সেই বাড়ি থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লুম আবার। এবার ঘোড়ার গাড়িতে নয়, স্রেফ পায়দলে। আমাদের ঘিরে ঘিরে চলল আরও জনাসাতেক লোক।
রাস্তাটা এবড়ো-খেবড়ো—দূরে দূরে মিটমিটিয়ে আলো জ্বলছে। পথের ধারে কাঁচা ড্রেন, কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল, কতকগুলো ছাড়া-ছাড়া বাড়ি, কয়েকটা ঠেলাগাড়িও পড়ে আছে। এদিকে-ওদিকে। দুজন লোক আসছিল—ভাবলুম চেঁচিয়ে উঠি, কিন্তু তক্ষুনি আমার কানের কাছে কে যেন ফ্যাঁসফাঁস করে বন-বেড়ালের মতো বললে, এই ছোকরা, একেবারে স্পিকটি নট। চেঁচিয়েছিস কি তক্ষুনি মরেছিস, এবার খেলনা পিস্তল নয়—সঙ্গে ছোরা আছে!
লোক দুটো বোধ হয় কুলি-টুলি হবে, যেতে-যেতে কটমটিয়ে কয়েকবার চেয়ে দেখল আমাদের দিকে। আমি প্রায় ভাঙা গলায় বলতে যাচ্ছিলুম—বাঁচাও ভাই সব কিন্তু ছোরার ভয়ে নিজের আর্তনাদটা কোঁত করে গিলে ফেলতে হল।
এর মধ্যে টেনিদা একবার আমার হাতে চিমটি কাটল। যেন বলতে চাইল, এই চুপ করে থাক!
হঠাৎ লোকগুলো আর-একটা ছোট রাস্তার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। একজন সেই রাস্তা ব্রাবর আঙুল বাড়িয়ে বললে, দেখতে পাচ্ছ?
আমরা দেখতে পেলুম।
রাস্তাটা বেশি দূর যায়নি—দুপাশে কয়েকটা ঘুমিয়ে-পড়া টিনের ঘর রেখে আন্দাজ দুশো গজ দূরে গিয়ে থমকে গেছে। সেখানে একটা মস্তবড় লোহার ফটক, তাতে জোরালো ইলেকট্রিক লাইট জ্বলছে আর ফটকের মাথার ওপর লেখা রয়েছে : জয় মা তারা স্টুডিয়ো।
ঘেঁটুদা বললে, চলে যাও—ওইখানেই তোমাদের কাজ। এই কাঁথারামকেও সঙ্গে নিয়োনস্যির কৌটোটা বিজয়কুমারের পকেট থেকে লোপাট করে এর হাতে দেবে, তারপর যেমন গিয়েছিলে—সুট করে বেরিয়ে আসবে। ব্যস, তা হলেই কাজ হাসিল। তারপরেই তোমাদের হাত ভরে প্রাইজ দেবে সিন্ধুঘোটক।
—কিন্তু একটা নস্যির কৌটোর জন্যে আমি গজগজ করে উঠলুম।
–নিশ্চয় নিদারুণ রহস্য আছে—ঘেঁটুদা আবার বললে– : কিন্তু তা জেনে তোমাদের কোনও দরকার নেই। এখন যা বলছি, তাই করো। সাবধান স্টুডিয়োর ভেতরে গিয়ে যদি কোনও কথা ফাঁস করে দাও, কিংবা পালাতে চেষ্টা করে, তা হলে কিন্তু নিদারুণ বিপদে পড়বে। সিন্ধুঘোটকের নজরে পড়লে একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত লুকিয়ে বাঁচতে পারে না, সেটা খেয়াল রেখো।
টেনিদা বললে, খেয়াল থাকবে।
ঘেঁটুদা আবার বললে, আমরা সব এখানেই রইলুম। গেটের দারোয়ান বিজয়কুমারের পেয়ারের চাকর কম্বলরামকে চেনেতোমাকে বাধা দেবে না। আর তুমি কাঁথারামকেও নিজের ভাই বলে চালিয়ে দেবে। গেট দিয়ে ঢুকে একটু এগিয়েই দেখবে গুদামের মতো প্রকাণ্ড একটা টিনের ঘর—তার উপর লেখা রয়েছে ইংরিজিতে ২। ওটাই হচ্ছে দু নম্বর ফ্লোর, ওখানেই বিজয়কুমারের শুটিং হচ্ছে।
—ফ্লোর! শুটিং! এ সব আবার কী ব্যাপার?—টেনিদা ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইল : ওখানে আবার গুলিগোলার কোনও ব্যাপার আছে নাকি?
—আরে না—না, ও সমস্ত কোনও ঝামেলা নেই। বললুম তো ফ্লোর হচ্ছে গুদামের মতো একরকমের ঘর, ওখানে নানারকম দৃশ্য-শ্য তৈরি করে সেখানে ফিল্ম তোলা হয়। আর শুটিং হল গিয়ে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলাকাউকে গুলি করার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই!
–বুঝতে পারলুম। আচ্ছা—দু নম্বর ফ্লোরে না হয় গেলুম-সেখানে না হয় দেখলুম, বিজয়কুমারের শুটিং হচ্ছে—তখন কী করব?
সুযোগ বুঝে তার কাছে গুটি গুটি এগিয়ে যাবে। সে হয়তো জিজ্ঞেস করবে, কী রে কম্বুলে, দেশে গিয়েই সঙ্গে সঙ্গে চলে এলি যে? আর স্টুডিয়োতেই বা এলি কেন? উত্তরে তুমি বলবে, কী করব স্যার—দেশের বাড়িতে গিয়েই আপনার সম্পর্কে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখলুম-মেজাজ খিঁচড়ে গেল এজ্ঞে, তাই চলে এলুম। শুনলুম আপনি স্টুডিয়োতে এয়েছেন, তাই দর্শন করে চক্ষু সার্থক করে গেলুম। শুনে বিজয়কুমার হয়তো হেসে বলবে, ব্যাটা তো মহা খলিফা! বলে তোমার পিঠে চাপড়ে দেবে, আর একটা টাকা হাতে খুঁজে দিয়ে বলবে, নে—কিছু মিষ্টি-ফিষ্টি খেয়ে বাড়ি চলে যা। আমার ফিরতে রাত হবে, পারিস তো ভালো দেখে একটা মুরগি রোস্ট করে রাখিস। যখন এই সব কথা বলতে থাকবে, তখন সেই ফাঁকে তুমি চট করে তার পকেট থেকে নস্যির ডিবেটা তুলে নেবে।
—যদি ধরা পড়ে যাই?
-বলবে, পকেট মারিনি স্যার, একটা পিঁপড়ে উঠেছে, তাই ঝাড়ছিলুম।
—যদি বিশ্বেস না করে?
–অভিমান করে বলবে, স্যার, আমার কথায় অবিশ্বাস? আমি আর এ-পোড়ামুখ দেখাব —গঙ্গায় ড়ুবে মরব। বলতে বলতে কাঁদতে থাকবে। বিজয়কুমার বলবে কী মুস্কিলকী মুস্কিল! তখন তার পা জড়িয়ে ধরার কায়দা করে তাকে পটকে দেবে। আর ধাঁই করে যদি একবার আছাড় খায়, আর ভাবতে হবে না—তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে–বুঝেছ?
টেনিদা বললে, বুঝেছি।
—তা হলে এগোও।
—এগোচ্ছি।
—খবরদার, কোনও রকম চালাকি করতে যেয়ো না, তা হলেই—
—আজ্ঞে জানি, মারা পড়ব। ঘেঁ
টুদা খুশি হয়ে বললে, শাবাশ—ঠিক আছে। এবার এগিয়ে যাও—
টেনিদা বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, এগিয়ে চললুম।
আমরা দুজনে গুটিগুটি জয় মা তারা স্টুডিয়োর দিকে চলতে লাগলুম। ওরা যে কোথায় কোনখানে ভুট করে লুকিয়ে গেল, আমরা পেছন ফিরেও আর দেখতে পেলুম না।
আমি চাপা গলায় বললুম, টেনিদা?
—হুঁ!
—এই তো সুযোগ।
টেনিদা আবার বললে, হুঁ!
—সমানে হুঁ-হুঁ করছ কী? এখন ওরা কেউ কোথাও নেই—আমরা মুক্ত—এখন একেবারে বেপরোয়া হয়ে—মানে যাকে বলে উদ্দাম উল্লাসে ছুটে পালাতে পারি এখান থেকে। ফিল্ম স্টুডিয়ো যখন রয়েছে, তখন জায়গাটা নিশ্চয় টালিগঞ্জ। আমরা যদি জয় মা তারা স্টুডিয়োতে না গিয়ে পাশের খানা-খন্দ ভেঙে এখন চোঁ-চোঁ ছুটতে থাকি, তা হলে—
টেনিদা বিরক্ত হয়ে বললে, এখন কুরুবকের মতো বকবক করিসনি প্যালা, আমি ভাবছি।
কী ভাবছ? সত্যি সত্যিই তুমি স্টুডিয়োতে ঢুকে ফিল্মস্টার বিজয়কুমারের পকেট মারবে নাকি?
-শাট আপ! এখন সামনে পুঁদিচ্চেরি!
খুব জটিল সমস্যায় পড়লে টেনিদা বরাবর ফরাসী আউড়ে থাকে। আমি বললুম, পুঁদিচ্চেরি? সে তো পণ্ডিচেরী! এখানে তুমি পণ্ডিচেরী পেলে কোথায়?
—আঃ, পণ্ডিচেরী নয়, আমি বলছিলুম, ব্যাপার অত্যন্ত ঘোরালো। বুদ্ধি করতে হবে। আমি বললুম, কখন বুদ্ধি করবে? ইদিকে আমাকে আবার এক বিতিকিচ্ছিরি পাগল। সাজিয়েছে, মুখে কিচমিচ করছে সাতরাজ্যের দাড়ি, কুটকুটুনিতে আমি তো মারা গেলুম! ওদিকে তুমি আবার চলেছ পকেট মারতে ধরা পড়লে কিলিয়ে একেবারে কাঁটাল পাকিয়ে দেবে, এখন–
–চোপ রাও।
অগত্যা চুপ করতে হল। আর আমরা একেবারে জয় মা তারা স্টুডিয়োর গেটের সামনে এসে পৌঁছলুম। ভয়ে আমার বুক দুরদুর করতে লাগল—মনে হতে লাগল, একটু পরেই একটা যাচ্ছেতাই কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!
স্টুডিয়োর লোহার ফটক আধখোলা। পাশে দারোয়ানের ঘর আর ঘরের বাইরে খালি গায়ে এক হিন্দুস্থানী জাঁদরেল দারোয়ান বসে একমনে তার আরও জাঁদরেল গোঁফজোড়াকে
পাকিয়ে চলেছে।
টেনিদাকে দেখেই সে একগাল হেসে ফেলল!
—কেয়া ভেইয়া কম্বলরাম, সব আচ্ছা হ্যায়?
–হাঁ, সব আচ্ছা হ্যায়।
–তুমহারা সাথ ই পাগলা কৌন হে?
আমাকেই পাগল বলছে নিশ্চয়। যে-লোকটা আমাকে হাতের কাছে পেয়ে মনের সুখে মেক-আপ দিয়েছিল, তাকে আমার স্রেফ কড়মড়িয়ে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করল। প্রায় বলতে যাচ্ছিলুম, হাম পাগলা নেহি হ্যায়, পটলডাঙাকা প্যালারাম হ্যায়, কিন্তু টেনিদার একটা চিমটি খেয়েই আমি থেমে গেলুম।
টেনিদা বললে, ই পাগলা নাহি হ্যায়-ই হ্যায় আমার ছোট ভাই কাঁথারাম।
–কাঁথারাম?—দারোয়ান হাঁ করে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বললে, রাম—রাম–সিয়ারাম! রামজী-নে দুনিয়ামে কেতনা অজীব চীজোঁকো পয়দা কিয়া। আচ্ছা—চলা যাও অন্দরমে। তুমহারা বাবু দুলম্বর মে হ্যায়–হুঁয়াই শুটিং চল রহা হ্যায়!
আমরা স্টুডিয়োর ভেতরে পা দিলুম। চারদিকে গাছপালা, ফুলের বাগান, একটা পরী-মাকা ফোয়ারাও দেখতে পেলুম—আর কত যে আলো জ্বলছে, কী বলব। দেখলুম, সব সারি-সারি গুদামের মতো উঁচু-উচু টিনের ঘর, তাদের গায়ে বড় বড় শাদা হরফে এক-দুই করে নম্বর লেখা। দেখলুম, বড় বড় মোটরভ্যানে রেডিয়োর মতো কী সব যন্ত্র নিয়ে, কানে হেডফোন লাগিয়ে কারা সব বসে আছে, আর রেডিয়োর মতো সেই যন্ত্রগুলোতে থিয়েটারের পার্ট করার মতো আওয়াজ উঠছে।
প্যান্টপরা লোকজন ব্যস্ত হয়ে এপাশ ওপাশ আসা-যাওয়া করছিল, আর মাঝে-মাঝে কেউ-কেউ তাকিয়ে দেখছিল আমার দিকেও। একজন ফস করে এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
–বাঃ, বেশ মেকআপ হয়েছে তো! চমৎকার!
মেক আপ! ধরে ফেলেছে!
আমার বুকের রক্ত সঙ্গে সঙ্গে জল হয়ে গেল। আমি প্রায় হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু টেনিদা পটাং করে আমাকে চিমটি কাটল।
লোকটা আবার বললে, এক্সট্রা বুঝি?
এক্সট্রা তো বটেই, কম্বলরামের সঙ্গে কাঁথারাম ফাউ। আমি ক বলবার জন্যে হাঁ করেছিলুম, কিন্তু তক্ষুনি টালিগঞ্জের গোটাকয়েক ধাড়ী সাইজের মশা আমার মুখ বরাবর তাড়া করে আসাতে ফস করে মুখটা বন্ধ করে ফেলুলম।
টেনিদা বললে, হ্যাঁ, স্যার, এক্সট্রা। থিয়োরেম নয়, প্রবলেম নয়, একদম এক্সট্রা! আর এত বাজে এক্সট্রা যে বলাই যায় না।
–বা-রে কম্বলরাম, বিজয়কুমারের সঙ্গে থেকে তো খুব কথা শিখেছ দেখছি। তা এ কোন্ বইয়ের এক্সট্রা?
—আজ্ঞে জিয়োমেট্রির। থার্ড পার্টের।
লোকটা এবারে চটে গেল। বললে, দেখো কম্বলরাম, বিজয়কুমার আদর দিয়ে দিয়ে তোমার মাথাটি খেয়েছেন। তুমি আজকাল যাকে তাকে যা খুশি তাই বলো। তুমি যদি আমার চাকর হতে, তা হলে আমি তোমায় পিটিয়ে স্রেফ তক্তপোশ করে দিতুম।
বলেই হনহন করে চলে গেল সে।
আমি ভয় পেয়ে বললুম, টেনিদা–কী হচ্ছে এসব?
টেনিদা বললে, এই তো সবে রগড় জমতে শুরু হয়েছে। চল—এবার ঢোকা যাক দু নম্বর স্টুডিয়োতে।