চতুর্থ পরিচ্ছেদ – সোনাপোকা
সেদিন বেলা তৃতীয় প্রহরে উৎসবকারীরা ক্লান্ত দেহে এবং ঈষৎ মদমত্ত অবস্থায় স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিল। মাঠের মাঝখানে ইক্ষুযন্ত্রটি নিঃসঙ্গভাবে দণ্ডায়মান ছিল; কেবল কয়েকটা কাক ও শালিক পাখি তখনও আখের ছিবড়ার মধ্যে মাদকদ্রব্য অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল।
গোপা ও রঙ্গনা আপন কুটিরে ছিল। বেলা পড়িয়া আসিতেছে দেখিয়া গোপা মেয়েকে ডাকিল— ‘রাঙা, আয় তোর চুল বেঁধে দিই।’
রঙ্গনা মায়ের সম্মুখে আসিয়া বসিল। গোপা তাহার চুলে তেল দিল, কাঁকই দিয়া চুল আঁচড়াইয়া সযত্নে বেণী রচনা করিল। তারপর কানড় সাপের ন্যায় দীর্ঘ বেণী জড়াইয়া জড়াইয়া কবরী বাঁধিয়া দিল। পক্ক তাল ফলের ন্যায় সুপুষ্ট কবরী রঙ্গনার মাথায় শোভা পাইল।
চুল বাঁধিয়া গোপা নিজের আঁচল দিয়া রঙ্গনার মুখখানি অতি যত্নে মুছিয়া দিয়া ললাটতটে খদিরের টিপ পরাইয়া দিল, স্নেহক্ষরিত চক্ষে অনিন্দ্যসুন্দর মুখখানি দেখিয়া গণ্ডে একটি চুম্বন করিল।
রঙ্গনা মায়ের এমন স্নেহার্দ্র কোমলভাব কখনও দেখে নাই, সে লজ্জা পাইল। সে কেমন করিয়া জানিবে তাহার মায়ের মনের মধ্যে কী হইতেছে। গোপার মন আশায় আকাঙ্ক্ষায় অধীর হইয়া উঠিয়ছিল; তাহার যেন আর ত্বর্ সহিতেছিল না। কবে আসিবে রঙ্গনার বর? এখনি আসে না কেন? চাতক ঠাকুরের কথা শুনিয়া অবধি সে কেবলই মনে মনে দেবতার উদ্দেশে বলিতেছিল— ‘ঠাকুর, আমাকে যত ইচ্ছে শাস্তি দাও, কিন্তু রাঙা যেন সুখী হয়!’
মাতার পদধূলি মাথায় লইয়া রঙ্গনা সলজ্জ চক্ষু তুলিল— ‘মা, পলাশবনে আল্তা-পোকা খুঁজতে যাই?
গোপা বলিল— ‘তা যা। ঘটি নিয়ে যাস, একেবারে বাথান থেকে দুধ দুয়ে ফিরবি।’
রঙ্গনা ঘটি লইয়া পলাশবনের দিকে চলিল। আজ পূর্বাহ্ণে চাতক ঠাকুরের সহিত সাক্ষাতের পর হইতে তাহার মনেও যেন কোন মধুর ভবিতব্যতার বাতাস লাগিয়াছে। মন উৎসুক উন্মুখ, প্রাতঃকালের বিষণ্ণ বিরসতা আর নাই।
বনে প্রবেশ করিয়া রঙ্গনা দেখিল, সেখানে আরও কয়েকটি গ্রাম্যযুবতী উপস্থিত হইয়াছে; তাহারাও দোহনপাত্র লইয়া আসিয়াছে, বাথানে গো-দোহন করিয়া ঘরে ফিরিবে। কারণ, উৎসব উপলক্ষে আর সব কাজ বন্ধ রাখা চলে, গো-দহন না করিলে নয়। যুবতীদের সকলেরই একটু প্রগল্ভ অবস্থা, ইক্ষুরসের প্রভাব এখনও দূর হয় নাই। তাহারা রঙ্গ-রসিকতার ছলে পরস্পরের গায়ে হাসিয়া ঢলিয়া পড়িতেছে; স্খলদঞ্চলা হইয়া দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। তাহাদের মধ্যে যে চটুল বাক্-চাতুর্যের বিনিময় হইতেছে তাহাতে আদিরসের ব্যঞ্জনাই অধিক।
রঙ্গনা তাহাদের দেখিয়া একটু থতমত হইল। কিন্তু পলাশবন বিস্তীর্ণ স্থান, সে তাহাদের এড়াইয়া অন্যদিকে গেল। যুবতীরা রঙ্গনাকে দেখিয়াছিল; তাহারা চোখ ঠারাঠারি করিয়া নিম্নকণ্ঠে হাস্যালাপ আরম্ভ করিল।
তাহাদের ভাঙা ভাঙা হাসির শব্দ রঙ্গনার কানে আসিতে লাগিল। উহারা যে তাহার সম্বন্ধেই আলোচনা করিতেছে তাহা বুঝিয়া রঙ্গনার গাল দুটি উত্তপ্ত হইল; কিন্তু সে তাহাদের ছাড়িয়া বেশি দূরেও যাইতে পারিল না। এই সমবয়স্কা যুবতীদের প্রতি তাহার মনে কোনও বিদ্বেষ ভাব ছিল না; বরং তাহাদের সহিত মিশিয়া তাহাদের সঙ্গসুখ লাভ করিবার গভীর ক্ষুধা তাহার অন্তরে ছিল, কিন্তু তবু উপযাচিকা হইয়া তাহাদের সমীপবর্তিনী হইবার হঠতাও তাহার ছিল না। সারাজীবনের একাকিত্ব তাহাকে ভীরু করিয়া তুলিয়াছিল।
লাক্ষাকীটের অন্বেষণে বিমনাভাবে এদিক ওদিক ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ একটা সোনাপোকা দেখিয়া রঙ্গনা উৎফুল্ল নেত্রে সেই দিকে চাহিয়া রহিল। আবার সোনাপোকা! সুবর্ণদেহ পতঙ্গটা বোধহয় রাত্রির জন্য আশ্রয় খুঁজিতেছিল; সে একটা বৃক্ষকাণ্ডে বারবার আসিয়া বসিতেছিল, আবার উড়িয়া যাইতেছিল। তাহার সোনালী অঙ্গে আলোর ঝিলিক খেলিতেছিল।
রঙ্গনা কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া সন্তর্পণে স্কন্ধ হইতে আঁচল নামাইয়া হাতে লইল, তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইল। সোনাপোকা বা কাঁচপোকা দেখিয়া ধরিতে ইচ্ছা হয় না— এমন মেয়ে সেকালে ছিল না, একালেও নাই।
রঙ্গনা আঁচল হাতে লইয়া গাছের নিকটবর্তিনী হইতেই সোনাপোকাটা উড়িয়া গেল; কিন্তু বেশি দূর গেল না, কাছাকাছি ঘুরিতে লাগিল। রঙ্গনার মনে হইল, যে সোনাপোকা আজ সকালে তাহার চুলে বসিয়াছিল এ সেই সোনাপোকা। সে মহা উৎসাহে তাহার পিছনে ছুটাছুটি করিতে লাগিল।
যুবতীরা দূর হইতে সোনাপোকা দেখিতে পাইতেছিল না, কেবল রঙ্গনার ছুটাছুটি দেখিতেছিল। কিছুক্ষণ দেখিবার পর একটি যুবতী বলিল— ‘রঙ্গনা এমন ছুটোছুটি করছে কেন ভাই? দ্যাখ্ দ্যাখ্— ঠিক যেন বাথানিয়া গাই।’*
রসিকতা শুনিয়া অন্য যুবতীরা হাসিয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল। আর একজন বলিল,— ‘তা হবে না? অত বড় আইবুড়ো মেয়ে—!’
ওদিকে রঙ্গনা আরও কিছুক্ষণ সোনাপোকার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া অবশেষে তাহাকে আঁচল চাপা দিয়া ধরিয়া ফেলিল। চোখে মুখে উচ্ছল আনন্দ, আঁচলসুদ্ধ সোনাপোকাকে মুঠির মধ্যে লইয়া কানের কাছে আনিয়া শুনিল, মুঠির ভিতর হইতে আবদ্ধ সোনাপোকার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন আসিতেছে।
এই সময় তাহার চোখে পড়িল, যুবতীরা অদূরে আসিয়া কৌতূহল সহকারে তাহাকে নিরীক্ষণ করিতেছে। রঙ্গনা আর আত্মসম্বরণ করিতে পারিল না, ছুটিয়া তাহাদের কাছে গিয়া কলোচ্ছল কণ্ঠে বলিয়া উঠিল— ‘ও ভাই, দ্যাখো আমি সোনাপোকা ধরেছি!’
যুবতীরা কিছুক্ষণ নির্বাক হইয়া রহিল। তারপর, যে মেয়েটি বাথানিয়া গাইয়ের রসিকতা করিয়াছিল সে কথা কহিল। তাহার নাম মঙ্গলা; যুবতীদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা বাক্-চটুলা। মঙ্গলা বলিল— ‘ওমা সত্যি? তা ভাই, তুমি তো সোনাপোকা ধরবেই, তোমার তো আর আমাদের মত গুব্রে পোকার বরাত নয়। একটু দেরিতে ধরেছ, এই যা। তা কেমন সোনাপোকা ধরলে দেখি। সত্যি সোনাপোকা বটে তো?’
রঙ্গনা এই বাক্যের ব্যঙ্গার্থ বুঝিল কিনা বলা যায় না; সে মঙ্গলার কাছে গিয়া তাহার কানের কাছে সোনাপোকার মুঠি ধরিল, বলিল— ‘হ্যাঁ, সত্যি সোনাপোকা, এই শোনো না।’
মঙ্গলা মুঠির মধ্যে গুঞ্জন শুনিল। আরও কয়েকটি যুবতী কান বাড়াইয়া দিল; তাহারাও শুনিল। মঙ্গলা বলিল— ‘গুন্ গুন্ করছে বটে। তা সোনাপোকা না হয়ে ভোমরাও হতে পারে। — হ্যাঁ ভাই, সোনাপোকা ভেবে একটা কেলে-কিষ্টে ভোমরা ধরনি তো?’
‘না, সোনাপোকা।’ বলিয়া রঙ্গনা যেন সকলের প্রতীতি জন্মাইবার জন্যই অতি সাবধানে মুঠি একটু খুলিল। সোনাপোকা এই সুযোগেরই প্রতীক্ষা করিতেছিল, ভোঁ করিয়া বাহির হইয়া তীরবেগে অন্তর্হিত হইল।
রঙ্গনা বলিল— ‘ঐ যাঃ!’
যুবতীরা উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। মঙ্গলা বলিল— ‘হায় হায়, এত কষ্টে সোনাপোকা ধরলে তাও উড়ে গেল। ধরে রাখতে পারলে না? এর চেয়ে আমাদের গুব্রে পোকাই ভাল, তারা উড়ে পালায় না। কি বলিস ভাই?’ বলিয়া সখীদের প্রতি কটাক্ষ করিল।
সখীরা মুখে আঁচল দিয়া হাসিল। রঙ্গনার মুখখানি ম্লান হইয়া গেল। এতক্ষণে সে নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিল, ইহারা তাহাকে লইয়া ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করিতেছে। তাহার চোখ দুটি মাটিতে নত হইয়া পড়িল। স্খলিত আঁচলটি ধীরে ধীরে স্কন্ধের উপর তুলিয়া লইয়া সে গমনোদ্যত হইল।
মঙ্গলা কহিল— ‘দুঃখ কোরো না ভাই, তোমার কপালে আবার সোনাপোকা আসবে। যার অমন রূপ, তার কি সোনাপোকার অভাব হয়?’
রঙ্গনা তাহার প্রতি বিহ্বল দৃষ্টি তুলিয়া বলিল— ‘কী বলছ ভাই তুমি? আমি বুঝতে পারছি না।’
‘বলছি, গাঁয়ের কাউকে তো আর তোমার মনে ধরবে না। তোমার জন্যে পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্তুর আসবে।’ বলিয়া ব্যঙ্গভরে হাসিতে হাসিতে মঙ্গলা বাথানের দিকে চলিয়া গেল। অন্য যুবতীরাও তাহার সঙ্গে গেল।
রঙ্গনা কিছুক্ষণ তাহাদের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিল। তারপর একটু রাগ হইল। সে মনে মনে বলিল— ‘আসবেই তো রাজপুত্তুর!’
রঙ্গনার অদৃষ্টদেবতা অন্তরীক্ষ হইতে এই দৃশ্য দেখিয়া বোধহয় একটু করুণ হাসিলেন। যে ব্যঙ্গোক্তি অচিরাৎ সত্য-রূপ ধরিয়া দেখা দেয়, যে-কামনা সফলতার ছদ্মবেশ পরিয়া আবির্ভূত হয়, তাহার প্রকৃত মূল্য অদূরদর্শী মানুষ কেমন করিয়া বুঝিবে?
অতঃপর রঙ্গনা কিয়ৎকাল বৃক্ষশাখায় ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রমে বৃক্ষতল ছায়াচ্ছন্ন হইল। এতক্ষণে অন্য মেয়েগুলা গো-দোহন শেষ করিয়া নিশ্চয় বাথান হইতে চলিয়া গিয়াছে। রঙ্গনা নিজের দোহনপাত্রটি মাটি হইতে তুলিয়া লইয়া বাথানের দিকে পা বাড়াইয়াছে এমন সময় পিছন দিকে একটা শব্দ শুনিয়া সচকিতে ফিরিয়া চাহিল।
উত্তর দিকের তরুচ্ছায়ার ভিতর দিয়া এক পুরুষ শ্বেতবর্ণ অশ্বের বল্গা ধরিয়া আসিতেছে। বিশালকায় পুরুষ; তাহার পাশে ক্লান্ত স্বেদাক্ত অশ্বটিকে খর্ব মনে হয়। পুরুষের দেহে বর্ম চর্ম, কটিবন্ধে অসি, মস্তকে লৌহ শিরস্ত্রাণ; কিন্তু বেশবাসের পারিপাট্য নাই। কপালে ক্ষতরেখার উপর রক্ত শুকাইয়া আছে। রঙ্গনা ও পুরুষ পরস্পরকে একসঙ্গে দেখিতে পাইল। পুরুষ থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
দুইজনে কিছুক্ষণ নিষ্পলক নেত্রে পরস্পরের পানে চাহিয়া রহিল। তারপর পুরুষ অশ্বের বল্গা ছাড়িয়া দিয়া রঙ্গনার দিকে অগ্রসর হইল। রঙ্গনার বুকের মধ্যে তুমুল স্পন্দন আরম্ভ হইয়াছিল। সে সম্মোহিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মনে পড়িল, চাতক ঠাকুর দেখিয়াছিলেন, শ্বেত অশ্বপৃষ্ঠে বিশালকায় পুরুষ রণক্ষেত্র হইতে উল্কার বেগে ছুটিয়া বাহির হইতেছে। এ কি সেই অশ্বারোহী?
পুরুষ রঙ্গনার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; রঙ্গনাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া তাহার মুখমণ্ডল বিশদ হাস্যে ভরিয়া গেল। সে সহজ মার্জিত কণ্ঠে বলিল— ‘আমার ভাগ্য ভাল যে একলা তোমার দেখা পেলাম। কাছেই বোধহয় গ্রাম আছে, কিন্তু গ্রামে যাবার আমার ইচ্ছা নেই। আমি রণক্লান্ত যোদ্ধা, আমাকে কিছু খাদ্য পানীয় দিতে পার?’
রঙ্গনা মোহাচ্ছন্নের ন্যায় চাহিয়া রহিল; তারপর মুখ হইতে আপনি বাহির হইয়া আসিল— ‘তুমি কি রাজপুত্তুর?’
পুরুষের চক্ষে সবিস্ময় প্রশ্ন উঠিল। তারপর সে ঊর্ধ্বে মুখ উৎক্ষিপ্ত করিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। প্রাণখোলা কৌতুকের হাসি। মানুষটি যে স্বভাবতই মুক্তপ্রাণ, তাহা তাহার হাসি হইতে প্রতীয়মান হয়। অবশেষে সহসা হাসি থামাইয়া সে বলিল— ‘আমার পরিচয় কি কপালে লেখা আছে? ভেবেছিলাম পরিচয় দেব না। কিন্তু তুমি ধরে ফেলেছ। তবে একটু ভুল করেছ, আমি রাজপুত্র বটে, কিন্তু আপাতত রাজা।’
এই পুরুষের সহজ বাক্ভঙ্গি এবং অকপট কৌতুকহাস্য শুনিয়া রঙ্গনা অনেকটা সাহস পাইয়াছিল, প্রথম সাক্ষাতের বিহ্বলতাও আর ছিল না। তবু বিস্ময় অনেকখানি ছিল। সে পুরুষের কথার প্রতিধ্বনি করিয়া বলিল— ‘রাজা!’
পুরুষ বলিল— ‘হাঁ, গৌড়দেশের রাজা। আমার নাম— মানবদেব।’
‘কিন্তু— গৌড়দেশের রাজার নাম তো শশাঙ্কদেব।’
মানব নীরবে কিছুক্ষণ রঙ্গনার সরল সুন্দর মুখখানি দেখিয়া ধীরে ধীরে বলিল— ‘মহারাজ শশাঙ্কদেব আজ আট মাস হল দেহরক্ষা করেছেন। আমি তাঁর পুত্র। তুমি বোধহয় বিশ্বাস কর না—’
অবিশ্বাস করার মত মনের অবস্থা রঙ্গনার নয়। বিশেষত গ্রামে রাজা-রাজড়ার খবর কয়জন রাখে? কোন্ রাজা মরিল, কে নূতন রাজা হইল— এ সকল সংবাদ গ্রামাঞ্চলে বহু বিলম্বে আসে, আসিলেও বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে না। রঙ্গনা জন্মাবধি শুনিয়াছে শশাঙ্কদেব রাজা; রাজা যে মরিতে পারে, এ সম্ভাবনা তাহার মনে আসে নাই। এখন মানবের শালপ্রাংশু আকৃতির দিকে চাহিয়া তাহার মনে তিলমাত্র সংশয় রহিল না। সে যুক্তকরে বলিল— ‘মহারাজের জয় হোক।’
রাজাকে ‘জয় হোক’ বলিয়া সম্ভাষণ করিতে হয় ইহা সে চাতক ঠাকুরের কাছে পৌরাণিক গল্প শুনিবার কালে শিখিয়াছিল।
মানব হাসিল। বলিল— ‘জয় আর হল কৈ? আজ তো পরাজয় হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছি। ভাগ্যে জয়ন্ত ছিল— নইলে—’ বলিয়া মানব তাহার জয়ন্ত নামক রণঅশ্বের দিকে দৃষ্টি ফিরাইল, কিন্তু অশ্বকে দেখিতে পাইল না। তৃষ্ণার্ত অশ্ব অদূরে জলের আঘ্রাণ পাইয়া নদীর দিকে গিয়াছে।
রঙ্গনার দিকে ফিরিয়া মানব বলিল— ‘পরাজিতকে সকলে ত্যাগ করে, জয়ন্তও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তুমি ভরসা। — তোমার নাম কি?’
রঙ্গনা নাম বলিল। মানব স্মিত-প্রশংস দৃষ্টি তাহার সর্বাঙ্গে বুলাইয়া হঠাৎ গাঢ়স্বরে বলিল— ‘তোমার মত রূপসী রাজ-অবরোধেও বিরল। কপালে সিঁদুর দেখছি না; এখনও কি বিয়ে হয়নি?’
নেত্র অবনত করিয়া রঙ্গনা মাথা নাড়িল। মানব বলিল— ‘তোমাকে যত দেখছি ততই আশ্চর্য লাগছে, এই সুদূর জনপদে তুমি কোথা থেকে এলে জানি না, কিন্তু মনে হয় তোমার হৃদয় তোমার দেহের মতই কোমল। আমি তোমার কাছে আত্ম-সমর্পণ করলাম, আজ রাত্রির জন্য আমাকে রক্ষা কর।’
রঙ্গনার মনে পড়িল তাহার রাজপুত্র ক্ষুৎপিপাসাতুর। চকিতে মুখ তুলিয়া সে বলিল— ‘তুমি এখানে থাকো, আমি এখনি তোমার জন্যে দুধ দুয়ে আনছি।’ বলিয়া দোহনপাত্র লইয়া সে ছুটিয়া গেল।
যতক্ষণ দেখা গেল মানব সেই দিকে চাহিয়া রহিল। ভাবিল, এ কি পলাশবনের বনলক্ষ্মী! তারপর বৃক্ষকাণ্ডে পৃষ্ঠ রাখিয়া সে নিজের ভাগ্য চিন্তা করিতে লাগিল।
আজ হইতে ঠিক আট মাস পূর্বে গৌড়কেশরী শশাঙ্কদেব বৃদ্ধ বয়সে দেহরক্ষা করিয়াছেন। শশাঙ্ক একদিকে যেমন দুর্ধর্ষ বীর ছিলেন অন্যদিকে তেমনি অসামান্য কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন; ত্রিশ বৎসর ধরিয়া তিনি এক হাতে পূর্ববঙ্গের রাজ্যগৃধ্নু নৃপতিবৃন্দকে এবং অন্য হাতে প্রতিহিংসাপরায়ণ হর্ষবর্ধনের বিপুল রাজশক্তিকে রুখিয়া রাখিয়াছিলেন। তাঁহার জীবদ্দশায় শত্রু গৌড়রাজ্যে পদার্পণ করিতে পারে নাই।
শশাঙ্কের মৃত্যুর পর তৎপুত্র মানব গৌড়ের সিংহাসনে বসিল। মানবের বয়স ত্রিশ বৎসর। পিতার মতই সে দুর্মদ বীর, তাহার বিপুল দেহে সিংহের পরাক্রম। কিন্তু তাহার স্বভাব উন্মুক্ত ও সরল, মনের কথা সে গোপন রাখিতে পারে না; ছলচাতুরী তাহার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। যতদিন সে যুবরাজ ছিল ততদিন পিতার অধীনে সৈনাপত্য করিয়াছে, অসীম বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছে; কিন্তু মন্ত্রণাসভায় তাহার বুদ্ধি বিকাশ লাভ করে নাই। তাই সিংহাসন লাভের পরেও তাহার প্রকৃতিগত স্বধর্ম পরিবর্তিত হইল না। যে-মন্ত্রিগণ শশাঙ্কের জীবিতকালে মাথা তুলিতে পারেন নাই, তাঁহারা এখন মাথা তুলিয়া পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ করিলেন; রাজ্যের কল্যাণচিন্তা ভুলিয়া আপন আপন শক্তিবৃদ্ধির চেষ্টায় তৎপর হইলেন। রাজপুরুষদের মধ্যে ঘরে ঘরে চক্রান্ত চলিতে লাগিল; রাজ্যের মর্মকোষে কীট প্রবেশ করিল।
শত্রুপক্ষ এতবড় সুযোগ উপেক্ষা করিল না। কামরূপ-রাজ ভাস্করবর্মা গোপনে হর্ষবর্ধনের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন, তিনি সসৈন্যে গৌড়ের উত্তর প্রান্ত আক্রমণ করিলেন।
কজঙ্গলের শিলা-বন্ধুর উপত্যকায় ভাস্করবর্মার সহিত মানবের যুদ্ধ হইল। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঈর্ষার বিষ সেনাপতিদের মনেও সঞ্চারিত হইয়াছিল। দ্বিপ্রহর পর্যন্ত যুদ্ধ চলিবার পর মানব ঠুঝিল যুদ্ধে জয়ের আশা নাই। রক্তাক্ত দেহে সে রণক্ষেত্র ত্যাগ করিল। এখন তাহার একমাত্র ভরসা শত্রুর আগে কর্ণসুবর্ণে পৌঁছিয়া আর একবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
আজ দ্বিপ্রহরে রণক্ষেত্র হইতে বাহির হইয়া সে দক্ষিণ দিকে ঘোড়া ছুটাইয়া দিয়াছিল। কিন্তু কজঙ্গল হইতে কর্ণসুবর্ণ বহু দূর, অশ্বপৃষ্ঠেও দুই দিনের পথ। মানব পলাশবনের ভিতর দিয়া ঘোড়া ছুটাইয়া অবশেষে সন্ধ্যার প্রাক্কালে ভগ্নদেহে ক্ষুৎপিপাসার্ত অবস্থায় বেতসগ্রামের উপকণ্ঠে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল।
সম্মুখে রাত্রি, পশ্চাতে শত্রু আসিতেছে। এই উভয় সংশয়ের মাঝখানে দাঁড়াইয়া সন্ধ্যার ছায়ান্ধকারে মানব নিজ ভাগ্য চিন্তা করিতেছে— অতঃপর অদৃষ্ট-শক্তি তাহাকে কোন্ পথে লইয়া যাইবে? ভবিষ্যতের গর্ভে কোন রহস্যের ভ্রূণ লুক্কায়িত আছে?— ভাবিতে ভাবিতে তাহার অধরে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। রঙ্গনার পুষ্পপেলব যৌবন-লাবণ্য তাহার চোখের সম্মুখে ভাসিতে লাগিল।