০৪. স্কুল থেকে বের হয়ে

স্কুল থেকে বের হয়েই মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “আরে অক্সব্রীজ স্কুলের সায়েন্স স্যার।” আমরা দেখলাম উসখু খুশকু চুল খোঁচা খোঁচা দাড়ি একজন মানুষ আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “স্যার আপনি?”

মানুষটি বলল, “হ্যাঁ। আমি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”

“আমার জন্যে? কেন?”

“তোমার সাথে একটু কথা ছিল।”

“বলেন স্যার।”

খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটা আমাদেরকে দেখিয়ে একটু ইঙ্গিত করে বললেন, “তোমার সাথে একটু নিরিবিলি কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

ঝুম্পা মুখ শক্ত করে বলল, “বলিস না মিঠুন। খবরদার একা একা নিরিবিলি কথা বলবি না। সাক্ষী রেখে কথা বলবি।”

মিঠুনের সায়েন্স স্যার অবাক হয়ে ঝুম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সাক্ষী রেখে কথা বলবে?”

“হ্যাঁ। এখন থেকে মিঠুন আর একা একা কারো সাথে কথা বলবে না।”

মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “জী স্যার। এরা সবাই আমার বন্ধু। আপনি এদের সামনে কথা বলতে পারেন।”

সায়েন্স স্যার বললেন, “কিন্তু কথাগুলো খুব সেনসিটিভ।”।

মিঠুন বলল, “সমস্যা নাই। আমার এই বন্ধুরাও খুব সেনসিটিভ ”

আমরা জোরে জোরে মাথা নাড়লাম আর সায়েন্স স্যার কেমন যেন ঘাবড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে মানে, আমি আমাদের স্কুলের সেই এক্সপ্লেশনটার ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”

“বলেন।”

“স্কুলটা খোলার জন্যে ডিসিশন নেয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দিচ্ছে না। বলছে-” স্যার থেমে গিয়ে এদিক সেদিক তাকালেন।

“কী বলছে?”

“মানে ইয়ে একপ্লোশনে যে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করা হয়েছে সেটার মাঝে ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টদের এক্সপ্লেসিভের একটা মিল আছে। তারা সন্দেহ করছে–”

“কী সন্দেহ করছে?”

“না মানে ইয়ে বলছিলাম কী—” সায়েন্স স্যার ইতস্তত করে বললেন, “আমরা সবকিছু বলেছি, কিন্তু পুলিশ বিশ্বাস করতে চাইছে না। বলছে ক্লাশ এইটে পড়ে একটা ছেলের পক্ষে এটা করা সম্ভব না। নিশ্চয়ই কোনো বড় মানুষ আছে।”

ঝুম্পা বলল, “মিঠুন তুই কোনো কথা বলবি না। খালি শুনে যা।”

আমরাও জোরে জোরে মাথা নাড়লাম, “শুনে যা। খালি শুনে যা।”

সায়েন্স স্যার মনে হয় আরো একটু ঘাবড়ে গেলেন, বললেন, “তুমি যদি পুলিশকে একটু বুঝিয়ে বল কেমন করে করেছ। বিশেষ করে কেন করেছ”।

ঝুম্পা আবার গম্ভীর গলায় বলল, “খবরদার মিঠুন, তুই একটা কথাও বলবি না। একটা কথাও না।”

স্যার বলল, “ঠিক আছে পুলিশকে বলতে হবে না। খালি আমাকে বল কেন করেছ। কী উদ্দেশ্য–আমি চিন্তা করে পাই না।”

ঝুম্পা বলল, “বলবি না।”

স্যার বলল, “আমি কথা দিচ্ছি কাউকে বলব না। কাউকে না।

ঝুম্পা বলল, “খবরদার মিঠুন তুই একটা কথা বলবি না। তুই এখন আর অক্সব্রীজ স্কুলে পড়িস না। এখন তুই আমাদের স্কুলে পড়িস। (ঝুম্পা আমাদের কথাটা বলার সময় বুকে একটা থাবা দিল) তোর ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব এখন আমাদের (আবার বুকে থাবা। আমাদের পারমিশান ছাড়া তুই যদি একটা কথা বলিস অমর! তোর ঠ্যাঙ্গ ভেঙ্গে দিব (হাত মুঠি করে ঘুষি দেওয়ার ভঙ্গি)।”

মিঠুন তার সায়েন্স স্যারের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা না বলে একবার ঘাড় ঝাকুনী দিল। সায়েন্স স্যার তখন দাঁড়িয়ে পড়লেন, আমরা হেঁটে হেঁটে চলে এলাম।

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাটতে একজন একজন করে সবাই নিজেদের বাসার দিকে চলে গেল, থেকে গেলাম শুধু আমি আর মিঠুন। আমি মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোর বাসা কোথায়?”

“ঐ তো কাজী বাড়ীতে।”

“কাজী বাড়ী তো পিছনে ফেলে এলাম।”

“জানি। এতো তাড়াতাড়ি বাসায় গিয়ে কী করব তাই তোর সাথে একটু হাঁটি।”

“আমার বাসায় যাবি?”

“বাসার লোকজন বিরক্ত হবে না তো? বড় মানুষেরা ছোটদের দেখলে খুব বিরক্ত হয়।”

“না হবে না। আমার বাসায় কোনো লোক টোক নাই।”

“কোনো লোক নাই?”

“না। খালি আমার বাবা আর আমি।”

“তোর মা?”

“মরে টরে গেছে মনে হয়। বাবা কিছু বলে না, আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি না।”

কথাটা সত্যি না। আসলে আমি যখন ছোট তখন আমার মা বাবাকে ছেড়ে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে গেছে। সেই কথাটা বলতে লজ্জা করে দেখে কাউকে বলি না।

মিঠুন তার ঠোঁট সূঁচালো করে শীষ দেওয়ার চেষ্টা করল, শীষের শব্দ হয়ে বাতাস বের হওয়ার একটা শব্দ হল। বলল, “তোর বাবা কী করে?”

“কিছু করে টিরে না।”

“তাহলে?”

“তাহলে কী?”

“তোদের চলে কেমন করে?”

“চলে টলে না।”

মিঠুন খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হি হি করে হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল, “তোর কী মজা।”

মিঠুনের এই কথাটা অবশ্যি সত্যি। আমার বয়সী অন্য যে কোনো ছেলের থেকে আমার জীবন বেশী মজার। বাবা একটু আধপাগলা ধরণের মানুষ, আমার মনে হয় মা সেজন্যেই বাবাকে ছেড়ে চলে গেছে। শহরে আমাদের একটা দোতলা বাসা আছে নিচের তলাটা ভাড়া দেওয়া আছে, দোতালায় আমরা থাকি। ভাড়ার টাকা দিয়ে আমাদের টেনে টুনে দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে বাবা টাকা কামাই করার জন্যে কিছু একটা করার চেষ্টা করে, তখন টাকা পয়সা নষ্ট হয়, টাকা পয়সার টানাটানি হয়। বাবা আমাকে কিছুই বলে না আমি যেটা ইচ্ছা হয় করি। আমিও বাবাকে কিছু বলি না বাবার যেটা ইচ্ছা হয় করে।

মিঠুনকে নিয়ে দোতালায় এসে দেখলাম দরজা খোলা, তার মানে বাবা বাসায়।

বাবা বাইরের ঘরে সোফায় আধাশোয়া হয়ে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখছিল। আমাকে দেখে বলল, “দশ বলে ষোল রান দরকার, হেরে যাবে মনে হয়।”

কার সাথে কার খেলা, দশ বলে ষোল রান না হলে কেন হেরে যাবে আমি বুঝতে পারলাম না বোঝার চেষ্টাও করলাম না। আমার সাথে যে মিঠুন একটা নূতন ছেলে এসেছে মনে হয় বাবা সেটা লক্ষও করেনি। আমি বললাম, “বাবা এই যে মিঠুন। আমাদের ক্লাশে পড়ে।

বাবা টেলিভিশন থেকে চোখ না তুলে বলল, “নো বল হয়েছে। দশ বলে, পনেরো রান।”

আমি মিঠুনকে বললাম, “আয় উপরে যাই।”

মিঠুন বলল, “চল।”

আমাদের বাসার মাঝে ছাদটা একটু খোলামেলা, আমার কিছু করার না থাকলে ছাদে এসে শুয়ে থাকি। দিনের বেলা মেঘ আর রাত্রে তারা দেখি। ছাদে একটা চিলেকোঠা আছে, এই ঘরটা আমার নিজস্ব। মেঝেতে একটা মাদুর বিছানো আছে। পাশে একটা পুরানো শেলফে কিছু গল্পের বই। দেওয়ালে ছবি, রং দিয়ে সরাসরি দেওয়ালে আঁকা হয়েছে। ঘরটি আমার নিজস্ব— তাই বাইরের কেউ আসে না, এলে দেওয়ালের ছবি দেখে নিশ্চয়ই ভয় পেতো। প্রথম ছবিটি একজন মানুষের, সে বুক কেটে তার হৃৎপিণ্ডটি টেনে বের করে আনছে, মানুষটার মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন, হাতে পায়ে রক্ত। দ্বিতীয় ছবিটা একটা পিশাচের, থমথমে মুখ শুধু চোখ দুটি ভয়ংকর। ঠোটের পাশ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তৃতীয় ছবিটা একজন মানুষের, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে, জিবটা বের হয়ে আছে।

মিঠুন ছবিগুলো দেখে ভয় পেলো না, চমৎকৃত হল। বলল, “তুই খুব ভালো আঁকিস। তার থেকে ইম্পরট্যান্ট কী জানিস?”

“কী? “তোর আইডিয়াগুলো ভালো। এরকম আইডিয়া আমি দেখি নাই।” আমি বললাম, “তোকে এখানে এনেছি কেন জানিস?”

“কেন?”

“কেন?”

“এটা আমার ঘর। তোকে এই ঘরটা দেখাতে এনেছি।”

“দেখলাম।”

“এই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ আসে না।”

মিঠুন দেওয়ালের ছবিগুলো দেখিয়ে বলল, “কেউ আসলেও ভয়ে পালাবে।”

আমি বললাম, “তোর এই ঘরটা পছন্দ হয়?”

“হবে না কেন?”

“তোকে আমি এই ঘরটা দিয়ে দিলাম। তুই ইচ্ছা করলে এইখানে তোর ল্যাবরেটরি বানাতে পারিস।”

মিঠুন জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল। বলল, “সত্যি?”

“সত্যি।”

“আমার ল্যাবরেটরি?”

“হ্যাঁ। তোর ল্যাবরেটরি।”

“কেউ কিছু বলবে না? টান দিয়ে যন্ত্রপাতি, ক্যামিকেল নালায় ফেলে দিবে না?”

মিঠুনের তখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, মাথা নেড়ে বলল, “আমার নিজের ল্যাবরেটরি?”

“হ্যাঁ। তোর নিজের ল্যাবরেটরি।”

মিঠুনকে আমরা কয়েকদিন হল দেখছি, চোখে চশমা মাথায় এলোমেলো চুল গম্ভীর মুখ দেখে কেমন যেন বড় মানুষের মতো মনে হয়। আমাদের চিলেকোঠায় সে তার ল্যাবরেটরি বসাতে পারবে শুনে প্রথমবার তার মুখে সত্যিকারের একটা হাসি ফুটে উঠল আর তাকে একটা বাচ্চা ছেলের মতো দেখাতে লাগল : মিঠুন ঘরটার ভিতরে কয়েকবার হেঁটে তার পকেট থেকে শিশিটা বের করে বলল, “আমি তাহলে ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা এই খানে রেখে যাই?”

“রেখে যা।”

“কেউ নিবে না তো?”

“না কেউ নিবে না। এটা একটা নেওয়ার মত জিনিষ না।”

মিঠুন গম্ভীর মুখে বলল, “শিশিটা পড়ে ভেঙে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”

“ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” বলে আমি আমার ছোট একটা বাক্স এনে শিশিটাকে কাপড়ে জড়িয়ে বাক্সের ভিতরে রেখে দিলাম, বললাম। এখন এটা পড়ে ভেঙ্গে যাবে না।”

 

পরদিন ক্লাশে বসে মিঠুন তার খাতায় আঁকিবুকি করতে করতে বিড় বিড় করে নিজের সাথে কথা বলতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ তোর কী হয়েছে? কার সাথে কথা বলছিস?”

মিঠুন বলল, “কারো সাথে না। ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা কীভাবে টেস্ট করব ঠিক করছি।”

“কীভাবে করবি?”

“জিনিষটার ভর বের করতে হবে। তাপমাত্রা, তাপ পরিবহন, রেজিস্ট্যান্স এগুলো সব বের করতে হবে। কেমন করে বের করা যায় তাই দেখছি।”

“কেমন করে বের করবি?”

“এখনো জানি না, কিছু যন্ত্রপাতি লাগবে।”

“যন্ত্রপাতি কোথায় পাবি?”

মিঠুন মাথা চুলকালো, “এখনো জানি না। কিনতে হবে।”

এটা ছিল বিজ্ঞান ক্লাশ আর এরকম সময় বিজ্ঞান স্যার ক্লাশে ঢুকলেন! স্যারের নাম আক্কাস আলী, আমরা ডাকি কালা পাহাড়–কারণ আক্কাস আলী কালো এবং পাহাড়ের মত বড়। স্যার ক্লাশে এসে সাধারণত একটু কষ্ট করে চেয়ারের দুই হাতলের ফাঁক দিয়ে নিজের শরীরটা ঢুকিয়ে বসে পড়েন। তারপর মুখ হা করে ঘুমিয়ে যান, বিচিত্র শব্দ করে তার নাক ডাকতে থাকে।

আজকে কী হল কে জানে কাল পাহাড় স্যার, একটা বেত নিয়ে ক্লাশে ঢুকলেন আর কষ্ট করে চেয়ারে ঢুকে না গিয়ে ক্লাশের সামনে দাঁড়িয়ে নানারকম শব্দ করে হুংকার দিতে লাগলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন, “তোরা সবাই লেখা পড়া করিস তো?”

আমরা মাথা নাড়লাম। স্যার হাতের বেত দিয়ে টেবিলে চটাশ করে মেরে বললেন, “আর লেখাপড়া করবি কেমন করে? কী পড়বি? বইয়ের মাঝে সব ভুলভাল লেখা।”

বইয়ের মাঝে ভুলভাল কী লেখা আমার জানার ইচ্ছে করছিল কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। তখন কালা পাহাড় স্যার নিজেই বললেন, “তোদের বইয়ে লেখা ভারী আর হালকা জিনিষ ছেড়ে দিলে নাকী দুইটা একসাথে নিচে পড়বে। এটা কখনো সম্ভব?”

আমরা চুপ করে রইলাম শুধু মিঠুন মিহি গলায় বলল, “সম্ভব।”

কপাল ভালো কালাপাহাড় স্যার মিঠুনের কথা শুনতে পেলেন না। আমরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। স্যার বললেন, “ভারী জিনিষ আগে পড়ে হালকা জিনিষ পড়ে পরে। দুনিয়ার সবাই এই কথা জানে। আর বইয়ে পুরা উল্টা কথা লেখা। তাজ্জবের ব্যাপার।”

মিঠুন চিকন গলায় বলল, “একসাথে পড়ে।”

কালাপাহাড় স্যার এবার মিঠুনের কথা শুনে ফেললেন, চমকে উঠে বললেন, “কে? কে কথা বলে?”

মিঠুন বলল, “আমি স্যার।”

স্যার এবারে প্রথম মিঠুনকে দেখতে পেলেন, তারপর বাঘ যেভাবে হরিণকে ধরে কিংবা বিড়াল যেভাবে ইদুরকে ধরে কিংবা টিকটিকি যেভাবে পোকাকে ধরে ঠিক সেইভাবে মিঠুনের দিকে এগিয়ে এলেন, বললেন, “তুই কী বলেছিস?”

“আমি বলেছি ভারী জিনিষ আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে।”

স্যার শূন্যে শপাং করে বেতটা মেরে হুংকার দিলেন, “কোনদিন দেখেছিস একসাথে পড়তে?”

“বাতাসের বাধা—”

“ফালতু কথা। বাতাসের আবার বাধা কী?” স্যার হুংকার দিলেন, “বেরিয়ে আয় আজকে তোকে বেতিয়ে সিধে করে দেব। বাতাসের বাধা বের করে ছাড়ব।”

মিঠুন কোনো কথা বলল না, কাঠ হয়ে বসে রইল।

“বের হয়ে আয় বলছি, আজ তোকে দেখাচ্ছি মজা।”

মিঠুন ঢোক গিলে আমার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “মারবে নাকী আমাকে?”

“হ্যাঁ।”

“ব্যথা লাগবে?”

“হ্যাঁ।” “বেশী?”

“শরীরটা শক্ত করে রাখিস না। ঢিলে ঢালা করে রাখিস তাহলে ব্যথা একটু কম লাগবে।”

কালাপাহাড় স্যার আবার হুংকার দিলেন, “বের হয়ে আয়।”

মিঠুন বের হয়ে এগিয়ে গেল, স্যার মিঠুনকে মারার আগে বেতটা বাতাসে শপাং করে মেরে একবার প্র্যাকটিস করে নিলেন, তারপর দাঁত মুখ খিচিয়ে এগিয়ে গেলেন, মিঠুন দুই হাত উপরে তুলে বলল, “স্যার, স্যার একটা কথা।”

“কী কথা?”

“আমি যদি আপনাকে দেখাই ভারী আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে তাহলে কী—”

“আমাকে দেখাবি?”

“জী স্যার।”

“দেখা।”

মিঠুন মাথা চুলকাল, বলল, “একটু সময় লাগবে স্যার।”

কালাপাহাড় স্যার ভুরু কুঁচকে বললেন, “সময় লাগবে?”

“জী স্যার।”

“কতোক্ষণ?”

“কয়েকদিন

কয়েকদিন শুনে স্যার আবার বেত তুললেন, বাতাস শপাং করে মেরে আরেকবার প্র্যাকটিস করলেন তারপর এগিয়ে এলেন। মিঠুন বলল, “স্যার, স্যার, স্যার”

“কী হল?”

“কয়েকদিন সময় আর স্কুলের ল্যাবরেটরি রুমটা লাগবে তাহলে আপনাকে পরীক্ষা করে দেখাতে পারব স্যার।”

আমরা মিঠুনের সাহস দেখে অবাক হলাম, কালাপাহাড় স্যার মনে হয় আরো বেশী অবাক হলেন। মিঠুনের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ করে তার মনে হতে লাগল যে তাকে আগে কোনোদিন দেখেননি। জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কে? কোথেকে এসেছিস?”

“আমার নাম মিঠুন স্যার, আমি স্যার নূতন এসেছি।”

“আগে কোন স্কুলে ছিলি?”

“অক্সব্রীজ।” কালাপাহাড় স্যার এবারে চমকে উঠেলেন, “অক্সব্রীজ?”

“জী স্যার।”

স্যার কিছুক্ষণ মিঠুনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “অক্সব্রীজ ছেড়ে এই স্কুলে কেন?”

মিঠুন চুপ করে রইল।

কালাপাহাড় স্যার আবার হুংকার দিলেন, “কেন?”

“আমাকে বের করে দিয়েছে।”

“কেন?”

“ল্যাবরেটরি ক্লাশে একটা গোলমাল হয়েছিল।”

“সেইজন্যে বের করে দিল? কী রকম স্কুল এইটা? মিঠুন বলল, “খুবই ফালতু স্কুল স্যার।”

কালাপাহাড় স্যারের মনে হল এই উত্তরটা খুবই পছন্দ হল, স্যার দুলে দুলে হে হে করে হাসলেন। বললেন, “ফালতু স্কুল?”

“জী স্যার।”

“কেন?”

আমরা দেখলাম মিঠুন তার মাথা চুলকাচ্ছে, মনে হয় ভালো একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “চিন্তার স্বাধীনতা নাই।”

“চিন্তার স্বাধীনতা? সেইটা আবার কী জিনিষ?”

“যেমন মনে করেন স্যার বইয়ে লেখা আছে ভারী আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে। কিন্তু আমরা স্যার এই ক্লাশে আলোচনা করছি যে ভারী আর হালকা জিনিষ একসাথে পড়ে না। ভারী জিনিষটা আগে পড়ে। এইযে সার এইটা হচ্ছে চিন্তার স্বাধীনতা। যেটা সত্যি না সেইটাও আলোচনা করা যায়।”

কালাপাহাড় স্যার আবার গরম হয়ে উঠলেন, বললেন, “কে বলেছে। এটা সত্যি না?”

মিঠুনটা কতো বড় গাধা, চুপচাপ থাকলেই বেঁচে যায়, কিন্তু চুপচাপ থাকল না, বলল, “স্যার আমি বলেছি।“

কালাপাহাড় স্যার চোখ লাল করে তাকালেন, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, মিঠুন তার আগেই বলল, “স্যার আপনি বলেছেন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাতে।”

“আমি বলেছি?”

“জী স্যার। আমি দেখাব।”

“আর যদি দেখাতে না পারিস?”

“পারব স্যার।” মিঠুন আমতা আমতা করে বলল, “শুধু-”

“শুধু কী?”

“শুধু ল্যাবরেটরি ক্লাশটা যদি আমাদের ব্যবহার করতে দেন।”

“ল্যাবরেটরি ক্লাশ?”

মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “জী স্যার। সব সময় তালা মারা থাকে। আমি খোজ নিয়েছিলাম অফিস থেকে বলেছে চাবি নাকী হারিয়ে গেছে।”

কালাপাহাড় স্যার মুখ শক্ত করে বললেন, “মোটেও চাবি হারায় নাই। আমার কাছে আছে।”

“তাহলে স্যার আমাদেরকে যদি দেন তাহলে আমরা ল্যাবরেটরিটা পরিষ্কার করে ফেলব। জানালা দিয়ে দেখেছি স্যার ভিতরে অনেক ময়লা। মাকড়শার জাল। কবুতরের বাসা। পরিষ্কার করে স্যার আপনাকে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখাব যে ভারী আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে।”

আমরা ভেবেছিলাম কালাপাহাড় স্যার প্রচণ্ড রেগে মিঠুনকে পেটাতে শুরু করবেন, কিন্তু স্যার কিছুই করলেন না, খানিকক্ষণ মিঠুনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুই বলছিস অক্সব্রীজ খুবই ফালতু স্কুল?”

“জী স্যার। আমি ঐ স্কুলে ছিলাম স্যার। আমি জানি।”

“আমরা আরো ভাবতাম খুব বুঝি ভালো স্কুল।”।

আমরা দেখলাম মিঠুন মিচকে শয়তানের মত বলল, “না স্যার খুবই ফালতু স্কুল।“

মহব্বত জান স্কুলের ছাত্ররা আমরা যেরকম অক্সব্রীজ স্কুলকে হিংসা করি, আমাদের স্যারেরাও হিংসা করেন। তাই দেখলাম কালাপাহাড় স্যার দুলে দুলে হাসলেন, বললেন,“ফালতু স্কুল। হে হে হে!”

মিঠুন বলল, “তাহলে স্যার ল্যাবরেটরি রুমের চাবিটা?”

আমরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না যখন শুনলাম কালাপাহাড় স্যার বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে নিস। কিছু ভাংবি না তো?”

মিঠুন জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না স্যার ভাংব না।”

“চুরি করবি না তো?”

“না স্যার চুরি করব না।”