সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে ডিনার শেষ করে তো ফিরে এলাম। কিন্তু তারপর পর পর চার-পাঁচদিন সর্বদা দিনে রাত্রে অশোক রায়কে ছায়ার মত অনুসরণ করেও মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিরীটী বলতে লাগল, এদিকে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম শুধু গত বৎসরখানেক ধরে মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি অশোক রায়ের একটু বিশেষ করে ঘনিষ্ঠতা চলেছে এবং বৈকালীতে মিত্রা সেনই অশোকের আসল আকর্ষণ। যতক্ষণ বৈকালীতে ও থাকে মিত্রা ও অশোক কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু রাত এগারোটা বাজবার পর থেকেই অশোক যেন কেমন চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে। চোখেমুখে একটা উত্তেজনা ফুটে ওঠে। রাত এগারোটায় ঠিক মিত্রা সেন চলে যায়। এবং মিত্রা সেন চলে যাবার পর থেকেই অশোকের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখা দেয়। অথচ মজা এই, ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকালেও রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার আগে কখনও সে বৈকালী থেকে বের হয় না। এবং রাত সাড়ে এগারোটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগেই ঠিক বের হয়ে পড়ে—এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। এই তো গেল অশোকের ব্যাপার। তারপরই নজর দিলাম ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর ওপরে। তাঁর চেম্বারের attendance একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে আটটা; দেড় ঘণ্টা চেম্বারে বসেই চলে যান হাসপাতালে। বেলা গোটা বারো নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে বাইরের কলগুলো সেরে বেলা দেড়টায় ঠিক বাড়ি পৌঁছন। বিকেলে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা চেম্বার অ্যাটেনডেন্স। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় চেম্বার থেকে বের হয়ে এসেন গাড়িতে চাপেন এবং সোজা চলে আসেন আমির আলী অ্যাভিতে নিজের বাড়িতে। বাড়িতে একবার রাত্রে পৌঁছানোর পর সকলেই জানে হাজার টাকা দিলেও এবং যত সিরিয়াস সেই হোক না কেন রাত্রে কখনও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেউ বাড়ির বাইরে আনতে পারবে না। এবং, নানা ভাবে খবর নিয়ে দেখেছি, কথাটা মিথ্যে বা অত্যুক্তি নয়। রাত্রে চেম্বার থেকে ফেরবার পর সত্যিই আর তিনি বাইরে যান না। এদিকে ভুজঙ্গ ডাক্তার চেম্বার থেকে চলে যাবার পরই তাঁর একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার ও একজন নার্স বাদে আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাকি আর সব চেম্বার থেকে চলে যায়, চেম্বারের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঐ চেম্বার ও নার্সিং হোমে থাকে একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার একজন নার্স ও প্রহরায় থাকে একজন শিখ দারোয়ান গুলজার সিং ও কুক মাধোলাল। কিন্তু মজা আছে ঐখানেই। রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকে রাত প্রায় একটা দেড়টা পর্যন্ত মধ্যে মধ্যে এক-একখানা প্রাইভেট গাড়ি এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়—কখনও কোন পুরুষ, আবার কখনও কোনো মহিলা গাড়ি থেকে নেমে দরজার কলিংবেলের বোতামটা গিয়ে টেপেন। নি:শব্দে দরজা খুলে যায়। তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং পনের মিনিট থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার চেম্বার থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে চেপে চলে যান। প্রতি রাত্রে এই একই ব্যাপার ঘটছে।
কিরীটীর কথায় বাধা না দিয়ে পারি না, বলি, এ যে রীতিমতো সিনেমা-কাহিনী হে!
তাই বটে। শোন, শেষ হয়নি এখনও। আমার next step হল যে যে গাড়ি রাত্রে চেম্বারে আসে তাদের নাম্বারগুলো টুকে অনুসন্ধান করে তাদের মালিকদের খুঁজে বের করা। শুরু করে দিলাম। এবং এইখানে এসেই ব্যাপারটা যেন আরও বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে গেল।
কি রকম? প্রশ্ন করলাম।
শোন হে সুব্রতচন্দ্র! কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গলায় বেশ একটু আমেজ এনে বললে, চমকে উঠো না যেন এবারে নামগুলো শুনে। অশোক রায় ছাড়াও এক নম্বর সুচরিতা দেবী আর একসেলেন্সী মহারাণী অফ সোনাপুর স্টেট। দু নম্বর বিখ্যাত আর্টিস্ট বর্তমানে নব্য চিত্রকরদের মধ্যমণি সোমেশ্বর রাহা। তিন নম্বর বিখ্যাত পাল অ্যাণ্ড কোংএর তরুণ প্রোপাইটার শ্ৰীমন্ত পাল। চার নম্বর—স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী। পাঁচ নম্বর বর্তমানের শ্রেষ্ঠ চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক। ছ নম্বর-উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ। আর চাই?
বিস্ময়ে আমি সত্যিই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটী একে একে যে সব নামগুলো করে গেল তাদের মধ্যে যে কেবল শহরের বর্তমান নামকরা ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ই আছে তাই নয়, এমন নামও করলে যাদের নাম। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।
এরাই রাত্রির বিভিন্ন যামে নিয়মিত ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে হানা দেয়।
কিন্তু কেন?
.
কিরীটীর কাহিনী শেষ হবার পর দুজনে চুপচাপ বসেছিলাম। ঘরের মধ্যে যেন হঠাৎ একটা স্তব্ধতার গুরুভার জমাট বেঁধে উঠেছে।
এবং এতক্ষণে যেন বুঝতে পারছি আজ সকালে কিরীটীর ভুজঙ্গ চৌধুরী দর্শনে গমনটা আকস্মিক বা সামান্য খেয়ালের বশে নয়। সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী হয়েছিল।
সদ্য কিরীটীর মুখে শোনা বিচিত্র নামগুলো ও সেই সঙ্গে সেই লোকগুলোর চেহারা ও এতদিনকার তাদের সকলের আমাদের জানিত বাইরের পরিচয়টা মনের মধ্যে বিচিত্র এক চিন্তার সৃষ্টি করেছিল।
অশোক রায়, মহারাণী সুচরিতা দেবী, আটিষ্ট সোমেশ্বর রাহা, পাল এ্যাণ্ড কোং-এর শ্ৰীমন্ত পাল, অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী, অভিনেতা চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক, উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ–সমাজ বা সোসাইটিতে সকলেই এমন বিশেষ পরিচিত যে নাম করলেই সকলকে চেনা যায়।
সেই একটা দিক এবং দ্বিতীয় দিকটা হচ্ছে প্রত্যেকের অবস্থা, অর্থাৎ আর্থিক অবস্থা সচ্ছল। সকলেরই যাতায়াত আছে ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে। এবং যাতায়াতটা দিনের আলোয় প্রকাশ্যে নয়, রাত্রির অন্ধকারে,বলতে গেলে এক প্রকার গোপনেই এবং ভুজঙ্গ ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু কেন?
কেন ওরা সকলেই ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে রাত্রে যাতায়াত করে? বিশেষ করে চেম্বার যখন বন্ধ থাকে এবং তিনি যখন সেখানে থাকেন না!
হঠাৎ কিরীটীর কথায় আবার চমক ভাঙল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস সুব্রত?
কি?
সকলেই ভুজঙ্গ ডাক্তারের ওখানে যায় এবং রাত্রি এগারটার পর!
হ্যাঁ।
শুধু তাই নয়, সে সময় সাধারণত ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ তো থাকেই এবং সে সময়টা ডাক্তার চৌধুরী তাঁর বাড়ি থেকে কখনও বের হন না। এর থেকে একটা কথা কি স্বতঃই মনে হয় না যে,ডাক্তারের এ সময়টায় চেম্বারে অনুপস্থিতি ও ওদের সেই সময়ে গমনাগমন, কোথায় যেন একটা রহস্য রয়েছে! হয়ত এমন কোন আকর্ষণ সেখানে আছে যার টানে–
কিন্তু তাই যদি থাকে তো সেটা কি হতে পারে? তোর কি মনে হয়?
মনে তো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু মনে হলেই তো হয় না। ভুললে চলবে কেন আমাদের, ডাঃ চৌধুরী এবং অন্যান্য সকলেরই সোসাইটিতে আজকের দিনে একটা পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে।
তা অবিশ্যি আছে। শুধু তাই নয়, আর একটি ব্যাপার হচ্ছে ঐ বৈকালী সঙ্ঘ।
হ্যাঁ, খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমি, ঐ সব ব্যক্তিবিশেষের বৈকালী সঙ্ঘেও নিয়মিতযাতায়াত আছে এবং তারা প্রত্যেকেই সেখানকার মেম্বার।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। কিন্তু আরও একটু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে, বিশেষ ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী কখনও আজ পর্যন্ত বৈকান্ধী সঙ্ঘে পা তো দেনইনি, এমন কি সঙ্ঘের ওপরেও নাকি তিনি মর্মান্তিক ভাবে চটা। সঙ্ঘের নাম পর্যন্ত নাকি তিনি শুনতে পারেন না।
কেন?
তাঁর ধারণা বৈকালী সঙ্ঘটা নাকি আসলে একটা যৌন ব্যভিচারের গোপন কেন্দ্র। যত সব তথাকথিত অ্যারিস্টোক্রেটিক পয়সাওয়ালা তরুণ-তরুণীরা ঐখানে সেই উদ্দেশ্যেই মিলিত হন। আর ঠিক সেই কারণেই আমি fill up the blank পূর্ণ করতে পারছি না কদিন ধরে ভেবেও। অথচ আমাদের ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের পুত্র তরুণ ব্যারিস্টার শ্রীমান অশোকের যাতায়াত নিয়মিত দু জায়গাতেই। সে যাক গে, তুই একটা কাজ করতে পারবি?
কি?
মিত্রা সেনের গতিবিধি সম্পর্কে একটা রিপোর্ট আমাকে এনে দিতে পারবি?
সে কি আর ঠাকুরপোর দ্বারা সম্ভব হবে? বরং আমি—
চমকে দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখি বক্তা আমাদের কিরীটী-গৃহিণী শ্রীমতি কৃষ্ণা বৌদি। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনার ফাঁকে চায়ের ট্রে হাতে কখন যে নিঃশব্দে কৃষ্ণা বৌদির সেই ঘরে আবির্ভাব ঘটেছে দুজনের একজনও সেটা টের পাইনি। এবং বুঝতে পারা গেল শুধুআবিভাবই নয়, আমাদের শেষের আলোচনার অংশটুকুর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে।
কিরীটীই বলে, কৃষ্ণা!
হাতের ট্রেটা সামনের ছোট টেবিলটার উপরে রাখতে রাখতে কৃষ্ণা বৌদি বললে, হ্যাঁ কৃষ্ণাই। সর্বাগ্রে চা-সুধার দ্বারা গলদেশ ভিজাইয়া লওয়া হউক, তারপর যাহা আমার বক্তব্য, পেশ করিতেছি।
দুজনেই আমরা হাসতে হাসতে ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিলাম হাতে।
কৃষ্ণা বৌদিও একটি কাপ হাতে নিয়ে কিরীটীর পাশের সোফায় বসল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে চেয়ে শুধাল, কি বলছিলে কৃষ্ণা?
বলছিলাম তোমার মিত্রা সেনের সংবাদটা ঠাকুরপোর দ্বারা ঠিক সুবিধে হবে না, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
তুমি!
হ্যাঁ। নারীর মনোলোকের সংবাদ নারীই ঠিক যোগাড় করতে পারে।
কিন্তু—
ভাবছ চিনে ফেলবে! না, মা-ভৈষী! একটা রাত একটু আমাকে ভাবতে দাও, তারপর আমি কাজে নামব।
কৃষ্ণা জবাব দিল।