তায় মরে পড়ে আছে।
লাউঞ্জে ফিরে দেখি তখনও লুসিলি চিৎহয়ে শুয়েছিল। নিঃশাস এলোমোলো ভাবে পড়ছিল। তাকে ভীষণ খারাপ দেখাচ্ছিল।
ব্রাণ্ডির গ্লাসটা নিয়ে এসে বললাম, এই যে, একটু খেয়ে নাও। দেখ, কেঁদে কোন লাভ নেই।
তার মাথাটা তুলে একটু খাওয়ালাম। কি ঘটেছে আমি দেখতে যাচ্ছি। এখানেই অপেক্ষা কর। যত শীঘ্র পারি দেখেই ফিরে আসছি।
তখন ঘড়িতে এগারোটা বাজতে কুড়ি। সে মাথা নাড়ল। ..
তাকে সেখানে রেখে ক্যাডিলাকটার কাছে গিয়ে বুঝলাম এই অবস্থায় গাড়ীটাকে রাস্তায় নেওয়া যাবে না। যদি কেউ দেখতে পায় তবে সকালের কাগজে খবর পড়ার পর দুটোর মধ্যে যোগাযোগ আবিষ্কার করার চেষ্টা করবে। আমার ধারণা ঘটনাটা কাগজে বার হবে।
এখন আমার একটা গাড়ির প্রয়োজন। মনে পড়ল রাস্তার আরও নীচের দিকে সিবোর্নের বাড়ী। সে ছুটি কাটাতে সেখানে আসে তার একটা গাড়ীও আছে। প্রায়ই তার বাড়ীতে গিয়েছি। জানতাম যে গ্যারেজের দরজার ওপরে একটা পেরেকে সে চাবিটা ঝুলিয়ে রাখত। ঠিক করলাম তার গাড়িটা নেব।
সিবোর্নের গাড়িটা হচ্ছে উনিশশো পঞ্চাশ সালের পন্টিয়াক। গাড়িটা এত বড় যে এখানে আসার সময় তার ছটা ছেলেকে নিয়ে আসত। পন্টিয়াকটা রাস্তায় নামিয়ে ক্যাডিলাকটা গ্যারেজে রেখে দরজা লাগিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রাখলাম।
পন্টিয়াকটা জোরে চালিয়ে সমুদ্রের ধারের রাস্তায় আসতে মাত্র দশ মিনিট লাগল।
খুব সাবধানে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি ঘাসের ধারে প্রায় ছ টা গাড়ি দাঁড়িয়ে। একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোক সমুদ্রের দিকে যাওয়ার রাস্তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাস্তার প্রবেশপথ আটকে পুলিশের দুজন লোক তাদের দাঁড় করানোমোটর সাইকেলের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
শেষ গাড়িটার পাশে নিজের গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলাম।
একজন মোটা মানুষ মাথার পিছন দিকে একটা পানামা টুপি লাগিয়ে তার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে পুলিশ দুজনের দিকে চেয়েছিল।
তার কাছে এসে স্বাভাবিক স্বরে বললাম, কি হয়েছে? গণ্ডগোল কিসের?
সে আমার দিকে ফিরে চাইল। তখন বেশ অন্ধকার। গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলো নিচের দিকে প্রতিফলিত হচ্ছিল। সে আমার পায়ের দিকটা দেখতে পাচ্ছিল।
একটা অ্যাক্সিডেন্ট। পুলিশের একজন লোক মারা গিয়েছে। আমি চিরদিনই বলে এসেছি পুলিসের এই লোকগুলো যেভাবে গাড়ির সামনে এসে পড়ে তাতে তারা নিজেদেরই বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে। এই লোকটাও সেই কাণ্ড করেছে।
মারা গিয়েছে?
হ্যাঁ, ধাক্কা মেরে পালানো আর কি। কে করেছে বলতে পারছি না। আমি যদি সেই হতভাগার মত পুলিশটাকে মেরে কোন সাক্ষী থাকত না তবে চারপাশে ঘুরতাম আর মনে মনে দুঃখ পেতাম।
কিন্তু তাকে পুলিশরা ধরতে পারলে তাকে একেবারে কুশে বিধে মারবে। আমার ধারণা এই শহরের পুলিশেরা নাৎসিদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
আত্মহত্যা করেছে, বললেন না? নিজের গলার স্বর যেন চিনতে পারছিলাম না। ঠিক তাই। মাথার উপর দিয়ে গাড়ি চলে গিয়েছে। নিশ্চয়ই গাড়ির পাশটায় ধাক্কা মেরেছিল ফলে হতভাগাটা পিছনের চাকার ঠিক নিচে গিয়ে পড়েছিল। একজন লম্বা ছিপছিপে চেহারার লোকের দিকে দেখাল, লোকটা জনতার দিকে চেয়ে কি যেন বলছিল। এই লোকটা তাকে দেখেছে, তার পরনে ধূসর রং এর পোশাক ছিল। ও আমাকে বলল যে বেচারার মুখটা রক্তের মত দেখাচ্ছিল।
পুলিশদের একজন রাস্তায় এসে গর্জন করে উঠল, এই শকুনির দল, অনেক সহ্য করেছি। এখান থেকে সরে যাও। তোমাদের মতই এক বদমাস ধাক্কা মেরে অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়েছে। এখান থেকে ভাগো সব।
মোটা লোকটা মুখ বেঁকিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল।
আমি পন্টিয়াকটা চালিয়ে সোজা বাংলোর দিকে এলাম।
লাউঞ্জের দিকে যখন হাঁটছিলাম, দেখলাম লুসিলি এক বড় ইজিচেয়ারে গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছে। মুখটা ভীত, পুরোন পার্চমেন্ট কাগজের রং এর মত দেখাচ্ছিল।
লাউঞ্জে পৌঁছলে সে বলল, সব ঠিক হয়ে গিয়েছে, চেস?
গ্লাসে ডবল হুইস্কি ঢেলে জল মিশিয়ে খেয়ে ফেললাম।
না, সব ঠিক, এ কথা বলব না, বলে চেয়ারে বসলাম।
উঃ।
কিছুক্ষণ বাদে লুসিলি বলল, কিছু দেখতে পেয়েছিলে?
পুলিশ এসে গেছে? আমি তাকে দেখতে পাইনি।
আমাদের এখন কি করা উচিত তোমার মনে হয়, চেস?
ঘড়িতে এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। মনে হয় না আমরা কিছু করতে পারব।
তুমি বলতে চাও আমাদের কিছুই করার নেই?
আমিও ঠিক তাই বলতে চাইছি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।
কিন্তু চেস, আমরা নিশ্চয়ই কিছু একটা করব। আমার থেমে যাওয়া উচিত ছিল যদিও অ্যাক্সিডেন্ট। আর একবার দেখলে হয়ত সে আমাকে চিনতে পারবে। হয়ত সে গাড়ির নম্বরটা নিয়ে রেখেছে। আমাদের কিছু করা উচিত।
এস, তোমাকে বাড়িতে রেখে আসি।
লুসিলি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কিছু একটা আমার কাছে চেপে যাচ্ছ, তাই না? ব্যাপারটা কি?
খুবই খারাপ খবর লুসিলি। যতটা খারাপ হতে পারে। তবে ভয় পাবার কিছু নেই।
কি বলতে চাইছ?
তাকে তুমি চাপা দিয়েছ।
হা।
আমাকে বাড়ি নিয়ে চল, চেস। রোজারকে অবশ্যই বলতে হবে।
তিনি কিছুই করতে পারবেন না।
না, সে পারবে। সে পুলিশের এক ক্যাপ্টেনের বন্ধু। সে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে।
কি বুঝিয়ে বলবে?
আমি সবে মাত্র গাড়ি চালাতে শিখেছি। এটা কেবল একটা অ্যাক্সিডেন্ট।
মনে হয় না তাতে কোন ফল হবে।
তার কি খুব জোর আঘাত লেগেছে? তুমি কি বলতে চাও–সে মারা গিয়েছে?
হ্যাঁ, সে মারা গেছে।
উঃ, চেস…।
ভয় পেও না। আমাদের আর কিছু করার নেই। বেশ গোলমেলে ব্যাপার। মাথা খারাপ করা ঠিক হবে না…..
তার ঠোঁট কেঁপে উঠল। তুমি তো গাড়িতে ছিলে না। তোমাকে নিয়ে তাদের কিছু করার নেই, সব দোষ আমার।
এই ব্যাপারে আমরা দুজনেই ছিলাম, লুসিলি। তোমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার না করলে হয়ত তুমি জোরে গাড়ি চালাতে না, তোমারা ও আমার ততটা দোষ।
উঃ চেস…। মুখটা নামিয়ে কেঁদে উঠল।
এক মুহূর্ত চেয়ে তাকে দুই হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলাম।
এই নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, বললাম। কাগজে কি বেরিয়েছেনা দেখার আগে আমাদের করার কিছু নেই। পরে যা হয় ঠিক করা যাবে।
ধর কেউ যদি আমাকে ধাক্কা দিতে দেখে থাকে?
কেউ দেখে নি। সমুদ্রের ধারে কেউ ছিল না, আমি দু হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরলাম। আঘাত করার পর কোনও গাড়ি যেতে দেখেছ?
মনে হয় না। অবশ্য মনে করতে পারছি না।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ, সুসিলি। মনে করার চেষ্টা কর।
ফিরে এসে সে বসল।
ঠিক আছে। এখন শান, কাল কাগজ দেখার পর আমরা আলোচনা করব। তুমি কাল আসবে? সকাল দশটায়; পারবে?
সে আমার দিকে চেয়েছিল, তার দৃষ্টি শূন্য মনে হল।
ওরা কি জেলে পাঠাবে? সে প্রশ্ন করল।
আমি চমকে উঠলাম। যদি ধরতে পারে তবে জেলে পাঠাবে। পুলিশদের মেরে নিস্তার নেই।
ওভাবে বোলো না।
এতে ফল হবে না, কাল কখন আসতে পারবে? দশটায় আসবে?
তুমি নিশ্চিত যে, আমরা কিছু করতে পারব না?
কাগজে কি বলে! কাল সকালেই জানতে পারব। সকালে দেখা করে ঠিক করে নেব কি করতে হবে।
তুমি কি মনে কর, রোজারকে বলতে হবে? সে কিছু করতে পারবে।
তাকে তুমি বলতে পার না, লুসিলি। যদি বল, তাহলে আমার গাড়িতে কি করছিলে বলবে? সমুদ্রের ধারে কি করছিলে বলবে? সমুদ্রের ধারে তুমি ও আমি ছিলাম এবং পোশাক খুলে সাঁতার কাটছিলাম কি করে বুঝিয়ে বলবে? আমার মনে হত যে তোমার স্বামী কিছু পারবে তবে তোমার সঙ্গে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতাম, কিন্তু তিনি কিছুই পারবেন না। যদি কিছু বল তবে বিবাহ বিচ্ছেদ এবং আমিও চাকরী হারাব।
এক দৃষ্টিতে সে আমার দিকে চেয়ে রইল; পরে জোর গলায় বলল, জেলে যাওয়ার চেয়ে বিবাহ–বিচ্ছেদ ভাল। রোজার আমাকে জেলে যেতে দেবে না। আমার প্রভাব দারুণ। আমার বিশ্বাস সে আমাকে জেলে যেতে দেবে না।
তার দেহে আস্তে নাড়া দিলাম।
লুসিলি, তুমি বাচ্চার মত কথা বলছ।
সে কিছুতেই লোকমুখে বলাবলি করতে দেবে না যে তার স্ত্রী জেলে গিয়েছে।
তুমি বুঝতে পারছ না ঘটনাটা কি ভয়ানক, শান্তভাবে বলার চেষ্টা করলাম, তুমি পুলিশের লোককে মেরেছ, এটা অ্যাকসিডেন্ট, তোমার লাইসেন্স নেই। পুলিশ না হয়ে অন্য কাউকে মারতে, তোমার স্বামী সেটাচাপা দিতে পারতেন। কিন্তু আইসেনহাওয়ারের চেয়ে তার যদি বেশি প্রভাব থাকে এবং নিশ্চয়ই তার নেই, সেই অবস্থায় তিনি কিছুই করতে পারবেন না।
তুমি বলতে চাও জেলে যেতে হবে? ভয়ে তার তাজা তরুণ সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেল।
আমার দিকে চেয়ে সে তার ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। লুসিলি মাথা নাড়ল।
ঠিক আছে, এবার এস। তোমাকে বাড়ি রেখে আসি।
সে উঠে দাঁড়িয়ে সদর দরজার কাছে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
আমরা কি গাড়িতে যাচ্ছি না, চেস? মনে হয় না যেতে পারব গাড়িটায়।
আমার আর একটা গাড়ি আছে। হাতটা বাহুতে রেখে বারান্দার দিকে আসতে সাহায্য করলাম।
হলঘরের আলোটা নিভিয়ে সদর দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম; সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তখন শুনতে পেলাম, এই যে, এটা আপনার গাড়ি?
আমি বেশ চমকে উঠেছিলাম। লুসিলি জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে শুনতে পেলাম; উপস্থিত বুদ্ধি তখনও কাজ করছিল–সে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াল অন্ধকার বারান্দায়, যাতে দেখা না যায়।
নিচে গেটের কাছে একজন লোক দেখতে পেলাম। অন্ধকারে শুধু বোঝা যাচ্ছিল যে সে দীর্ঘকায় ও মোটা। সিবোর্নের পন্টিয়াকটার পিছনে একটা বুইক কনভারটিবল দাঁড়িয়েছিল। পন্টিয়াকটার পিছনের আলো এটার বনেটে পড়েছিল।
লুসিলিকে চাপা গলায় বললাম, যেখানে আছ সেখানেই থাক। বলে নিচে নেমে মানুষটার সামনে এলাম।
সে বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, বিরাট গোঁফ এবং বেশ হাসিখুশি মুখ হুইস্কির মত লাল। ভেবেছিলাম আপনি আমাকে দেখেছেন। এটা কি জ্যাক সিবোর্নের গাড়ি নয়?
হ্যাঁ, আমি এটা ধার নিয়েছি, আমারটা ভাল করতে পাঠিয়েছি।
আপনি স্কট?
হা।
হাতটা বাড়িয়ে দিল। পরিচিত হয়ে খুব আনন্দিত, আমি টম হ্যাকেট। জ্যাক কখনও আমার নাম উল্লেখ করেছে কিনা জানি না। আপনার নাম অবশ্য অনেকবার আমার কাছে বলেছে। এই পথে যাচ্ছিলাম, দেখতে এলাম বুড়োটা এসেছে কিনা।
তার সঙ্গে করমর্দন করতে করতে ভাবছিলাম লুসিলিকে দেখেছে কিনা। হলঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসছিলাম তখন সেখানে আলো জ্বলছিল।
না, জ্যাক আগস্টের আগে এখানে আসবে না, কখনই আগে আসে না।
একটা চান্স নিলাম। আমি পাম–বের পথে যাচ্ছিলাম। পারাডাইশো হোটেলে কয়েক সপ্তাহ ছিলাম। আমার স্ত্রী ট্রেনে কাল সকালে আসবে। সে গাড়িতে বেশিদূর যেতে পারে না তার অসুখ করে। আমার অবশ্য এতে কিছু এসে যায় না। ভেবেছিলাম জ্যাক এখানে আছে, বেশ গল্পগুজব ও ড্রিংক করা যাবে।
আগস্টের আগে সে তো এখান আসবে না।
হ্যাঁ, আপনি তো তাই বললেন। যদি আপনার কাজ না থাকে তবে চলুন না কোথাও গিয়ে ড্রিংক করা যাক। রাতটা বেশ সুন্দর।
পারলে খুব খুশী হতাম, কিন্তু আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
আচ্ছা, আমার মনে হয়েছিল দুজনে একটা ছোটখাট পার্টি করতে পারি, তাই না? পন্টিয়াকটার দিকে চেয়ে বলল, পুরোন বাস, ভাল চলে?
খুব ভাল
আপনার যখন কিছুই করার নেই চলুন না আমাদের ওখানে। প্যারাডাইশো, সুন্দর জায়গা, বেশ স্ফুর্তি করা যাবে। গার্ল ফ্রেন্ডকেও নিয়ে আসতে পারেন। ঠিক আছে, আজ এই পর্যন্ত।
সে হাত নেড়ে গাড়িতে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গেটের লোহার বড় রডটা আঁকড়ে ধরেছিলাম। হৃৎপিণ্ডটা কাঁপছিল।
কাঁপা গলায় লুসিলি বলল, ও আমাকে দেখেছে?
আমার সঙ্গে একটি মেয়ে আছে এটা সে দেখেছে। কিন্তু তোমাকে সে চিনতে পারেনি, ভয় পাবার কিছু নেই।
তার হাত ধরে পন্টিয়াকের ভিতরে এসে ঢুকলাম।
সে মৃদু গলায় বলল, তুমি ঠিক বলছ যে রোজারকে কিছু বলব না?
তার কাঁধে হাত রেখে আস্তে একটা নাড়া দিয়ে, কখনই বলবে না। তিনি তোমার জন্যে কিছুই করতে পারবেন না। যদি তাঁকে বল তাকেও একই পথে ঠেলে দেবে। এটা কি বুঝতে পারছ না? পুলিশের হাতে তোমাকে তুলে না দিলেও একটা শান্তি অন্ততঃ দেবেন। সমস্ত ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও। কি করতে হবে সব কাল তোমাকে বলব।
সে কাঁদতে শুরু করল। জোরে পাম বুলেভার্দের দিকে গাড়ি চালালাম।
.
০২.
আমি বড় রাস্তায় সারি সারি গাড়ির পিছনে এসে পড়লাম। যেগুলো একটু একটু করে শহরের দিকে যাচ্ছিল। এত ভয়ানক ট্রাফিক জাম আগে কখনও দেখিনি। পুলিশের লোকটা মারা যাওয়ার জন্যেই এরকমটা হয়েছে।
সামনে কি হচ্ছে দেখতে পেয়ে লুসিলি কান্না থামাল।
ব্যাপারটা কি?
জানি না? চিন্তা করার কিছু নেই।
একটু একটু করে এগোতে লাগলাম। ঘড়িতে দেখলাম বারটা বেজে দশ তার বাড়ি পৌঁছতে এখনও প্রায় দু মাইল বাকী।
হঠাৎ সামনের গাড়িগুলো একেবারে থেমে গেল। পুলিশের একজন লোক হাতে জোরালো ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে গাড়ির সারি ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল এবং যাবার সময় প্রত্যেকটি গাড়ির উপর আলো ফেলছিল।
আমার গা ঘামে ঠাণ্ডা।
লুসিলি ভয়ে ভয়ে, এরা আমার খোঁজ করছে, বলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল।
তার হাত চেপে বললাম, চুপ করে বস। ওরা তোমার খোঁজ করছে না। ওরা গাড়িটা খুঁজছে। চুপ করে বসে থাক।
পুলিশের একজন কাছে এগিয়ে আসতে সে একটুও না নড়ে যথেষ্ট বুদ্ধির পরিচয় দিল।
আমাদের ঠিক সামনের গাড়ি থেকে একজন দীর্ঘকায় চওড়া কাঁধের মানুষ বেরিয়ে পুলিশকে বলল, এসব কি ব্যাপার? আমি পাম বে–তে যেতে চাই। আপনারা এই রাস্তা পরিষ্কার রাখতে পারেন না?
পুলিশের লোকেরা তার উপর আলোটা ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে বললেন, যদি তাই মনে হয় থানায় গিয়ে অভিযোগ করুন। যখন সব ঠিক হবে, আমরা আপনাদের যেতে দেব, তার আগে নয়।
তখন বিরাট চেহারার লোকটি নরম গলায় বলল, যাই হোক ব্যাপারটা কি স্যার? খুব বেশি দেরি হবে কি?
গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে গেছে। শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়া প্রতিটি গাড়ি আমরা লক্ষ্য করছি। খুব বেশি দেরি হবে না।
আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে সে ফ্ল্যাশলাইটের আলো গাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে বাম্পারের কাছে নিয়ে এল তখন এত জোরে হুইলটা চেপে ধরলাম যে আঙ্গুলগুলো ব্যথা করল।
পুলিশের লোকটা হাতের আলোটা আমার মুখ থেকে লুসিলির মুখে ফেলল। সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।
তার বাহুতে চাপ দিয়ে বললাম, সহজভাবে নাও।
লুসিলি কিছুই বলল না।
আমার সামনের গাড়িটা চলতে শুরু করল, আমিও পিছন পিছন চলতে লাগলাম। পরে ধীরে ধীরে গাড়ির গতি বাড়ল।
ওরা আমার খোঁজ করছে, তাই না চেস?
ওটা কোথায়? যে গাড়িটা ওরা খুঁজছে।
এমন এক জায়গায় যেখানে ওরা খোঁজ পাবে না। দেখ, তুমি কি ভয় পাওয়া কমাবে?
পাম বুলেভার্দের মোড়টা পেরিয়ে এবার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। গেবলসের ফটকে বারোটা বেজে দশ মিনিটে এসে পৌঁছলাম।
গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললাম, আগামীকাল সকাল দশটায় তোমার দেখা পাচ্ছি।
লুসিলি খুব আস্তে গাড়ি থেকে বেরিয়ে, চেস! ভয় করছে, ওরা আমারই খোঁজ করছে।
ওরা গাড়িটার খোঁজ করছে। এখন মন থেকে সবকিছু মুছে ফেলল। কাল সকালের আগে আমাদের কিছু করার নেই।
কিন্তু ওরা সব গাড়িগুলো পরীক্ষা করে দেখছে। ব্যাপারটা গুরুতর। রোজারকে কি জানাব? এসব ব্যাপারে সে খুব ভাল।
না, উনি কিছু করতে পারবেন না। আমিই একা সামলে নিতে পারি। আমার ওপর বিশ্বাস রাখ।
জেলে যাওয়ার কথা আমি ভাবতে পারছি না।
তোমাকে জেলে যেতে হবে না। কাল আবার আলোচনা করা যাবে।
বেশ, তবে কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কিন্তু চেস যদি মনে কর সামলাতে পারবে না, তবে রোজারকে বলব।
আমি সবটা সামলাব। সবটা আমার উপর ছেড়ে তুমি ঘুমোতে যাও।
লুসিলি স্খলিত পায়ে বাড়ির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল।
সে অদৃশ্য হওয়ার পর পন্টিয়াকে ফিরে বাংলোর দিকে ছুটলাম।
যখন ফিরছিলাম ভয়ের একটা জগদ্দল পাথর আমার কাঁধে নিঃশব্দে এসে বসল।